রত্নদীপা দে ঘোষ

বাঁশীতে আমায় উৎসব করেছে যে ///
শূন্য হয়ে যায় চোখের রোদ, রোদের সরোদ। হেরো ফুটবলের মতো আকাশ। মাঠকলম চুপটি বসে থাকে সন্ধ্যাতারার জলে। ছলছল আমার ভেতরেও। চইপাখির হইচইকণাদের বাইরে নিয়ে আসার চেষ্টা করি। ছায়াআলোর মুখ, ব্যথার রক্ত মাংস আর পুঁজ। ডানার ঝাঁপতাল। যতই ডাকি, পাণ্ডুলিপি ততোই ভেতরের গরীবঘরে। ছুতোনাতার রাজপ্রাসাদ আমার, কুটীরভজনে গড়ে ওঠে উৎসবের মায়াঅঞ্জন, হর্ষের শ্রীখোল। 

ভাঙা স্মৃতির পিপীলিকা। নহবতটি ভারি অদ্ভুত। হুশ করে প্রথমেই ভেসে ওঠে, ইমনপাহাড়ের দ্যুতিকল্যাণ। অদ্ভুত তার তাকানো। রোমন্থনের দু’পাশে দরজা। জানালার কাঁধ এতই পল্কা, যেন সামান্য বাতাসের বেলোয়ারিতে ঝরে যাবে আত্মকুহেলীর কুয়াশা-জোনাকি। একটু ছুলেই রম্ভানদীতীর, অপ্সরা-গেরামের মধুর গ্রাম। জল্পাই রঙের পথসঞ্চার। দরজার কুহুপাখা। দেখি, বিদ্যুৎপল্লবে গাঁথা এক সিন্দুক গল্পকার। কত রহস্যের পান্না, কোকিলমুগ্ধ এই সিন্দুক ... খুলে দেখি? 

আমাকে অবাক কোরে, হঠাৎ খুলে যায় সিন্দুকের বাদশা। অপরূপ। রাজাধিরাজের নক্সা। চরম ব্রহ্মাণ্ড, মৃদঙ্গের সাদাজুঁই। লালজুঁই। নীলজুঁইয়ের অগ্নিতে ছল্কেওঠা। চাঁদ। চাঁদনিরাতের চক্রান্তে বেজে উঠছে অতীন্দ্রিয় বালিকাদের ওড়না। ধূপকাঠির মণিপলাশ। এমন সৌন্দর্য দেখতে দেখতে ভুলে গিয়েছি, এ কি ইরাবতীর মাস? নাকি ঐশী-হাতছানিতে জ্বলে উঠেছে পিঙ্গলাতারার নক্ষত্র? শুধু বাসনার বিসর্জন? ভ্রূকুটি ছুঁয়ে মাটির ভুরু, দোলপ্রদীপের মঞ্চ? নাকি সর্বনাশের আনন্দ, আনন্দের চিকুর? 

দেখে দেখে আশা মেটে না। বরং আরও বেশি তীব্র হয়ে ওঠে সাগরডাকের পদ্মচিঠি। সল্মা আর জরি আক্রান্ত সেইসব ধ্রুবপাখিদের দেখে চরাচরও ক্রমশ মেদুর। পাক্ষিক পৃথিবী হয়ে ওঠে প্রতিদিনের ডাকনাম। ডাকচিঠিদের বৃষ্টিঠিকানা। ঠিকানার পরপারে মহাকালের ঘোলা জল্বায়ু। পূর্বরাগের পাঁজর। মনে হয়, যা কিছুই দেখছি, কিছুই সত্য নয়। অথচ মিথ্যেও নয়। সত্যিমিথ্যের মাঝখানে, যাযাবরী লণ্ঠনে জারিত জড়োয়া, সখাপূর্ণ এক স্তব্ধতা। 

স্তব্ধতার নাভি আর হৃদি। চক্ষুদুটি চোখের মতোই দেখতে, অথচ চোখ নয়। কান্নার শাঁখ আর শাঁখা দুই-ই পলার মতোই অতিবন্দিত লাল। প্রকৃতিঋতুর বীণাভিখারি। হাস্নুহানার গরিমায় সেজে উঠছে ভিক্ষাপাত্রের ব্যাঙ্গমী আর ব্যাঙ্গমা। মহাশূন্যে যদি চেনা কেউ না থাকে, তাহলে স্পষ্ট করে কিছু চেনা যায় না, জানাও যায় না। লজ্জাবতী বকুলের তলায় কীভাবে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকে প্রবন্ধের ঘরোয়া ভ্রমণ, লেখাগদ্যের আবদার। কোন সঞ্চারীতে ডুবে মরেছে গঙ্গাফড়িঙের ডিঙি, চেনা হয়না তাকেও... 

ভাবি, চিনতে না পারি, লিখে রাখি সেই প্রত্যন্ত-আন্তরিক অচেনা-মাঝিকেই। অন্তত তার ছবিদ্যাখার আঁকাটুকু। একাটুকু। একানাবিকের নৌকোভ্রমখানি লিখে রাখি অমিত-অক্ষরে, জ্যোৎস্নার সফরে। রাত্রির বন্যায় না হয় লিখেই রাখলাম সামুদ্রিকদিন। একখণ্ড রঙ্গন। গনগনে জ্যোতির যন্ত্রণা। কখনো সরল, কখনো সাপটা-সোজা কখনো আবার দুর্দান্ত পাপড়ি-প্রবণ উচ্চাঙ্গ-সঙ্গীত। উজ্জ্বল নয় সবখানি, তবু ধুতুরা-জীবনের আড়ালে, মুখরমৌন। বকসাদা দেওয়ালের আব্রুহীনতা, একটুও যদি লিখে দিতে পারি ... 

ভোর-ভোর। গানপ্রধান অঞ্চল। গান এখানকার প্রধান তপোবন, তপস্যার গানদ্বীপ। মোহনার আত্মীয়। আত্মার বাঁশীটিও। শুধু যাত্রাপথ নয়। হেমকান্ত জলবায়ুর মহাবোধিকক্ষও বটে। কাশফুলের হাতে লেখা নবপত্রিকা। খেলা-না-খেলার হোম। রসায়ন-যজ্ঞের শস্যদানা। সোনালীবৃক্ষের হরিণযাপন। এমন জংগলে অরণ্য পাই কই, সহজিয়া প্লাবনে কবেই ভেসে গিয়েছে অরুণ একতারার নকশী...এ কেমন উৎসব? পাতার ওপর-বিছানায় চুপিচুপি চলাচল দিচ্ছে আগ্নেয়-স্তবের পুস্পমঞ্জুরি। ঋষিকল্প মেদিনীর ভুবনজোড়া সন্ন্যাস? এ তবে কার কাঁথাগাছের রেশ? 

ওগো তুমি কার? কোন পথিকের বিরহে হয়েছ বিবাগী, তিরতির প্রজাপতি আর বিবাহের তিতির... অনিকেত, বলো কেমন স্বরে শোনাই তোমাকে রঙিন পুলকে মাতোয়ারা সাদাকালো প্রাকৃতিক ফোয়ারা, আহিরবোলের শ্যামজ সানাই ... 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সুচিন্তিত মতামত দিন

নবীনতর পূর্বতন