দর্শিনীর আজ একটু লেট। প্রার্থনা সঙ্গীতএর সময় স্কুল প্রাঙ্গনে উপস্থিত থাকতে পারবে কি না সন্দেহ !তারপরেই পৌঁছবে তার রিক্সা। মিনিট কুড়ির রাস্তা রিক্সায়। লেট তার খুবই কম হয় কোথাও পৌঁছোতে, বরং গন্তব্যে সময়ের একটু পূর্বে পৌঁছতেই সে বরাবর পছন্দ করে ।এভাবেই সে তার দীর্ঘ স্কুল,কলেজ,ইউনিভার্সিটির দিনগুলো পেরিয়ে এসেছে ।
টিচার্স কমনরুমে পা রাখতেই ক'জোড়া চোখ যেন দৃষ্টিনিক্ষেপের ভঙ্গিমায় দর্শিনীকে বুঝিয়ে দিল,আর কতদিন চলবে এমনতর লেট ?হ্যাঁ,বেশ কিছুদিন ধরে তার ক্রমাগত দেরী হচ্ছে বৈকী ! কারণটা কিছু অযাচিত অতিথির হঠাত্ আগমন ।
অযাচিত কারণ সেই অমানিশার দিনগুলোতে, সেই ঝড়-ঝঞ্ঝার দিনগুলোতে কোন আত্মীয় -স্বজনকেই দর্শিনী বা তার মা পাশে পায়নি । বরং প্রতিবেশীরাই তখন হয়ে উঠেছিলেন পরম আত্মীয় । তাই সে সকল আত্মীয়দের অযাচিত ছাড়া আর কিই বা বলা যায় !
ব্যাগটা কমনরুমের টেবিলে রেখে 'সেভেন-বি' এর দিকে পা বাড়াতেই মধুরাদির সাথে দেখা,মধুরাদি কিছুটা কৌতূহলী চোখে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন,''কি রে,আবার দেরী আজ ?সিনিয়র টিচাররা কিন্তু একটু বাঁকা চোখেই দেখছেন !কাল থেকে টাইম মত আসার চেষ্টা করিস কেমন !'' দর্শিনী চোখ দুটো নীচের দিকে করে মাথাটা বাঁদিকে করে নীরবে সম্মতি জানাল ।
ছিঃ!কি লজ্জার কথা ! না-না,এমন দেরী আর কখনো করবে না সে ।তা সে কারণ যতই গুরুতর হোক না কেন !
একের পর এক ক্লাস,প্রথম বৈশাখের তীব্র দাবদাহ,তারওপর ক্ষণে-ক্ষণে লোডশেডিং সব মিলিয়ে মাথা ঠান্ডা রেখে ক্লাস নেওয়া যে কি কষ্টসাধ্য !নেহাৎ মেয়েগুলো তাদের দিদিমনিকে একটু ভয় করে,তাই সে ক্লাসে ঢোকামাত্র মাছের বাজার সহসা গীর্জার প্রার্থনা হলে পরিণত হয় । এই যা স্বস্তির !
স্কুল ছুটির পর শ্যামলের রিক্সায় উঠেই মনে পড়লো একটু সুপার মার্কেট যেতে হবে । আজ মা তাঁর মাসতুতো ভাই ও তাঁর পরিবারের জন্য ফ্রাইড রাইস ও চিলি চিকেন করবেন । তাই সে সকল ইনগ্রেডিয়েন্স ও নিজের কিছু কসমেটিক্স ও পত্রিকা কিনতে যেতেই হবে কাছের সুপার মার্কেটটিতে ।মামা বলে ডাকতে দর্শিনীরও খুব সাধ হয় ।কিন্তু যখন সে মাত্র এগার বছর আর তার মা একেবারেই আটপৌরে গৃহিনী,এমন অবস্থায় বাবা কিডনী ফেইলর হয়ে চলে গেলেন ।হঠাত্ পায়ের নীচ থেকে যেন মাটি সরে গেল,একেতো পিতৃহারা হওয়ার বেদনা তারওপর কোথায় কি ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স আছে কিছুই মায়ের জানা ছিল না । সেই অনভিপ্রেত পরিস্থিতিতে আত্মীয়-পরিজনের কাছে মা একটু মানসিক শক্তি চেয়েছিলেন কিন্তু তারা মাকে ফিনান্সিয়াল সাহায্যপ্রার্থী হিসেবে ভেবে ভ্রমিত হয় ।আর মার থেকে দর্শিনীর থেকে যতটা দূরত্ব বজায় রাখা যায় ততটাই দূরত্ব বজায় রেখেছিলেন তারা এতকাল ।আজ দর্শিনী তার মায়ের কঠোর পরিশ্রমের ফলস্বরূপ পড়াশুনো শিখে সমাজে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে,পায়ের তলার মাটি শক্ত করেছে । তাই সেসকল দুঃসময়ের কথা মনে পড়লে আজ কোন আত্মীয়-পরজনদের সঙ্গেই আর নূতন করে সম্পর্ক তৈরী করতে ইচ্ছে করে না তার ।কিন্তু মা দীর্ঘদিন নিজের লোকেদের থেকে দূরে থাকার দরুণ তাঁর হয়তো আজ আবার পুরোনো সম্পর্ক,ভাই-বোন,মাসী-পিসিদের আবার কাছে ফিরে পেতে ইচ্ছে করে । আর দর্শিনী মায়ের ইচ্ছেকে সম্মান করে বলেই,বাড়িতে আগত মানুষগুলোর সাথে নিখুঁত অভিনয় করে চলেছে ।
!!দুই!!
সারাটাদিন তীব্র তাপপ্রবাহের পর বিকেলেবেলা কালবৈশাখী ঝড় ও তার সাথে বৃষ্টি যেন পরম কাঙ্খিত ।সপ্তাহে রবিবার বিকেল বেলা দর্শিনী চলে আসে এই কফিশপ টা তে । আজও এসেছে,এসে দেখে অর্ক ঈশান কোনের টেবিলটাতে বসে আছে ।বরাবর সেটিতেই বসে তারা ।অর্ক জানালার দিকে মুখ করে বাইরের বৃষ্টি দেখছে ।দর্শিনী টেবিলে ব্যাগ রেখে চেয়ার টেনে বসতেই অর্কর যেন সম্বিত্ ফিরলো ।''কি বৃষ্টি !ভিজেছো বুঝি ?''দর্শিনী স্মিত হেসে,''না,তুমি কতক্ষণ ?''অর্ক একটু ভেবে,''তা দশ মিনিট হবে ।''
এভাবেই রবিবারের বিকেল কাটে তার সাথে । দর্শিনী ও অর্কর সম্পর্ক সাত বছর হতে চলল । অর্ক একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ।সপ্রতিভ,বন্ধুবত্সল ও উদার মনের অর্ক ।অর্ক এবার দর্শিনীকে বিয়ে করতে চাইছে,দর্শিনীও তাইই চায় । তবু কিছু কথা আগে থেকে পরিষ্কার হয়ে যাওয়া ভাল । আর সেই পরিষ্কার হতে গিয়েই জল যেন আরও ঘোলা হয়ে গেল ! প্রথমে অর্ক বলে উঠেছিলো তা কেমন করে হয় ? দর্শিনী বলেছিল কেন হয় না? বিয়ের পর তুমিও যেমন তোমার বাবা-মা এর সাথে থাকবে তেমনি আমার মাও থাকবেন আমাদের সাথে । আফটার অল আমার মা এর তো আমি ছাড়া আর কেউই নেই। বাবার অকাল মৃত্যুর পর এই মা-ই আমাকে বড় করেছেন,বাইরের জগতের যে কিছুই বুঝতেন না, জাস্ট আমার জন্য একটা ছোট্ট চাকরি করে আমাকে পড়াশোনা শিখিয়েছেন, আমার সমস্ত শখ-আহ্লাদ সাধ্যমত পূরণ করতে চেষ্টা করেছেন । ভালোবেসে বিয়ে করবো বলে মা কে স্বার্থপরের মত একা রেখে চলে আসবো ?তা কি হয় অর্ক ? তুমিই বলো ? অমনি অর্ক বিরস মুখে,''না,তা তো বলিনি । কাকিমা কে বিয়ের পর আমাদের বাড়ির কাছে কোথাও রেন্টে রেখে দাও ।''
''নাহ, মা আমার সাথেই থাকবেন, সেখানে তুমিও চাইলে তোমার মা-বাবা এর সাথে থাকতেই পারো । কিন্তু এমনটা হবে না যে, তুমি তোমার বাবা-মা কে নিয়ে থাকবে,আমিও থাকবো, শুধু আমার মা-ই ব্রাত্য হবেন । পুরুষরা যদি তাদের পেরেন্টসদের নিয়ে থাকতে পারেন তবে একটি মহিলাই বা কেন তার পেরেন্টসদের নিয়ে থাকতে পারবেন না ? এ কেমন সমাজ !
''কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ টেবিলে দু'জন মুখোমুখি বসে, তারপর দুটো কফির বিল মিটিয়ে অর্ক আশি বলে চলে গেল । চেনা ভালোবাসার মানুষটি সহসা বড় অচেনা হয়ে কোথায় যেন মিলিয়ে গেল ! দর্শিনী তার নিঃসার শরীরটাকে কোনক্রমে চেয়ার থেকে তুলে মন্থর পদে চলল মা -র বুকে একটু মুখ গুঁজতে, তার একমাত্র অবলম্বন কে আরও আকড়ে জড়িয়ে ধরতে !
moumitasenguptaslg@gmail.com
সুচিন্তিত মতামত দিন