ধরিত্রী গোস্বামী

বিমুঢ় লোভের পরে
দত্তবাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া সিসিটিভি ফুটেজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দ্বিতীয়বার দেখার পরে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল ইনস্পেক্টর অঙ্কুশ রায়ের বুকের অন্তস্থল থেকে। নাহ, কিচ্ছু ক্লু পাওয়া যাচ্ছে না। কিভাবে একটা সুস্থ স্বাভাবিক পরিবার আচমকা সবাই একসঙ্গে অসুস্থ হয়ে পড়ল এবং সেই অসুস্থতা একেবারে মৃত্যু ডেকে আনল প্রত্যেকের সেইটা কিছুতেই পরিষ্কার হচ্ছে না। 

ঘটনা দিন পাঁচেক আগেকার। প্রত্যুষ দত্ত এলাকার নামজাদা উকিল। উকিল পাড়াতেই মস্ত বড় পৈতৃক বাড়িতে স্ত্রী, পুত্র এবং একমাত্র অবিবাহিত বোনকে নিয়ে ছিল ওনার সংসার। প্রত্যুষবাবুর স্ত্রী এবং বোন দুইজনেই স্কুল-টিচার, যথাক্রমে অঙ্ক এবং জীবন বিজ্ঞানের। ছেলে পল্লব এইবারে মাধ্যমিক দিয়ে ইলেভেনে উঠেছিল। সচ্ছল প্রতিষ্ঠিত পরিবার। তবু কিভাবে এমন অঘটন ঘটে গেল কিছুই সূত্র না পেয়ে দিশেহারা লাগছিল অঙ্কুশের। সেদিন সন্ধ্যের ঘটনা। দত্ত পরিবারের প্রত্যেকে হঠাৎ প্রচন্ড শ্বাসকষ্টে ভুগতে শুরু করেন। নাকের ছিদ্র থেকে আরম্ভ করে ভিতর অব্দি তীব্র দহন জ্বালায় ছটফট করতে থাকেন প্রত্যেকে। না ভুল হোল। দত্তবাবুর বোন পিয়ালিদেবি কপাল জোরে কিভাবে রক্ষা পেয়ে গেছেন এই অদ্ভুত দুর্ঘটনার হাত থেকে। প্রতিদিনের অভ্যাস মত সন্ধ্যায় তিনি ছাদে পায়চারি করতে গিয়েছিলেন। স্কুলের খাতা দেখতে বসার আগে একটু হাঁফ ছাড়তে রোজ সন্ধ্যায় এটা ছিল তার বাঁধা রুটিন। কিন্তু সেদিন ছাদ থেকে নেমে আসার পরে দাদা বৌদি আর পলুর অবস্থা দেখে তড়িঘড়ি আম্বুলেন্স ডাকতে হয় তাকে। শহরের সব থেকে বড় মাল্টিস্পেশালিটি হাসপাতালের আইসিইউতে আটচল্লিশ ঘন্টার কাছাকাছি লড়াই চালাবার পরে একে একে স্ত্রী, ছেলে এবং শেষে প্রত্যুষবাবু নিজে হার মেনে নিয়েছিলেন। এলাকার প্রভাবশালী পরিবারটার এমন পরিণতির তদন্ত ভার ঘাড়ে এসে পড়া ইস্তক নাওয়া খাওয়া ভুল হয়ে যাচ্ছে ইনস্পেক্টর অঙ্কুশের। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন হদিস করতে পারল না সে।

পোষ্টমর্টেম রিপোর্টার জন্য অঙ্কুশের মনটা হাপিত্যেশ করে বসেছিল। সেটা এল বিকেলে। কোন একটা বিষাক্ত কিছুর অন্তঃশ্বসনের ফলেই যে প্রত্যেকের মৃত্যু হয়েছে, সেই কথাই রিপোর্টে বলা হয়েছে। নাকের ঝিল্লি থেকে আরম্ভ করে ফুসফুসের ভিতর পর্যন্ত চামড়া বিষক্রিয়ায় ঝলসে গেছে, তাতে বড় বড় ফোস্কা লক্ষ্য করা গেছে। নিউমোনিয়ার লক্ষণ স্পষ্ট প্রত্যেকটি দেহে। কিন্তু কিসের থেকে এই কান্ড সেইটার কোন হদিস পাওয়া গেল না। ভর সন্ধ্যেবেলায় লোহার গেট, দারোয়ান, দুটি কুকুর পেরিয়ে এসে আততায়ী কিভাবে এবং কি বিষ ছড়িয়ে দিয়ে গেল সেইটাই খুব ভাবাচ্ছে অঙ্কুশকে।

পিয়ালিদেবিকে বার তিনেক জেরা করা হয়ে গেছে। নিজে অবিবাহিতা, ভাইয়ের পরিবারটাই ছিল তার নিজের মত। পলু তো পিসির আদরে যত্নে নিজের মাকে এক রকম খেয়ালেই রাখত না। পিয়ালিদেবি ফ্যামিলি এ্যালবাম বার করে দেখাচ্ছিলেন। পলুর সঙ্গে বিভিন্ন মুহূর্তের ছবি। “কিছু মনে করবেন না পিয়ালিদেবি, অত্যন্ত ব্যক্তিগত প্রশ্ন করছি একটা। আপনি নিজে সংসার করেননি কেন?” অঙ্কুশের এই প্রশ্নে এক সঘৃণ অভিব্যক্তি মুহূর্তের জন্য যেন জ্বলে উঠেছিল পিয়ালিদেবির চোখে। কিন্তু সে অঙ্কুশের ভুলও হতে পারে। “সে নিতান্ত ব্যক্তিগত কারণ অফিসার, এই কেসের সঙ্গে জড়িয়ে লাভ হবে না,” এই ছিল পিয়ালিদেবির প্রতিক্রিয়া। “দাদা বৌদি ছিলেন আমার সব। কিরকম লস্ট লাগছে নিজেকে,” আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠেন বছর তেতাল্লিশের এই স্কুল শিক্ষিকা। অঙ্কুশ কিন্তু হাল ছাড়ে না। কোন নমনীয়তা দেখাবার সুযোগ নেই তার হাতে। এখন অব্দি কোন সূত্র হাতে আসেনি। আর পিয়ালিদেবি সেদিনের ঘটনার একমাত্র জীবিত সাক্ষী।

“সেদিন আপনি ঘটনার সময় ছাদে ছিলেন। সন্দেহজনক কিছু বা কাউকে দেখতে পেয়েছিলেন?”

“আমাদের ছাদের সামনের দিকটা বন্ধ। তাই গেট অব্দি নজরে আসে না। তাছাড়া গেটে তো আখতার ছিল। কেউ ঢুকলে কি সে দেখতে পেত না? আমি বাড়ির পিছনের দিক, যেদিকটা খোলা বাগান, সেদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ওদিক দিয়ে কাউকে আসতে যেতে চোখে পড়েনি। অবশ্য যা জঙ্গল হয়ে আছে!” পিয়ালিদেবিকে আনমনা দেখায়।

“জঙ্গল কেন? পরিষ্কার করা হত না?”

“আগে সবই হত। ইদানিং দাদা কিরকম বদলে যাচ্ছিল। কোন ব্যাপারেই উৎসাহ দেখাত না। আগে বছর বছর বাড়ি রঙ হত। সামনের বাগান ফুলে ভরে থাকত। পিছনে এত জঙ্গল ছিল না। এখন অবস্থা দেখছেন না?”

“প্রত্যুষবাবুর এই মানসিক পরিবর্তনের কারণ? ওনার পেশাগত দিক থেকে তো প্রতিকূল সংবাদ কিছু পেলাম না। তবে কি পারিবারিক?”

পিয়ালিদেবি চুপ করে কি যেন ভাবতে থাকেন। অঙ্কুশ কিন্তু হাল ছাড়ে না। পিয়ালিদেবির মুখের দিকে চেয়ে অপেক্ষা করে। কিছু বাদে মুখ নিচু করে পিয়ালিদেবি বলেন, “যারা চলে গেলেন তাদের নামে এসব তথ্য দেওয়া উচিত কিনা জানিনা। তবে হত্যাকারী শাস্তি পাবে এই আশায় আপনাকে জানাচ্ছি। ওদের মধ্যে দাম্পত্য বনিবনা হচ্ছিল না। দাদা ডিভোর্সের কথাও চিন্তা করছিল।”

“সেকি!” এই নতুন তথ্যে চমকে ওঠে অঙ্কুশ।

“হ্যাঁ, দোষটা দাদারই। কারু সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল। কলকাতার কোন মহিলা উকিল। আমি ঠিক জানি না। বৌদি খুলে বলেনি আমাকে। শুধু পলুর কথা ভেবে দাদা এগুতে পারছিল না। এই নিয়ে এতটাই মানসিক অশান্তিতে ভুগত ইদানিং যে আর কোনদিকে উৎসাহ ছিল না।”

সেদিন বাইক চালিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে দ্রুত চিন্তা করছিল অঙ্কুশ। কেস আরও কেঁচিয়ে গেল মনে হচ্ছে। মফঃস্বলের সীমানা ছাড়িয়ে এবার জাল ছড়িয়ে পড়ল কলকাতা অব্দি। কে মহিলা, কোন মহিলার সঙ্গে প্রত্যুষবাবুর কেমন ঘনিষ্ঠতা, তার পরিণতিতেই এই ঘটনা কিনা সেই সব খতিয়ে দেখতে হবে। নাঃ সমস্যা জটিল হয়ে উঠছে ক্রমশ। 

পরের দুদিন অঙ্কুশ এই দিকটা নিয়েই ভেবে কাটাল। খোঁজখবর লাগাল প্রত্যুষবাবুর পুরনো সহপাঠী চেনা পরিচিতদের ব্যাপারে। পুরনো এবং নতুন কোন সম্পর্ক। কিছুই তথ্য হাতে এল না। শুধু জানা গেল কিছু ধারদেনা হয়েছিল ইদানিং। তার মধ্যে একটা অগ্রগতি অঙ্কুশের চিন্তা আরও বাড়াল। সেদিন রাতে টিভির খবরে শুনল প্রত্যুষবাবুর পারিবারিক অশান্তি আর সম্পর্কের কথাটা রিপোর্টারদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে। অঙ্কুশ তাজ্জব! যে তথ্য পুলিশকে দিতে সংকোচ করছিলেন পিয়ালিদেবি, সেটা মিডিয়ার কাছে কেন খুলে দিলেন! সাধারণত মফঃস্বলের দিকে অপরাধে এতটা মিডিয়া আলোকপাত হয় না। এত তদন্তও না। কিন্তু যেহেতু পরিবারটি নামজাদা এবং প্রত্যুষবাবু নিজে প্রতিষ্ঠিত মানুষ তাই কেস গোটানো সহজ হোল না। টকসিকোলজি রিপোর্ট এল। সেখানে শরীরের শ্বাসনালীর রন্দ্রে রন্দ্রে উরুশিওল নামের জৈব রাসায়নিকের সন্ধান পাওয়া গেছে। সম্ভবত মৃত্যুর কারণ এটাই। কিন্তু ভরসন্ধ্যেবেলায় তিনজন মানুষকে ঘরে ঢুকে কে এইটে শুঁকিয়ে মারল, কিভাবে মারল, সেটাও তো ভেবে দেখার মত। তবে কি প্রত্যুষবাবু নিজেই? সমস্যার কোন সমাধান খুঁজে না পেয়ে, মানসিক অশান্তিতে দীর্ণ হয়ে পুরো পরিবারটিকেই শেষ করে দিলেন এভাবে? নাকি তার স্ত্রী গোপাদেবি? মধ্যবয়সে এসে স্বামীর এমন প্রতারণা সহ্য করতে না পেরে মানসিক ভারসাম্য হারালেন? বাদ দিলেন না পেটের সন্তানকেও? এবং ননদকে এর মধ্যে জড়াবেন না বলেই এমন সময়টা বাছলেন যখন ওরা তিনজন কাছাকাছি থাকবেন কিন্তু পিয়ালিদেবি সামনে থাকবেন না? প্রত্যুষবাবুর এমন অসময়োচিত অস্থিরগতিকে এভাবেই রুখে দিলেন নিজের এবং সন্তানের প্রাণের বিনিময়ে? 

একটা সূত্র ধরতে পেরে যারপরনাই খুশি এবং উত্তেজিত হোল অঙ্কুশ। এই কেসটা সমাধান করতে পারলে চাকরিতে সুনাম এবং উন্নতি দুই-ই আসবে। অনেকদিন পরে তৃপ্তি করে ডিনার সেরে একটা সিগারেটে টান মেরে তাড়াতাড়ি শুতে গেল সেদিন। কিন্তু মাঝরাতে আচমকা ঘুমটা ভেঙে গেল কেন অঙ্কুশ বুঝতে পারল না। বিছানায় অনেকক্ষণ ছটফট করার পরে শেষে সেটা পরিষ্কার হোল। না হিসেব মিলছে না। কোথাও যেন আবার জড়িয়ে যাচ্ছে সবকিছু। কিন্তু সেটা কি অঙ্কুশ এখনও বুঝতে পারছে না।

#

“আচ্ছা, এইটা তো আপনাদের পৈতৃক বাড়ি?” পরের দফার জেরায় অঙ্কুশ জানতে চায় পিয়ালিদেবির কাছে। “হ্যাঁ” ছোট্ট জবাব আসে। “এই সম্পত্তির আজকের বাজার মূল্য অনেকখানি। এটা কি সবটাই আপনার ভাইয়ের নামে?” অঙ্কুশের পরের প্রশ্ন। “না, জীবিতকালেই বাবা উইল করে আমাদের সমান ভাগ দিয়ে গেছেন। ব্যাঙ্কের টাকাও দুইজনের নামে,” আজ পিয়ালিদেবিকে অসম্ভব শান্ত লাগছিল। অঙ্কুশের জেরা কিন্তু তখনও চলছে, “দাদার পরিবারের অবর্তমানে তাহলে সবটাই আপনার হয়ে গেল? আর তো কেউ ভাগীদার নেই সম্ভবত!” এইবারে মেজাজ হারালেন পিয়ালিদেবি, “আপনার উদ্দেশ্য কি? আমাকে খুনি সাজানো? সম্পত্তির জন্য দাদা বৌদি আর পলুকে মেরেছি আমি? জানেন ওরা ছাড়া আমার আপন বলতে আর কেউ নেই?” সন্তাপে ভেঙে পড়লেন যেন পিয়ালি। খারাপ লাগল অঙ্কুশেরও। সত্যি এইটা প্রমাণ করার মত তথ্য তার হাতে কিছু তো নেই। শুধু একটা আবছা অনুমান। কিন্তু পুলিশ অফিসারের দুর্বল হলে চলে না। সন্দেহ করতে হবে সবাইকে। “আপনার মোবাইল আর ল্যাপটপটা আমি আজ একটু নেব মিস দত্ত, একটু লাগবে।” এবারে ফোঁস করে জ্বলে ওঠেন দিদিমণি। “ইয়ার্কি হচ্ছে? আমার কাল তিনটে ক্লাস আছে। সামনে ইলেভেনের পরীক্ষা। কোশ্চেন পেপার করা চলছে। এ কি অন্যায় আবদার।” এবারে আরও কড়া হয় অঙ্কুশ। “আপনাকে কাজ করার জন্য একটা স্পেয়ার ল্যাপটপ থানা থেকে পাঠিয়ে দিচ্ছি আমি। কিন্তু এটা আমার দরকার।” হাল ছেড়ে পিয়ালি বলেন, “ঠিক আছে এক ঘণ্টা সময় দিন, কিছু জিনিস পেন ড্রাইভে তুলে নেব।” সঙ্গে সঙ্গে রাজি অঙ্কুশ। “নিশ্চয়, তবে সেটা আমার সামনে বসে করতে হবে। ভুলে যাবেন না, আপনি আমাদের সন্দেহের তালিকায় রয়েছেন।” নিরাশ্বাসে পিয়ালি বলেন “খুব ভাল কথা। যা যা ইচ্ছে নিয়ে যান। কিছুৎ তো  পেলেন না, দেখুন যদি আমাকেই খুনি সাজাতে পারেন শেষ পর্যন্ত।”

বুকের ভেতরে প্রচন্ড ধড়ফড় নিয়ে গেট দিয়ে বেরুবার মুখে দেখা দারোয়ান আখতারের সঙ্গে। সে তো আগেই জানিয়েছিল সেদিন সে ছোটি-দিদির চিৎকার শুনেই ছুটে গেছিল। এ ছাড়া আর কিছু জানে না। আজ গেটে দেখা হোল কাজের মেয়ে নমিতার সঙ্গে। এর সঙ্গে আগেও কথা বলেছে অঙ্কুশ। আজ নমিতার হাতের প্যাকেটে নারকেল ছোবড়া। “আমিই তো রোজ ধূনা দি সন্ধ্যাবেলাতে। যা মশা। অত জঙ্গল থাকলে মশা হবেনি?” অঙ্কুশ থামাল নমিতাকে। “ঘটনার দিন তুমি কোথায় ছিলে? তোমাদের ছোট ম্যাডাম ধূনা দিচ্ছিল, সি সি ক্যামেরায় ছবি দেখেছি।” “হায়, আমাকে যে সেদিন দাবাবু বাজার থেকে গরম গরম জিলিপি ভাজিয়ে আনতে পাঠাল গো। ছোটদিমনি আর বৌদি দুজনেই খাবে বলেছিল। কিন্তু সে খাওয়া আর হোল কই? ফিরে এসেই তো দেখি এই কান্ড। একটু বাতাসের জন্য হাঁকুপাঁকু করছে তিনটে মানুষ আর ছোটদি ছুটোছুটি নাগিয়ে দিয়েছে একেবারে।” আর একটা ছোট্ট প্রশ্ন বাকি ছিল অঙ্কুশের। “জিলিপির দোকানটা কদ্দুর?” “তা একটু দূর আছে বাবু। আসতে যেতে আধা ঘন্টা। দাঁড়িয়ে ভাজিয়ে আনতে আরও দশ মিনিট,” চলে যায় নমিতা।

#

এরপরের ঘটনা সংক্ষেপে বলি। সারারাত মোবাইল আর ল্যাপটপ ঘেঁটে রাতজাগা লাল চোখে পরেরদিন ভোরেই আবার দত্তবাড়ির গেটে হাজির অঙ্কুশ। এবার আখতারকে সঙ্গে নিয়ে পিছনের বাগানে তল্লাশি। পিয়ালিদেবি ওপর থেকে চেঁচিয়ে বলে দিলেন, “আখতার পুলিশদাদাকে বলে দিও বিষাক্ত সাপের আড্ডা পিছনে। বেশি ঝোপে ঝাড়ে না ঢোকে যেন। ওখানে কিছুই খুঁজে পাবেন না উনি।” মনে মনে হাসে অঙ্কুশ। সে যা খুঁজছিল ততক্ষনে দেখতে পেয়ে গেছে তাকে। প্রাচীন আম কাঁঠালগাছের গুড়ি জড়িয়ে জড়িয়ে বেড়ে উঠেছে প্রচুর পয়জন আইভির ঝোপ। বিছুটি জাতীয় গাছ একপ্রকার, উত্তর আমেরিকার সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার নানা প্রান্তে, এমনকি ভারতের নানা প্রদেশেও মাঠে ঘাটে জন্মায়।

এরপর সব তথ্য সাজিয়ে পিয়ালিদেবিকে গ্রেপ্তার করা ছিল সময়ের অপেক্ষা। সাংবাদিক বৈঠকে সব গুছিয়ে বলল অঙ্কুশ। হাজির ছিলেন জেলার হোমরাচোমরা অফিসাররাও। অঙ্কুশ ততক্ষনে বেশ হিরো হয়ে উঠেছে।

“সিসিটিভি ফুটেজে প্রথম খটকা লাগে ঘটনার দিন সন্ধ্যেবেলায় পিয়ালিদেবি নিজে ঘরে ঘরে ধুনো দিচ্ছেন এই দৃশ্যে। বাড়িতে সব সময়ের কাজের মেয়ে থাকার পরেও। আসলে প্ল্যান করে নমিতাকে দূরের দোকান থেকে গরম গরম জিলিপি ভাজিয়ে আনতে পাঠানো হয়েছিল প্রত্যুষবাবুকে দিয়েই। তারপর খুব সরল ভঙ্গিতে নিজের ওপরে তুলে নিয়েছিলেন ধুনো দেবার দায়িত্ব। সন্ধ্যার মুখে মশার উৎপাত বাড়ে। অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু প্রতিটা ক্লিপেই দেখা যাচ্ছে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ধুনো দেওয়া চলছে। তারপরেই পিয়ালি উঠে গেলেন খোলা ছাদে। কিন্তু কেন? এই প্রশ্নটা মাথায় ঘুরে যাচ্ছিল। আপাতভাবে খুব সামান্য ঘটনা। তবু কোথাও একটা খটকা লাগছিল। এরপরেই ইচ্ছে করে ঘটনার মোড় ঘুরিয়ে দেবার জন্য দাদা বৌদির সম্পর্কের অবনতির গল্প ফাঁদলেন উনি। সেটা মিডিয়ায় চাউর করে দেওয়া হয় ইচ্ছাকৃত ভাবে। তদন্তের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া ছিল উদ্দেশ্য। কিন্তু এতে সন্দেহ আরও বাড়ে আমার। ইস্কুলে খোঁজ নিয়ে ভাসাভাসা জানতে পারি পিয়ালির কোন এক পুরুষবন্ধু আজকাল মাঝেমাঝে স্কুলের অফ পিরিয়ডে বা ছুটির পরে দেখা করতে আসতেন। তার মানে বাড়িতে সম্মতি ছিল না। দাদার ভয়ে বাড়িতে আসতে বলতে পারতেন না। একটা মোটিভ তবে পাওয়া গেল। দাদা বৌদি আর ভাইপোকে সরিয়ে দিয়ে সমস্ত সম্পত্তি গ্রাস করা এবং এমন কারুর সঙ্গে সংসার পাতা যাকে দাদা পছন্দ করতেন না। তাই এভাবে পথের কাঁটা সরানো।

কিন্তু হত্যা করা হোল কিভাবে? বায়োলজির টিচারের বিষাক্ত গাছ গাছড়ার বিষয়ে অনেক কিছু জ্ঞান থাকা স্বাভাবিক। তবু ল্যাপটপ সিজ করে রিসেন্ট ব্রাউজিং হিসট্রি ঘাঁটতেই সব পরিষ্কার। কিছুদিন যাবত নানান বিষাক্ত গাছপালা এবং তাদের প্রয়োগ নিয়ে পড়াশুনা করে চলেছিলেন পিয়ালি। কিভাবে কোন সন্দেহ এবং প্রমাণ না রেখে কাজ হাসিল করা যায়। শেষ অব্দি মনে ধরেছিল পয়জেন আইভি। খুব কমন বিষ নয়। কিন্তু অব্যর্থ। এবং হাতের নাগালে পাওয়া গেল ওদের পিছনের বাগানেই। পয়জন আইভির পাতা শুকনো করে ধুনোর সঙ্গে বেশি পরিমাণে মিশিয়ে দিলে নিঃশ্বাসের সঙ্গে শরীরে প্রবেশ করে স্লো পেনফুল মৃত্যু ডেকে আনবে। কেমিকেলটার নাম উরুশিওল। পাতা থেকে চামড়ায় লাগলে জ্বালা ফোলা হয়। বিছুটির গোত্র। কিন্তু নিঃশ্বাসের সঙ্গে শরীরে প্রবেশ করলে মারাত্মক। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে উরুশিওল পাওয়া গেছিল। আর তবু আমার মনে যেটুকু দোদুল্যমনতা ছিল তা দূর হয়ে গেল সেদিন নমিতার কথায়। বোন আর স্ত্রীর আবদার রাখতে সেদিন নিজেই নমিতাকে জিলিপি আনতে পাঠিয়েছিলেন প্রত্যুষবাবু। স্বামী স্ত্রী সম্পর্ক খুব তলানিতে নেমে গেলে কি এটা সম্ভব হত? নাকি সময় হিসেব করেই নমিতাকে স্পট থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন পিয়ালি, দাদার কাছে জিলিপি খাবার আবদার করে যাতে নিজে হাতে বিষবাষ্পে শ্বাস রোধ করে শেষ করে দেওয়া যায় দাদার পরিবারকে? উত্তর আশা করি পরিষ্কার এখন সবার কাছে!”


drdharitrigoswami@gmail.com



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.