আগের পর্বেই বলেছি, রাবণকে যেমন তামিল বলা যাবে না, তেমনই সিংহলীও বলা যাবে না। কিন্তু কেন? এমনিতে শ্রীলঙ্কায় সংখ্যাগুরু বৌদ্ধ প্রভাবের কারণে রামায়ণের কাহিনি নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে দৈনন্দিন চর্চা খুব একটা নেই। তার উপরে ভারতীয় মহাকাব্য হিসেবে রামায়ণের পরিচিতি তার চর্চার সুযোগকে আরও সংকীর্ণ করেছে, কারণ দক্ষিণ এশিয়ার নিজস্ব রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতায় এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড়ো ও শক্তিধর দেশ ভারতের সমস্ত প্রভাবকে অস্বীকার করা বা এড়িয়ে চলা এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলির কাছে এখন অনেক ক্ষেত্রে যেন আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে! কিন্ত যে রাবণের নাম 'লঙ্কেশ' বা 'লঙ্কেশ্বর' বলে অবিচ্ছেদ্য হয়ে গেছে এই অঞ্চলের সংস্কৃতিতে, তাঁকে কীভাবেই-বা অস্বীকার করতে পারে শ্রীলঙ্কার মানুষজন! তাই মূলধারায় চর্চা কম থাকলেও সে-দেশের লোকগাথা থেকে উপকথা হয়ে মাঝেমাঝেই রাবণ তাঁর 'Larger than life' ভাবমূর্তি নিয়ে ফুটে ওঠেন শ্রীলঙ্কার ইতিহাসচর্চায়, সাংস্কৃতিক আন্দোলনে ও সাহিত্য-পরিমণ্ডলে।
এমনিতে শ্রীলঙ্কায় রাবণের ভাবমূর্তি যেমন একজন বীর যোদ্ধার, তেমনই একজন প্রজাদরদী কল্যাণকামী মহান শাসকের। মানুষ বিশ্বাস করে যে তাঁর রাজত্বে প্রাচীন লঙ্কা সাম্রাজ্য-বিস্তারে, ব্যবসা-বাণিজ্যে, শিল্পচর্চায়, নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্যে পৌঁছে গিয়েছিল উন্নতির সর্বোচ্চ শিখরে। হয়তো সেই কারণেই আধুনিক সিংহলী জাতীয়তাবাদের প্রবক্তাদের একটা অংশ রাবণকে প্রাচীন সিংহলী কাল্ট ফিগার হিসেবে তুলে ধরতে চাইছেন। 'হেলা মুভমেন্ট' নামে পরিচিত এই মতবাদের জনক শ্রীলঙ্কার প্রখ্যাত ভাষাবিদ ও সাহিত্যিক মুণিদাসা কুমারাতুঙ্গা। প্রসঙ্গত, রাজা বিজয়ের রাজত্বের আগে পর্যন্ত শ্রীলঙ্কা 'হেলাদিভা' বা হেলাদ্বীপ নামে পরিচিত ছিল। কথিত আছে, তখন সেখানে চারটি জাতির বসবাস ছিল। তাদের মধ্যে তিনটির কথা আগেই আমাদের আলোচনায় এসেছে অর্থাৎ দেববংশীয়, রাক্ষস ও যক্ষ। আর চতুর্থ জাতিটি ছিল নাগবংশীয় (অর্থাৎ সর্প-উপাসক)। রাজা বিজয়ের সময় থেকে হেলাদিভা ক্রমশ সিংহল নামে পরিচিত হতে থাকে। কিংবদন্তি অনুযায়ী বিজয় ছিলেন সিংহবংশীয়। তাই তাঁর 'সিংহ' এবং হেলাদিভার 'হেলা'-র সংযুক্তিকরণে হয় 'সিংহল'। হেলা মুভমেন্টের উদ্দেশ্য ছিল পাশ্চাত্য ও ভারতীয় প্রভাব অস্বীকার করে শ্রীলঙ্কার প্রাচীন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে প্রতিষ্ঠিত করা। কুমারাতুঙ্গার মৃত্যুর পরে এই আন্দোলন পরিচালনার ভার যায় সে-দেশের বিখ্যাত কবি ও চিন্তাবিদ অরিসেন আহুবুধুর হাতে। আহুবুধু তাঁর ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত বই 'সাকভিথি রাভানা'-য় লিখেছেন যে, প্রাচীন লঙ্কায় রাবণ খ্রিস্টপূর্ব ২৫৫৪-২৫১৭ সময়কালে রাজত্ব করেছেন। তাঁর মতে, রাবণ সূর্যবংশীয় ছিলেন (কৌতূহলজনকভাবে, রামও তাই) এবং রাবণের নামের 'রা' অংশটি সূর্যকে বোঝায় ও 'বণ' অংশের অর্থ প্রজন্ম। যদিও মনে রাখতে হবে, রামায়ণের ব্যাখ্যাতাদের কাছে আমরা 'রাবণ' শব্দের অন্য অর্থ পেয়েছি। প্রসঙ্গত, রামায়ণের প্রচলিত কাহিনিকে উড়িয়ে দিয়ে আহুবুধু জানিয়েছেন যে লঙ্কার সিংহাসনের লোভেই বিভীষণ রামের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে তাঁকে দিয়ে লঙ্কা আক্রমণ করিয়েছিলেন, রাবণের সীতাহরণের গল্পটি আদৌ কোনো কারণই নয়! এই প্রসঙ্গে অধ্যাপক বুদ্ধদাসা হেওয়াভিথারানা জানিয়েছেন, কলম্বোর কাছে উত্তর কালুতারা নামক যে-এলাকায় বিভীষণ বাস করতেন, সেই অঞ্চল আজও 'দেশাশত্রু' নামে পরিচিত। আহুবুধু তাঁর গবেষণায় রাবণ ও তাঁর পূর্বপুরুষদের প্রাচীন লঙ্কার স্থায়ী বাসিন্দাই প্রমাণ করতে চেয়েছেন। তাঁর মতে, উত্তর-মধ্য শ্রীলঙ্কার পোলোন্নারুয়া অঞ্চল থেকে রাবণের পূর্বসূরীরা এসেছেন এবং ওই জায়গার নামকরণ তাঁর পিতামহ পুলস্ত্যের নাম থেকে হয়েছে।
এই পর্যন্ত পড়লে রাবণকে জন্মসূত্রে সিংহলী ভাবতে ইচ্ছে করতেই পারে। কিন্তু রাবণের উপর যে ভারতের দাবিও কম নয়, বরং একটু বেশিই জোরালো, তা আমাদের দ্বিতীয় পর্বের আলোচনাই প্রমাণ করেছে। তাছাড়া, আধুনিক শ্রীলঙ্কার কোন জনগোষ্ঠী রাবণকে নিজেদের পূর্বসূরী ভাববে? সংখ্যালঘু তামিলরা? নাকি, সংখ্যাগুরু সিংহলীরা? রাবণ যে তামিল ছিলেন না, তার বেশ কিছু যুক্তি নিয়ে আমরা আগেই আলোচনা করেছি। আর আজকের সিংহলীদের মূলত রাজা বিজয়সিংহ ও তাঁর অনুগামীদের উত্তরপুরুষ মনে করা হয়। প্রসঙ্গত, রাজা বিজয় খ্রিস্টপূর্ব ৫৪৩-৫০৫ সময়ে সিংহলের শাসনক্ষমতায় ছিলেন, এবং তাঁদের প্রাচীন বঙ্গ ও কলিঙ্গ থেকে আগত মনে করা হয়। অবশ্য এ-নিয়ে কিছু মতবিরোধ যে নেই, তা নয়। বিজয়সিংহ আদতে যে-রাজ্যের যুবরাজ ছিলেন, সেই সিনহাপুরা বা সিমহাপুরা ঠিক কোথায় ছিল? অনেক ইতিহাসবিদের মতে, সিনহাপুরা ছিল কলিঙ্গতে, যা আজকের ওড়িশায় হতে পারে অথবা ঝাড়খণ্ড বা অন্ধ্রপ্রদেশের উত্তরাংশেও হতে পারে। রমেশচন্দ্র মজুমদার, যিনি ১৯৩৭-১৯৪২ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন, তাঁর 'Outline of the History of Kalinga' বইতে এর উল্লেখ করেছেন। আবার নীহাররঞ্জন পট্টনায়েকের 'Economic History of Orissa' অনুযায়ী সিনহাপুরার অবস্থান ছিল আজকের অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীকাকুলাম শহরের কাছে সিঙ্গুপুরম নামক গ্রামে। শ্রীলঙ্কার তামিল ইতিহাসবিদ মুদালিয়ার সি রসানায়গম তাঁর 'Ancient Jaffna' বইতে বর্তমান ওড়িশার জাজপুর বা গঞ্জামের নিকটবর্তী সিংপুর শহরকেই বিজয়ের সিনহাপুরা বলে উল্লেখ করেছেন। পাশাপাশি তিনি লিখেছেন: "There are others who think that Sinhapura is the present village of Singur which is a station in the Tarakesvar branch of the East Indian Railway, ten miles from Tarakeswara in the district of Hughli...This identification may be correct, for ancient Singur appears to have been of considerable size and importance and a flourishing commercial town on the old bank of the river Sarasvati. The followers of Vijaya were also called Gangetic settlers, and the descendants of those who settled in North Ceylon called themselves afterwards as of the Gangakula or Gangavamsa." ঠিক এই যুক্তি ধরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের রিডার ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের কারমাইকেল প্রফেসর হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী আজকের পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার সিঙ্গুরকে বিজয়সিংহের সিনহাপুরা বলেছিলেন, হরিহর পাণ্ডা 'Professor H.C. RayChaudhuri, as a Historian' বইতে সে-কথা উল্লেখ করেছেন। এই আলোচনাগুলি এতই যুক্তিসঙ্গত যে, অন্য কয়েকজন ইতিহাসবিদ সিনহাপুরাকে বিহারের মগধে বা গুজরাতের সিহরে বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কোনো অঞ্চলে বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করলেও সেগুলি গ্রহণযোগ্য হয়নি। তাহলে একথা সহজেই বোঝা যাচ্ছে যে আজকের সিংহলীদের সঙ্গে রাবণের যোগাযোগের সূত্র খুবই ক্ষীণ, বরং আমাদের অর্থাৎ বাঙালিদের সঙ্গে তাদের বেশ একটা শক্তপোক্ত যোগ থাকতে পারে।
তবে সরাসরি যোগসূত্র কম থাকলে কী হবে, আধুনিক শ্রীলঙ্কার লেখক-মহল কিন্তু রাবণের কিংবদন্তি নিয়ে যথেষ্ট সচেতন। সে-দেশে তাই রাবণের উপর একাধিক গবেষণামূলক কাজ হচ্ছে সিংহলী ও ইংরেজি, উভয় ভাষাতেই। এরকম কয়েকটি কাজের উল্লেখ আমরা গত পর্বে এবং এখানে ইতিমধ্যেই করেছি। এই ধারার আরেকটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন হলো ২০১৩ সালে প্রকাশিত 'Ravana, King of Lanka', লেখক মিরান্দো ওবেয়সেকেরে। রাবণ সম্পর্কে সিংহলীদের এই আগ্রহ প্রসঙ্গে এক ভারতীয় লেখকের সাম্প্রতিক (প্রকাশকাল ২০১৭) একটি বইয়েরও উল্লেখ করবো। বালা সাঙ্কুরাত্রির লেখা 'my name is ravana'( হ্যাঁ, এইভাবেই ছাপা হয়েছে বইটির নাম) বইটি এমনিতে অত্যন্ত সাধারণ ও রাবণ-বিষয়ক চর্চায় নতুন কোনো আলো ফেলতে ব্যর্থ। বিষ্ণুর দ্বাররক্ষক জয় ও বিজয়ের শাপগ্রস্ত হয়ে যথাক্রমে রাবণ ও কুম্ভকর্ণ হয়ে জন্ম নেওয়ার সেই প্রথাগত অলৌকিক কাহিনি ও তার ততোধিক অলৌকিক পরিণতি ছাড়া বইটিতে কিছুই নেই। ভাগ্যিস বিভীষণ ও শূর্পনখাকে নিয়েও এরকম কিছু লেখা হয়নি! যদিও কেন হয়নি, তার একটা কারণ অবশ্য অনুমান করা যায়; তবে সেই আলোচনায় আবার পরে আসবো। বাস্তবত, রাবণ-চর্চায় এই বইয়ের থেকে অনেক বেশি গভীরতাসম্পন্ন ও চিন্তার খোরাক যোগানোর মতো কাজ ভারতীয় লেখকরা করেছেন। তবু কেন এই বইটির কথা আলাদা করে বলছি? কারণ, বইটির শেষে শ্রীলঙ্কায় রামায়ণের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত স্থানগুলির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা আছে, আর হয়তো সেই কারণেই আছে সে-দেশের পশ্চিম প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ইসুরা দেভাপ্রিয়া ও শ্রীলঙ্কার পর্যটন উন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যান উদয়া নানায়াক্কারা প্রেরিত শুভেছাবাণী। রাবণকে নিয়ে সিংহলীদের এই স্বীকৃতি ও প্রচ্ছন্ন অহংকার আসলে যে তাঁকে নিজেদের করে দেখানোর চেষ্টারই প্রকাশ, তা বুঝতে কষ্ট হয় না। তাই আমরা বলতেই পারি, শ্রীলঙ্কার সংস্কৃতি চর্চার মূলধারায় না-থেকেও রাবণ কিন্তু শ্রীলঙ্কার সর্বত্র আছেন। নেহাতই বাল্মীকি-বর্ণিত খল-চরিত্র হলে কি তিনি এই গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পারতেন!
এবার আবার ফিরে আসা যাক ভারতীয় ভূখণ্ডে। আগের পর্বেই বলেছিলাম, রাবণকে আত্তীকরণের দ্রাবিড়-প্রচেষ্টা নস্যাৎ করা গেলেও দ্রাবিড় সংস্কৃতিতে রাবণের প্রভাব অস্বীকার করা যাবে না। তামিলনাড়ু-সহ গোটা দক্ষিণ ভারতেই হিন্দু ধর্মের প্রাধান্য রয়েছে, এবং সর্বত্রই রামায়ণ যথেষ্ট জনপ্রিয়। দক্ষিণ ভারতীয়দের কাছেও রামই নায়ক, রাবণ নন। কিন্তু রাবণকে নিয়ে অন্তঃসলিলা নদীর মতো একধরনের সম্ভ্রম ও শ্রদ্ধা যে দক্ষিণ ভারতীয় মননে বয়ে চলেছে, তাও একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়। দক্ষিণের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক বহিঃপ্রকাশে তার প্রভাব ফুটে উঠতেও দেখা যায়। তাই হয়তো দক্ষিণ ভারতীয়দের নামকরণে যেমন 'রামন' শব্দটি থাকে, তেমনই রাবণন নামের দক্ষিণ ভারতীয় মানুষ পাওয়াও বিরল নয়। অথবা ধরা যাক, ২০১৭-র ৫ সেপ্টেম্বর বেঙ্গালুরুতে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের বন্দুকের গুলিতে নিহত অসমসাহসী সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশের কথা, যাঁর বাবা পালায়াডা লঙ্কেশাপ্পা নিজেও ছিলেন কন্নড় সংস্কৃতি জগতের সুপরিচিত নাম। আমরা তো জানি, প্রাচীন বা মধ্যযুগীয় লঙ্কায় যখনই যে-ই রাজত্ব করে থাকুক না-কেন, লঙ্কেশ বা লঙ্কেশ্বর বলতে একমাত্র রাবণকেই বোঝায়। কিন্তু কেন তথাকথিত একটি খল-চরিত্রের নামেও নামকরণ করে মানুষ? শিকড়ের খোঁজ শেষ করে সে-সব বুঝতে এবার আমরা সরাসরি ঢুকে পড়বো রাবণের অন্দরমহলে, আগামী পর্বের হাত ধরে।
।। ক্রমশ।।
সুচিন্তিত মতামত দিন