কৃষ্ণা রায়

আগুন রঙা আনন্দ






পাশের ফ্ল্যাটের বিমলবাবুর নাতনি ঝিমলিকে ওর মা বাবা আমার জিম্মায় রেখে পুজোর বাজার করতে বেরিয়েছে। বিমলবাবু অনেকদিন অসুস্থ, বিছানা-বন্দী। স্ত্রী মারা গেছেন বছর পাঁচেক আগে। বছর সাতেকের মেয়েটি বেশ চঞ্চল। আয়ার কাছে আজকাল থাকতে চায়না। আমার সঙ্গে তার বেজায় বন্ধুত্ব। এবারে নাকি তার বারোটা ড্রেস হবে। রেডিমেড নয় , টেলারকে দিয়ে করাতে হবে। দক্ষিণ কলকাতার এক নামি টেলারিং শপে আজ নাম লেখাতে হবে, ডিসাইনের খুঁটিনাটি লিখে ফর্ম ফিল আপ করে টাকা অ্যাডভ্যান্স করতে হবে। তাহলেও যে সব জামা হবে এমন গ্যারান্টি নেই। সেটা জানা যাবে এক সপ্তাহ বাদে। ঝিমলির মা বেশ আধুনিক, অন্তত পোষাক-পারিপাট্যের ক্ষেত্রে তো বটেই। মেয়েকে নতুন ধরণের জামা পরানোটা তার একটা বিশেষ শখ, আমার মতে অবশ্য অবসেসন। সে যাক, প্রতিবেশি হিসেবে মেয়েটাকে কিছুক্ষন রাখতে হবে, মন্দ কি? এতে আমারো ভাগ্যে এক্টু বাড়তি আনন্দ জুটবে। মেয়েটা বেশ কলকল করে কথা বলে, স্কুলের দিদিমণিদের খুঁটিনাটি কী চমৎকার করে গল্প করে। ওর মার কথায় মাসিমণি, ও কিন্তু খুব বানিয়ে বানিয়ে কথা বলে, সব কথা ধরবেন না। বুঝতে পারি মেয়েটার একটা বিশাল কল্পনার জগত আছে। আমিও ওর সঙ্গে আগডুম বাগডুম গল্প করি, আমার ছেলেবেলার। 

ঝিমলির মা বাবা রাত ন’টা নাগাদ আমার ফ্ল্যটে বেল দিল। মাসিমণি, খুব জ্বালিয়েছে নিশ্চয় বিচ্ছুটা! দুজনের মুখ খুশিতে উদ্ভাসিত। বুঝলাম ফারস্ট রাউনডে মিশন সাকসেস ফুল। ওদের খুশিতে আমিও যোগ দিলাম , বা! এবারে ঝিমলি তাহলে বারোটা ড্রেস পাচ্ছেই। আমারটা কিন্তু এর মধ্যে ধরা নেই ----, ঝিমলি তোমার ভাল ফিটিংস এর একটা জামা কিন্তু আমায় দু এক দিনের মধ্যে দিও। ঝিমলির মা হাসল, আবার আপনি কেন? প্রতিবার দেন, আর ও তেমন ছোট তো নেই। এই তো এত হচ্ছে। ঝিমলি চোখ পাকিয়ে বলল, মণিদি আমায় দেবে বলেছে, নেবনা কেন? ঝিমলির আমি মণিদি। ওর মা-ই ডাকতে শিখিয়েছে। হাসি মুখে গুড নাইট বলে ঝিমলি টা-টা করে চলে গেল। দরজা বন্ধ করতে করতে ভাবলাম, মেয়েটাকে একটা আগুন রঙা ফ্রক দেব। যেমন পরতে চেয়েছিলাম আমি কতকাল আগে। আমার মেয়ে নেই, তাই এসব শখ মেটেনি। আমার ছেলে এখনো বিয়ে করেনি, করলেও বলেছে চাইলড লেস বাই চয়েস থাকবে। । মনে মনে হাসি, আমি কী এখন ঝিমলিকে দিয়ে দুধের সাধ ঘোলে মেটাতে চাইছি? না, তাই বা কেন? ঝিমলি আমার খুব আপন । রক্তের সম্পর্ক ই কি সব নাকি?

যাব যাব করে সাতদিন কেটে গেছে। ঝিমলের জামার মাপ নিয়েছি, কেনা হয়ে ওঠেনি। আসলে ভাবছিলাম , এবারে আমিও ঝিমলির মায়ের মত একটা নিজের পছন্দের ডিজাইন দেওয়া ফিটিংস জামা দর্জিকে দিয়ে বানাব। কিন্তু যা সব শুনি আজকাল, অর্ডার নেবে কি না কে জানে! পাড়ার বহু চেনা মিমি টেলারিঙে খোঁজ করলাম । ওরা দুঃখ দুঃখ মুখ করে বলল, কাকিমা একটু দে্রি করে ফেলেছেন, আর তিন দিন আগে হলেও— 

অগত্যা, আমার অফিসের সামনে “স্মার্ট –ফিটে” ঢুঁ মারলাম। কয়েক বার এদের কাছে টুকটাক ব্লাউজ করিয়েছি। রিসেপ্সনের অল্পবয়সী ছেলেটি খুব খাতির করে অভ্যর্থনা জানিয়ে প্রশ্ন করল, কটা ব্লাউজ? সালোয়ার কামিজ ক সেট? আমার উত্তর , একটাই , একটা বাচ্ছা মেয়ের জামা, কথা দিয়ে ফেলেছি। ছেলেটি সৌজন্যের হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে একই রকম গলায় বলল, স্যরি ম্যাডাম , আমার এবার বাল্ক অর্ডার ছাড়া নিচ্ছিনা। বেটার নেক্সট টাইম। অফিস আর বাড়ির পথে আরো কয়েকটা দোকানে চেষ্টা করলাম। কোথাও কেউ রাজি নয়। পরিচিত সহকর্মীদের কাছে সাজেসন চাইলাম, সবাই এক বাক্যে বলল, মণিদীপাদি, ওসব প্ল্যান ছেড়ে মেয়েটাকে রেডিমেড জামা কিনে দিন । পুজোর আর তিন সপ্তাহ বাকি, কেউ নেবেনা অর্ডার , তাছাড়া বাচ্ছাদের মরডান লুকের ফ্রক মানেই প্রচুর ঘোটেলা কেস। যেচে ঝামেলা নিচ্ছেন কেন? দোকানে ওকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে ওর পছন্দ মত জামা কিনে দিন , কেস সল্ভড। 

কত সহজে এই প্রজন্ম সব কিছুর সমাধান করে দেয়। সবীকার করছি, বাস্তব সম্মত পরামর্শ ই দিচ্ছে। কিন্তু কী করে ওদের বলব, জামাটা শুধু ঝিমলি পরবেনা , পরবে অনেক ঝাপসা ঝাপসা দিনের পেছনে অপেক্ষায় থাকা, আরেকটা ছোট্ট মেয়ে, যে জামাটা আজ অবধি তার পরা হয়ে ওঠেনি। 

রাখালদা এসেছে, রাখালদা এসেছে। রোববারের সকালে খুশির ছটা। বিশ্বকর্মা পুজোর জন্য পাড়ার সব বাড়ির একতলার বারান্দার রেলিং ঘিরে মাঞ্জা দিচ্ছে কাকুরা, বড়দাদারা। প্যানডেলের বাঁশ, ত্রিপল এই এল বলে। ভোর রাত থেকে বাঁশ পড়ার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যাবে , আর কী ভালই না লাগবে। এর মধ্যে বিশ্বকর্মা পুজোর দুদিন আগেই রাখালদা এসে গেছে। আমরা ছোট মেয়েরা সবাই ভিড় করেছি, মা কাকিমা, পিসি, জ্যাঠাইমা সবাই জড়ো হয়েছে। রাখালদার কানে পেন্সিল, গলায় জড়ানো মাপ নেওয়ার লম্বা ফিতে, হাতে ছোট্ট নোটবুক । তার মধ্যেই ঢুকে যাবে আমাদের প্রাণ ভোমরার খুঁটনাটি। ঘটি হাতা ফ্রক না , মেগিয়া হাতা? হাতা ছাড়া ফ্রক, লো কাট ফ্রক , ডিপ নেক কাট, এক কাটের ফ্রক , গলার কাছে ঘন ফ্রিল দেওয়া ফ্রক--- কত রকমারি বায়না। এর মধ্যে সদ্য বিয়ে হয়ে আসা কোন নতুন কাকিমা হালে দেখা সিনেমার নায়িকার ছাঁদে ফ্যাশনেবল জামার আবদার করছেন, রাগী নন্দী জেঠিমা তার বড় মেয়ের জন্য গলা বন্ধ জামার হুকুম দিচ্ছেন। রাখালদা অবিচলিত , সবার সব বায়না টুকে রাখছেন । মুখ জোড়া হাসি। সব্বার সব জামা এসে যাবে, এই ধরুন, মহালয়া থেকে ষষ্ঠী , না না, কথা এক্কেবারে পাক্কা। কারুর ডেট তৃতীয়া তো, কারুর পঞ্চমী। কাকীমারা কেঊ কেউ রাগ রাগ গলায় সাবধান করেন, নিচ্ছ তো এক গাদা অর্ডার , পারবে কথা রাখতে? প্রতিবার তো এক স্তোকবাক্য আওড়াও । বাচ্ছাগুলো হাঁ করে বসে থাকে। নবমী অব্দি পেরিয়ে যায় --- নেহাত তোমার হাতের কাজ ভাল তাই --- না হলে কি ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হয়। গোলগাল মোটাসোটা রাখালদার এসব কটু বাক্যে বিন্দুমাত্র ভাবান্তর হোতনা। কান ছোঁয়া হাসি ছড়িয়ে রাখালদা চলে যেত, পেছন পেছন আমরা সমস্বরে চেঁচাতাম,রাখালদা আমারটা আগে, কিংবা আমার ঘ্টি হাতা ফ্রকটা কিন্তু ষষ্ঠীর দিনের জন্য। রাখালদা, প্লিজ, আমার অষ্টমীর জামায় লেস একটু বেশি লাগিও। কাকিমারা সামনা সামনি রাগ দেখালেও, রাখালদা চলে যাওয়ার পর একবাক্যে বলতেন, এত শস্তায় এ তল্লাটে কে আর এমন দর্জি আছে? আমরাও না হয় একটু মানিয়ে নেব।

একেকবার এক একটা বাড়ির জামা সব জামা আসতনা।ষষ্ঠী, সপ্তমী, সব পেরিয়ে যায় , রাখালদা সে বাড়ির পথ মাড়ায়না, রাস্তায় ধরা পড়লে হাসি মুখে বলত, আরে জামা রেডিতো, শুধু এই বোতামটা, কিংবা এই তো গলার হেম সেলাই দেওয়ার কাজ চলছে । তবে যাই ঘটুক , অষ্টমীতে অবশ্য সবার সব অর্ডার মাফিক জামা এসে যেত। নবমীতে দোকান বন্ধ করে রাখালদা মেদিনীপুরে দেশের বাড়ি চলে যেত । তখন আমি ক্লাস ফাইভ। নতুন কাকার বিয়ে উপলক্ষে তার শ্বশুর বাড়ি থেকে আমার জন্য আগুন রঙ্গা একটা সিল্কের পিস পাঠিয়েছে। মা , ফুল কাকিমা, নতুন কাকিমা সবাই অনেক গবেষণা করে দারুণ ডিজাইন দিয়েছে। রাখালদা আশ্বাস দিয়েছে, চিন্তা নেই, মণি -মামণির জন্য এই জামাটা হবে আমার এবারের মাস্টার পিস। রাখালদা আমাদের সব ছোটদের নামের সঙ্গে মামনি যোগ করে খুব স্নেহ ভরে ডাকতেন। সারা পাড়ার বন্ধুরা , সারা ক্লাশএর মেয়েরা সবাই জেনে গেল , আমার এবার একটা দারুণ জামা হচ্ছে। ওটা একবার মাকে লুকিয়ে ষষ্ঠীর দিন চুপি চুপি পরে নেব , তারপর অষ্টমীর রাতে--- সবাই বলে আমার গায়ের রঙ ফরসা, মুখখানা না কি ভারি টুলটুলে । আমাদের বাড়ির পাশের গলির তিন নম্বর বাড়ির শান্তনুদা একদিন আমার গাল টিপে বলেছে, মণিরে তোকে বড় হলে যা দেখতে হবেনা! ওই জামাটা পরে ওকে ভাল করে দেখাতে হবে। দেখতে দেখতে সবার বাড়ি জামা আসা শুরু হল। আমার সেবারে মোটে দুটো জামা হবে, একটা প্রতিবারের মত পিসিমার নিজের হাতে বানানো ফ্রক, যা দেখে বন্ধুরা মুখ ভেংচে বলতে, নাই ছিরি নাই ছাঁদ, মণির জামা বরবাদ। অন্যটা বাবার দেওয়া। বাবার ওপর সারা সংসারের ভার, অতএব সবার ভাগ্যে যা বরাদ্দ , আমার জন্য তাই, একটি সুতির ঘটি হাতা ফ্রক। আমার মামার বাড়ির অবস্থা ভাল নয়, কখনো জামা কাপড় দিতে পারেনা। এক মাত্র নতুন কাকা বছরে একবার দামি ফ্রক দেয়। সেবারে খুব হাকোবা চিকণের জামা উঠেছে। কিন্তু বিয়ের পর নতুন কাকার অবস্থা নাকি টানটান , নতুন শ্বশুর বাড়ির জন্য অনেক কিছু কিনতে হবে। অতএব , মায়ের যুক্তি ওইতো ওদের বাড়ি থেকে পাঠানো সিল্কের পিস টাই তোর নতুন কাকার দেওয়া হল। আমার ঘটি ফ্রক মহালয়ার দিন বাড়িতে এসে গেল। রাখালদা , অন্যটা? রাখাল্দার মুখে সবরগীয় হাসি, হবেরে মা, ভাল জামার খাটনি আছে। সবুর কর। 

সপ্তমী পেরিয়ে গেল, অষ্টমীর দুপুর পেরিয়ে বিকেল মরে আসছে, আমার ম্লান মুখ দেখে বাবা সবয়ং ফিল্ডে নামল। সন্ধি পুজো হয়ে গেল, আমি তখনো ঘটি হাতায় আটকে। বন্ধুদের কেউ কেউ সমবেদনা জানাল, পাবি , ঠিক পাবি, কাল পরবি। আজ সবাই পরেছে, কাল সবাই তোকে দেখবে। অনেক রাতে বাবা বাড়ি ফিরল বিরক্ত মুখে, কী নাকি কাপড় কাটাকাটিতে ভুল হয়েছে। এত ভজকট ডিজাইন দাও কেন? 

মা ভিতু গলায় বলল, কাল তো নউমি, রাখাল বাড়ি চলে যাবে। 

বাবা আরো বিরক্ত , তোমার মেয়ের সাধের জামা খুব ভোরেএ বাড়িতে পৌঁছে তিনি নাকি ট্রেন ধরবেন। 

সারা রাত ঘুম এলোনা। ভোর হল, পাড়ার পুজোয় ঢাক বাজা শুরু হল। চান করে সবাই পুজোর ডালা নিয়ে মন্ডপের দিকে যাচ্ছে । বাজার যাওয়ার জন্য বাবাকে রেডি হতে দেখে আমি অস্থির, বাবা তোমার সঙ্গে যাই ----

দূর থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম রাখালদার দোকান খোলা, নি শ্চিন্ত হই , এবার জামাটা পাব। একটু কাছে আসতেই দেখলাম, দোকানের সামনে বহু লোকের জটলা। ভেতরে ডাঁই করা কাটা কাপড়ের স্তুপ। রাখালদার দোকানের দুই কর্মচারী ক্যাশ বাক্স ভেঙে পালিয়ে গেছে। রাখালদা কপালে হাত রেখে মাথা নামিয়ে বসে আছে, আর দুরন্ত গালাগালির ফুলকিতে ছোট্ট দোকান ঘরে মুহুরমুহু বাজ পড়ছে । বাবা বলল, ঠগ, জোচ্চর, ভণ্ড , বাচ্ছাদের ঠকাতে লজ্জা করেনা? আরো কতকি কথা--- বাবার হাত ধরে নিঃশব্দে বাড়ি ফিরলাম। বাকি পুজোটা কেটেছিল খাটে মুখ গুঁজে। বাবা, নতুন কাকা হাকোবা চিকণের জামা কিনে দিতে চেতেছিল। আমি গাঢ অভিমানে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, চাইনা এবারে কোন জামা, হলুদ সিল্কের জামা তো নয়ই , কোনদিনের জন্য নয়। কেঁদে কেঁদে গলায় ব্যথা হয়ে গিয়েছিল। 

সকালে ঘুম ভাঙ্ল গলায় ব্যথা নিয়ে, কাল রাতে ঝমঝমে বৃষ্টি পড়েছে। আমি বা চিন্ময় কেউ টের পাইনি। চিন্ময়কে বলব কাল রাতে দেখা সবপ্নের কথা? না থাক, ওসব আমার একার কথা। তাছাড়া এতদিনে জীবন সঙ্গীকে দিব্যি চিনেছি। ওএসব ঠিক বুঝবেনা, হয়তো বলেই বসবে, বেশ তো কিনে নিলেই পারতে একটা আগুন রঙের সিল্কের শাড়ি, বা চুড়িদার সেট। ঠিক করলাম আজ একবার অফিস ফেরত মার কাছে যেতে হবে। অনেক দিন যাইনি , পুজোর জামা –কাপড় কিনে একেবারে যাব ভেবেছিলাম, কিন্তু ভেতরে ভেতরে কোথায় যেন একটা ক্ষীণ আশা ঘুরপাক খাচ্ছে। সেবারের পর রাখালদার দোকানে বাবা আর আমার জন্য জামা তৈরি করার অনুমতি দেন নি। তবে বছরে দু তিনটে জামা আমার হোত, সেখানেই। মা লুকিয়ে লুকিয়ে ব্যবস্থা করে রাখত। দশ বছর ধরে অনেক কষ্ট করে রাখালদা আবার ভাঙ্গা চোরা দোকানটা দাঁড় করিয়েছিল।ভাইপোরা তারপরে নাকি আরো বড় করেছে। মা কি বলতে পারবে দোকানটা এখন কোথায়? 

রাখালদা কি এখনো বেঁচে আছে মা ? ফোনে প্রশ্ন করতেই মা বেজায় বিরক্ত । আমাকে বলে কয়ে সে কি বেঁচে আছে? নিজের শরীর নিয়ে মরছি, আদিখ্যেতা! হঠাত টাপুর কথা মনে হল, আমার ছোটবেলার বন্ধু , বিয়ে-থা করেনি, পুলিশে চাকরি করে, ওপাড়ায় থাকে। অফিস ফেরত টাপুর বাড়ি যেতেই ও হাঁ । আমার আসার উদ্দেশ্য শুনে কুলকুল করে হাসল, বুঝেছি, ব্লাউসের কিসস্যা। চল, নিয়ে যাচ্ছি , তবে লেট করেছিস মণি। ওর ভাইপো গুলো হেভি খচড়া। পারমিসন দেবে কি? তবে কাটিঙ্গের কাজ ও বুড়ো এখনো নিজের হাতেই করে। 

কত বছর ---- পঁচিশ নাকি আরো বেশি--- এই রাখালদাকে আমি চিনিনা। আলো ঝলমলে দোকানের শেষ প্রান্তে একটা বেখাপ্পা মানুষ, রোগা খয়াটে পাথুরে চেহারা, মুখ খানা নিস্পৃহ। জীবনের সব হাসি ওই মুখ থেকে কেউ কি শুষে নিয়েছে? চেয়ারে বসা অবস্থায় গম্ভীর গলায় বলল, কী হবে? 

টাপু ভারিক্কি গলায় বলল, আমাদের পাড়ার মণি, তোমার হাতের জামা পরে বড় হয়েছে। তুমি না বোলোনা কিন্তু। এক খানা দু খানা ব্লাউজ –ও তোমার হাতের ময়লা। পাথুরে মুখ আরো গম্ভীর , ব্লাউজ হয়না এখানে। 

না, ব্লাউজ না, একটা ফ্রক , বছর সাতেকের মেয়ের মাপে। নমুনা- মাপ সঙ্গে আছে। কাপড় কত্টা লাগবে? আমি মণি রাখালদা। চিনতে পারছনা? 

হাতে মোবাইল ফোন নাচাতে নাচাতে রাখালদা হাসল, আমি কাপড় চিনি, মাপ নিই, কাস্টমার মনে রাখা আমা্র কাজ নয়। এ দোকানে ভাল কাপড়ের স্টক আছে, পছন্দ করুন , তারপর আসুন। 

মজুরি কত বলবেনা ? 

ডিজাইনের ওপর রেট হয়। 

আগুন রঙ্গা না হলেও গাঢ কমলা , হলুদের অনেক গুলো শেডের সিল্কের কাপড় পেলাম। 

এবারে ডিজাইন দেখাও। 

দরকার নেই। এতকাল বাদে যখন কষ্ট করে এসেছেন, যা চেয়েছিলে্ন তাই পাবেন। সাতদিন বাদে এসে নিয়ে যাবেন। ঠিকানা , হ্যাঁ, ফোন নাম্বারটাও রেখে যান ।

আডভ্যান্স কিছু দিতে হবে? 

নিশ্চয়ই। 

কত? 

বেশি না, কথার খেলাপের সম্ভাবনায় কিছু গরম গরম কথা আর----

রাখালদা! 

জানি গো মণি মামণি, তোমার সেই আগুন রঙ্গা সিল্কের জামাটা একদিন আমায় করে দিতেই হবে, এতো আমার জানাই ছিল, শুধু কবে সেটা জানতাম না, --- বিশ্বাস করো এবার আর ----

আমায় যেতে হয়নি, যত্ন করে প্যাকেট বন্দী জামা পাঁচদিনের মাথায় আমার ফ্ল্যাটে পৌঁছে গেল। ভেতরে ছোট্ট চিরকুট, “মণি মামণি, অদেখা , তোমার ভালবাসার ছোট্ট মানুষটির জন্য আমি যত্ন করেই জামাটা তৈরি করেছি, যেমন চেয়েছিলাম তোমার জন্য--- অনেক কাল আগে। আফশোষ একটাই আমি যে ভন্ড নই শুধু তোমার বাবা সেটা জেনে যেতে পারলেন না। এ জামার মজুরি হয়না, সেটা দেওয়া বা নেওয়ার ক্ষমতা তোমার আমার কারুর নেই। পারলে মাঝে মাঝে এসো “ 

ভাবিনি, জামাটা ঝিমলির এত পছন্দ হবে। আর তার থেকেও বেশি পছন্দ হয়েছে তার মায়ের। কল্পনায় দেখছি সারা পুজোয়-- সপ্তমী অষ্টমী নবমীতে ঝিমলি আগুন রঙ্গা প্রজাপতির মত ছুটে চলেছে পাড়ার পুজো মন্ডপে। ও কে? ঝিমলি? না ক্লাস ফাইভের মণি? নতুন কাকার শবশুর বাড়ি থেকে পাওয়া সেই আগুন রঙ্গা সিল্কের কাপড়ের জামা গায়ে আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে।! 

ঝিমলির হাসিতে ছড়িয়ে যাচ্ছে জীবনের অমল আনন্দ , আনন্দ ছাড়া জীবনের উৎসব হয় নাকি? 

মা-কে বলতেই হবে, জানো মা, পৃথিবীতে এখনো অনেক রাখালরা বেঁচে আছে, নিভৃতে বাঁশি বাজিয়ে আজো তারা ডাক দেয়, আর তাইতো জীবনেড় পড়ন্ত দিনেও কত গোপন, মধুর্ আগুন রঙ্গা আনন্দ-উৎসবের সবাদ পাওয়া যায়! বাবা এই সত্যিটা শুধু জেনে যেতে পারলনা।

krishna.roy@rediffmail.com

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সুচিন্তিত মতামত দিন

নবীনতর পূর্বতন