আজ মহাষষ্ঠী। শহরের এই দিকটা কোলাহল বর্জিত। ভেজানো দরজা ঠেলে মায়ের ঘরে ঢুকে দেখি মা আনমনা বসে আছে। ঘরের জানলাগুলো সন্ধ্যের পর বন্ধ করেই দেওয়া হয়, তবুও দূর থেকে মাইকে হালকা একটা গানের সুর ভেসে আসছে। মা উদাস ভাবে বসে আছে সামনে দুই পা মেলে, কোলের উপর একটি বই খোলা, তার উপর মায়ের চশমা। একটু আগে অতনু ফোন করেছিল। ও এখন নিউ জার্সিতে। কোম্পানির একটা প্রোজেক্ট নিয়ে গেছে সপ্তাহ খানেক হল। এবার পূজোয় দেশে নেই অতনু।
‘মা বই পড়ছ?’
‘এখন আর বেশীক্ষণ বই-এ চোখ রাখতে পারি না রে, ব্যথা করে। দুর্গা পূজোর উপর একটা প্রবন্ধ পড়ছিলাম।’
কই, দেখি, দাও, আমি পড়ে শোনাই।’
মা খুশীর হাসিতে মুখে আলো ছড়িয়ে বলে, ‘তুই পড়ে শোনাবি সোনাই?’
আমি সোহিনী। মায়ের সোনাই। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে মা আমাদের সঙ্গেই থাকে। ছোটবেলায় যদিও বাংলা মিডিয়াম স্কুলে পড়াশুনা করেছি, কিন্তু একটি কম্প্যুটার কোম্পানিতে কাজের সূত্রে বাংলা বই পড়ার সঙ্গে সম্পর্ক চুকে গেছে। অনেকদিন পরে কোন বাংলা পত্রিকায় চোখ রাখি, পড়তে থাকি—‘পৃথিবী সূর্যকে ঘিরে ঘিরে ঘুরে চলেছে তার আপন ছন্দে। চলতে চলতে কখনও সে চলে যায় কক্ষপথের দূরতম প্রান্তে, কখনও বা চলে আসে সূর্যের খানিক নিকটে—তার এই চলার খেয়ালে আমাদের এখানে শীতের হাওয়ায় নাচন লাগে আমলকির ডালে কিম্বা খরবায়ু বয় বেগে অথবা শিউলির ডালে কুঁড়ি ভরে আসে, মালতী লতায় দুইবেলা খোঁজ নিতে আসে মৌমাছির ঝাঁক, আর রাশি রাশি সোনার ধানে ভরে ওঠে তরী। বহিঃ প্রকৃতিতে ঋতুর এই বৈচিত্র্য অন্তরের দেবতার ভোগের জন্য নানা স্বাদের নৈবেদ্য নিবেদন। আমি আছি, তাই তো জগৎ! তা না হলে জলে স্থলে অন্তরীক্ষে এত বিপুল সৌন্দর্যের আয়োজন আর কার জন্য? অঝোর-ধারা বরিষণ-ক্ষান্ত মেঘমুক্ত নীলাকাশে সাদা মেঘের ভেলা আর মাটির আঁচলে লুটিয়ে পড়া রোদের সোনা —শরৎ প্রকৃতির এই ‘নয়ন ভোলানো’ রূপ দেখে মানুষের মনের সুপ্ত খুশীই বাইরে এক উৎসবকে কেন্দ্র করে মূর্তি ধরতে চায়, ঘরছাড়া প্রবাসী খোঁজে ঘরের মানুষের কাছে ফিরবার অছিলা, অভিমানে দূরে সরে যাওয়া সম্পর্ক উৎসবের আমেজে কাছে এসে কোলাকুলি করে হৃদয় জুড়ায়—এটাই উৎসবের প্রাণের কথা। আর ঋতুর এত বৈচিত্র্য বঙ্গভূমির মতো প্রকট হয়ে আর কোথাও তেমন ভাবে ধরা দেয় না। যদিও বিগত কয়েকদশক ধরে বিশ্বজুড়ে ভয়াবহ পরিবেশ দূষণ ও ‘গ্লোবাল ওয়র্মিং’ যে ভাবে সব ঋতুবাহারকে গ্রাস করে চলেছে, সেই প্রভাব থেকে ‘সুজলাং সুফলাং শস্য শ্যামলাং’ বাংলাও মুক্ত নয়। তবুও একদা যত উৎসবের আয়োজন হয়েছে, তা সবই সৃষ্টি ঐ প্রকৃতির নানা রূপের সঙ্গে মানব-হৃদয়ের তালমেল থেকেই। শীতের শুষ্কতার অবসানে যখন ঋতুরাজ বসন্তের আগমনে শাখে শাখে নতুন কিশলয়—তখনই দোল উৎসব। প্রাচীন বঙ্গের দুর্গোৎসবও ছিল এই বাসন্তী দুর্গা পূজো। পরে রামচন্দ্রের অকালবোধনই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তার ঐতিহাসিক কারণের সঙ্গে সঙ্গে ঋতুরাণী শরতের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও একদা কৃষিনির্ভর বাংলার মাঠভরা সোনালী ধানের শীষ অবশ্যই সঙ্গত কারণ।’
পড়া থামিয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘আচ্ছা মা, রাম তো উত্তরভারতেই জনপ্রিয়। তবে ‘অকালবোধন’ বাংলারই একান্ত নিজস্ব উৎসব হয়ে উঠেছে কি ভাবে?’
তন্দ্রা দেবী সারাদিন বই পড়েন। বই তাঁর নিত্যসঙ্গী। বলেন, ‘বঙ্গে শারদীয়া দুর্গাপূজার ইতিহাস খুব বেশী প্রাচীন নয়। বাল্মীকি রামায়ণে রামের দুর্গাপূজার কথা পাওয়া যায় না। বরং রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয়ের জন্য রাম সূর্যের পূজা করেছিলেন এবং সেই পূজায় পুরোহিত ছিলেন অগস্ত্য মুনি। বাল্মীকি রামায়ণের যুদ্ধকাণ্ডে আছে সেকথা। ‘অকালবোধন’-এর কৃতিত্ব প্রাপ্য পঞ্চদশ শতকের কবি কৃত্তিবাস ওঝার। কৃত্তিবাস নিজে তাঁর রামায়ণ রচনা প্রসঙ্গে ‘গৌড়েশ্বরের সভায় কৃত্তিবাস’ কবিতায় লিখেছেন—
রাজপণ্ডিত হব মনে আশা করে।
সপ্তশ্লোক ভেটিলাম রাজা গৌড়েশ্বরে।।
নানামতে নানা শ্লোক পড়িলাম রসাল।
খুসি হৈয়া মহারাজ দিল পুষ্পমাল।।
সন্তুষ্ট হইয়া রাজা দিলেন সন্তোক।
রামায়ণ রচিতে করিলা অনুরোধ।।
মুনি মধ্যে বাখানি বাল্মীকি মহামুনি।
পণ্ডিতের মধ্যে কৃত্তিবাস গুণী।।
বাপ মায়ের আশির্বাদ গুরুর কল্যাণ।
রাজাজ্ঞায় রচে গীত সপ্তকাণ্ড গান।।
সাতকাণ্ড কথা হয় দেবের সৃজিত।
লোক বুঝাইতে কৈল কৃত্তিবাস পণ্ডিত।।
তন্দ্রা দেবী বলে চলেন, “এ বিষয়ে ভাষাবিদ্ সুকুমার সেন তার ‘ভারতীয় আর্য সাহিত্যের ইতিহাস’ বই-এ বিশেষ ভাবে আলোচনা করেছেন। বাংলায় প্রথম শারদীয় দূর্গাপূজা আরম্ভ হয় ১৫ শতকের শেষ ভাগে নদীয়া জেলার তাহেরপুরের জমিদার রাজা কংসনারায়ণ খান মহাশয়ের রাজবাড়িতে ৷ গৌড়েশ্বরের অনুরোধে রামায়ণ রচনা করবার পর নদীয়ার ফুলিয়ার কবি কৃত্তিবাস ওঝা নদীয়ার রাজা কংসনারায়ণের সভাপণ্ডিত হয়েছিলেন। নিজের প্রতিপত্তি জাহির করবার জন্য রাজা কংসনারায়ণ প্রাচীন কালের দিগ্বিজয়ী সম্রাটদের মত ‘অশ্বমেধ’ যজ্ঞ করিবার বাসনা করেন৷ কিন্তু তাঁর কুলপুরোহিত রমেশচন্দ্র শাস্ত্রী মহাশয় বলেন যে এই যুগে ‘অশ্বমেধ’ যজ্ঞ নিষিদ্ধ৷ তবে সভাপন্ডিত কৃত্তিবাস ওঝা মহাশয়ের সহিত শলাপরামর্শ করিয়া পুরোহিত রমেশ শাস্ত্রী মহাশয় রাজাকে বুঝাইলেন যে কলিযুগে অকালবোধন ‘শারদীয় দুর্গাপূজা’ করিলে অশ্বমেধ যজ্ঞের সমতুল্য রাজ-খ্যাতি প্রচারিত হইবে৷ রাজা কংসনারায়ণ তাই করেছিলেন।” কংসনারায়ণ খান তৎকালীন ৮ লক্ষ টাকা ব্যয় করে বিপুল লোক লস্কর লাগিয়ে পূজা শুরু করলেন। কয়েক বছর ধরে এই পূজার অর্থ যোগান দিতে গিয়ে তিনি সর্বস্বান্ত হলেন। তাঁর রাজ্য এবং রাজবংশ নিশ্চিহ্ন হল কিন্তু থেকে গেল কৃত্তিবাসী রামায়ন এবং তার “অকাল বোধন”।
মায়ের জ্ঞানের ব্যাপ্তিতে গর্ব হয়। আবার জানতে চাই, “এর আগে দুর্গা পূজোর প্রচলন বঙ্গে ছিল না?”
“মহাভারতে পাওয়া যায়, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পূর্বে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আদেশে অর্জুন দুর্গার স্তব করেছিলেন। সবচেয়ে প্রাচীন মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তিটি পাওয়া যায় পঞ্চম শতাব্দীতে। জানা যায়, প্রথম শতকে কুষাণ যুগে, পঞ্চম শতকে গুপ্ত যুগে, সপ্তম শতকে পাল যুগে এবং ১১-১২ শতকে সেন যুগে দেবী মহিষমর্দিনীরূপে পূজিত হয়েছেন। কুষান যুগে দুর্গা ছিলেন লাল পাথরের তৈরি। পাল যুগে দেবী ত্রিনয়নী এবং চারহাত বিশিষ্ট। দশভুজা দুর্গার আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৮ শতকে।”
“এই কংসনারায়ণের দুর্গা পূজোর ইতিহাসটা কি?”
এমনিতে বেসরকারী কম্প্যুটার ফার্মে ছুটিছাটা কম। পূজোর কয়েকদিন মেয়েটার অফিস ছুটি। তার উপর পূজো গণ্ডার দিনে জামাই কাছে নেই। অনেকদিন পর মা-মেয়েতে বসে প্রাণ খুলে গল্প হচ্ছে, আজ তাই মেয়ের জানার আগ্রহে তন্দ্রাদেবীও বলে চলেন।
“কংস নারায়ণের আদিপুরুষ মনুসংহিতার বিখ্যাত টিকাকার কুলক ভট্ট। পরবর্তীকালে এই পরিবারেই জন্ম নেন রাজা কংস নারায়ণ। তাঁর আসল নাম ছিল মুকুন্দ, পরে তিনি কংস নারায়ণ নামটি গ্রহণ করেন।
এসময় বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার জমিজমার হিসাবের জন্য সম্রাট আকবর তোডরমলকে নির্দেশ দেন। তোডরমল কংসনারায়ণকে নিয়ে একাজ শুরু করেন, পরে হঠাৎ সম্রাট তোডরমলকে বিশেষ কাজে দিল্লীতে ডেকে পাঠান এবং জমিজমা হিসাবের বাকি কাজ কংসনারায়ণ একাই দক্ষভাবে সামলাতে থাকেন এবং যাবতীয় হিসাব-নকশা ইত্যাদি পাঠিয়ে দেন দিল্লীতে। সম্রাট তাঁর কর্মদক্ষতায় খুশী হন। সবাই ভেবেছিল তাঁকেই সম্রাট পরবর্তী সুবেদার নিযুক্ত করবেন কিন্তু তা না করে সম্রাট দূত মারফত কংসনারায়ণের জন্য “রাজা” খেতাব এবং বাংলার দেওয়ান হওয়ার সংবাদ পাঠান। সমস্ত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সম্রাট তাঁকে সুবেদার পদে নির্বাচিত করলেন না দেখে কংসনারায়ণ অন্তরে ব্যথা পেলেন। তিনি সম্রাটের দেওয়া ‘রাজা’ খেতাব গ্রহণ করে দেওয়ান পদ ত্যাগ করে নিজের জন্মভুমি তাহেরপুরে ফিরে গেলেন এবং পৈতৃক বিশাল জমিদারির উন্নতিসাধনে মন দিলেন। এক সময় তাঁর মনে হল যে, নিজের রাজবংশের পতনের পিছনে তাঁর নিশ্চয় কোনও ভূমিকা আছে। তিনি বাংলার বিখ্যাত পণ্ডিতদের রাজসভায় আমন্ত্রণ জানিয়ে তাঁদের কাছে আপন কোনও পাপকর্মের কারণে বংশের অবনতি হয়ে থাকলে তার প্রায়শ্চিত্তের জন্য বিধান চাইলেন এবং কোনও মহাযজ্ঞ করে পাপ খণ্ডন করতে চাইলেন। বাসুদেবপুরের ভট্টাচার্যরা বংশানুক্রমে তাহেরপুরে জমিদারদের কূল পুরোহিত ছিলেন। এই বংশেরই সন্তান বিখ্যাত তান্ত্রিক রমেশ শাস্ত্রী। তিনি তখন বাংলা, বিহার এবং উড়িষ্যার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ পণ্ডিত ছিলেন। তিনি ঐ সভায় উপস্থিত ছিলেন। তিনি বললেন, ‘শাস্ত্রে বিশ্বজিৎ, রাজসূয়, অশ্বমেধ ও গোমেধ এই চার মহাযজ্ঞের বিধি আছে, কিন্তু বিশ্বজিৎ এবং রাজসূয় যজ্ঞ শুধু সার্বভৌম সম্রাট করতে পারেন। আপনি ভূ-স্বামী তাই এর অধিকারী নন। এ ছাড়া অশ্বমেধ এবং গোমেধ এ দুটি যজ্ঞ কলিতে নিষিদ্ধ এবং ক্ষত্রিয়ের কর্ম। তাই তা সম্ভব নয়।’ কংসনারায়ণ বিধান শুনে বিমর্ষ হয়ে পড়লে রমেশ শাস্ত্রী বললেন, “কলির মহাযজ্ঞ হচ্ছে দুর্গোৎসব। সকল জাতির মানুষ এটি করতে পারে, এতে সকল যজ্ঞের ফল পাওয়া যায়, সত্য যুগে রাজা সুরথ প্রথম এই যজ্ঞ করেছিলেন।” শাস্ত্রীমশায় তাঁর বক্তব্যের স্বপক্ষে শাস্ত্রপ্রমাণ দিয়ে কৃত্তিবাসী রামায়ণ থেকে রাবণ বধার্থে রামের অকালবোধনের মাধ্যমে শরৎকালে দুর্গাপূজার বর্ণনা দেন।
এতে উৎসাহিত হয়ে কংসনারায়ণ রাজসিকভাবে (কিংবদন্তী প্রচলিত) প্রায় ৮ লক্ষ টাকা ব্যয় করে বাংলা ৮৮৭ সালের আশ্বিন মাসে মহা ষষ্ঠী তিথিতে অকালবোধনের মাধ্যমে দেবী দুর্গার প্রতিমা গড়ে প্রথম দুর্গাপূজা করেন। কংসনারায়নের প্রথম দুর্গা পূজাটি হয়েছিল রাজবাড়ি সংলগ্ন প্রধান ফটকের পাশেই একটি বেদীতে। দেবী দুর্গার সমস্ত গহনা করা হয়েছিল স্বর্ণ ও মনি-মুক্তা দিয়ে। এর পাশেই তিনি নির্মাণ করেন প্রথম দুর্গা মন্দির। রাজপ্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ওই মন্দিরে দুর্গাপুজা হত। দেশ বিদেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষ আসতেন পূজায় অংশ নিতে। রাজপ্রথা বিলুপ্ত হলে রাজার বংশধররা ভারতে চলে যান। ১৯৬৭ সালে রাজা কংস নারায়নের রাজবাড়িসহ সব জমি লিজ নিয়ে সেখানে গড়ে তোলা হয় তাহেরপুর ডিগ্রি কলেজ। এরপর থেকে মন্দিরটি বন্ধ হয়ে যায়। পরে ২০১৩ সালে হিন্দু সম্প্রদায়ের দাবিতে কলেজ কর্তৃপক্ষ মন্দিরটি খুলে দেন।
রাজবাড়ির গোবিন্দ মন্দিরে কেবল একটি বৃহৎ শিলা লিপি রয়েছে যাতে পৃথিবীর দুর্গাপূজার প্রতিষ্ঠা, স্থান, সন, তারিখ ও অতীত কিছু ইতিহাস রয়েছে। এই শিলা লিপি ছাড়া আর তেমন কিছু নিদর্শন নেই। তাহেরপুরের দুর্গাপূরীতে দেবী দুর্গার মূল বেদী পর্যন্ত এখন নেই। বর্তমানে দুর্গাপূরীর বেদীমূলে কলেজ এবং তার পাশে তিনশ বছরের সেই নাম না জানা প্রাচীন গাছটি ‘অচিন বৃক্ষ’ হয়ে কালের স্মৃতি বহন করছে।”
ছোটবেলার মতো আবদারের সুরে বলি, “অকালবোধনের গল্পটা বলো না মা!”
তন্দ্রাদেবী যেন সেই ছোটবেলার সোনাইকে দেখছেন। ভালো লাগে তাঁর মহাষষ্ঠীর পুণ্যলগ্নে রামকথা বলতে। তিনি বলে চলেন, “কৃত্তিবাস লিখেছেন, রাবণ বধ এবং জানকীকে উদ্ধার করার জন্য শ্রীরামচন্দ্র শরৎকালে দেবীপূজা করেছিলেন। মূলত দেবীর পূজা বসন্তকালে হয়ে থাকে। শ্রীরামচন্দ্র দেবী ভগবতীকে অকালে বোধন করেছিলেন। সীতা উদ্ধারের জন্য লঙ্কাধিপতি দশানন রাবণের সঙ্গে রামচন্দ্রের ঘোর যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে একে একে মারা পড়েছেন লঙ্কার সব বড়ো বড়ো বীর। রাবণ তখন একা কুম্ভের মতো রক্ষা করছেন লঙ্কাপুরী। তিনিও শ্রান্ত, বিধ্বস্ত। এমনকি একবার তো হনুমানের হাতে প্রচুর মার খেয়ে অজ্ঞানই হয়ে গেলেন। বেগতিক বুঝে রাবণ অম্বিকার স্তব করলেন:
আর কেহ নাহি মোর ভরসা সংসারে।
শঙ্কর ত্যজিল তেঁই ডাকি মা তোমারে।।
রাবণের কাতর স্তবে হৈমবতীর হৃদয় টলল। তিনি কালী রূপে রাবণকে কোলে তুলে নিয়ে তাঁকে দিলেন অভয়। এই খবর রামের কানে যেতেই তিনি প্রমাদ গণলেন। তাই যতবার রাম ভগবতী অম্বিকার আশিসধন্য রাবণের শিরোচ্ছেদ করেন, ততবার তা জোড়া লেগে যায়। জানকী উদ্ধার অসম্ভব জেনে রাম বিমর্ষ হয়ে পড়লেন। দেবতারা বিষম বিপদে পড়ে দেবরাজ ইন্দ্রের দ্বারস্থ হলেন। ইন্দ্র দেবতাদের আর্জি নিয়ে গেলেন ব্রহ্মার কাছে। তখন দেবতাদের সঙ্গে যুক্তি করে পদ্মযোনি ব্রহ্মা স্বয়ং উপস্থিত হয়ে মহামায়ার প্রসন্নতা লাভের জন্য রামকে নিদ্রিতা দেবীকে অকালে জাগ্রতা করে পূজা করতে অনুরোধ করলেন, এবং স্বয়ং সেই পূজায় পৌরোহিত্য করবেন বললেন। রাম বললেন, “দুর্গাপূজার প্রশস্ত সময় বসন্তকাল। শরৎকাল তো অকাল। অকালবোধনে নিদ্রা ভাঙাতে হলে কৃষ্ণানবমীতে বিধান রয়েছে শাস্ত্রে। মার্কণ্ডেয় পুরাণমতে সুরথ রাজা প্রতিপদে পূজা আরম্ভ করেছিলেন। কিন্তু এখন পূজা সম্ভব কিভাবে?” ব্রহ্মা শুক্লাষষ্ঠীতে কল্পারম্ভ করে বোধন করার বিধান দিলেন এবং বিধান শুনে রাম মহাখুশি হলেন।
চণ্ডীপাঠ করি রাম করিল উৎসব।
গীত নাট করে জয় দেয় কপি সব।।
শ্রীশ্রীচণ্ডী-তে পাই, সুরথ রাজা দেবী দুর্গার মাটির মূর্তি গড়ে পূজা করেছিলেন—‘তৌ তস্মিন্ পুলিনে দেব্যাঃ কৃত্বা মূর্ত্তিং মহীময়ীম্।’ (চণ্ডী, ১৩।১০)। রামচন্দ্রও পূজা করেছিলেন নিজের হাতে তৈরি মাটির প্রতিমায়—‘আপনি গড়িলা রাম প্রতিমা মৃন্ময়ী’। ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় বেল গাছের তলায় হল দেবীর বোধন। অধিবাসের সময় রাম স্বহস্তে বাঁধলেন নবপত্রিকা।
সায়াহ্নকালেতে রাম করিল বোধন।
আমন্ত্রণ অভয়ার বিল্বাধিবাসন।। …
আচারেতে আরতি করিলা অধিবাস।
বান্ধিলা পত্রিকা নব বৃক্ষের বিলাস।।
সপ্তমী ও অষ্টমী দুই দিন সকালে স্নান করে রাম ‘বেদবিধিমতে’ পূজা করলেন। অষ্টমী-নবমীর সন্ধিক্ষণে রাম সন্ধিপূজা করলেন। দুই দিনই রাতে চণ্ডীপাঠ ও নৃত্যগীত হল।
রামচন্দ্রের নবমী পূজার বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন কৃত্তিবাস। বহুরকম বনফুল ও বনফলে পূজার আয়োজন হল। ‘তন্ত্রমন্ত্রমতে’ পূজা হল। কিন্তু ভগবতীর দর্শন ও আশীর্বাদ পেলেন না। সীতা উদ্ধারের আশা নেই দেখে তিনি একেবারে ভেঙে পড়লেন। তখন বিভীষণ পরামর্শ দিলেন, সেখান থেকে দশ বছরের পথ—দেবীদহে আছে বিরল নীলোৎপল, একশত আটটি নীল পদ্ম দিয়ে অঞ্জলী দিলে দেবী তুষ্ট হবেন। কে যাবে অতদূরের পথ? ভক্তশিরোমণি হনুমান বললেন, ‘প্রভু, আমি এক দণ্ডে শত নীল শতদল এনে দেব।’ যে কথা সেই কাজ। হনুমান পদ্ম এনে দিলেন, রাম সঙ্কল্প করে পূজায় বসলেন। কিন্তু দেবী রামের ভক্তি পরীক্ষা করার জন্য একটি পদ্ম লুকিয়ে রাখলেন। একশ-আট নীলোৎপল দানের সঙ্কল্প ব্যর্থ হতে দেখে রাম চোখের জলে ভেসে স্থির করলেন, জগতের সব লোকে যখন তাঁকে কমলনয়ন বলে, তখন নিজের একটি চোখ উৎপাটিত করে দেবীকে অর্ঘ্য দেবেন।
চক্ষু উৎপাটিতে রাম বসিলা সাক্ষাতে।
হেনকালে কাত্যায়নী ধরিলেন হাতে।।
কর কি কর কি প্রভু জগত গোঁসাই।
পূর্ণ তোমার সঙ্কল্প চক্ষু নাহি চাই।।
তখন মহামায়া প্রকট হয়ে রামকে রাবণ বধের বর দিলেন। কৃত্তিবাসের অনবদ্য ছন্দে তার প্রকাশ—“অকালবোধনে পূজা, কইলে তুমি দশভূজা, বিধিমতে করিলা বিন্যাস/লোকে জানাবার জন্য, আমারে করিতে ধন্য, অবনীতে করিলা প্রকাশ/রাবণে ছাড়িনু আমি, বিনাশ করহ তুমি, এত বলি হইল অন্তর্ধান/নাচে গায় কপিগণ, প্রেমানন্দে নারায়ণ, নবমী করিল সমাধান/দশমীতে পূজা করি, বিসর্জিয়া মহেশ্বরী, সংগ্রামে চলিলা রঘুপতি/আদেশ পাইয়া রাম, সিদ্ধ হইল মনস্কাম, চণ্ডীলীলা মধুর ভারতী।।”(কৃত্তিবাসী রামায়ণ; লঙ্কাকাণ্ড)।
আর সেই থেকে শরতে দেবীপূজা অকালবোধন নামে পরিচিত। যদিও কৃত্তিবাসী রামায়ণের দুর্গোৎসব বিবরণের সঙ্গে পৌরাণিক দুর্গোৎসব বর্ণনা ঠিক হুবহু মেলে না। যেসব পুরাণমতে আজ বাংলায় দুর্গাপূজা হয়, তার একটি হল কালিকাপুরাণ। এই পুরাণে রামচন্দ্রের দুর্গাপূজার বর্ণনা পাওয়া যায়।
সোহিনী আবার পত্রিকার পাতায় চোখ রাখে। লেখা রয়েছে, “বৃহদ্ধর্মপুরাণ-এ রামের জন্য ব্রহ্মার দুর্গাপূজার বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়—কুম্ভকর্ণের নিদ্রাভঙ্গের পর রামচন্দ্রের অমঙ্গল আশঙ্কায় দেবতারা ভীত হলেন। মহামায়া দুর্গার পূজা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই দেখে রামচন্দ্রের মঙ্গলের জন্য স্বয়ং ব্রহ্মা পৌরোহিত্য করতে রাজি হলেন। শরৎকাল দক্ষিণায়ণ, দেবতাদের নিদ্রার সময়। তাই ব্রহ্মা স্তব করে দেবীকে জাগালেন। দেবী তখন কুমারীর বেশে এসে ব্রহ্মাকে বললেন, বিল্ববৃক্ষমূলে দুর্গার বোধন করতে। দেবতারা মর্ত্যে এসে দেখলেন, এক দুর্গম স্থানে একটি বেলগাছের শাখায় সবুজ পাতার রাশির মধ্যে ঘুমিয়ে রয়েছে একটি পরমাসুন্দরী বালিকা। ব্রহ্মা বুঝলেন, এই বালিকাই জগজ্জননী দুর্গা। তিনি বোধন-স্তবে তাঁকে জাগ্রতা করলেন। ব্রহ্মার স্তবে জাগ্রতা দেবী বালিকামূর্তি ত্যাগ করে চণ্ডিকামূর্তি ধারণ করলেন। ব্রহ্মা বললেন, “রাবণবধে রামচন্দ্রকে অনুগ্রহ করার জন্য তোমাকে অকালে জাগ্রতা করেছি। যতদিন না রাবণ বধ হয়, ততদিন তোমার পূজা করব। যেমন করে আমরা আজ তোমার বোধন করে পূজা করলাম, তেমন করেই মর্ত্যবাসী যুগ যুগ ধরে তোমার পূজা করবে। যতকাল সৃষ্টি থাকবে, তুমিও পূজা পাবে এইভাবেই।” একথা শুনে চণ্ডিকা বললেন, “সপ্তমী তিথিতে আমি প্রবেশ করব রামের ধনুর্বাণে। অষ্টমীতে রাম-রাবণে মহাযুদ্ধ হবে। অষ্টমী-নবমীর সন্ধিক্ষণে রাবণের দশমুণ্ড বিচ্ছিন্ন হবে। সেই দশমুণ্ড আবার জোড়া লাগবে। কিন্তু নবমীতে রাবণ নিহত হবেন। দশমীতে রামচন্দ্র করবেন বিজয়োৎসব।” তাই হল। মহাবিপদ কেটে গেল অষ্টমীতে; তাই অষ্টমী হল মহাষ্টমী। রাবণ বধ করে মহাসম্পদ সীতাকে লাভ করলেন রাম; তাই নবমী হল মহানবমী। যদিও কৃত্তিবাসী রামায়ণের সূত্র ধরে লোকে মনে করে, শরৎকালের দুর্গাপূজার সূচনা করেছিলেন রাম। কিন্তু এই সম্মান বৃদ্ধ পিতামহ ব্রহ্মারই প্রাপ্য। বাংলার লক্ষ লক্ষ দুর্গাপূজায় আজও বোধনের সঙ্কল্প পাঠ হয়:
ওঁ ঐং রাবণস্য বধার্থায় রামস্যানুগ্রহায় চ।
অকালে ব্রহ্মণা বোধো দেব্যস্তয়ি কৃতঃ পুরা।।
অহমপাশ্বিনে ষষ্ঠ্যাং সায়াহ্নে বোধয়মি বৈ।
হে দেবী, রাবণবধে রামকে অনুগ্রহ করার জন্য ব্রহ্মা তোমার অকালবোধন করেছিলেন, আমিও সেইভাবে আশ্বিন মাসের ষষ্ঠী তিথিতে সন্ধ্যায় তোমার বোধন করছি।
এই পর্যন্ত পড়ে আমি থামলাম, মনে মনে ষষ্ঠীর সেই পুরনো স্পিরিটটা স্মৃতিতে জাগিয়ে তুলতে চেষ্টা করি। সেইসময় পূজোর আগে বাতাসে একটা গন্ধ ভাসত...কি যেন সেই গন্ধটা? সেটা মনের মধ্যে খুঁজতে খুঁজতে আবার পড়তে থাকি।
পূজোর গন্ধ...
“খুব বেশী দিনের কথা নয়। যখন পূজো আসার আগে বাতাসে হালকা হিমভাব টের পাওয়া যেত। রবীন্দ্রনাথের ‘এসেছে শরৎ হিমের পরশ লেগেছে হাওয়ার পরে, সকাল বেলায় ঘাসের আগায় শিশিরের রেখা ধরে’ কথাগুলো অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়নি। সেই সময় বিশ্বকর্মা পূজো এসে গেল মানেই ‘তোদের পূজোর ছুটি কবে থেকে রে?’ বন্ধুদের পরস্পরের দেখা হলেই ছিল এই প্রশ্ন। মহালয়ার পরে কোন কোন স্কুল খোলা থাকত, তবে বেশীর ভাগ স্কুল, অবশ্যই বাংলা মিডিয়াম, অ্যানুয়াল পরীক্ষার রুটিন দিয়ে মহালয়া থেকেই পূজোর ছুটির ঘোষণা করে দিত। তখম পূজোর ছুটির পরেই থাকত অ্যানুয়াল পরীক্ষার খাঁড়া! তাই পূজোর ছুটির মধ্যেও সকালে রোজ বই নিয়ে বসতে হতো—যদিও সপ্তমী থেকে দশমী পর্যন্ত সমস্ত অভিভাবকই ছেলেমেয়েদের শাসন শিথিল করতেন, বই নিয়ে বসায় ঐ দিনগুলোয় থাকত ছাড়।”
মনে মনে ভাবি, পূজোর ঢাকের বাদ্যি আমাদের সময়ের ছেলেমেয়েদের মনে যে আনন্দের তুফান তুলত, তার সঙ্গে এখনকার কোন তুলনাই চলে না। এখন সারা বছর ধরে দশ নম্বরের টেস্ট, রেজাল্টের বদলে গ্রেড কার্ড, ফেল বস্তু উধাও—সব কিছু অন্যরকম। যেন এক ভিন্ন যুগ! আমাদের ছেলেবেলায় ঘরে ঘরে প্রায় প্রত্যেক উঠানেই শিউলি গাছ থাকত। শিউলির গন্ধে শরতের সান্ধ্য বাতাস ভারী হয়ে থাকত। এখন শিউলি গাছ শোভিত উঠানওয়ালা বাড়ি ইতিহাস। বহুতল বাড়ির নিচে শপিং মল, গ্যারেজ। বাতাসে শুধুই এগরোল, চাউমিন, বিরিয়ানির গন্ধ।
পূজোর গান, পূজোসংখ্যা, পূজোর খানাপিনা...
মা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে, ‘কি রে কি ভাবছিস সোনাই?’ বলি, ‘কিচ্ছু না!’
মনে পড়ছে, পুজোর আগে প্রত্যেক বছর রিলিজ হতো নতুন গান। মনের ভিতর গুনগুনিয়ে ওঠে আশা ভোঁসলের গাওয়া ‘কিনে দে রেশমি চুড়ি, নইলে যাবো বাপের বাড়ি, দিবি বলে তাল পাটালি (‘কাল কাটালি’-র অপভ্রংশ) জানি তোর জারিজুরি।’ মা হঠাৎ গেয়ে ওঠে, ‘টাপুর টুপুর বৃষ্টি ঝরে, কোন সে আকাশ থেকে, ও আমার কমলিনী, শিহরিয়া যায়...’ এত বছর পরেও মা-র গলা কি মিষ্টি! মিমিদের সেভাবে পূজোর গান নেই, কিম্বা আছে হয়তো, ওরা দেখি নিজেদের মধ্যে সোয়্যাগ সোয়্যাগ বলে, কি জানি এখনকার গান গুলো মনের মধ্যে দাগ কাটে না, আমি বোধহয় বুড়ি হয়ে যাচ্ছি, হয়তো এটাই জেনারেশন গ্যাপ! পূজোসংখ্যা ছিল আমাদের পূজোর অন্যতম শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ! ‘শুকতারা’, ‘আনন্দমেলা’ আমাদের, আর ‘দেশ’ মায়ের জন্য। পড়া তো নয়, গেলা। উপুড় হয়ে শুয়ে বই পড়তে পড়তে সন্ধ্যা হয়ে যেত, আর চোখ খারাপ হয়ে যাবে, মায়ের বকুনিতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বই রেখে উঠে পড়তে বসা...সেসব মিমিরা জানে না। এখন চশমা চোখে সেই উপুড় হয়ে শুয়ে বই পড়ার আনন্দ গত জীবনের স্মৃতি হয়ে গেছে।
পাতা ওলটাতে একটা ক্যাপশন চোখে পড়ে— ‘এবার আসি পূজোর খাওয়া দাওয়ায়।’ পত্রিকার অনেকগুলো পাতা জুড়ে রয়েছে কলকাতার হরেক রেস্টুরেন্টে পূজো স্পেশাল নানা খাবারের হদিশ। মায়ের দিকে তাকাই। মুখে মৃদু মধুর হাসি। পাঠ বন্ধ রেখে মা-কে উসকে দিয়ে বলি, ‘মা, সবাই মিলে সেই নাড়ু বানানো মনে পড়ে তোমার?’ বেরিয়ে আসে আরও কিছু স্মৃতির মণিমুক্তো। ‘তোর বাবা বিশ-পঁচিশটা নারকেল আনতো। সব বাড়ি বাড়ি বিজয়া করতে নিয়ে যাওয়া হবে, আর কিছু আগ তুলে রাখা হতো লক্ষ্মীপূজোর জন্য।’
মায়ের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে আমি বললাম, ‘আমরাও হাত লাগাতাম নাড়ু পাকাতে!’
পবন দাদা, ছোটপিসি, মা মিলে নারকেল কোড়াতো। মা নাড়ুর পাক দিত, দুই রকমের নাড়ু হতো। অর্ধেক লাল নাড়ু, গুড়ের, আর অর্ধেক সাদা নাড়ু, সেগুলো চিনির। বিজয়া দশমীর পরদিন, একাদশী লাগলেই ছোটরা দল বেঁধে সব বাড়িতে বড়দের প্রণাম করতে যাওয়ার চল ছিল, উদ্দেশ্য নাড়ু ও নিমকি খাওয়া। কোন বাড়ির নাড়ু কেমন হয়েছে, সেই নিয়ে আলোচনা চলত। কে কটা নাড়ু খেয়েছে তারও প্রতিযোগিতা ছিল।
“পূজোর দিনগুলোতে তোমার কি খাটুনিই না হতো! এক এক দিন, এক এক রকম রান্নার মেনু। সারাদিন রান্নাঘরেই কেটে যেত, তাই না মা?”
‘তাই তো রে! ষষ্ঠীর দিন নিরামিষের নানা পদ, সপ্তমীতে মাছ, অষ্টমীতে সকালে অঞ্জলী দিয়ে খিচুড়ি খাওয়া আর রাত্রে এলাহি খাওয়া দাওয়া। সব আয়োজন তো ঘরেই হতো। তোদের এখনকার মতো বাইরে থেকে খাবার আনানোর তো কোন চল ছিল না! নবমীতে খাসির মাংস, লাল শাক ভাজা, দশমীর দিন বছরের শেষ ইলিশ খাওয়া, ভাপা, ভাজা, ইলিশের মাথা দিয়ে কচুর শাক কত কি!’
“বাবা কিন্তু তোমাকে অষ্টমীর দিন রাত্রে সারারাত ধরে ঠাকুর দেখাতো!”
“হ্যাঁ রে, সারাদিন রান্নাবান্নার পর সারারাত ধরে ঠাকুর দেখা...খুব কষ্ট হতো জানিস! এখন বরং ঘরে বসে টিভিতে এই পূজো পরিক্রমা দেখতে বেশ লাগে!”
বাইরে কলকণ্ঠ শুনে মা-মেয়ের পাঠে বিরতি। ঘরে ঢোকে সোহিনীর মেয়ে মিমি, ‘মা, বুবলাদের সঙ্গে ঠাকুর দেখতে যাবো? রিনি আর সঞ্জুও যাচ্ছে।’ নতুন জিনস আর টপে মিমিকে দারুণ লাগছে। ওকে খুঁটিয়ে দেখে বলি, ‘স্কার্ফটা নিয়ে যাও, ফেরার সময় মাথায় জড়িয়ে নেবে, এখন অল্প হিম পড়ে। শরীর খারাপ হলে আবার ‘আকাশ’ ক্লাস মিস হবে, উল্টোপাল্টা খেও না, আর শোন, বেশী রাত করবে না।’ সঞ্জু এগিয়ে এসে বলে, ‘ডোন্ট ওয়রি আন্টি, আমি ঘরে ছেড়ে দিয়ে যাবো।’ মনে মনে ভাবি, ‘ছেড়ে দিয়ে যাবো, মানেটা কি? আরশোলা না ছারপোকা যে ছেড়ে দেবে? কেন, পৌঁছে দেব বলা যায় না?’ যাক, এসব ভেবে লাভ নেই। এমনিতে মিমি নিজেই খুব সচেতন। এবার এগারো ক্লাস। মেডিকেল এন্ট্রান্সের জন্য ‘আকাশ’-এর টিউটোরিয়াল ক্লাস নিচ্ছে নাইন থেকে। ওরা সব একসঙ্গে পড়ে। সঞ্জুটার সঙ্গে ভাব বেশী। বেরোনোর আগে বন্ধুদের সঙ্গে মা ও দিম্মাকে নিয়ে সেলফি তোলে মোবাইলে আর ফেসবুকে পোস্টও করে দেয়। এরকম স্ট্যাটাস আপডেট এখন সারা রাস্তা ধরে চলতেই থাকবে। ওরা চলে যায়, ঘরে ছড়িয়ে রেখে যায় অনেকরকম পারফিউম আর বডি স্প্রে-র মিশ্র গন্ধ। একটা নিশ্বাস পড়ে সোহিনীর নিজের অজান্তেই।
মায়ের চোখ আর্দ্র। আরেকবার চশমা খুলে হাতে নিয়ে আঁচলে মোছে, চোখের দৃষ্টিতে শূন্যতা। সোহিনী পাঠ স্থগিত রেখে নিশ্চুপ, বহুযুগের ওপার হতে আষাঢ় আসার প্রতীক্ষা...মৌন ক্ষণ, ফ্যানের শব্দ আর ঘড়ির টিকটিক...মা বলে ওঠে, ‘জানিস, কত বছর আগের কথা, আজও ভুলতে পারি না!’
‘কোন কথাটা, মা?’
‘তোর বাবার দেওয়া অঞ্জলী!’
আমার আবছা মনে পড়ে। তখন নক্সাল আন্দোলন তুঙ্গে। বাবা তখন লেকটাউন থানায় পোস্টেড। রাত্রে বাবা না ফেরা পর্যন্ত মা ঘর-বার করত। মা-র কাছেই গল্প শুনেছি, বাবাকে দেবতার মতো মানতো সকলে। যত রাতই হোক, ডিউটি সেরে বাড়ি ফিরে স্নান সেরে ধবধবে সাদা পৈতে আঙুলে জড়িয়ে গায়ত্রী জপ না করে খাবেন না। একবার নাকি একটি ছেলে খাকি পোশাক দেখে কোনও বাড়ির ছাদের উপর থেকে বোমা ছুঁড়তে গেলে, তার সঙ্গী হাত চেপে ধরে বলেছিল, “কি করিস? চক্রবর্তী স্যার অন্য মানুষ। ওনাকে মারলে নরকেও ঠাঁই হবে না!” পরে দলের অন্য ছেলেরাই একথা বাবাকে জানিয়েছিল। সেদিন অনেক রাত হয়েছে। সেদিন ছিল চতুর্থী। আর দুটো দিন পরেই মায়ের বোধন। বাবার ডিউটির চাপ থাকত, তাই আমাদের পূজোর জামাকাপড় কেনাকাটায় দেরী হতো। মহালয়ার পরে কোনও একদিন মা-বাবা রিক্সায় করে আমাদের দুই বোনকে কোলে বসিয়ে পূজোর বাজার করতে বেরোত। অনেক রাত হয়েছে। বাবা এখনও ফেরেনি। মা-র মুখে উৎকণ্ঠার ছাপ আমাদেরও চোখে পড়ছে। প্রায় বারোটার কাছাকাছি। ঘুম এসে গেছে। বাবার কড়া নাড়ার বিশেষ ছন্দে তড়াক করে উঠে বসেছি। ঘুম ঘুম চোখে দেখছি, কলাপাতায় করে একরাশ শিউলি ফুল এনেছে বাবা, দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে সবটা ঢেলে দিচ্ছে মায়ের মাথায়, আর আমার মায়ের মুখে অপার্থিব হাসি, গর্ব, লজ্জা মিলেমিশে একাকার—সেদিন বুঝেছিলাম, অশোকগড়ের ঠাকুর নয়, সবেদাবাগানের ঠাকুর নয়, বি-হাইভ কলোনির ঠাকুরও নয়, সত্যিকারের মা দুর্গাকে ঠিক এই রকমই দেখতে!’
মা-র চোখ ছলছল করে ওঠে, ‘জানিস, পূজো আসলেই শিউলি ফুলের গন্ধ পাই আজও!”
ঘরে বিদেশী পারফিউমের গন্ধ, মায়ের স্মৃতির শিউলি ঘ্রাণের সঙ্গে আরও একটা গন্ধ জেগে ওঠে মনে, যেন এক অচেনা ‘দারুচিনি দ্বীপ’-এর গন্ধ!...
ক্লাস নাইন। আজ অষ্টমী। শাড়ি পরে অঞ্জলী দেব আমরা সবাই। মিলি, টুসি, ছন্দা সবাই ডাকছে, ‘সোনাই তোর হল?’ আমি সর্বত্র পিন গেঁথে সোনালী জড়িপাড় সুন্দর একটা জাম রঙা তাঁতের শাড়ি পড়ে বের হতেই সবাই হৈ হৈ করে উঠল, ‘কি দারুণ লাগছে রে তোকে! আজ পাগন পাগোল হয়ে যাবে!’ ওদের মারতে ছুটে যাই, হিহি করে হাসতে হাসতে মেয়ের দল কলকল করতে করতে হাজির হই পূজো প্যান্ডেলে। হ্যাঁ, ঠিক যা ভয় করেছি তাই...পাগন দাঁড়িয়ে আছে আর ভীড়ের মধ্যে ঠিক আমাকেই দেখছে। নতুন তাঁতের শাড়ির গরমে ঘেমে উঠছি। মাইকে অঞ্জলীর মন্ত্র বলছেন যোগেন কাকা—‘বলো সবাই, জয়ন্তীই মঙ্গলাআ কালীই ভদ্রকালীই কপালিনীইইই...’ যেই না ‘এষ সচন্দন বিল্বপত্র পুষ্পাঞ্জলী ...দুর্গায়ৈ বৌষট্’ সঙ্গে সঙ্গে একমুঠো ফুল এসে পড়ছে মাথায়, পিঠে। পাগনটা সত্যিই পাগোল। মা দুর্গাকে অঞ্জলী দেবে, তা না আমার গায়ে ফুল ছুঁড়ে যাচ্ছে! লজ্জায় কান মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। ভাগ্যিস, ভীড়ের মধ্যে কেউ বুঝতে পারছে না! অঞ্জলী দেওয়া শেষ হতে যখন ভীড় একটু ফাঁকা হল, মিলি বলল, ‘আজ মা দুর্গার সঙ্গে সঙ্গে আরেকজনকেও অঞ্জলী দিয়েছে একজন!’ অমনি সবাই রে রে করে উঠল, হ্যাঁ, আমরাও দেখেছি।’ ছিঃ কি লজ্জা কি লজ্জা!
আজ এত বছর পরেও সব গন্ধ ছাপিয়ে কিশোরী বেলার সেই পাড়ার পূজো প্যান্ডেলের ধুনোর গন্ধ আমাকে আচ্ছন্ন করে তোলে!
sumanasaha948@gmail.com
সুচিন্তিত মতামত দিন