জীবনের চলার পথে তৈরি হয় নানান অভিজ্ঞতা। কখনও তা মানুষকে ঘিরে,কখনও কোন গ্রাম কিংবা শহরকে ঘিরে আবার কখনও কোন বিশেষ সম্প্রদায়, তাদের রীতিনীতি-উৎসবকে ঘিরেও। এভাবেই জানা ও চেনার পরিধিতে এসে পড়েন এমন কিছু মানুষ যাদের তথাকথিত ভদ্রলোক বা শহুরে, শিক্ষিত লোক কেউ বলেন না, তারা গ্রাম্য, ব্রাত্য সংষ্কৃতির লোক হিসাবেই পরিচিত। আজ এইরকমই এক সম্প্রদায়ের একটি পরব বা উৎসব সম্বন্ধে বলব, যাদের খুব ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি।
পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান,বীরভূম, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া ইত্যাদি জেলাগুলিতে আদিবাসীদের অবস্থান লক্ষণীয়। তৎকালীন বিহার এবং বর্তমান ঝাড়খন্ডেও আদিবাসীদের অবস্থান যথেষ্ট বেশী। জন্ম পূর্বতন বিহার,অধুনা ঝাড়খন্ডের প্রত্যন্ত গ্রামে হওয়ার জন্য খুব ছোটোবেলা থেকেই এইসব আদিবাসীদের চাল-চলন, রীতিনীতি, উৎসব, পরব এসবের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। রাজনৈতিক কারণে গ্রামটি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত হলেও গ্রামটির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কোন হেরফের হয় না। চতুর্দিকে ছোট ছোট টিলা, উঁচু-নিচু ধানক্ষেত আর শাল-মহুয়ার জঙ্গল ঘেরা এই ছোট্ট গ্রামটিতে কয়েকঘর মাত্র ব্রাহ্মন ছাড়া বাকি সবই আদিবাসী। তারা হল মাহাত, কুর্মি, রাজোড়, সাঁওতাল ইত্যাদি। মূলতঃ এই সব পরিবারের পুরুষদের উচ্চবর্ণ পরিবারগুলির জমিতে জন মজুর খাটা এবং মেয়েদের গৃহস্থ বাড়িগুলিতে ফাইফরমাশ খাটার কাজ করতেই দেখেছি। তাদের ঘরদোর ছিল নিকোন, একেবারে ঝকঝকে,তকতকে। বিহার অঞ্চলে দুর্গাপূজার চেয়েও কালীপূজা বা দেওয়ালির জাঁকজমক বেশী। আর ঠিক এই সময়েই দেখেছি ওদের বাঁধনা উৎসব। আদিবাসী সমাজের পরিবারগুলিও অর্থনৈতিক ও অনেকসময় রাজনৈতিক কারণে বিভিন্ন অঞ্চলে আজ ছড়িয়ে পড়েছেন। ফলে একই পরব আঞ্চলিক প্রভাবে অন্য নাম, বা অন্য আচার নিয়মে পালিত হচ্ছে। মূল কিন্তু এক। বাঁধনা উৎসবটির কথা বলি।
উৎসবের কয়েকদিন আগে থেকেই তাদের ঘরদোর নিকোনর কাজ শুরু হয়। এই উৎসবটির কথা বলছি, কারণ আমাদের গ্রামে কালিপুজো আর বাঁধনা পরব, এই দুটিই ছিল আদিবাসী অধ্যূষিত গ্রামটির সবচেয়ে বড় উৎসব। গায়ে গায়ে লাগানো দুটি উৎসবে আদিবাসীদের সঙ্গে ব্রাহ্মণ পরিবারের মানুষগুলিও মেতে উঠতেন। চাষবাস সকলেরই আছে, বছরে একটা দিন তাই গরু-বাছুর-মোষ( ওদিকে চাষের জন্য বলদের চেয়ে মোষের ব্যবহারই বেশী) তাদের আদরযত্ন করা সকলেই ভালো চোখে দেখতেন। আদিবাসীদের মত বাড়ি বাড়ি টাকা চাইতে খাওয়া, হাঁড়িয়া খাওয়া, সারাদিন ধরে নাচা-গানা এসব ছিল না ব্রাহ্মণ পরিবারগুলিতে, ছিল না পরদিন গরু-খুঁটাও। কিন্তু একটা দিন গরু-মোষদের শিং-এ তেল মাখানো,তাদের ভাল করে খেতে দেওয়া, একটা দিন কোন কাজ না করিয়ে তাদের বিশ্রাম দেওয়া এগুলি পালিত হত। ব্রাহ্মণ পরিবারগুলিতে গোয়ালে আলপনা দেওয়া হত, যে আলপনার রং ছিল সাদা। বেশীর ভাগই পিটুলির
গোলা দিয়ে, তবে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য আলপনার মাঝে মাঝে সিন্দুরের টিপ ছাপ দিতাম আমরা ছোটোরা। আদিবাসীদের আলপনা কিন্তু নানা রঙের হত, যে রং তারা নিজেরাই তৈরি করত নানা রকম ভাবে। কাঠকয়লা পুড়িয়ে কালো রং করত, মনে আছে। বিশেষ করে আমরা তাদের বাড়ি গিয়ে সেই রং মুখে লাগিয়ে গোঁফ আঁকতাম। পোড়া ইঁট দিয়ে লাল রং করত। ভারি সুন্দর রং হত, যা তারা ঘরের আলপনায় দিত। বাঁধনা পরবের দিন সকাল থেকেই মেয়ে-পুরুষ নির্বিশেষে দফায় দফায় চলত নাচ আর বাড়ি বাড়ি টাকা-পয়সা চাওয়া, যে টাকা দিয়ে তারা হাঁড়িয়ার সঙ্গে খাবার জন্য মুরগী কিনত, মাংস কিনত। বাঁধনা পরবের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল গর-খুঁটা বা গরু-বাঁধনা। একটি গরুকে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় একটি খুঁটিতে বেঁধে রাখা হত। দফায় দফায় তাকে উত্যক্ত করে তোলা হত, খেপিয়ে তোলা হত বলাই ভালো। তারপরে সেই গরুকে ছেড়ে দিয়ে তার সঙ্গে লড়াই হত আদিবাসী যুবকদের। আমরা ছোটোবেলায় এইখেলা দেখার কোন অনুমতি পেতাম না, যেতে দেওয়াও হত না। কিন্তু পরে বড় হয়ে অন্যত্র এইখেলা দেখেছি। অনেকটা স্পেন দেশীয় বুল-ফাইটিং এর মত। আদিবাসী যুবকদের কাছে এই খেলা ছিল তাদের বীরত্বের প্রতীক এবং তা যথেষ্ট সম্মানের।
পরেও এই অনুষ্ঠানটি বর্ধমানের কাছে একটি গ্রামে দেখার সুযোগ হয়েছিল। রীতিনীতি কিছু এক হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, শিক্ষার প্রলেপ পড়ার জন্য, শস্য ফলনের সময়টি বদলে যাবার জন্য এবং অপেক্ষাকৃত আধুনিক মনস্কতার জন্য বলতে কোন দ্বিধা নেই,আদিবাসীদের যে সকল পরবগুলি সেই সময়ের বিহার,ঝাড়খন্ড অঞ্চলের গ্রামে দেখেছি, তুলনায় তার অনেক পরিবর্তন হয়েছে বর্ধমান ইত্যাদি অঞ্চলে। কোথাও সেই আদিবাসী সমাজের কঠোর নিজস্বতা চোখে পড়েনি। এমন কি আদিবাসীদের সবচেয়ে পবিত্র পূজার থান হল ‘জাহের থান’, যেভাবে আমরা দেখে অভ্যস্ত, তাও যেন হিন্দুদের তুলসীতলার আকার নিয়েছে। ধর্ম মানুষ তার নিজের প্রয়োজনেই সৃষ্টি করেছে, সুতরাং কতটুকু নেবে, কতটুকু বিসর্জন দেবে, সে তার নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু যে আদিবাসীদের অন্যতম বৈশিষ্ট্যই হল গোষ্ঠীর স্বতন্ত্রতা, তা কিন্তু কোথাও কোথাও অনেকাংশেই আজ ক্ষুণ্ণ। কোথাও ইচ্ছাকৃত, কোথাও অনিচ্ছাকৃত।
বর্ধমান থেকে ঢিল ছোঁড়া দুরত্বে গর্দানমারি, একটি আদিবাসী অধ্যূষিত গ্রাম, যদিও গ্রামের অধিকাংশ পরিবারই যীশুবাবার ভক্ত। অনেক বাড়ির ঘরে ঢুকবার মুখে দরজার উপরে যীশুবাবার ক্রশ ঝোলানো। কিন্তু তাতে কি! –ও পরব-পালে আমরা সবাই এক হঁইয়ে যাই। সব মানাই।‘
--সব মানাই মানে, কি কি?’ আমি জিজ্ঞেস করি যে মানুষটীকে, তার বয়স প্রায় তিন কুড়ি।
--আমাদের পরব গুলান,... ধরুন... বাহা আছে, করম আছে, সোহরাই আছে, তারপরে আপনার বড়দিন আছে, উঠবার দিন..মানে বাবা যেদিন উঠলেন....’
--উঠবার দিন মানে? মানে,গুড ফ্রাইডে?’ আবার জিজ্ঞেস করি তাকে।
-- হাঁ, যীশুবাবার ...সব!’
--কিন্তু এখানে তো বাঁদনা হয় না, এই শীতের সময় সোহরাই হয়, নিয়ম তো একই, তাই না?’
আমি বলি।
--হাঁ...একেই...যে জায়গার যে নিয়ম। ইখানে সোহরাই বলে। নিয়ম একেই বটে...!’
আমাদের ওখানে বিহারের গ্রামে কালী পুজোর সময় যে বাঁধনা পরব দেখেছি, সেটিই এখানে অনুষ্ঠিত হয় সোহরাই নামে, কিন্তু মাঘ মাসে। যাবার সময় পথে এই গ্রামের বন্ধু মেরী সোরেনের সঙ্গে আলাপচারিতায় যেটুকু জেনেছি। মেরীর সঙ্গে আমার পরিচয় সেক্রেড হার্ট চার্চে। কি একটা কাজে গিয়েছিলাম অনেকবছর আগে। তারপর থেকে প্রতি বছর বড়দিনের দিন দেখা হবেই। আমিও যাই ওখানে মোমবাতি জ্বালাতে। খুব ভালো লাগে এই অনুষ্ঠানটি। ঠিক যেন আমাদের মন্দিরে প্রদীপ দেবার মত। সেখানেই মেরী আমায় বলেছিল---সোহরাই আসছে,কদিন পরেই। যাবে দেখতে?’
--যদি নিয়ে যাও’
একদিনে তো হবে না, দুদিন যেতে হবে। নইলে বুঝতে পারবে না। একদিন পূজা, আর একদিন হাঁড়িয়া,গরু খুঁটা...’
--বেশ তো, তাই যাব!’ উৎসুক হয়ে উঠি আমি। মাঘ মাসের সেই সময় ওদের সোহরাই হয়। এমন সুযোগ কি কেউ হারায়!
গর্দানমারির ‘জাহের থান’ দেখে আমি অবাক। এর আগেও বেশ কয়েকটি আদিবাসী গ্রামে গেছি। ঠিক শাল-জারুল-মহুয়া গাছ দিয়ে ঘেরা না হলেও কয়েকটি গাছ দিয়ে ঘেরা একটুকরো সবুজ জায়গা চোখে পড়েছে গ্রামের এক প্রান্তে, কোথাও আবার মধ্যখানে, যা তাদের অতি পবিত্র স্থান ’জাহের থান’, যেখানে ওদের সমস্ত রকম পুজোর কাজ হয়। এই গ্রামেই প্রথম দেখলাম সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো একটি বেদী,তার তিনটি ঘর করা আছে। সেটিই এই গ্রামের ‘জাহের থান’। তিনটি ঘর ওদের মারাং বুরু আর দুই দেবতার জন্য নির্দিষ্ট করা আছে।
পূজার কয়েকদিন আগে থেকেই নতুন ধান দিয়ে তৈরি করা হয় মুকুট, যা এক একটি পরিবারের সব গরু,মোষকেই পরানো হয়। গরুদের পায়ের নখে, শিং-এ তেল দিয়ে ভালো করে মালিশ করা হয়। গরুগুলিকে বরণ করেন পরিবারের মেয়েরাই। চলে অনেকসময় গাই রাঙ্গানো। অর্থাৎ কোন একটি কৌটোর ঢাকা বা ওইধরনের কিছু একটা রঙের মধ্যে ডুবিয়ে গরুদের পিঠে ছাপ দেওয়া হয়। একে বলে গরু রাঙ্গানো। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় মনে হয়, বিভিন্ন পরিবারের গরুগুলিকে একসঙ্গে চরাতে নিয়ে যাবার ফলে যাতে চেনার উপায় থাকে, তাই এটি করা হয়। কাজটি এই সময় করা হয় বলে এটিও উৎসবের অন্তর্গত হয়ে গেছে।
সোহরাই পূজার দিন কিন্তু পূজাটি অনুষ্ঠিত হল মাঠের মধ্যে। নতুন ধান উঠে গেছে, ফলে মাঠ এখন খালি। নতুন ধান কেটে নেওয়ার ফলে ধান গাছের গোড়া লেগে আছে মাঠময়। সেই খালি জমিতে পুজো হল।
![]() |
সোহরাই পূজা |
সোহরাই পূজার উপকরণ হল একটি কুলোতে করে একটি কলা ও অন্য একটি ফলের কয়েকটি কুচি। মাঠের যে জায়গাটিতে পুজো হয়েছে, সেটি সামান্য একটু গোবর আর মাটি দিয়ে হাতে করে নিকিয়ে নেওয়া হয়েছে। তার উপর চাল গুঁড়ি ছড়িয়ে দেওয়ায় হয়েছে। পাঁচটি অথবা সাতটি সিন্দুরের টিপ কিংবা লম্বা করে দাগ দেওয়া হয়ে থাকে। কাঁঠাল গাছের ডাল থেকে কয়েকটি পাতা এনে রাখা হয়েছে। আর আছে একটি মুরগীর ডিম, তাতে সিঁদুর আর হলুদ মাখানো। ডিমটি ছোট মুরগীর ডিম...পরের দিন গরুগুলিকে ছেড়ে দেওয়া হয়, যে গরুটি এই ডিমটি মাড়ানো হবে, তাকেই খুঁটিতে বেঁধে গরু খুঁটার খেলা শুরু হবে। বলে রাখা ভালো, আদিবাসী সমাজের উৎসব গুলি মূলতঃ প্রকৃতিকে ঘিরেই হয়ে থাকে। প্রাচীনকাল থেকেই গাভীকে গোধন হিসাবে মান্য করা হয়ে থাকে। নতুন ধান, ধানের মুকুট এ সবই কৃষিকাজের সহায়ক, এখানে রূপক অর্থে ব্যবহৃত। আদিবাসী সমাজের মানুষগুলি যে কৃষিনির্ভর, এ তো জানা কথাই। এই ডিম এবং গরুর পা দিয়ে ( ষাঁড়) মাড়ানো ব্যাপারটি আসলে প্রজনন ক্রিয়ার রূপক। গ্রামের আদিবাসী মেয়েদের কাছে সেইরকমই শোনা গেল। তাহলে আদতে কি এই অনুষ্ঠান সেই আদি ও অকৃত্রিম প্রজনন দেবতার পূজা? ছোটোবেলায় যে বাঁধনা পরবের রীতিনীতি দেখেছিলাম, বয়স কম থাকার কারণেই হোক, কিংবা ভাল করে খুঁটিয়ে তা না দেখার জন্যই হোক, এই দিকটি সম্বন্ধে জানা ছিল না।
পরের দিন এখানেও হয় গরু খুঁটা বা গরু খেলানোর পরব। কোন এক যুবকের হাতে থাকে একটী কাপড়ের টুকরো, যা দিয়ে সে অনবরত গরুর চোখের সামনে কাপড়টি দোলায়, তাকে উত্তেজিত করে তোলার জন্য। সঙ্গে চলে ধামসা আর মাদলের বাজনা। মানুষের চীৎকার তো আছেই। উত্তেজনার চরম প্রকাশ! পূজা হয়ে গেলে সেই মাঠে বসেই চলে হাঁড়িয়া পানের আসর। তবে গর্দানমারি গ্রামে বয়স্কা মহিলারা হাঁড়িয়া পান করলেও অন্যান্য মেয়েরা কেউ হাঁড়িয়া পান করেন না।
আদিবাসীদের পূজার কোন মন্ত্র নেই। শুধুমাত্র প্রার্থনা জানানো হয় দেবতার কাছে। এই প্রার্থনাগুলি অনেকটা যেন আমাদের বৈদিক যুগের দেবতাদের কাছে প্রার্থনার মতই। যখন বেদ-উপনিষদের যুগে আমাদের দেবতার কাছে প্রার্থনা করা হোত—বৃষ্টি নেমে আসুক, পৃথিবী শস্যপূর্ণ হউক,গাভীরা সুরক্ষিত থাকুক, আমাদের নারীরা গর্ভবতী হউক ইত্যাদি।
আদিবাসীদের প্রার্থনাও সম্পদে পরিপূর্ণ শস্যশ্যামলা এক পৃথিবীর। এ প্রার্থনা তো আমাদের সকলের।
ছবি---ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়
দেবরাজ রায় (বাঁধনা পরবে আলপনা দেবার ছবি)
@Jharna Chattopadhyay
সুচিন্তিত মতামত দিন