জয়া চৌধুরী

আজাইরা বাজার কথন ১০.. জয়া উবাচ /

প্যারামাউন্ট মিষ্টি হাসি দেখবি তোরা আয় ... প্যারামাউন্ট মিষ্টি হাসি দেখবি তোরা আয়...ঘুরে ফিরে এই দুটি চরণ মন্দ্রিত হচ্ছিল চারপাশে। মানে গুরু গম্ভীরে নয় মুখ ব্যাদান করে ঠাঠা পোড়া ভাদুরে রোদে গাঁক গাঁক করে মাইকে গুঞ্জরিত হচ্ছিল সেই লাইন। এই তো সেদিন রবিবার দুকুর তিনটেয় এক সাহিত্য সভায় অনুবাদ কবিতা চেঁচাতে গেছিলাম। উদ্যোক্তাদের “লাঞ্চের” নেমন্তন্ন রক্ষা করতে দুটি ভাত মাছের মুড়োর ফোটোকপি ও কুচো আলুমিশ্রিত মুড়িঘন্ট এবং এক পিস রুই মাছের লেজের ওপর দিককার টুকরোর ঝোল খেয়ে ( কড়া করে ভাজা ছিল অবিশ্যি) ইদিক উদিক চাইছিলাম কিছু মুখ মিষ্টি করার জন্য। পানাসক্ত নই বলে আর কী কেনা যায় ভাবতে ভাবতে হঠাত চোখে পড়ল প্যারামাউন্ট শরবতের বিখ্যাত সেই দোকানটি। দুপুরে সেটির সবুজ দোর বন্ধ করা ছিল আর সিঁড়িতে আপনমনে খেলছিল নিকটস্থ ফুটপাথের শিশুরা। সতৃষ্ণ বিফল ফিরে এসেছিলাম সেদিন। স্প্যানিশের মায়াঘোরে ভুলে গেছিলাম সে ঘটনা। কিন্তু মগজ ভোলে নি । লোভাতুর মগজই আজ শুনিয়ে দিল- প্যারামাউন্ট মিষ্টি হাসি দেখবি তোরা আয় ... রিচারজের দোকানীকে বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম এই এলাকায় হঠাত প্যারামাউন্টের হাসি কথা কেন? ওরা কী কোন ফ্র্যাঞ্চাইজি নিলেন? আমার বিস্ময়ে সুপার বিস্মিত তিনি বললেন- মানে??? তারা মায়ের পুজো হচ্ছে তো। ওই জন্যই মাইকে গান বাজছে তারা মায়ের মিষ্টি হাসি...।

ক্ষী কান্ড!! মন তুই এমন খাইখাই বাতিক কবে থেকে হলি, অ্যাঁ? বুঝলেন মন যা চায় মানুষ সেটাই শোনে বা দ্যাখে। সে আপনি সত্যি দেখিয়ে বা বলে যতই গুঁতোতে থাকুন না কেন মানুষের মন এমনি অবাধ্য। তাই বলে কি এটাকেও নিয়ম বলা যাবে? তাহলে বাড়ির পাশ দিয়ে পিঠে বস্তা নিয়ে যে মানুষগুলো চেঁচাতে চেঁচাতে যায় ...কাগে এ এ এ এ পেপাআআআআআআ বলে সেখানে পূর্ণ রূপে কোন শব্দই তো নয় সেখানে সে কী বোঝানো হয়? সে জানি আপনারা না বলতেই বুঝে ফেলেছিন সেটি পুরনো পেপার বিক্রির হাঁক পাড়ছিল। কিন্তু যে বলছে সে নিজে কি শব্দগুলোর পুরোটা জানে? কিন্তু ব্যবহারটি সে জানে। পাড়ার পথে পথে কাগেএ এ এ এ এ বলে হাঁক পাড়লে বিক্রেতারা বুঝে যাবেন কোন হারানিধি এখন পাড়ায় এসেছে। যেভাবে - সিল কাটাউ... সিল কাটাউ... বলে হাঁক পেড়ে হকার বুঝিয়ে দেয় সে শিল খোদাই করতে এসেছে কিংবা ভোঁতা বঁটিতে শান দেবার লৌহচক্র চালিয়েই সে এ পাড়ায় এসেছে। ছোটবেলায় শিল খোদাই কাজ আমার ভারী কৌতূহলের কেন্দ্র ছিল। কেমন করে ঠুকঠুক করে পাথর ছেনে পরিপুষ্ট একটা মাছের ছবি ফুটে ওঠে নিরেট শিলের বুকে ভেবে অবাক লাগত। আমার জীবন বিজ্ঞানের খাতার পাতায়ও অমন মাছ আঁকতে পারতাম না আমি। গুঁড়ো গুঁড়ো একটা হাওয়া তখন চারপাশে ছটকাত। মানে হাওয়াটা হাওয়াই ছিল তাতে শুধু মিশত পাথর গুঁড়ো। আর আমার মন উসখুস করত ইস... আমি যদি শিল খোদাইয়ের সুযোগ পেতাম! আর প্যাডেল ঘুরিয়ে দা বটি ধার দেওয়া তো বিশেষ আগ্রহের ব্যাপার। এমন আলো ছলকাত চাকার গা বেয়ে আমার মনে হত চন্দননগরের লাইটিং এর মত ম্যাজিক জানে শিল খোদানোর লোকটা বুঝি। 

আচ্ছা সব্জী শব্দটির ব্যবহার আমাদের ছোটবেলার রান্নাঘরে দেখেছেন পাঠক? আমার কিন্তু মনে পড়ে না এই সব্জী শব্দটি আমাদের মা ঠাকুমারা ব্যবহার করতেন বলে। এখন কাষ্ঠ বাঙাল ঘর বলে তরকারি বলা হত কীনা তা বলতে পারব না। তবে প্রথম শব্দটা শুনি বিহারে গিয়ে। দেওঘরে দোকানে সিঙ্গাড়ার হাঁক পড়তেই সে দোকানী সামোসা হ্যাঁয় বলে আমারই কান পাকড়ে সমঝাইয়ে দেয় আমি বঙ্গালের বাহারে এসে পড়েছিনু। শীতের দেওঘরে কড়াইশুঁটির সিঙ্গাড়ার স্বপ্নে বিভোর আমায় হতাশ করে সে জানিয়েছিল ভিতর মে আলু কা সব্জী পুর হ্যাঁয়। সেই সন্ধ্যেয় জ্ঞানোন্মেষ ঘটেছিল আমাদের বাড়ির তরকারিই হোটেলে গেলে সব্জী ঘোষিত হয়। আবার সে জ্ঞানও বাতিল হয়ে যায় পরবর্তীতে। পাহাড়ী এলাকায় কলকাতার বাইরে গেলে হোটেলে রাতে রুটি আর সব্জী পাওয়া যায় বললে নির্ভুল আন্দাজ করি সেটি বিশুদ্ধ আলু কা ঘ্যাঁটই হোগা। এখানে সব্জী মানে চতুষ্পদের খাদ্য নয় বরং বিলিতি আলুর কথাই বলা হচ্ছে। 

সেদিন বাজারে গিয়ে শুনি এক বুড়ো মাছওয়ালা লুঙ্গি গুটিয়ে উবু হয়ে শান বাঁধানো চাতালে বসে হাঁক পাড়ছে- জ্যান্ত বাটা জ্যান্ত বাটা। মাত্র আশি টাকা কেজি। জ্যান্ত বাটা তেল চপচপে জ্যান্ত বাটা। এমন তেল পাবেন কে তেলে বিনুনি বাঁধবেন বাড়ির মেয়েরা। বুঝুন কান্ড! বাটা মাছের তেলে চুল বাঁধার এই অমোঘ আইডিয়া তো বাজারেই মিলবে। সে তেলে আঁশটে গন্ধের কথা ভুলে দলে দলে দৌড়ে আসবেন কর্তারা দুটি বাটা মাছের ঝাল খেয়ে পিত্তি রক্ষার লোভে। না হে উহারা গন্ধের কথা ভাববেনই না। উহারা জ্যান্ত পোর্শন টুকুই শুনবেন। বলেছি না মানুষ ততটুকুই শোনে যতটা সে শুনতে চায়। ক্রেতার ভাল করেই জানা আছে মাথায় তেল বাড়ির মেয়েরা মাখে না এখন। বিশেষ করে শহরে তো নয়ই । অতএব তেলের গন্ধ বাদে আশি টাকা আর জ্যান্ত থাকার গ্যারান্টিই বেলা এগারোটা সাঁইত্রিশে পচা মাছ কেনাতে টেনে আনবে খ’ন। 

ছেলেবেলায় এক নিকটাত্মীয় বৃদ্ধকে দেখতাম। বেশ বেশি বয়সে তার চরম অবিচারের শিকার এক পুত্রের কাছে থাকতেন। সেই পুত্রবধূ ভদ্রলোকের সারাজীবনের অন্যায় কাজের বিরুদ্ধে কোন নালিশ করতে গেলে তিনি শুনতেই পেতেন না। কী কও বউমা? অ্যাঁ? কিছুই শুনতে পাই না। কিন্তু বউমাটি যখন খাওয়ার তদারক করতেন কিংবা বৃদ্ধের অরুচি জিভের উপযোগী কোন খাবার তৈরী করে দিয়ে যেতেন। খাবার খাওয়ার পরে যদি জিজ্ঞেস করতেন- কেমন খাইছেন বাবা? তিনি দিব্য শুনতে পেতেন – হ হ খাইছি। মোচার ঘন্টটা বেশ সোয়াদের হইল আইজ। কী দিস এর মইধ্যে? তোমার শাশুড়ি মায়ের হাতে এইটি যা হইত… 

মোদ্দা কথা হল আমরা যা শুনতে চাই তাইই শুনি যা জানতে চাই তাইই জানি আর যা মানতে চাই তাইই মানি… বুঝলেন? 

jayakc2004@yahoo.co.in


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.