পিনাকি

শুনঃশেফ কথা বা ভারতের ‘গৌরব হত্যা’ - র ভূমিকা ...
!!১!!

পাতলা চেহারার এক মধ্যবয়সী যুবক দাঁড়িয়ে আছে । ঘাড় পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে চুলের গোছা , নাক টিকালো । চোখ দুটো স্থির । বর্ষাকালে নদীর মাথায় ঘন নীল রঙের মেঘ জমে থাকে , চারপাশে অপেক্ষারত পরিবেশ থেমে রয়েছে ; তখনই কাউকে না জানিয়ে তীক্ষ্ণ বিদ্যুৎ -তলোয়ার আকাশের স্তন চিড়ে দেয় ! দুগ্ধবতী যুবতির স্তনের বোঁটা ছিন্ন করে , পৃথিবীর মাটিতে ঝরতে থাকে জল বিন্দু । শ্রাবণের এই দৃশ্য মধ্যবয়সী যুবকের খুবই প্রিয় । সে প্রাসাদের জানালার ধারে দাঁড়িয়ে , নদীর উপরে তুলির আঁচড়ের মতন ছড়িয়ে থাকা আর মিশতে থাকা পাতলা আকাশের খেলা দেখছে । হাওয়া আসছে। এই মহল নদীর ধারে সারাবছর ফাঁকাই থাকে । বছরের এই সময়ে যুবক আর তার বান্ধবীরা একান্তে এই প্রাসাদে আসে । আনন্দ করে । যুবককে সমস্ত চিন্তা থেকে দূরে রাখে । 

গোদাবরীর ধারে এই প্রাসাদ , বিশ্বামিত্র নিজের পরিকল্পনাতেই তৈরী করিয়েছিলেন । দেবরাত তাঁর বড় প্রিয় । পিতাও দেবরাতের প্রিয় । এই প্রাসাদে তিনদিন এসেছে , এখানে প্রিয় বান্ধবীদের সাথে বেশ মজায় দিন কাটছে , তাও বাবার জন্য চিন্তা হয় । বিশ্বামিত্র নিজের বড় ছেলেকে আঁকড়ে ধরে তার খ্যাতি বৃদ্ধি করে চলেছে । 

দেবরাত নিজেও জানে -- বান্ধবীদের নিয়ে ঘুরতে আসার বিষয়টি খবর বাবার কাছে আছে । বাবা তাঁকে বিশ্বাস করে , ভালোবাসে । নিজের জীবনের অতীত দেবরাতকে এখনো মাঝে –মাঝে মাঝরাতে ঘুম থেকে ডেকে তোলে । সে জিজ্ঞেস করে , নিজেকে ভুলে যায়নি তো ? 

-দেবরাত ... 

ঘাড় ঘুরিয়ে , কামবতীকে দেখতে পেল । বুকে শুধু অন্তর্বাস পড়েছে , নিম্মাঙ্গে একখণ্ড বস্ত্র । দক্ষিণ জানালার হাওয়ায় , পাতলা রেশমের মতন কেশ গুচ্ছ উড়ছে ; নাকের উপর থেকে হাত চালিয়ে সরিয়ে দিয়ে হাসল ।এই হাসি শ্রাবণ দিনে বজ্রপাতের মতনই বুকের ভিতর চুরমার করে দিচ্ছে ! 

দেবরাত তাকিয়ে রয়েছে । ঘরের ভিতর , বর্ষা ভেজা আলো । বৃষ্টির শব্দ শোনা যাচ্ছে । 

-এদিকে , আমি তোমার অপেক্ষায় । 

-মিথ্যা কথা ।

-মাঝে – মাঝে আমিও মিথ্যা বলে ফেলি । এই যে তোমাকে কাছে আসতে বলছি , এখন যদি বলি দূরের বৃষ্টির ধারা যেমন ভাবে নদীর বুকে মিশছে ---- তা দেখাবার জন্য , এটা মিথ্যা বলা হবে । আমি চাইছিলাম আজকের এই মধ্যাহ্ন আমরা একসাথেই থাকব । 

কামবতী ধীরে –ধীরে এগিয়ে চলেছে , দেবারতের সামনে দাঁড়িয়ে বলল – আপনার পিতা আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছেন । সেই বার্তা নিয়ে বার্তাবাহক অপেক্ষারত । আজ থাকবেন , কাল সকালে উনি এই প্রাসাদ ত্যাগ করবেন । 

-আমি যাব । আমি পরশু এই স্থান ত্যাগ করব ।

-কেন ?

-পিতা আমার কাছে যে কোন রকমের বিনোদনের থেকে বেশী দামী । তিনি আমাকে আদর্শ জীবন দিয়েছেন। এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকবার মন্ত্র শুনিয়েছেন ।

-বুঝলাম না । 

- আজ যে দেবারতকে দেখছ , কুড়ি বছর আগে তার নবজন্ম হয়েছিল । 

-বুঝলাম না । 

-বুঝতে হলে তোমাকে কুড়ি বছর আগের এক রাতে ফিরতে হবে । আমার গল্প সেখান থেকেই শুরু... 

!!২ !!

মাটির ঘরের জানালা দিয়ে , বাইরে আশ্রমের চত্বরটা দেখে নিল । এখন রাত নারীর নাভির মতনই গভীর । অসীম । যে কোন মানুষ বাইরে পা রাখলেই মিশে যেতে পারে , মনে হয় অন্ধকারের রাতপোশাক গায়ে চাপিয়ে সে নিরুদ্দেশ হতে পারে । এমন সময় পালিয়ে যাওয়ার জন্যই উপযুক্ত । খুব সতর্কিত ভাবে দেখছে । নির্ঘাত বাকীরা ঘুমিয়ে আছে । এখন ধীরে ধীরে পা রেখে পালিয়ে যেতেই পারে ।

দেহে চাদর চাপিয়ে ,কাঁধে কাপড়ের ঝোলা নিয়ে , দরজার বাইরে পা রাখল । এইখানে তার জন্য কিছুই নেই । শুনঃশেফ মনে – মনে বলল - এই পৃথিবী তার জন্য নয় । যে ঘরে , পিতা –মাতার আশ্রয়ে সে বড় হয়েছে ,সেখানে তার মূল্য শুধুই পিতার অধীন বস্তু হিসেবে । সন্তান সে । পিতার ঔরসে জন্ম , তাই তার উপর অধিকার পিতার একান্ত । নিজের উপর নিজের কোন অধিকার নেই । এই গোষ্ঠীবদ্ধ সামাজিক নিয়মের ভারী অদ্ভুত নির্দয় সংস্কার । এটাই ভারতবর্ষ ? এখানেই সন্তান ব্যক্তিগত মালিকানার অন্তর্ভুক্ত ! তার এই কথা গুলো শুনবে কে ? বুঝবেই বা কে ? যে সংস্কারের শক্ত দেওয়াল এই সমাজের চারদিকে গাঁথা হয়েছে , হয় তুমি সেই দেওয়ালে মাথা কুটে মরে যাও । অথবা চীৎকার করতে থাকো । চীৎকার শুনে কেউ পাশে এসে দাঁড়াবে না । কেউ হাতে হাত রেখে সহযোগী হবে না । তাই কেউ আমাকে মেনে নিতে পারেনা ।আমার চিন্তা এদের কাছে ধ্বংসাত্মক । আমাকে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেই হবে । ঈশ্বরের নামে জীবিত দেহের বলিদান , কখনই কোন ঈশ্বরকে সুখি করতে পারে না । 

এইসব কথা ভাবতে -ভাবতে শুনঃশেফ আশ্রমের বাইরে পা রাখলেন । গোদাবরী নদীর ধার ঘেঁষে গভীর জঙ্গল। আকাশে গোল চাঁদ উঠেছে। চাঁদের বুক থেকে সাদা আলো ছড়িয়ে – ছিটিয়ে পড়ছে ।সেই আলোয় চারপাশ খুব শান্ত আর শিশুর হসির মতন সরল বলে মনে হয় । রাতের এই সময় দেখে কেউই টের পাবেনা , দিনের আলোয় এখানকার ক্ষমতাশালী মানুষের উগ্রতা ভয়ানক রূপ নেয় ! 

ঘোড়া নয় । পায়ে হেঁটেই গোদাবরী যাবে । তারপর ঘাঁটে বাঁধা কোন নৌকা চুরি করে দূরদেশে পালাবে । নিজেকে বাঁচাতে হবে , নচেৎ যে সংগ্রাম সে শুরু করেছে তা সফল হবে না । 

বেশ কিছুক্ষণ , খুব তাড়াতাড়ি পা চালিয়েই , জঙ্গলে ঢুকে গেল । চাঁদের আলো গাছেদের শাখা প্রশাখা ভেদ করে সম্পূর্ণ ভাবে আলোপথ তৈরী করতে পারছে না । আবার অন্ধকারও নেই । এই আলো আর অন্ধকারের মাঝের যে ঝাপসা আলোমাখা অন্ধকার , সেই মসৃণ অন্ধকারই একটা লম্বা পথ এঁকে দিল , জংলের জঙ্গলের বুকের মধ্য থেকে । সেখান দিয়ে হেঁটে গেলেই চলে আসবে গোদাবরীর তট । 

শুনঃশেফ এতক্ষণ খেয়াল করেনি , এইবার আচমকাই অনুভব করল পাতলা ভেজা অনুভূতি , গালের উপর। সে হাতের চেটো দিয়ে ছুঁয়ে দেখল জলের ছোট্ট লম্বা রেখা ! চোখ থেকে বেয়ে নামছে । এই কান্না তার ভিতরের ভাঙতে থাকা বিশ্বাসের । এই চোখের জল তার অপ্রাপ্য ভালোবাসার । চোখ থেকে গড়িয়ে নেমে আসা অশ্রু নিজের একান্ত গোপন চাহিদার ; যা মানুষের নির্দয়তার উষ্ণ আঘাতে গলে জল হয়ে গিয়েছে । এটা ভারতবর্ষ এখানে প্রচলিত ধারণার বাইরে বসবাসকারীর কোন স্থান নেই ।

শুনঃশেফ সত্য বুঝে গিয়েছিল অনেক আগেই , তবুও এতো আকাঙ্খা , ভালোবাসা , আশা ---- কাদের জন্য ছিল ? যে প্রথা চলে এসেছে , তার বিরুদ্ধে সে ভাঙতে –ভাঙতে কিছু গড়বার স্বপ্ন দেখছে । এই দেখাটাই আজ চারপাশের পরিচিত আপনজনের কাছে অপরাধের ! 

সে রুগ্ন , দুর্বল আর অত্যাচারিত দেহটাকে টেনে নিয়ে চলেছে । এটাই এখন একমাত্র সম্বল । সে শত আক্রমণের মধ্যেও নিজেকে পাল্টাবে না । আজ তার পাশে কেউ নেই , একদিন সকলেই বুঝবে । নিজেও জানেনা , তার এই আন্দোলন কোন পথে শুরু হবে ! থেমে থাকতে সে প্রস্তুত নয় । 

নিজের মনে ভাবছিল , আচমকাই খেয়াল হলও , অন্য পথে ঢুকে পড়েছে ! 

সামনে বেশ লম্বা ছায়ামূর্তি । হ্যাঁ গভীর জঙ্গলের ভিতর থেকে , গাছের পাতা সরিয়ে একজন বৃদ্ধ সামনে এসে দাঁড়ালেন । শুনঃসেফ দেখে কিছুটা চমকে গেল ! শেষ রাতের সীমায় এসে দাঁড়িয়েছে যে প্রহর , নিশাচর ছাড়া কেই বা জেগে থাকে । সকলের ভাগ্য তার মতন খারাপ হয়না । নিজের গৃহ নিজের ত্যাগ করেছে , গৃহের লোকেদের ঘুমের সুযোগ নিয়ে । শুনঃসেফ দস্যু নয় , চোর নয় --- অথচ তাকে এমন ভাবে পালাতে হবে । এই দেশে বিদ্রোহীদের জন্য এমন পরিণামই অপেক্ষা করছে । 

সামনের মানুষটি এগিয়ে এলেন । বললেন – কে তুমি ? 

বেশ গম্ভীর ভারী কণ্ঠ , সাদা- কালো লম্বা দাড়ি বুক পর্যন্ত , ঊর্ধ্বাঙ্গে কোন পোশাক নেই শুধু গলায় রুদ্রাক্ষের মালা , চোখ দুটো গভীর আর দৃঢ় । সে দিকে তাকিয়ে শুনঃসেফ থেমে গিয়েছে । এই শীতের মাসে , এই মধ্য বসন্ত পেড়িয়ে যাওয়া বৃদ্ধ বিন্দুমাত্র কাঁপছেন না ! শুনঃসেফ দেহে শীতের কাপড় , তাও সে ঘামছে । এই উত্তেজনা তার পরিস্থিতির জন্য । উল্টো দিকে জটাধারী বৃদ্ধ সাধু দাঁড়িয়ে আছেন , মুখে বিন্দুমাত্র প্রকৃতির ছাপ নেই ।

-আমি বহুদূর থেকে আগত এক পথিক । বিপদে পড়েই এসেছি । 

শুনঃসেফ কথা শুনে বৃদ্ধ সাধু বললেন - তুমি আমার সাথে এসো । গোদাবরীর তীরেই আমার কুঠিয়া । আমি এই শীতের রাতে জঙ্গলে সাধনার জন্য এসেছি , ধ্যান শেষ করে ফিরছিলাম । তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি ক্লান্ত , ক্ষুধার্ত । এসো । 

-আমাকে গোদাবরী পেড়িয়ে যেতে হবে । 

-সে ব্যবস্থা ও হবে । আমি প্রতি ভোরে নৌকা বিহার করি । আমার ব্যক্তিগত জলযান দেব । তুমি নিজে নৌকো চালাতে পারো ।

-হ্যাঁ । আমি নদী পেরিয়ে গেলেই , কোন মাঝিকে বলব এই পাড়ে দিয়ে যেতে । তার নৌকার সাথে আপনার জলযান বেঁধে নিয়ে আসবে ।

-ঠিকাছে , আগে তো আমার সাথে চলো । শেষ রাত বিশ্রাম নিয়ে , তোমার এমন পরিস্থিতির কারণ খুলে বলবে এসো ......

দুজনেই জঙ্গলের পূর্ব দিকের রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছেন । 

!!৩!!

শুনঃশেফ বসে আছে । কিছুটা দূরে বৃদ্ধ সাধু । ঘরে মাটির প্রদীপের আলো , দুজনের মুখে এসে মেখেছে । বাইরে রাত । ঠাণ্ডা । এখন দুজনের গায়েই শীত কাপড় । কুঠিয়া হচ্ছে অস্থায়ী আস্থানা । যারা যোগভ্যাস করেন , কেবল মাত্র কাজ চলাবার জন্য এই ক্ষণস্থায়ী ঘর তৈরী করেন । মেঝেতে খড় বিছিয়ে , তারউপর দুজনে বসেছে । 

শুনঃশেফ বলল – আমার পিতা ঋষি অজিগর্ত । নাম শুনে থাকতে পারেন । আমরা তিনভাই । আমি মেজো ছেলে শুনঃশেফ । আমার দাদার নাম শুনঃপুচ্ছ আর ভাই শুনঃ লাঙ্গুল । ছোট বেলা থেকেই আমি শুনে এসেছি , আমি আর পাঁচ জনের মতন নই । মানে চারপাশে যা ঘটে চলেছে , সেই মতবাদেই গা ভাসিয়ে দিতে রাজি নই । বাবার পৌরহিত্যের ব্যবসায় আমার দাদা আর ভাই খুব দ্রুতই যোগ্য উত্তরাধিকারী হয়ে গেল । আমি পারলাম না । কেন জানি , নিজেকে শুধুই শ্লোক আর বিধান দানের মধ্যে দেখতে চাইনি । নিজের চিন্তাকে সবচেয়ে বেশি সম্মান দিয়ে এসেছি , চারপাশের নিরীহ লোক গুলোর উপর যখন সংস্কারের নামে কর্তৃত্বের প্রহার করা হত , খুব যন্ত্রণা হত । ভারতীয় পিতা-মাতারা কেন তাঁদের সন্তানকে নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি মনে করেন ? আমি দেখে এসেছি , এখানে সন্তানকে বিক্রি করে দেওয়া হত । এই প্রথা নিষ্ঠুর ।ভারতবর্ষ , যে ভূখণ্ডের স্বপ্ন আমি দেখেছি তাতে এই প্রথা থাকতে পারেনা । ধীরে –ধীরে মানুষের বর্বরতা আরও ভয়ানক জায়গায় যাচ্ছে । আমি বিদ্রোহ করতে শুরু করি । আমার ভাইয়েরা আমাকে মেনে নিতে পারেনা । তারা মনে করে আমি তাদের পরিবারের স্মমান নষ্ট করছি । আমি জানিনা , সম্মান ব্যক্তিগত অনুভূতি , এখানকার মানুষেরা ভাবেন এই অনুভূতিও অন্যের আমানত ! আমরা কোন ভাবেই নিজেদের সামন্ততান্ত্রিক চিন্তা থেকে বেড়িয়ে আসতে চাইছি না । একদিন প্রকাশ্যে ঘোষণা করলাম , আমার পিতা-মাতার ঔরসজাত সন্তান আমি , তাঁদের লালন –পালনকে সম্মান দিচ্ছি , তাই বলে সন্তান কখনই জন্মাদাতার ব্যক্তিগত সম্পত্তি হতে পারে না । আমি আমার মালিক । এখান থেকেই শুরু হয়ে গেল আমার জীবনের গভীরতম দুর্যোগ । প্রচলিত প্রথার বিরুদ্ধে যেতে ই আমাকে সমাজচ্যূত করা হলও । এমন এক সময় ঈক্ষ্বাকু বংশের রাজা হরিশচন্দ্রের পুত্র রোহিত আসেন আমার পিতার কাছে । তিনি এক প্রস্তাব নিয়ে আসেন , আমার পিতা যদি তাঁর ছেলে বিক্রি করেন , তিনি বিপুল সম্পত্তির বিনিময়ে ক্রয় করবেন । পিতা এমনিতেই আমার উপর রেগে ছিলেন । তিনি ঠিক করলেন আমাকে বিক্রি করবেন । করেও দিলেন ,এক হাজার গরু , এক হাজার সোনার মুদ্রা , এক হাজার টুকরো বস্ত্র , আর প্রচুর –প্রচুর উন্নত জাতের ধানের পরিবর্তে আমাকে বিক্রী করে দিলেন । সম্মান রক্ষার নামে হত্যা করা হবে । রাজা হরিশ্চন্দ্র নিজের সম্মান রক্ষার জন্য পুত্র রোহিতকে বলি দিতে চেয়েছিলেন যজ্ঞে । পুত্রমোহ তাঁকে সে কাজ করতে দেয়নি । এদিকে তাঁর শাসন কালে পিতার সম্পত্তি নিজের সন্তান -- এই প্রথার প্রতি নীচুতলা থেকে প্রতিবাদ উঠতে শুরু করেছিল । তাই ক্ষমতা ধরে রাখবার জন্যই , উগ্র সংস্কার রক্ষার দরকার । ছেলের কথাতেই বাধ্য হয়েই চেয়েছিলেন , কোন ব্রাহ্মণ নিজের পুত্রকে রাজার জন্য বলি দিক । আমার বাবা গরীব । তাঁর ভাগ্য ফিরতে হলে , রাজার অনুগ্রহের শীল মোহরের দরকার ছিল । তাই আমাকে বিক্রি করে দিয়েছে । আমি প্রাণ ভয়ে নয় , এই ভারতীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে লড়ব , তাই ঘর ছেড়েছি । ধর্মের নামে তাঁরা যে প্রথাকে চাপিয়ে দিচ্ছেন , তাতে সমাজ ধ্বংস হবে । আমি বেঁচে থেকে এদের বিরুদ্ধে লড়তে চাই । ঘর ছেড়েছি । পথে আপনার সাথে দেখা ...। 

এতক্ষণ বৃদ্ধ সাধু চুপ করে শুনছিলেন । মাটির প্রদীপের আলোয় দুটো চোখ ঝলসে উঠেছে । তিনি বললেন –তুমি একা পারবে , এই চলে আসা ভারতীয় প্রথার বিরোধিতা করতে ! ভারতীয় পুরুষেরা নিজেদের ঔরসকে নিজেদের পুরুষত্ব ভেবে নেয় । তাই সে বীর্য যে প্রাণের সঞ্চার করেছে , তা ভারতীয় পুরুষেরা মনে করে , ব্যক্তিগত সম্পত্তি । তাইতো সন্তানের বিবাহ কিম্বা গতিবিধি সবকিছুতেই তারা হস্তক্ষেপ করতে চায়। নিজের সম্পত্তির রক্ষা করতে হবে । এটা শুধুই আর সংস্কার বা প্রথায় নেই । এটা এখন মানসিকতা হয়ে উঠেছে । প্রথা তুমি পাল্টিয়ে দিতে পারো । সংস্কারে পরিবর্তন আসতে পারে , কিন্তু মানসিকতাকে সম্পূর্ণ ভাবে মুছে ফেলবে কেমন করে ? পারবে ? 

শুনঃশেফ বলল - এতকিছু জানিনা , তবে এটা ঠিক আমাকে এখন উঠতে হবে । দেখুন আসন্ন প্রসবার মুখের মতনই নতুন আশায় পৃথিবীটা সেজে উঠেছে । সূর্য উঠবে । নদী তীরে আপনার নৌকো ছাড়বার সময় হয়ে এলো । 

-অবশ্যই । আমি নিজে তোমাকে সেখানে নিয়ে যাব । তুমি জানও , তোমার এই -‘গৌরব হত্যা’ প্রথার বিরোধিতার খবর রাজা রহিতের কানে গিয়েছিল , পাছে তুমি এই প্রথার বিরোধীতা করে ক্ষত্রিয়ের সার্বভৌমত্বের উপর আক্রমণ করেছো । তাই রাজা হরিশ্চন্দ্রকে দিয়ে প্রথার অছিলায় সম্মতি নিয়ে , তোমার পিতার কাছ থেকে ক্রয় করেছে । আসলে তোমাকে গোপনে হত্যা করা হবে । তোমার পিতার মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে । আজই মধ্যদিবস তোমার প্রাণের অন্তিম মুহূর্ত । 

-আপনি জানলেন কেমন করে !! মানে রাজপ্রাসাদে আজ মধ্যদিবসে আমাকে হত্যা করা হবে , এই খবর আপনি শুনলেন কেমন করে ?

কিছুক্ষণ থেমে বৃদ্ধ সাধু হেসে উঠলেন । তাঁর প্রবল হাসি শুনে শুনঃশেফ বলল – আপনি কে ?

হাসি থামিয়ে সাধু বললেন - তুমি যে যজ্ঞের জন্য এই স্থান ত্যাগ করছিলে । আমি সেই যজ্ঞের প্রধান পুরোহিত । আমিই পৌরোহিত্য করব । নাম বিশ্বামিত্র । 

শুনঃসেফ সাক্ষাৎ মৃত্যুর পাশে বসে আছে ! তার নিঃশ্বাস গিয়েছে থেমে । গলা শুকিয়ে গিয়েছে । এই বুঝি অন্তিম প্রহর । শেষ পর্যন্ত , শেষ রক্ষা হলনা ! 

!!৪!!

বাইরে বৃষ্টি অনেকক্ষণ আগেই থেমে গিয়েছে । বৃষ্টি থেমে গেলেও গাছেদের পাতার পীঠে স্থির জল বিন্দুর এখন ঝরে পড়বার সময় । নিথর হয়ে শুয়ে থাকা নদীর বুকের উপর যে শুকনো পাতা ভেসে চলেছে , ফুরিয়ে যাওয়া বিকেলের আলো -- তাকে আরও নিঃসঙ্গ করে দিয়েছে ।

বাইরে এখন আলো নেই । কক্ষের ভিতরেও নেই । সন্ধ্যার আঁচলে পৃথিবী ঢেকে গিয়েছে । এক হতভাগ্যর গল্প , অন্তিম পর্বে এসে থেমে গেল ! 

মধ্যবয়সী দেবরাতের মুখ দিয়ে যে গল্প স্রোতের মতন প্রবাহিত ছিল , তা সন্ধ্যার মতন স্থির ! কামবতী বলল –তারপর ?

-তারপর , শুনঃশেফ মৃত্যুকে আহ্বান করল । 

-প্রাণ গেল !! 

দেবরাত কিছুক্ষণ থেমে বলল 

-সামনে কে ছিলেন ? তুমি আন্দাজ করতে পারবে ? 

কামবতী মাথা নেড়ে বলল – না । 

-আমার পিতা বিশ্বামিত্র ! 

-মানে ?

-বৃদ্ধ সাধু এগিয়ে এসে বলল --- 

শুনঃশেফ তোমার সাহসে মুগ্ধ । তাই প্রাণ রক্ষার জন্য এক শর্ত রাখলাম । শুনঃশেফ কে নিজের গোত্র পাল্টাতে হবে । বিশ্বামিত্র তাকে দত্তক নেবেন । সে হবে বিশ্বামিত্রের পালিত পুত্র । আর সন্তান পিতার ব্যক্তিগত সম্পত্তি , তাই পিতার নির্দেশেই সে চলবে । এমন ভাবে শুনঃশেফের প্রাণ রক্ষা পাবে । তুমিও তোমার কাজ করে যেতে পারবে । আমি বিশ্বামিত্র , আমার পুত্রের বিরুদ্ধে কোন ক্ষত্রিয় কথা বলবার সাহস পাবেনা। এসো আজ থেকে তুমি দেবরাত । 

কথা গুলো শুনে কামবতী অবাক মুখে বলল - 

-সেই ছেলেটার এখন খবর জানেন ?মানে কোন দেবরাত ? 

- তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে । আমিই শুনঃশেফ , পরিচয় পাল্টে বিশ্বামিত্রে বড় ছেলে দেবরাত হয়েছি । পুনঃজন্ম হয়েছে । 

কামবতী কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল , বলল - কিন্তু কেন আপনি মেনে নিলেন ? আপনার প্রতিবাদের দায়িত্ব এখন কে নেবে ? দেবরাত হয়ে বেঁচে রয়েছেন । শুনঃশেফ ? তাঁকে মেরে ফেললেন ! এই সমাজে তাঁদেরই দরকার । আপনার অধিকার নেই , এমন ভাবে তাঁকে হত্যা করবার । আপোষ করলেন ! সে যে প্রতিবাদী ছিল। ভবিষ্যৎ ভারতের স্বপ্ন ছিল । এই দেশ এমনই আত্ম - প্রথার ধারা বহন করে চলেছে , এইসব প্রথা থেকে আগামী প্রজন্মকে মুক্ত করতে হবে । আপনি নিজে সৈনিক হয়েও কর্তব্য ত্যাগ করলেন ! 

বাইরে এখন সম্পূর্ণ অন্ধকার । কক্ষের জানালা দিয়ে নদীর শান্ত স্রোতের শব্দ আসছে । হাওয়া আসছে । সেই হাওয়ায় কামবতীর কেশগুলো উড়ছে । খোলা চুল । বুকে শুধুমাত্র অন্তর্বাস আছে । 

দেবরাত উদাস চোখে বলল – সে এখনো বেঁচে রয়েছে ।তোমাদের চেতনায় সে অমরত্ব পেয়েছে । শুনঃশেফের কথাই , ভারতবর্ষের প্রাচীন কথায় প্রথম ‘গৌরব হত্যা’ –র ভূমিকা হয়ে থাকবে । দেবরাত হারিয়ে যাবে । পিতা বলেছিলেন , প্রচলিত মানসিকতার জন্য লড়তে হলে মানসিক ভাবে প্রস্তুতি নিতে হয় । প্রজন্ম তৈরী করতে হবে । জাতিগত উগ্রতার বিরুদ্ধে লড়াই বেশ জটিল । এটা একটা মানসিক ব্যাধি । জানিনা ,আমি কতদূর এগিয়েছি । কিন্তু ভারতবর্ষ কোন পথে চলবে , তা ঠিক করবে ভারতবর্ষই ............ 

( গল্পের চরিত্ররা , সময় , পরিবেশ ‘ব্রহ্ম পুরাণ ’ এর আবর্তে সৃষ্টি হয়েছে । গল্পের ঘটনা , গতিবিধি আর চরিত্রদের চরিত্রায়ণ সম্পূর্ণ মৌলিক । কোন সম্প্রদায় বা মানুষকে আঘাত দিয়ে থাকলে ক্ষমাপ্রার্থী ।বেশ কিছুদিন আগে খবরের কাগজে পড়েছিলাম , এক তরুণীকে তাঁর পরিবারের লোক হত্যা করেছে , কেননা মেয়েটি নিচু জাতের ছেলের সাথে সম্পর্ক করেছিল ! হত্যা থেকেও আমার কাছে আশ্চর্য মনে হয়েছে , নিজের সন্তানকে নিজের সম্পত্তি ভেবে নিয়েছি আমরা ভারতীয়রা । এই ঘটনা নতুন আর ব্যাতিক্রমী নয় । আচ্ছা পুরাণে অনেক গল্পেই দেখেছি , সম্মানের জন্য পুত্রকে যজ্ঞে বলি দিয়েছে , তার অর্থ বা সমার্থক আমার কাছে মনে হয়েছে , বর্তমানের ঘটনা ।আবার হয়ত এটা সম্পূর্ণ আমার অজ্ঞতাই হবে । আমি এমন ভাবে দেখছি ! ) 

chakrabortypinaki50@gmail.com


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.