(পর্ব - ২)
পেনস ল্যান্ডিং দেখে এসে এবার হাজির হই আমেরিকার স্বাধীনতার অন্যতম প্রতীক "লিবার্টি বেল' এর সামনে। ফিলি হল আমেরিকার সেই জায়গা যা স্বাধীনতার যুদ্ধের গল্প বলে। ফিলাডেলফিয়ার প্রাণকেন্দ্রে এই লিবার্টি বেল।
আমেরিক স্বাধীন হয়েছিল ১৭৭৬ সালে। তার আগে এটি ছিল একটি ব্রিটিশ কলোনী। তখন এখানে তুলো, তামাক এবং অন্যান্য শস্যাদি চাষাবাদের জন্য প্রচুর লোক ক্রীতদাস হিসেবে আনা হত সুদূর আফ্রিকা থেকে। সেই মানুষদের কঠোর জীবন এবং করুণ কাহিনীর প্রেক্ষাপটেই তৈরী হয়েছে কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকার ইতিকথা। আমেরিকা যখন স্বাধীন হল তখন পেনসিলভেনিয়ার সকল ধনী এবং প্রভাবশালী লোকেদের বাড়িতে ক্রীতদাস থাকত কিন্তু কাল এবং বিবেকের ধাক্কায় সমাজে কিছু পরিবর্তণ আসতে শুরু করল। যার ফলে এব্রাহাম লিঙ্কনের রাস্ট্রপতি হবার সময় সকল ক্রীতদাসকে আইনত মুক্তি দেওয়া হল। এর ফলে আমেরিকার অভ্যন্তরে এক ভয়ানক গৃহযুদ্ধ লাগে যেখানে দক্ষিণ দিকের রাজ্যগুলি এই আইন মানতে আপত্তি জানায়। কিন্তু লিঙ্কন দৃঢ় হস্তে সেই বিদ্রোহ দমন করেন এবং ক্রীতদাসদের মুক্তি দিলেন। মুক্তি পেলেও বর্ণবৈষম্য চলতেই ছিল এবং কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর নানারকম অত্যাচার অব্যাহত ছিল। তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ও ছিলনা তখনো। অবশেষে বিংশ শতাব্দীতে মার্টিন লুথার কিং এর নেতৃত্বে সরকারীভাবে সেই অধিকার এবং বর্ণবৈষম্যের অবসান ঘটে।কৃষ্ণাঙ্গদের এই করুণ কাহিনীর সাথে জড়িয়ে রয়েছে ফিলাডেলফিয়ার ইতিহাস। লিবার্টি বেল দেখতে গিয়েও সেই এক কথামালা অণুরনিত হয়।
লিবার্টি বেল বা আমেরিকার স্বাধীনতার প্রতীকি এই বিশালাকার ঘন্টাটি অনেক কিছু মুক্তির কথা বলে। একাধারে আমেরিকার স্বাধীনতা, ক্রীতদাস-প্রথার অবসান, কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বর্ণবৈষম্যমূলক আচরণের থেকে মুক্তি এবং অবশেষে নারী স্বাধীনতা। তাই এই ঘন্টাটি দেখতে প্রচুর মানুষের ভীড় হয়।
আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণা থেকে সংবিধান সাক্ষরিত হবার সব ছোট ছোট গল্প রয়েছে এই লিবার্টি বেল মিউজিয়ামে। এই বিখ্যাত ঐতিহাসিক ঘন্টাটি ১৭৫৩ সালে তৈরী করা হয়। কিছুদিনের মধ্যেই এর গায়ে ফাটল ধরে। এর ওজন ২০৮০ পাউন্ড। এর কিছুদূরেই মিউজিয়াম অফ আমেরিকান রেভলিউশান, ইউ এস মিন্ট বা টাঁকশাল অবস্থিত। আরেকটি উল্লেখযোগ্য স্থান হল বেটসি রস হাউজ। কথিত আছে, ১৭৭৬ সালে প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন স্বয়ং বেটসি রস নামক এই মহিলার বাড়ি বয়ে গিয়েছিলেন আমেরিকার জাতীয় পতাকাটি কেমন সেলাই হচ্ছে তা দেখবার জন্য। এখন সেখানে প্রদর্শণী হয়। আড়াইশো বছর ধরে এই ফ্ল্যাগ মেকিং চলে আসছে তার পরম্পরা অনুযায়ী। আর আছে ক্রাইস্টচার্চ বিউরিয়াল গ্রাউন্ড। বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিনের পোষ্যপুত্রকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল সেখানে। এছাড়াও আছে বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন মিউজিয়াম। যিনি ছিলেন একাধারে আবিষ্কারক, মুদ্রক, কূটনৈতিক এবং সরকারী এক অনুচর ।মানে আক্ষরিক অর্থে জ্যাক অফ অল ট্রেডস।
সেদিনের মত বেড়ানো শেষ। এবার রেস্তোরাঁয় খেয়ে বাড়ী ফিরি উবের ধরে। ফিরে এসেই চালেডালে খিচুড়ি চাপিয়ে দি রাতের জন্য। সঙ্গে আলু আর ডিম ভাজা। তার পরেই লিখতে বসা একান্তে, নিজের সঙ্গে। প্ল্যান হয় বাবা আর ছেলের। পরদিনের জন্য। ছকে নেওয়া হয় আইটিনারি। ডাউন্টাউন ফিলি দেখাতে নিয়ে যাবে ছেলে।
ডাউন টাউনে সেন্টার সিটি হল ফিলাডেলফিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় ঝাঁ চকচকে প্রাণকেন্দ্র। এখানকার বিখ্যাত আর্ট মিউজিয়ামটি দেখতে গেলাম । মাসের একটি রবিবারে মিউজিয়ামের প্রবেশমূল্যে থাকে বিশেষ ছাড়। সেদিন যে যা খুশি দিয়ে টিকিট নিতে পারে। মানে মুক্ত হস্তে দানের মত ব্যাপার। অন্যদিনগুলোয় মহার্ঘ্য ডলার দিয়ে কিনতে হয় টিকিট। সৌভাগ্যবশত আমরা সেদিনই গেছি। আর সামান্য খরচা করে অত সুন্দর মিউজিয়ামটিতে পা রাখতে পেরেছি। নয়ত প্রবেশমূল্য বড়োই মহার্ঘ। আমেরিকায় এমন আর্ট মিউজিয়ামের ছড়াছড়ি। তবে এই মিউজিয়ামটিতে সব নামীদামী শিল্পীদের আঁকা ছবির সঙ্গে রায়েছে প্রচুর নতুন ধরণের রঙ্গীন পটারী । ঘরের পর ঘর শুধু পটারী। গ্যালারীর নিলয়-অলিন্দে, আনাচেকানাচে নানান আকৃতির পটারী। আর এশিয়ায়ন কর্ণারে ভারতের মাদুরাইয়ের একটি মন্দিরময় গ্রাম সম্পূর্ণ তুলে এনে বসিয়েছে ওরা। দাক্ষিণাত্যে দেখভালের অভাবে পোড়োটে হয়ে যাচ্ছিল। ধনবান দেশ ঝোপ বুঝে কোপ মেরেছে। সেখানে রাজকীয় গণেশ, দুর্গা থেকে কালী, ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর সকলেই রয়েছেন এক আকাশের নীচে। আর রয়েছেন স্বমহিমায় গৌতমবুদ্ধ। পাথরের সব অপূর্ব মূর্তি। ঠিক যেন মনে হল নিজের দেশে এসে ঢুকলাম।
indira.mukerjee@gmail.com
সুচিন্তিত মতামত দিন