ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

আদরের ফিলি
আদরের ফিলি (পর্ব - ১) 

আমেরিকার ফিলাডেলফিয়া শহরটির স্থানীয় আদুরে নাম হল ফিলি। পেনসিলভেনিয়া রাজ্যের অন্যতম বড় শহর এটি। আর প্রাচীনও বটে। উত্তরপূর্ব আমেরিকার একটি জনবহুল এই শহর ডেলাওয়্যার এবং স্কুকিল ( Schuylkill ) নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত। পেনসিলভেনিয়ার ফাইনন্সিয়াল হাবও বটে। আর এখানেই রয়েছে আমেরিকার আইভি লিগের অন্তর্ভুক্ত অন্যতম প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় ইউ-পেন বা ইউনিভার্সিটি অফ পেনসিলভেনিয়া। এখানে গবেষণারত পুত্রের দৌলতে ইউ-পেনের আনাচকানাচ পরিদর্শণ হয়ে গেল। কলকাতা থেকে মুম্বাই হয়ে ফিলাডেলফিয়া পৌঁছালাম যথাসময়ে। একটু বিশ্রাম নিয়েই বেঞ্জামিন ফ্র্যান্কলিনের গল্প শুনতে শুনতে পায়ে হেঁটেই পৌঁছে গেলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্দর মহল্লায়। পুরণো কাঠ-ইঁট-পাথরের গন্ধ যেন। দুপাশে সবুজ গাছের ক্যানোপি ঘেরা পথ দিয়ে হাঁটতে গিয়ে মনে পড়ে যায় ইউরোপিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কিটেকচার। কত বড় এই বিশ্ববিদ্যালয়। কত বিষয়ে গবেষণা এবং পাঠের সুযোগ। মুগ্ধতা আসে পরিবেশ দেখে।

বৈজ্ঞানিক বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন মানে যার গল্প আমরা ছোট থেকে বিজ্ঞান ব‌ইতে পড়ে এসেছি, যিনি আকাশের বজ্রের সঙ্গে বৈদ্যুতিক শক্তির যোগাযোগ পেয়েছিলেন, সেই ফ্র্যাঙ্কলিন হলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা । আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার মূলেও এনার নাম উঠে আসে অনেকের সঙ্গে। কলেজের মাঠে বিশাল ব্রোঞ্জের স্ট্যাচু এনার। আবার একটি চেয়ারে তাঁর বসে থাকা ক্যাজুয়াল একটি স্ট্যাচুও নজর কাড়ে। ছবি তোলার লোভ সামলানো যায়না। তিনি পড়ছেন অমেরিকার স্বাধীনতার খসড়াটি। মাঠের ওপর পড়ে থাকা একটি ভাঙ্গা বিশালাকার সাদা বোতাম। সেটি বেঞ্জামিনের স্মৃতিতে নির্মিত। শোনা যায় তাঁর কোটের একটি বোতাম নাকি পড়েছিল ঐ স্থানে। তাই শ্রদ্ধা জানিয়ে একটি স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ। মাঠের ওপর বিশাল একটি টুকটুকে লাল LOVE সৌধ। সারা ফিলাডেলফিয়ায় এই ভালোবাসা, ভ্রাতৃত্বের বাতাবরণ নাকি ছড়িয়ে রয়েছে। City of brotherly love বলা হয় উপছে পড়া কৃষ্ণাঙ্গ জনজাতির ফিলাডেলফিয়াকে।

পৃথিবীর প্রথম অসামরিক কম্পিউটারটি তৈরী হয়েছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। কম্পিউটার সায়েন্স ল্যাবে ঢুকে ঝটিতি সেই প্রকান্ড দেওয়াল গণক যন্ত্রটির দিকে তাকাই। ভয় করে। আমাদের আদি অনাদি ডেস্কটপ থেকে ল্যাপটপ ও তার পর পাম টপ, ট্যাবলেট ও সবশেষে মুঠোফোনের সবটুকুনিই এখন বাস্তব। ছোট্ট পরিসরে বৈজ্ঞানিক সত্যিটা ছোট হতে হতে কত ছোট হতে পারে তা দৈনন্দীন জীবনে প্রতিমূহুর্তে আমরা অনুভব করি কিন্তু এই সুপ্রাচীন কম্পিউটারটিতে এখনকার যন্ত্রের ডিএনএ টি যে সুপ্ত ছিল তা আর কে জানে? প্রকান্ড দেওয়াল জুড়ে কম্পিউটার। তার গায়ে বিচিত্র সুইচবোর্ডের মত নেটওয়ার্ক। এটি যেন প্রপিতামহ কম্পিউটার। কাঁচের আড়ালে সেটি যত্নে রক্ষিত। তাই ছবি তুললেই রিফ্লেকশান। অতএব না তোলাই শ্রেয় মনে হল। কেউ যেন বলে ওঠে, ছবি তুলো না, কোনো শব্দ কোরোনা। প্রপিতামহ নিদ্রা গিয়েছেন। 

পায়ে হেঁটে অথবা ট্যাক্সি নিয়ে যাওয়া যায় সাউথ স্ট্রীট। স্কুকিল নদীর ব্রিজএ গিয়ে উঠি। ক্রিশক্রস ভাবে এমাথা থেকে ওমাথা ব্রিজের ওপর দিয়ে রাস্তা চলে গেছে। বিকেলের পড়ন্ত রোদ্দুরে স্কুকিল নদী। গাড়ির শব্দে নদীর বহমানতার আওয়াজ নেই।এই নদীতে আমাদের মাগুর মাছের অনুরূপ ক্যাটফিশ এবং রুই এর মত দেখতে কার্প পাওয়া যায়। বেশ কয়েকজন উদ্যোগী মহিলাকে দেখা গেল নদীর তীর থেকে জাল, ফাতনা, বঁড়শী নিয়ে উঠে আসতে। সবুজ ঘাসে পাতা লোহার চেয়ারে গিয়ে বিশ্রাম নিয়ে আবার চলি। বিধ্বংসী ৯/১১ র স্মৃতিসৌধ রয়েছে। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের একটি ভাঙা লোহার বিম প্রোথিত রয়েছে সেখানে। আর সেই ভয়াবহ কাণ্ডে ফিলাডেলফিয়ার তিনজন ভিক্টিমের নাম রয়েছে লেখা। একটু নীরবতা। আবার হেঁটে পেরোই পথ। এবার দাঁড়াই ফিলির অন্যতম বৃহত রেলস্টেশনে। নাম থার্টিয়েথ স্ট্রিট। অ্যামট্র্যাক সহ লোকাল ট্রেনের জবরদোস্ত নেটওয়ার্ক। যথারীতি ব্যস্ততা সেখানে। সন্ধ্যের আলোয় ব্যস্ত অফিসযাত্রীদের পদচারণায় মুখরিত আশপাশ। টাটকা কফির গন্ধ এবং বেকারী প্রোডাক্টে ম ম করছে ঝাঁ চকচকে স্টেশন চত্ত্বর । এবার স্টেশন দেখে বেরিয়ে যাই রাস্তার ওপরে। মার্কেট স্ট্রীটে ।

ড্রেক্সল ইউনিভার্সিটি সেখানে। ঝকঝকে পথঘাট। পশ্চিমে সন্ধ্যে হয় রাত আটটা নাগাদ। আবারো চেস্টনাট রোডে এসে পড়ি। ইউ-পেন ক্যাম্পাসের মধ্যে। বেশ কয়েকটি চার্চ পড়ে পথের ধারে। একটি নামাজ পড়ার উপাসনা কেন্দ্রও বিদ্যমান। থরে থরে রেস্তোঁরা রয়েছে। আর ইউনিভ্যার্সিটির স্টুডেন্টদের জন্য রযেছে হরেকরকম স্ট্রীট ফুড নিয়ে ফুড ট্রাক। ছেলে জানাল দুপুরের লাঞ্চ সেরে নেয় স্টুডেন্টরা এখানেই। সস্তায় অতি সুস্বাদু আর পরিচ্ছন্ন মিল পাওয়া যায় এই ট্রাকগুলিতে। কত রকমের কুইসিন সেখানে। চাইনিজ, মেক্সিকান, আফ্রিকান, জাপানিজ, কোরিয়ান, আমেরিকান...হরেকরকম দেশের খাবার এক জায়গায়। এবার গ্রোসারী স্টোর্সে। পাশেই ইন্ডিয়ান মার্কেট। লন্ড্রোম্যাট। কয়েন ফেলে সাপ্তাহিক জামাকাপড় কাচবার ব্যবস্থা।

এখানে কিছু শহর আছে যেখানে নিজের গাড়ি ছাড়া বাইরে বেরুনো খুব দু:সাধ্য। কিন্তু ফিলাডেলফিয়া শহরটির যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্মলগ্নে যেন বৃহস্পতি তুঙ্গে। তাই বাড়ি থেকে বেরুলেই ইউনিভার্সিটি পাড়ার অনতিদূরেই পায়ে হেঁটে পৌঁছানো যায় বাস স্ট্যান্ড। মেগা বাসের আওতায় ডাবল ডেকার বাস এবং বোল্ট বাসের আওতায় নর্মাল এসি বাস আসে সময়মত। অনলাইন টিকিট কেটে উঠে পড়া যায়। এখান থেকে ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে নিউজার্সি, নিউইয়র্ক পাড়ি দিয়ে দিনে দিনে ঘুরে আসা যায়। ট্রেন, বাস, ট্যাক্সি এমন কি ট্রামের নেটওয়ার্কটি বেশ জনপ্রিয় এখানে। নিত্য অফিসযাত্রীরাও বাসে করে প্রতিদিন নিউইয়র্ক শহরে যান আবার ফিরেও আসেন দিনের শেষে।



বাস, ট্রাম(ট্রলি) এবং লোকাল ট্রেন পরিষেবা একটিমাত্র কোম্পানির অধীনে যার নাম সেপটা (SEPTA) বা সাউথ ইষ্টার্ণ পেনসিলভেনিয়া ট্রান্সপোর্টেশান অথোরিটি । আর তাই বুঝি এত সুসংবদ্ধ এই নেটওয়ার্ক ।

এবার ট্রামের সামনে। ট্রাম আমাদের বড় আদরের। এখনে বলে ট্রলি। কি সুন্দর ব্যবস্থা! সুড়ঙ্গর মধ্যে দিয়ে ট্রাম ঢুকছে একদিকে আবার বেরিয়ে যাচ্ছে সুড়ঙ্গর মধ্যে দিয়ে। ট্রামের ইষ্ট-ওয়েষ্ট ফিলি আসা-যাওয়া। ওয়েষ্টে ট্রামগুলি চলে রাস্তা দিয়ে আর ইষ্টে চলে আন্ডারগ্রাউন্ড। ডিজিটাল ক্লিকে মুখর হয় ট্রাম ট্র্যাক। বড় ভাল লাগে এই যোগাযোগ ব্যবস্থা। 

সেদিনের প্ল্যান বাড়ি থেকে ট্রেনে চেপে পেন'স ল্যান্ডিং অবতরণ। ফিলাডেলফিয়ার একটি মেরি টাইম সামুদ্রিক ঐতিহ্য আছে। জাহাজ তৈরী, বন্দরে জাহাজের নোঙর করা...সব মিলিয়ে একটি জলপথ সংক্রান্ত নৌ পরিমন্ডল । পেন'স ল্যান্ডিং এ পৌঁছলাম সকাল দশটায়। ডেলাওয়ার নদীর মনোরম রিভারফ্রন্ট। হালকা ঠান্ডায় সোনাগলা রোদ্দুরে এর চেয়ে সুন্দর সকাল আর হয় না। সারেসারে জাহাজ দাঁড়িয়ে রয়েছে। এখানেই সেই ঐতিহাসিক ইন্ডিপেন্ডেন্স সি-পোর্ট মিউজিয়ামটি। টিকিট কেটে ঢুকতে হবে।

গ্যালারীর মধ্যে দেখা গেল জাহাজ তৈরীর খুঁটিনাটি থেকে সে সময়কার স্লেভ ট্রেডিং এর করুণ উপাখ্যানের বিশদ বিবরণ। ওয়েলকাম এবোর্ড! বাটন টিপে গল্পমুখর হয়ে উঠল মিউজিয়ামের প্রতিটি গ্যালারী। সাক্ষী হলাম কত ঐতিহাসিক সময়ের দলিলের। ডিসাস্টারস অন ডেলওয়ার রিভার। বহুযুগের ওপার হতে উঠে আসা করুণ কাহিনী। নর্থ আমেরিকার বৃহত্তম সামুদ্রিক সংগ্রহশালা, অগণিত আর্টিফ্যাকটস, লার্জস্কেল জাহাজের মডেল, মিনিয়েচর জাহাজ বানানোর ওয়ার্কশপ সবকিছুই একছাদের নীচে।

দুশো বছরের ইতিহাস মূর্ত হতে শুরু করল আলো আঁধারির খেলায়। ঐতিহাসিক ধ্বংসলীলা ও তার থেকে পরিত্রাণ। ছবিতে তুলে ধরা আছে সে সব কালের দলিলে লেখা হৃদয়বিদারক ট্র্যাজেডি আর তার থেকে উদ্ধ্বার হওয়া ফিলাডেলফিয়া আজো স্বমহিমায়। নৌ-সৈনিকদের জয়ের কৃতিত্বে গৌরবাণ্বিত সেই ইতিহাস। নিজেদের জীবন তুচ্ছ করে যারা দিনের পর দিন নদীর বুকে জীবন গড়েছিল। বাঁচিয়েছিল কত কত প্রাণ। কত তেলবাহী ট্যাংকার জাহাজের বিস্ফোরণ, স্টিম বোটের এক্সপ্লোশান, কত সব মর্মান্তিক ঘটনা!

মিউজিয়াম দেখে এবার এগিয়ে চলি নদীর ওপরে রাখা দুটি ন্যাশানাল হিস্টোরিক ল্যান্ডমার্ক জাহাজে। টিকিটের মধ্যেই ধরা আছে এ দুটির প্রবেশমূল্য। বড় জাহাজটির নাম ক্রুজার অলিম্পিয়া আর অন্যটি একটি রাজকীয় সাবমেরিন, নাম বেকুনা।

Welcome aboard!

সত্যি সত্যিই যেটি পেরিয়ে এবার সাজানো জাহাজটির ভেতরে প্রবেশ করলাম। নাম ক্রুজার অলিম্পিয়া। এটি ম্যানিলা- বে 'র যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। এবং তারপর প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের্ "গান বোট ডিপ্লোমেসি' নানাদেশের কূটনৈতিক কার্যকলাপের প্রতীক হয়ে চিহ্নিত ছিল। ১৯২২ সালে এই জাহাজটির অবসর হয় এবং তারপর থেকেই এটি সি-পোর্ট মিউজিয়ামের সাথে আছে। জাহাজের ভেতর ঘুরে ঘুরে দেখা গেল। কত নিঁখুতভাবে এখনো মেইনটেন্ড এর অন্দরমহল। এর সাথেই রয়েছে বেকুনা সাবমেরিনটি যেটি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে প্রশান্ত মহাসাগরে জাপানের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। এর অভ্যন্তরে প্রবেশ করলে বোঝা যায় কত কম জায়গার মধ্যে একসঙ্গে কত মানুষ দিনের পর দিন থাকতে পারে । জলের নীচে এরূপ সহাবস্থান যে কি ভয়ানক ক্লস্ট্রোফোবিক তা না দেখলে বোঝা যায় না। দম আটকে আসতে পারে। এই ডেলাওয়ার নদীটিকে কেন্দ্র করেই ফিলাডেলফিয়ার উত্তরণ হয়েছিল এক অভিনব বন্দর শহরে।

indira.mukerjee@gmail.com


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.