জয়া চৌধুরী

আজাইরা বাজার কথন / জয়া চৌধুরী

- দেখুন ম্যাডাম, অন্যান্য সাবজেক্টে তো ও ভালই নম্বর পেয়েছে। কিন্তু ইংরিজিতে যা পেয়েছে তাতে আমরা সন্তুষ্ট নই।
- আপনাদের হাতে তো দেখবার জন্য বাচ্চার খাতা তুলে দেওয়া হয়েছে। নিজেরাই চেক করে দেখুন বাচ্চার যেখানে ভুল আছে সেখানেই নম্বর কাটা হয়েছে। অযথা কাটা হবে কেন?

- এই প্যারাগ্রাফে ও পাঁচে সাড়ে তিন পেল কেন?

মাথায় তোলা চশমাটা নাকের ওপর নিয়ে এসে দিদিমণি আবার দেখালেন – দেখুন আমাদের স্টেপ মারকিং করা আছে পরিষ্কার ভাবে। এর বেশি পাবার মত লেখে নি আপনার বাচ্চা।

নাছোড় বাবাটি বলেই চলেছেন- কিন্তু ও তো হিন্দী, ইতিহাস, অঙ্ক সব সাব্জেক্টেই যা পেয়েছে তা অনেক...

- দেখুন অঙ্কের সঙ্গে তো ইংরিজির তুলনা করা যাবে না

- না না তুলনা কেন করবো? কিন্তু আমার কাছে তো এটাও বোঝার বাইরে ও পাঁচে সাড়ে তিন পেল কেন? যেখানে ক্লাসে এই প্যারাটাই লেখানো হয়েছিল। এখানে তার চেয়ে খুব কিছু আলাদা তো লেখে নি, তাহলে নম্বর কাটবেন কেন টিচার? ক্লিয়ার হচ্ছে না

- দেখুন আমার যা বলার তা তো বললাম , এর পরেও যদি আপনার জিজ্ঞাসার কিছু থাকে আপনি প্রিন্সিপাল ম্যাডামের কাছে জানাতে পারেন।

- না না সে কি বলছেন। সাবজেক্টের ব্যাপারে সাবব্জেক্ট টিচারের সঙ্গেই কথা বলব...

কথাবার্তা শুনছিলাম মানে শুনতে বাধ্য হচ্ছিলাম এক ইংরিজি মাধ্যম বিখ্যাত স্কুলের ক্লাস এইটের ছাত্রের ফলাফল বেরোনর দিন। হ্যাঁ বোর্ডের রেজাল্ট নয়, বি এ এম এর রেজাল্ট নয় ক্লাস এইটের ছাত্রের বাবার এইরকম মনোভাব। শুনছিলাম আর ভাবছিলাম এইসব ছাত্রছাত্রীর ভবিষ্যৎ কতখানি উজ্জ্বল? উজ্জ্বলতা বলতে যদি মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির উচ্চ মাইনের কেরানী বৃত্তির চাকরি হয় সে কথা আমার আলোচনার বিষয় নয়। কিন্তু যদি সার্বিক সামাজিক প্রেক্ষিতের কথা ভাবী, জাতির ভবিষ্যতের কথা ভাবি তাহলে এর চেয়ে অধঃপতনের বিজ্ঞাপন তো আমি খুঁজে পাই না। জানি আগে সব ভাল ছিল এখন সব খারাপ- এমন বলাটা বার্ধক্যের লক্ষণ। কিন্তু পাশাপাশি আরো কিছু কথা মনে পড়ছে। আমাদের বাড়িতে ছোটবেলায় গল্প শুনেছি দাদুভাইকে তাঁর বাবা শিশুকালে ইস্কুলে ভর্তি করার সময় হেড মাস্টার মশাইকে বলেছিলেন- মশয়, এই আপনের হাতে পোলারে দিয়া গেলাম। হাড্ডি আমার চামড়া আপনের। না পড়লে পিটাইয়া চামরা খুইল্যা ফ্যালবেন যতক্ষণ না পড়া কইরা ওঠে। কিংবা তার পরের জেনারেশনে আমার মায়ের বেলা তার লেখাপড়ার তদারকী করত তার ঠাকুমা। ইস্কুল থেকে ফিরে সন্ধ্যাবেলা নাতনী পড়তে বসলে ঠাকুমা সামনে বসে পাহারা দিতেন। নিজে বসে বসে ঝিমাতেন কিন্তু চটকা ভাঙলেই চোখ পাকিয়ে নাতনীকেই শাসাতেন- ঝিমাস ক্যান? পড় মন দিয়া। বিকেলের খেলাধুলোর পর চোখ ভরে ঘুম এলে মার তখন মনে হত -হে ভগবান কী কড়া ঠাম্মা রে বাবা! অন্যের ঠাম্মার কেমন আহ্লাদ দেয় আর আমার ঠাম্মা শত্তুর। তারপর ঘুমের অতলে তলিয়ে যেতে যেতেই পাখার ডান্ডির খোঁচা- অই, বইস্যা বইস্যা ঝিমাস ক্যান? ল্যাহাপড়া করতে লাগব না? কিছুক্ষণ পড়তে না পড়তেই ঘুমের চোটে যখন ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা, তখন ছোট বাইরে করতে যাবার নামে কলঘরে যাওয়া। সেখানে একটা বাঁধানো সিঁড়িতে বসেই মিনিট দশেকের ছোট্ট ন্যাপ দিয়েই ফের পড়ার জায়গায় প্রহরী ঠাকুমার আওতায় ফেরা। 

প্রসঙ্গত মা ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে প্রথম দু/ তিনের মধ্যেই চিরকাল থাকত। 

এমনকী আমাদের প্রজন্মের সবার নিশ্চয় মনে আছে ছোটবেলায় আমাদের মা বাবা পড়া করছি কি না, কোচিং এর নাম করে অন্য কথাও আড্ডা দিচ্ছি কি না এইসবই খেয়াল রাখতেন, ব্যাস ওইটুকুই। নিজেদের লেখাপড়া করে নেবার দায়িত্ব নিজেদেরই ছিল। টিচার নম্বর কম দিলে অভিযোগ করলে পালটা বাবা বলেছে- নিশ্চয় তুই ঠিক মত লিখস নাই। আবার নালিশ করস? পরের বার য্যান এই কথা না শুনি। 

শিক্ষকের ভুল হয় না এমন নয়। ভুল কার না হয়? কিন্তু তার জন্য এমন অশালীন বা নাছোড়বান্দা ঘ্যান ঘ্যান যদি অভিভাবকেরা করেন তাহলে ছেলেমেয়েরা কি করে শিখবে জীবনে কোন জিনিস অধিক গুরুত্বপূর্ণ? বিষয় জানা না অথবা বিষয়ে নম্বর পাওয়া? জানা থাকলে নম্বর আজ না হোক কাল আসবেই। কিন্তু গোঁজামিল দিয়ে বা সাজেশন ভিত্তিক যে নম্বর পাওয়া তা দিয়ে কিছু কি নতুন হয়? গত পঞ্চাশ বছরে ভারত থেকে বিজ্ঞানে কটি আবিষ্কার হয়েছে যার পৃথিবীতে সাড়া ফেলেছে? বিজ্ঞান দর্শন ইতিহাস অঙ্ক কোন বিষয়ে সৃষ্টিশীলতা বেড়েছে গত তিরিশ বছরে? আমাদের কি ভেবে দেখতে হবে না কোথায় খামতি থাকছে? সে কি আমাদের চেষ্টায় খামতি? খাটুনি তে খামতি? দ্রুত সাফল্য বাসনার অভ্যাস? স্বার্থপর হয়ে যৌথ কাজে অনীহার ত্রুটিতে? কোথায় কোথায় কোথায়? 

আজাইরা নয় বোধহয় এ প্রশ্ন। উত্তর আপনাদের কাছেই খুঁজি...


jayakc2004@yahoo.co.in


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.