নিবেদিতা ঘোষ মার্জিত

আমোদিনীঃ সিদ্ধা
সকলেই উদ্বাহু হইয়া নৃত্য করিতেছে। তাহার সাথে চলিতেছে মহোল্লাসে মহানাম সংকীর্তন। আমোদিনীর হৃদয় ভক্তিরসে রসসিক্ত। ফুল,মালা, ধুপকাঠি, প্রদীপের আলোর সজ্জায় চৈতন্যদেবের ছবি টি উদ্ভাসিত হইয়া আছে। কতকাল হইয়া গিয়াছে এই আনন্দ হইতে বঞ্চিত রহিয়াছে সে।ভ্রাতৃদ্বিতীয়াতে আসিয়াছিল সে। তখন এই আনন্দ হয় নাই। সংসার হইতে কয়েক দিন অবকাশ লভিয়াছে। পিতার বয়স হইলেও বড় মধুর কণ্ঠস্বরে তিনি নাম গান করিয়া থাকেন। মাতার মুখের দিকে তাকাইয়া অনাস্বাদিত আনন্দে বুক ভরিয়া গেল। তিলকের মধ্যে তাঁহার কপালের সিন্দুর বিন্দু খানি জ্বল জ্বল করিতেছে। তুলসী বৃক্ষটির চারি পাশে আলিম্পন। বড় পবিত্র এই পরিবেশ। আমোদিনীর মন অপূর্ব সুখে ভাসিল। 

সকলে প্রসাদ লইয়া চলিয়া গেলে, উঠান পরিস্কার করিয়া মা স্নান করিতে গেলেন। আমোদিনী বসিল পিতার কাছে। বড় স্নেহঘন মুহূর্ত। কন্যা কে পিতা বলিলেন, “ এবার জামাই কে বল দীক্ষা নিয়ে নেবার জন্যে। গুরুদেব এই মাসটা এই অঞ্চলেই থাকবেন।”

কন্যা সলজ্জ কণ্ঠে বলিল, “ ওর এই সব ভালো লাগে না বাবা। ওকে এই সব বলতে পারবো না।” পিতার শ্রবন শক্তি ক্ষীণ। তিনি না শুনিয়া বলিয়া যাইতে লাগিলেন,“ গুরুদেব দয়া করলে সব কষ্ট চলে যায়। কোন বিপদ হয় না।” “তিনি সব পাপ গ্রহণ করেন।”মা তাঁহার স্নিগ্ধ কণ্ঠস্বরে তাই বললেন।আমোদিনীর বুকে এক প্রবল দ্বিধা আসিয়া মহা আলোড়ন ফেলিয়া দিল। 

আমোদিনীর স্বামী খুব শক্ত মনের পুরুষ। একাধারে প্রশাসনিক দায়িত্ব ও বিরাট পরিবারের জ্যেষ্ঠ পুত্র হওয়াতে তাহাকে সকলে সম্ভ্রমের সহিত দেখিয়া থাকে। আমোদিনী পিতামাতার মধ্যে যে স্বাভাবিক সরল ঈশ্বরপ্রীতি দেখিয়া ছিল, স্বামীর ভিতরে তাহার কণামাত্র নাই।তিনি বিজ্ঞান মানেন, যুক্তি মানেন।কিন্তু ধার্মিক উল্লাস গুলিকে ভণ্ডামো বলিয়া এড়াইয়া চলেন।অপর দিকে তিনি আমোদিনীর কণ্ঠে পদাবলী শুনিয়া প্রেমপূর্ণ নেত্রে দৃষ্টিপাত করিয়া থাকেন। আমোদিনীর পরম নির্ভরতা এই মানুষটির উপরে। সে বুঝিতে পারে তাঁহার স্বামীর হৃদয় মন্দিরে তাহার জন্যে এক খানি প্রদীপ নিত্য জ্বলিয়া থাকে। কিন্তু পিতামাতা যে দীক্ষা গ্রহণ এর জন্যে উদ্যোগ করিতেছেন, ইহা যে তিনি কি ভয়াবহ পরিহাসের সহিত প্রত্যাখ্যান করিবেন তাহা ভাবিয়া আমোদিনী শিহরিত হইল।পিতা মাতা ইহা জানিয়া প্রবল কষ্ট পাইবেন। আর গুরুদেব কে আমোদিনী সেই শিশুকাল হইতে দেখিয়া আসিতেছে। তিনি আমোদিনী কে স্নেহ করেন। আমোদিনীও তাহাকে অন্তর হইতে শ্রদ্ধা করিয়া থাকে। 

স্বামী দূরভাষে জানাইল তাহাকে লইতে আসিতেছে। আমোদিনীর পিতামাতা দীক্ষার জন্যে আয়োজন করিতে লাগিল। জামাতা আর কন্যার লাগিয়া নবীন বস্ত্র, দীক্ষার উপাচার এই সব লইয়া গৃহ সরগরম হইয়া রহিল। “এসব থাক মা, পরে হবে” নিম্ন স্বরে কন্যার কথা উভয়ই শুনিতে পারিলেন না।

গুরুদেব আসিয়াছেন। করবদ্ধ হইয়া আমোদিনীর পিতা তাঁহার সামনে দণ্ডায়মান।আমোদিনীর স্বামী মধ্যরাতে আসিয়াছে। গৃহের দ্বিতলে সে নিদ্রিত রহিয়াছে। আমোদিনীর কনিষ্ঠ ভ্রাতা ছুটিয়া যাইল জামাইবাবুর নিদ্রাভঙ্গ করিতে।মা নানা উপাচার লইয়া অনুষ্ঠানের ব্যাবস্থাপনায় শশব্যস্ত হইলেন।গুরুদেব কে প্রনাম করিয়া আমোদিনী স্বামীর কাছে গমন করিল।শ্যালক কর্তৃক এই অদ্ভুত খবর শুনিয়া বিচিত্র ভ্রুভঙ্গী করিয়া শয্যায় বসিয়া আছে আমোদিনীর স্বামী। কনিষ্ঠা ভ্রাতা কে আমোদিনী চা আনিতে বলিল। 

“ আমি এই সব ঢঙ করতে পারবো না বলে দিলাম। আমাকে আগে বলোনি কেন? রিডিকিউলাস।” আমোদিনী তাহার মুখের উপর হাত দিয়া চুপ করাইল। “তুমি এমন ভাবে বলো না। ... শুনতে পেলে কষ্ট পাবে।”

ঝড়ের সন্মুখে শুকনো পাতা যেরূপ উড়িয়া যায়, তাহার কথাও সেইরূপ উড়িয়া যাইল। 

“ এইসব বোগাস ব্যাপারে আমাকে একদম টানবে না বলে দিলাম।আর তুমি ঐ সব হরেকেষ্ট করবে বাড়িতে? একদম না …” আমোদিনী একাই নীচে নামিল। মাতাকে ডাকিয়া বলিল, সে একান্তে গুরুদেব কে কিছু নিবেদন করিবে।পিতা সস্নেহে জামাতার খোঁজ লইল। মাতা পিতা তাহার মনবাঞ্ছা শুনিয়া অবাক হইয়াছেন।

গুরুদেব দেখিলেন, দেবী স্বরূপা দীপ্তি লইয়া আমোদিনী একাকী তাঁহার সন্মুখে আসিয়া নতজানু হইয়া বসিল। 

“আমার কিছু বলার আছে ।” স্নেহদৃষ্টি দিয়া গুরুদেব সম্মতি জানাইলেন।“ আপনি আমাকে সেই ছোটবেলা থেকে চেনেন, আমি তখন থেকেই আপনাকে শ্রদ্ধা করে এসেছি। বাবা বলেন আপনি আমাকে দীক্ষা দিলে আমার সব কষ্ট চলে যাবে। মা বলেন আপনি আমার সব পাপ গ্রহণ করবেন। কিন্তু আমি আজ খুব সংকটএর মধ্যে আছি।আমার স্বামী খুব সৎ তিনি দীক্ষা মানেন না। আমি একা কোন সিধান্ত গ্রহনের উপযুক্ত বলে কেউ আমাকে মনে করে না। দীক্ষা না নিলে বাবামা খুব কষ্ট পাবে। আর স্বামী যা মনে করেন তাকেও আমি অমান্য করতে পারি না। আমি কি করবো?” 

চা খাইতে খাইতে আমোদিনীর স্বামীর শ্রবণগোচর হইল। গুরুদেব মোটর গাড়িতে উঠিবার কালে আমোদিনীর পিতা কে বলিতেছেন, “ আমার মা গঙ্গাস্নান করতে ভয় পেতেন। সাঁতার জানতেন না। কিন্তু ঠাকুমা গঙ্গাস্নান না করলে রান্নাঘরে ঢুকতে দেবেন না বলে নিত্য গঙ্গাস্নান করতেন। শেষ বয়সে কান খারাপ হয়ে গিয়ে ছিল।ডুবে স্নান করার জন্যে ”।

niveditaghosh24@gmail.com


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.