রাহুল ঘোষ

পরাজিতদের গল্প      /   অন্দরমহল
পর্ব ৪ 
দ্বিতীয় পর্বে লিখেছিলাম, বিশ্রবা-কৈকেশীর বিবাহের পিছনে একটি নিখুঁত রাজনৈতিক পদক্ষেপ ছিল। সেই পদক্ষেপটি বোঝার জন্য আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে এই ঘটনার অনেকটা আগে। অগ্রজ মাল্যবান ও অনুজ মালীকে নিয়ে দীর্ঘ প্রচেষ্টায় এক অপরাজেয় অসুরশক্তি গড়ে তুলেছিলেন কৈকেশীর পিতা সুমালী। তথাকথিত সব দেবশক্তি, এমনকি অসুরদের অন্য সব প্রজাতিকে পরাজিত করে তখন তাঁরা প্রায় একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিপতি। এই তিনভাইয়ের মূল শক্তিই ছিল একতা ও পরস্পরের জন্য অনুভূতি। এঁরা কখনোই বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে পারতেন না। কথিত আছে, বিস্তীর্ণ সাম্রাজ্যের অধিকারী হয়েও একসঙ্গে থাকার জন্য এই তিনজন নাকি দেবশিল্পী বিশ্বকর্মাকে একটি সৌন্দর্যময় নগরী বানিয়ে দিতে অনুরোধ করেন। তবে সে-নগরীকে দেবরাজ ইন্দ্রের বাসস্থান অমরাবতীর থেকেও সুন্দর হতে হবে। প্রাথমিকভাবে অনিচ্ছুক হলেও বিশ্বকর্মা তাঁদের জন্য সেভাবেই লঙ্কা নগরী তৈরি করে দেন। কোনো-কোনো সূত্র অবশ্য বলে, লঙ্কা আসলে ময়দানব বা মায়াসুরের তৈরি, যিনি অসুরদের শ্রদ্ধেয় শিল্পী এবং বিশ্বকর্মার থেকে তাঁর দক্ষতা বেশি বই কম নয়। তিনি লঙ্কার প্রকৃত নির্মাতা হোন বা না-হোন, তাঁর ভূমিকার কথা আমাদের এই আলোচনায় পরে আবার আসবে। সে যাই হোক, এরকম একটি ঐশ্বর্যময় নগরীতে সুমালীরা অবিচ্ছেদ্য তিনভাই সপরিবারে নিশ্চিন্তে বসবাস করতেই পারতেন, কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ালো মূলত দুটি বিষয়। প্রথমত, লঙ্কার মতো চোখধাঁধানো জনপদে অসুর ভ্রাতৃত্রয়ের এই সমৃদ্ধি দেখে তাঁদের হাতে বারবার পরাজিত দেবকূল যারপরনাই ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠলেন। তাঁরা ভাবছিলেন অসুরদের এই বাড়বাড়ন্তকে কীভাবে আটকানো যায়। দ্বিতীয়ত, স্বর্গ অর্থাৎ তথাকথিত দেবলোক অধিকার করার জন্য এই অসুরভ্রাতাদের, বিশেষত জ্যেষ্ঠ মাল্যবানের বাসনা ক্রমশ উদগ্র হয়ে উঠছিল। কোনো-কোনো ব্যাখ্যায় দেখতে পাই, কনিষ্ঠ মালীর এ-নিয়ে বিশেষ আগ্রহ না-থাকলেও মধ্যম সুমালী এই বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন। তবে তিনি ছিলেন আরেকটু রয়ে-সয়ে এগোনোর পক্ষপাতী। তাঁর বক্তব্য ছিল, তিনভাইয়ের ছেলেরা আরও বড়ো হোক, অভিজ্ঞ হোক, বলশালী ও দক্ষ যোদ্ধায় পরিণত হোক, এবং ততদিনে অসুরকূলের শক্তি আরও বিস্তৃত হোক; তারপরে না-হয় দেবলোক আক্রমণ করা যাবে। কিন্তু মাল্যবানের ইচ্ছাই এক্ষেত্রে প্রাধান্য পেল। অসুরশক্তি রওনা হলো দেবলোক দখলের অভিযানে। অবশ্য দেবকূলও ততদিনে আর বসে নেই। অসুরদের কাছে বারবার লাঞ্ছিত হওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে সতর্ক তাঁরা এবং প্রভাবশালী মুনি-ঋষিরা সাহায্য চেয়েছেন দেবশক্তির অন্যতম প্রধান বিষ্ণুর কাছে, এবং বিষ্ণু কথা দিয়েছেন যে তিনি দেবলোককে এই অসুর-আতঙ্ক থেকে মুক্তি দেবেন।

বিষ্ণুর কথা এলে, হিন্দু ধর্মবিশ্বাসে সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর যে 'ত্রিদেব' অর্থাৎ Holy Trinity-র কথা আছে, তাও চলে আসে। ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর, এই ট্রিনিটির মধ্যে ব্রহ্মার পরিচিতি সৃষ্টিকর্তা (Creator) হিসেবে। বিষ্ণু হলেন রক্ষাকর্তা বা পালনকর্তা (Protector/ Preserver), আর মহেশ্বর বা শিব ধ্বংসকর্তা (Destroyer/ Annihilator)। অর্থাৎ ধর্মবিশ্বাস অনুসারে জগতের সবকিছুরই জন্ম, জীবনকাল এবং ক্ষয় বা মৃত্যু এই তিন 'সুপ্রিম অথরিটি'-র হাতে। তাই যদি হয়, তাহলে পৃথিবীর সমস্ত প্রাণের প্রতিই এঁদের সমদৃষ্টি ও নিরপেক্ষতা থাকার কথা। ব্রহ্মা ও মহেশ্বরের কাজে সেই নিরপেক্ষতা অবশ্য আমরা বিভিন্ন ক্ষেত্রেই দেখতে পাই। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, বিষ্ণুর কাজে সেই নিরপেক্ষতা অনুপস্থিত! তিনি জগতের অন্যতম নির্ণায়ক শক্তি হয়েও কখনোই নিরপেক্ষ নন, বরং দৃষ্টিকটূভাবে দেবকূল ও ব্রাহ্মণ্যবাদের পক্ষপাতী। এই কারণেই কি অসুর-সংস্কৃতিতে বাকি দুই প্রধান দেবতার উপস্থিতি থাকলেও বিষ্ণু অনুপস্থিত? রামায়ণের কাহিনি ও চরিত্রগুলির আধুনিক পুনর্নিমাতাদের অন্যতম রাহুল রাজনের ইঙ্গিত কিন্তু সেদিকেই। তাঁর মতে, অসুর-সংস্কৃতিতে ব্রহ্মা 'প্রজাপতি' নামে এবং মহেশ্বর 'রুদ্র' নামে পরিচিত হলেও, এমনকি মহেশ্বর-সঙ্গিনী পার্বতীও অসুর-সংস্কৃতিতে 'শক্তি' নামে আরাধ্যা হলেও, সেখানে বিষ্ণুর কোনো অস্তিত্ব নেই! এই প্রসঙ্গে অবশ্য আমাদের মনে রাখতে হবে, বিভিন্ন গবেষণায় বিশেষজ্ঞরা দেখিয়েছেন যে মহেশ্বর বা শিব আসলে আদিবাসী ও অনার্য সংস্কৃতির দেবতা, বহিরাগত আর্যরা পরে এসে তাঁকে অর্থাৎ তাঁর ভাবমূর্তিকে দখল করেছে। এই প্রসঙ্গে একটু বাস্তবোচিত আলোচনার সন্ধান করলে আমরা দেখবো, আনন্দ নীলকণ্ঠন তাঁর 'Asura: Tale of the Vanquished'-এ রাবণের বয়ানে লিখেছেন, 'We learned that Shiva was a great Asura king of antiquity, when the Asuras were a wandering tribe. I love to think that he is The God, my personal favourite.' একই জায়গায় দেব-অসুর লড়াই ও দেববংশীয়দের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, 'But they fought back. They staged a battle from the south to reclaim their lost land. They won occasional victories and even held sway over all of India at times. However, it was the intellectual war that they were losing. Tribes which came from the north-west, had began losing their moornings and a synthesis with the Asuras had began. They stole the great Asura God, Shiva. Brahma, the teacher, also became their god. However, the most prominent god who suddenly appeared was Vishnu.' এই বর্ণনা থেকেই ভারতীয় সংস্কৃতির পট-পরিবর্তনে প্রাচীন অধ্যায়ের ছবিটি ফুটে ওঠে। এখন আমাদের মনে হতে পারে, নির্ণায়ক ত্রিশক্তির অন্যতম হলেও বিষ্ণু নিরপেক্ষ নন কেন? যেখানে ব্রহ্মা ও শিব যথাসম্ভব নিরপেক্ষ, এবং যোগ্য হলে দেব-অসুর কেউই তাঁদের কৃপাদৃষ্টির (এক্ষেত্রে বরদান) থেকে বঞ্চিত হয় না, সেখানে পালনকর্তার এ কী আচরণ! এখানে হয়তো আমাদের মনে পড়বে, উপনিষদে রাক্ষসদের আসলে 'রক্ষক' বলা হয়েছে এবং তার সূত্র ধরে রামায়ণেও। আবার ব্রাহ্মণ্যবাদ-নির্দেশিত ধারণায় বিষ্ণুই জীবজগতের রক্ষাকর্তা। এই জায়গা থেকেই কি রাক্ষসদের বিষ্ণুর প্রতিস্পর্ধী ভাবার শুরু? এই কারণেই কি বিষ্ণুর সঙ্গে অসুরকূলের চিরকালীন বৈরী? এই ভাবনাটিকে কিন্তু উড়িয়ে দেওয়া যাবে না! 

যাই হোক, দেবলোক দখলের অভিলাষে সুমালীরা তিনভাই মুখোমুখি হলেন বিষ্ণুর। অন্য দেবতাদের তাঁরা হেলায় হারিয়েছেন। ব্রহ্মা ও শিব যথারীতি এই লড়াইয়েও নিরপেক্ষ, কিন্তু বিষ্ণু তো তা নন। অতএব এই প্রথম কঠোর প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে হলো অসুর-ভ্রাতৃত্রয়কে। বিষ্ণুর সুদর্শনচক্রে মালীর শিরচ্ছেদ হয়ে গেল। আগেই বলেছি, সুকেশপুত্রেরা ছিলেন অবিচ্ছেদ্য। সবচেয়ে ছোটোভাইয়ের মৃত্যু বাকি দু'জনকে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করে দিল। নেতাদের এই হাল দেখে সৈন্যরাও মনোবল হারিয়ে রণে ভঙ্গ দিল। যুদ্ধের মূল নীতিমালার অন্যতম হলো, কখনও পরাজিত ও পশ্চাদপসরণকারী শত্রুপক্ষকে আক্রমণ করতে নেই। কিন্তু বিষ্ণু অসুরসেনাদের তাড়া করলেন লঙ্কা পর্যন্ত। এই ঘটনার একটি চমৎকার বর্ণনার সৃষ্টি করেছেন রাধা বিশ্বনাথ তাঁর লেখা 'Ravanaleela'-য় (Surprisingly, Vishnu came after the retreating Rakshasa forces. A basic and sacred principle of warfare is that a retreating enemy is never attacked. Malyavant therefore stopped and questioned the leader of the Deva force. 'You call yourself "God", so how can you indulge in such a blatant flouting of dharma?' he asked.)। ফলে পিছু হটলেও সুমালী ও মাল্যবান আর লঙ্কায় থাকতে না-পেরে আত্মগোপন করলেন পাতালে (আমরা ধরে নেবো, জনবিরল কোনো গোপন জায়গায়)। বিষ্ণুর উদ্যোগে লঙ্কার সিংহাসনে বসানো হলো কুবেরকে, যিনি আসলে দেবলোকের ধনসম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করেন!

ঠিক এখান থেকেই বিশ্রবা-কৈকেশীর বিবাহের অন্তরালের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপটির জন্ম। কুবের বা বৈশ্রাবণ ছিলেন বিশ্রবা ও তাঁর প্রথম স্ত্রী ইলাবিদা (মতান্তরে দেবপর্ণী)-র সন্তান। কুবেরের এমন প্রতিপত্তি বৃদ্ধির খবর আত্মগোপনকারী সুমালীর অজানা ছিল না। পরাজিত ও হতমান হলেও তিনি যে-কোনো উপায়ে লঙ্কায় নিজেদের রাজত্ব ফিরে পাওয়ার আশা ছাড়েননি। শুধু তাই নয়, সমগ্র অসুরজাতির সম্মান ও অহংকার পুনরুদ্ধারের জন্যও লঙ্কা ফিরে পাওয়া তাঁর জন্য অত্যন্ত জরুরি ছিল। অসুরদের অসাধারণ শারীরিক শক্তি, সাহস ও যুদ্ধকৌশল নিয়ে তাঁর আস্থার অভাব ছিল না। কিন্তু শক্তি ও দক্ষতায় দেবকূলের থেকে উন্নত হয়েও অসুরেরা হেরে যাচ্ছিল দেববংশীয়দের বুদ্ধিমত্তার কাছে। অসুরেরা ছিল সরল চিন্তাধারার, এবং নিজেদের শক্তি নিয়ে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী, যে-আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে অহংকারের পার্থক্য করা মুশকিল! কিন্তু সোজাপথে আদৌ সব যুদ্ধ জেতা যায় না, বা জিতলেও সেই জয় ধরে রাখা যায় না। তাই দেবতারা প্রায়ই অসুরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বাঁকাপথ নিতেন, যে-কারণে অসুরদের কাছে তাঁরা আরও ঘৃণার পাত্র ছিলেন। সুমালী বুঝেছিলেন, দেবকূলের বিরুদ্ধে জয়ের স্থায়িত্ব আনতে ও লঙ্কা উদ্ধার করতে এমন কাউকে দরকার, যে শক্তি-সাহস-যুদ্ধবিদ্যায় অসুরদের মতো পরাক্রমী হওয়ার পাশাপাশি বিদ্যা-জ্ঞান-শাস্ত্রচর্চায় হবে দেবতাদের সমকক্ষ। অর্থাৎ দুই জাতির সমস্ত সদগুণের সমাহার ঘটবে তার মধ্যে। সুমালীর মনে হলো, কুবেরের পিতা অর্থাৎ ব্রহ্মার পৌত্র বিশ্রবাই হতে পারেন তেমন সন্তানের উপযুক্ত জনক, আর সেই সন্তান গর্ভে ধারণ করার উপযুক্ত বলে তিনি নির্বাচিত করলেন নিজের মেয়ে কৈকেশীকে। 

অসুর-সমাজ বরাবরই ছিল অনেক উন্মুক্ত ভাবনাচিন্তার। কোনো মেয়ের মতের বিরুদ্ধে তাকে কোনো বৈবাহিক সম্পর্কে বাধ্য করা যেত না। বিশ্রবার সঙ্গে কৈকেশীর বয়সের পার্থক্য অনেক। সদ্যযুবতী কৈকেশী কি রাজি হবেন প্রৌঢ় বিশ্রবার সঙ্গে বিয়ের এমন পরিকল্পনায়? এই সংশয় সুমালীর ছিল। কিন্তু তাঁকে অনেকটা বিস্মিত করেই কৈকেশী এই পরিকল্পনার অংশীদার হতে রাজি হয়ে গেলেন। সম্ভবত ঐশ্বর্যশালী লঙ্কায় রাজকন্যা হিসেবে কাটানো শৈশবের পরে এই আত্মগোপনকারী জীবন মেনে নিতে পারছিলেন না তিনি। কিছুটা নিজের মুক্তির জন্য এবং অনেকটাই অসুরজাতির ভবিষ্যতের স্বার্থে তিনি পিতার প্রস্তাবে সায় দিলেন। কিন্তু তিনি রাজি হলে কী হবে, বিশ্রবা কেন চাইবেন একজন অসুরকন্যাকে বিয়ে করতে! সেই দায়িত্বও কৈকেশী নিজের কাঁধে নিলেন। যক্ষ রাজকন্যা তারকার মেয়ে হিসেবে মায়ের সৌন্দর্যের অধিকাংশটাই উত্তরাধিকারে পেয়েছিলেন তিনি। গায়ের মাজা রং, আকর্ষণীয় দেহবল্লরী, আবেদনময় চোখ---সবকিছু মিলিয়ে তিনি যেন আধুনিক ইংরেজিতে যাকে বলে Dusky Beauty, ঠিক তেমন! মেনকা যেমন বিশ্বামিত্রের তপস্যাভঙ্গের জন্য তাঁকে সিডিউস করেছিলেন, কৈকেশী ঠিক তা করলেন না। তবে তাঁর রূপের ছটায় মুগ্ধ হয়ে বিশ্রবা তাঁকে বিয়ে করলেন। সুমালীর প্রথম লক্ষ্য পূরণ হলো। এবার তাঁর অপেক্ষা সেই দৌহিত্রের জন্য, যে তাঁর স্বপ্ন সফল করবে।

রাবণ, কুম্ভকর্ণ, বিভীষণ ও শূর্পনখা--- কৈকেশী ও বিশ্রবার এই চার সন্তান। শূর্পনখাকে কেন্দ্র করে রামায়ণের কাহিনির একটি পুনর্নির্মাণে কবিতা কানে লিখেছেন যে, তিনপুত্রের পরে চতুর্থটি কন্যাসন্তান হওয়াতে কৈকেশী বেশ হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। যদিও তিনি বুঝতেন যে তাঁর প্রথম পুত্র রাবণই তাঁর পিতৃকূলের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়ে উঠছে, তবু তাকে সাহায্য করার জন্য ও ভবিষ্যতের অসুর-সাম্রাজ্যকে দৃঢ়তম করার জন্য যত বেশি সম্ভব পুত্রসন্তান জন্ম দিতে চেয়েছিলেন কৈকেশী। দ্বিতীয় স্ত্রীর এই উদ্দেশ্য যে বিশ্রবার অগোচর ছিল, তা নয়। কিন্তু পিতামহ ব্রহ্মার মতো তিনিও সম্ভবত দেব-অসুরকে নিরপেক্ষভাবে দেখতেন। তাছাড়া এটাও হতে পারে যে, তিনি কৈকেশীর এতটাই রূপমুগ্ধ হয়ে থাকতেন যে এসব চিন্তাকে খুব একটা আমল দেননি!

পরবর্তী ঘটনার বিশ্লেষণে যাওয়ার আগে এখানে একবার কৈকেশীর চার সন্তানের দৈহিক বৈশিষ্ট্য আলোচনা করে নেওয়া জরুরি। মিশ্রবিবাহের সন্তান হিসেবে এই চার ভাই-বোনের চেহারা কেমন ছিল, তা নিয়ে অনেক কৌতূহলোদ্দীপক আলোচনা আছে। সেগুলি বিশ্লেষণ করার আগে আমাদের মনে করে নিতে হবে, অসুরকন্যা হলেও কৈকেশী কিন্তু খাঁটি অসুর নন, কারণ তাঁর মা তারকা যক্ষ প্রজাতির মেয়ে। এমনকি, বাবা সুমালীও সম্পূর্ণ অসুর নন, কারণ সুমালীর বাবা সুকেশ অসুর হলেও মা দেববতী গন্ধর্বকন্যা। সুতরাং মিশ্রবিবাহের ধারা কৈকেশীর পিতৃকূলে আগেই ছিল; তিনি নিজে দেববংশে বিবাহিত হয়ে সেটাকেই আরও জোরদার করলেন, এই যা! ফলে গৌরবর্ণের দেব, কৃষ্ণবর্ণের অসুর, হলুদাভ গন্ধর্ব, শ্বেতকায় কিন্নর, উজ্জ্বল কালোরঙের যক্ষ ইত্যাদি সবরকম বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মানোর সম্ভাবনাই তাঁর সন্তানদের ছিল। নানা বর্ণনায় যতটুকু জানা যায়, এই চার ভাই-বোনের চেহারার বিভিন্নতাও ছিল সেরকমই। রাবণ যেমন তাঁর পিতার মতো গৌরবর্ণ, তেমনি তাঁর মাতৃকূলের পুরুষদের মতো দীর্ঘদেহী, প্রশস্ত বুক ও চওড়া কাঁধের অধিকারী এক আকর্ষণীয় পুরুষ; তাঁর চোখের মণি পিঙ্গল বা তৈলস্ফটিক রঙের, ইংরেজিতে যাকে আমরা 'Amber' বলি। কুম্ভকর্ণ সেখানে অস্বাভাবিক বিশালাকৃতির ঘন কৃষ্ণবর্ণের পুরুষ, যাঁর চোখের রংও কুচকুচে কালো। বিভীষণও রাবণের মতোই ফর্সা, কিন্তু উচ্চতায় পিতা বিশ্রবার মতো খর্বকায়, চোখের রং বাদামি । পিতা বিশ্রবার সঙ্গে তাঁর চেহারার মিল সব সন্তানের চেয়ে বেশি। আর শূর্পনখার চেহারার যে-বর্ণনা পাওয়া যায়, তাতে তিনি মা কৈকেশী বা মাতামহী তারকার মতো সুন্দরী না-হলেও যথেষ্ট আকর্ষণীয়া, শুধু তাঁর গায়ের রংটি আরও একটু চাপা। তাঁর চোখের মণি আবার রাবণের চোখের মতো, যা কোনো-কোনো আলোচককে এই সিদ্ধান্তে আসতে সাহায্য করেছে যে চোখের এই আশ্চর্য মিলই আসলে রাবণ ও শূর্পনখার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কিছু-কিছু মিলের কারণের অন্যতম পরিচায়ক। এসব তো গেল রাবণ-সহ কৈকেশীর চার সন্তানের শারীরিক উপস্থিতির বর্ণনা। কিন্তু এসব দিয়েই তো আর লঙ্কা উদ্ধার বা অসুর সাম্রাজ্যের বিস্তার সম্ভব ছিল না। তার জন্য জরুরি ছিল যে-সব প্রচেষ্টা, যা বিশেষত রাবণকে করে তুলবে পুরুষকারের প্রমুখ প্রতিনিধি এবং সম্ভাব্য সমস্ত শৌর্য-বীর্যের অধিকারী, সেইসব ঘটনার দিকে এবার চলে যাবো আমরা, পরবর্তী পর্বে। (ক্রমশ)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.