ভেজানো দরজাটিকে অপরাহ্নের শেষ আলোয় জমা রেখে এগিয়ে যায় সমীর। এ ঘর তার চিরদিনের। পাড়ার মানুষ জনের সঙ্গে কথা বলে আসার জন্যই সে বেড়িয়েছিল। ক্লাবের ছেলেরা অপেক্ষা করছিল তার নির্দেশে। ভিতরে এসে দেখে অলোক তখনও বসে রয়েছে ঠিক আগের ভঙ্গিতেই।
জীবন মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা দুটি মানুষের শেষ অন্তরঙ্গতার মূহুর্তটিকে ক্যাামেরাবন্দী করলো সমীর। অলোকের বাল্যাবন্ধু, এবং হিতাকাঙ্খী। সদ্য মাতৃহারা অলোককে একটু সময় দিয়েছিল সে। অন্তিম ক্রিয়াকর্মের ব্যাবস্থানার ছুতোয় বাইরে গেছিলো। অপেক্ষারত ভিড়ের সঙ্গে আলোচনা করে এলো। মৃতা কাকীমার শেষ সময়ের সঙ্গীরা চেনে তাকে। কাকীমাও ছিলেন সমীর অন্ত প্রাণ। কিন্তু এই মূহুর্তটা শুধুই থাক কাকীমার একমাত্র সন্তান অলোকের। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল না সে কোন ডক্টরেট করা,পদ্মশ্রী পুরস্কার প্রাপ্ত একটি নামকরা কলেজের প্রিন্সিপাল। এইক্ষণটুকু যেন এক মাতৃহারা পুত্র সন্তানের। অকৃত্রিম অন্তরঙ্গ এই আন্তরিক ক্ষণ থাকলো সেলুলয়েডের ফ্রেমে ।
সন্তুষ্টির অমৃতকে পান করে বড় হয়েছিল অলোক। বাবা মার একমাত্র সন্তান হওয়ায় জীবনের সব চাওয়াকে পাওয়ার সুন্দরতায় ভরে যেতে দেখেছিল সে। দরিদ্রের মা মরা সন্তান সমীরকে খুব ভালোবাসতো অলোক। বাড়িতে ডেকে আনতো মাঝে মধ্যে। সেই শুরু-তাই তারই সাথে সাথেই মিলে যেত অলোকের ব্যবহৃত পু্রনো ও ছোট হয়ে যাওয়া জামা কাপড়, কাগজ পেন , খাবার দাবার। সমীরের একশোটা চাওয়ার একটি পূরণ করতেন ভগবান কিন্তু অলোক পূর্ণ করতো অনেকখানি।
সমীর মায়ের ভালোবাসা কি বোঝার আগেই তিনি বিদায় নিয়েছিলেন পৃথিবী থেকে। সৎমা নিজের সন্তান নিয়ে ব্যাস্ত। সমীরের খবর নেওয়ার কেউ ছিল না। বাবাও না। সদ্য মৃতা মিতা কাকীমা সেই সময় আপন করে কাছে টেনে নিয়েছিলেন। মুখ দেখেই বুঝতে পেরে যেতেন তার খিদে পেয়েছে। অলোকের সঙ্গে এক টেবিলে খাবার খেতে খেতে একসময় পোশাক, বইপত্র, সবই পেয়ে যেতে থাকলো।এবাড়ির প্রদীপকাকু ও মিতা কাকীমা বাবার সঙ্গে কথা বলে সমীরকে নিজের কাছে রেখে দেন।
আজ সমীরও এই শহরের এক উচ্চ বিদ্যালয়ের টিচার। তার নিজস্ব পরিবার স্ত্রী পুত্র থাকলেও আজও এই পরিবার তার কাছে খুব কাছের জায়গা।এখন বড় ইচ্ছা করছে কাকীমার মাথায় সেও একটু হাত বুলিয়ে দেয়। কাকীমাকে জড়িয়ে ধরে মন উজাড় করে কেঁদে ওঠে। কিন্তু পারছে না। তার চোখের জলের ফোঁটায় ফোঁটায় পা ভিজতে থাকে কাকীমার। অশ্রুর অঞ্জলি দিতে থাকা সমীরের নিঃশব্দ বেদনার আর্তি ছড়িয়ে পড়ে উপস্থিত অপেক্ষারত জনতার মধ্যেও।
অথচ এই বাড়ি একদিন কতো ঝলমলে,প্রাণচঞ্চল ছিল। এ বাড়ি ছিল এই শহরের প্রাণ। কাকীমা ও কাকুর সৃষ্টি কর্মযজ্ঞ চলতো এ বাড়িতে সারাক্ষণ। শুরু হয়েছিল একটু একটু করে। অলোক ছিল বুদ্ধি মান ,স্কলার। কৃতী সন্তান। বাবা মার গর্ব। কাজের জন্য এখান ওখান ছুটতে হয়। কলকাতা থেকে মাঝে মধ্যে আসতো। ধীরে ধীরে একসময়ে নিঃসঙ্গ আর অসহায় হয়ে পড়ছিলেন কাকু ও কাকীমা। বাজার হাট করে দেওয়া,ডাক্তার এর কাছে নিয়ে যাওয়া, ব্লাড টেস্ট করানো এ সব কিছুতেই সমীর ছিল সম্বল। বিশ্বাসের এতটা উত্তরণে শেষে পৌঁছে গেল সে যে এ টি এম কার্ড, ব্যাঙ্ক একাউন্ট সব সামলাতে লাগলো সে।
পথশিশুদের নিয়ে প্রথম হেলথকেয়ারের ব্যঁবস্থা করলেন কাকু আর কাকীমা মিলে। এক রবিবার সকালে হলো কাজের শুরু।ভালো সাড়া পাওয়া গেলে শুরু করলেন পড়াশোনা। নিচের ঘরের একতলাটা নিয়ে আরম্ভ হলো তাদের এই অভিযান। সম্পূর্ণ বিনা খরচে চললো তাদের এই নিরলস সাধনা। শিক্ষিত প্রচুর ছাত্র ছাত্রীরা আজ এই শহরের গর্ব। কেউ স্কুল মাস্টার, কেউ কেরানী, কেউ হাবিলদার কারো নিজস্ব ব্যবসা। বস্তির ধারের মানুষগুলিই আজ তাদের সন্তানদের দৌলতে দুবেলা দুমুঠো শান্তির ভাত খেতে পাচ্ছে। শিক্ষার আলোয় জগতকে ছুঁয়ে তারা সভ্যতসমাজে মিশে সেই জগতের একজন হতে পেরেছে। প্রদীপ কাকুর মৃত্যুর পর সে দায়িত্ব বয়ে আনছিল কাকীমা ও সমীর। ইদানীং কাকীমার শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না। সমীর ব্যাপারটা খানিকটা অলোকের উপর ছেড়ে দিয়েছিল। সময় বয়ে যাচ্ছিল। তার মধ্যে এই দুর্ঘটনা।
-স্যার।এক ছাত্রের ডাকে সম্বিত ফেরে।
-হ্যা বল্
-এবার আমাদের রওনা দিতে হবে স্যার।সবাই এসে গেছে।
-ও হ্যা। অলোক চল ভাই। কাকীমাকে নিয়ে যাবার পালা।
ঘর ছেড়ে মৃতদেহ নিয়ে শ্মশানযাত্রা করে ছোট্ট দলটি। মিতাকাকীমা ফেলে যান তার সুনাম, সুন্দর ব্যবহার, আর অলোকের মতো সন্তান কে।
অন্তেষ্টিক্রিয়ার পর অলোক সারা বাড়িতে একা। স্ত্রী ও মেয়ে ফিরে গেছে কলকাতায়। সে সময় চেয়েছে সমীরের কাছে বাচ্চাদের জন্য। স্মৃতি তে আসছে শুধুই বাবা মা। অনুভবের এই একান্ত স্মৃতি তর্পণে বড়ই শূন্যতা। কি যেন নেই। কাকে যেন চাই-কে সে? একটা বিশ্বাসী অবয়ব ফুটে ওঠে তার সামনে। নির্ভরতার পরম আশ্বাস। প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলে অলোক।
0408sujata@gmail.com
সুচিন্তিত মতামত দিন