পূজা মৈত্র

মূল্যায়ন-হাতেগরম
মূল্যায়ন, মানে ইভ্যালুয়েশন। শব্দটা শুনলেই স্কুল স্কুল ভাব চলে আসে মনের মধ্যে। প্রতি চ্যাপ্টারের পর মূল্যায়ন, প্রত্যেক সপ্তাহে মূল্যায়ন,জামাকাপড়ের পরিচ্ছন্নতার মূল্যায়ন, শিক্ষক শিক্ষিকাদের সাথে ব্যবহারের মূল্যায়ন এবং সমস্ত মূল্যায়নের পরিশেষে একটি রেজাল্ট অর্থাৎ কিনা নতিজা, সেই অনুযায়ী হয় গ্রেডেশন। সেই হিসাবে দেখতে গেলে ছোটবেলা থেকেই প্রতি পদক্ষেপে আপনি মূল্যায়িত হয়ে এসেছেন-আজও হয়ে চলছেন।

এখনকার মূল্যায়ন আবার আরো সহজ,চটজলদি। এই ধরুন আপনি কারোর পছন্দের নায়কের বিরুদ্ধে ফেসবুকের দেওয়ালে এক লাইন লিখে ফেললেন-ব্যাস আপনি হয়ে গেলেন তার “হেটার্স”,তখন সেই নায়কের অন্ধ ভক্তটা আপনি আর আপনার মতো আর পাঁচজনকে ব্যঙ্গ করে মিম বানাতে থাকবে বাংলায় যাকে বলে কিনা “ট্রোল করতে থাকবে। একই ব্যাপার ক্রিকেটার,ফুটবলারদের ক্ষেত্রেও চলে। আবার ধরুন আপনি কোন রাজনৈতিক পোস্টে গঠনমূলক মতামত রাখলেন,এক মুহূর্তের মধ্যে আপনার মূল্যায়ন শেষ। রেজাল্ট বেরিয়ে যাবে-“চাড্ডি”, “ছাগু”, “সেকু”, “তিনু”, “মাকু” এইসব বিশেষণের। যার কোনটাই হয় তো আপনি নন। কোন নীতির সমালোচনা করলেই চটজলদি মূল্যায়িত হতে হচ্ছে-“দেশদ্রোহী” কি “পাকিস্তানের দালাল” আখ্যায়। ভাবতেই অবাক লাগে-দেশ কত এগিয়েছে। একটা মন্তব্যের কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই যারা সোশ্যাল মিডিয়ার তামাম লোকজন তার মূল্যায়ন সেরে ফেলে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে-খাপ বসাচ্ছে তার দেওয়ালে। 

সাহিত্য জগতের মূল্যায়ন এখন আরো সহজ। ভেবেচিন্তে গোটা পনেরো লাইনের একটা কবিতা পোষ্ট করলেন-মাথা খাটিয়েই। আপনার একটি পত্রিকা আছে। আপনি বাৎসরিক সাহিত্য পুরষ্কার দেন এবং দেখতেও মন্দ নন। আর যাবে কোথায়  পনেরো সেকেন্ডের মধ্যে পনেরো দুগুনে ত্রিশটার বেশি লাইক চলে আসবে (বলাবাহুল্য) কবিতাটি তাদের একজনও পড়েননি “বাঃ”, “অসাধারণ”, “অপূর্ব”-ইত্যাদি টাইপসুলভ মন্তব্যগুলো আপনার তেলা মাথায় আরো আরো তেল দিতে ছড়িয়ে পড়বে দেওয়ালময়। কবিতাটির মূল্যায়ন হয়েছে ভেবে আপনি আত্মতৃপ্তি লাভ করবেন-অথচ কবিতাটির কোনরকমেই মূল্যায়ন হল না। মূল্যায়ন সেদিন হবে-যেদিন  আপনি সম্পাদনা করবেন না-কাউকে কোথাও লেখা ছাপিয়ে দেবেন না,কোনও পুরষ্কার অনুষ্ঠান করবেন না,বয়সের সাথে দু-চারটে বলিরেখাও পড়ে যাবে তখন ঐ ত্রিশটি লাইকের একটি লাইকও পেলেন না পেলেও-যে ক’টি পাবেন জানবেন-মূল্যায়ন হয়েছে।

আপনি একটি উপন্যাস লিখেছেন। কি গল্প সংকলন-তার প্রকৃত মূল্যায়ন চান। অথচ পত্রিকা দপ্তরে পাঠিয়ে মাসের পর মাস গালে হাত দিয়ে বসে আছেন। একদম ঘাবড়াবেন না। সম্পাদক,সহ-সম্পাদকের ফোন নাম্বার জোগাড় করে কোন ঠাণ্ডা রেস্তোঁরাতে “কাপে কফি দে” বলে চিল্লিয়ে উঠুন-দেখবেন একটি লম্বা চওড়া মূল্যায়ন প্রকাশিত হয়েছে। আপনার লেখার-যেটা নিজে মেকি জানলেও দুনিয়ার সামনে সগর্বে তুলে ধরে আগামী বেশ কয়েকবছর তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলবেন। 

আবার দেখুন মানুষের পোশাক আশাক একটু “ব্র্যান্ড” মতো না হলেই আমরা মূল্যায়ন করে নিই-তার কোন রকমে টেনেটুনে সংসার চলে। অথচ তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে তার সাতপুরুষের ব্যবসা রমরমিয়ে চলছে আর আপনি নতুন পাওয়া চাকরির পয়সা হু-হু করে উড়িয়ে চলেছেন স্ট্যাটাস কেনার মোহে। 

একটি মেয়ে মদ খায়,সিগারেট খায়-জানতে পারলেই তার মূল্যায়ন হয়ে যায় সে স্লাট,বাংলায় বেশ্যা। একটি ছেলে একটু মেয়েলি হলেই গে,চলজলদি হয় মূল্যায়ন। চটপট পড়ে যায় তকমা। সবাই তাদের উপর হাসতে থাকে-আপনিও। অথচ মেয়েটি ওয়ান ম্যান উওম্যান,ছেলেটিও স্ট্রেইট। প্রচলিত ধারনা অনুযায়ী আমরা সবাই সবটা দেখে বুঝে নিতে চাই। যত কম সময়ে সম্ভব,সবাই ভারী ব্যস্ত যে আজ। 

তাই মূল্যায়নের এই জেট গতির ক্ষিপ্রতায় কতটা মূল্যায়ন হচ্ছে আর কতটা ভাঁওতাবাজি-তা উপরওয়ালা (যদি থেকে থাকেন) জানেন। প্রত্যেকেরই সবার আগে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মূল্যায়ন করা উচিৎ সময় নিয়ে। 

maitrapuja1984@gmail.com

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.