পিনাকি

কালো বাক্সের আড়ালে
!!১!!

সবে মাত্র মুড়ির বাটিতে হাত দিয়ে , আচারের তেল দিয়ে মাখা মুড়ি মুখে পুড়লাম ।

-ইস! কেমন যেনও মিইয়ে গেছে ! 

আমি আর মুমিন পাশাপাশি বসেছি । সামনে ত্রিনয়নদা । পা ছড়িয়ে বিছানার উপর বসে আছে। আমরা মেঝেতে বসেছি , মাদুর পেতে । যারা এই বাড়িতে আসেননি , তারা এলে বুঝতে পারবেন এই কলকাতায় যেই সব উপাদান , উপকরণ বাতিল হয়ে যাচ্ছে ; আমারা সেইসব কিছু এখানে মহানন্দে ব্যবহার করছি । এই ঘরে আলমারি , খাট , আর একটা ইজি চেয়ার রাখা আছে । ঘরে ঢুকতেই সোজা খাট পাতা ।খাটের পিছনে লম্বা জানলা , যা দিয়ে ৬৮ বি যোধপুর পার্কের মাঝারি চওড়া রাস্তাটা দেখা যায় । খাটের বাঁদিকে হেলান দেওয়া কেদারা বেশ লম্বা আর শক্ত সেগুন কাঠের হাতল । কেদারার থেকে পাঁচ পা এগিয়ে গেলেই কাঠের আলমারি । পারলৌকিক, হিন্দু দর্শনের, প্রেতচর্চার বই । সাথে বিদেশি ও অন্যান্য ধর্মে মৃত্যু দর্শন এবং নানাদেশের মোটা –মোটা বাঁধানো পুরানো বই । 

মুড়ি মিইয়ে যাওয়ার কথাটা ত্রিনয়নদার। আমি তাকিয়ে বললাম – আপনিই এতো দেরী করে খেলে এমনটাই হবে দাদা। এখন রাত আটটা, আর মুমিন এনেছিল সন্ধ্যা ছটায় !

-দেখো বেদ , এইযে বসে –বসে , হেলেদুলে মজিয়ে রসিয়ে গল্প করতে – করতে খাওয়া । এর মজাই আলাদা । আচারের তেল দিয়ে মুড়ি মাখা আর সাথে লম্বা বেদুনি কাঁচা লঙ্কা দিয়ে । এই লোভনীয় পরমান্ন এক খাবলায় শেষ করবার নয় । বুঝলে ? 

-তাহলে আটটা ? মানে এটা বাড়াবাড়ি হলনা ?

-তা আগে বুঝিনি । এই মাত্র টের পেলাম । মুচমুচে বেগুনি ভেজা রুমালের মতন ক্যাতক্যাতে হয়ে গিয়েছে । আর মুড়ি ? ভেজা মনে হচ্ছে ।

-এখন তাহলে কি করবেন । 

-না , খেয়েই নেব । 

ঠিক এই সময় বেল বেজে উঠল । জানালা দিয়েই , বাইরের জায়গা দেখা যাচ্ছে । ত্রিনয়নদা দেখে বললেন - বয়স ষাটের কাছাকাছি হবে । যতটা দেখলাম অবস্থাপন্ন । 

আমরা তিনজন উপরের মানে দ্বোতলার ঘরে বসে রয়েছি । ব্রজদা রান্না ঘরে রাতের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত । আমার দিকে তাকিয়ে ত্রিনয়দা বললেন – চাপ নিও না । ব্রজদা দরজা খুলে দেবে । 

সিঁড়িতে শব্দ ভাসছিল , চাপা বুটের শব্দ আমাদের ঘরের দিকেই এগিয়ে আসছে । ঘড়িতে রাত আটটা দশ । মুমিন দরজার দিকে তাকিয়ে বলল - নমস্কার । 

আমি তাকিয়ে দেখলাম একজন বৃদ্ধ , বেশ অবস্থাপন্ন ঘরের । মাথার চুল সাদা হয়ে গিয়েছে।মধ্য উচ্চতার চেহারা । চোখে চওড়া ফ্রেমের চশমা পড়েছেন । গাল ভর্তি চাপদাড়ি । আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন – আমি ত্রিনয়ন ঘটকের সাথে কথা বলতে চাই ।

মুমিন আমার দিকে, আমি ত্রিনয়নদার দিকে । আর ত্রিনয়নদা দু’হাত জোর করে বলল- নমস্কার । আমি ত্রিনয়ন ঘটক । বলুন ...

কিছুক্ষণ লোকটি ত্রিনয়নদার দিকে তাকিয়ে রইলেন । তারপর বললেন – আমি কিছু ব্যক্তিগত কথা বলতে চাই । 

ত্রিনয়নদা বলল – দেখুন , আমি আপনাকে চিনতে পারছি না । তাছাড়া আমার কথা আপনাকে কে বলল ? 

-আমি জানতে পেরেছি স্যার । 

-হ্যাঁ কিন্তু আমি আপনার সাথে কথা বলব কেন ? মানে কথা শুনতে আপত্তি নেই , তবে প্রথমেই বলছি আমি যেই বিষয় নিয়ে কাজ করছি বা করে চলেছি , তা কিন্তু সম্পূর্ণ ভাবে সমাজের বৈজ্ঞানিক স্তর দ্বারা স্বীকৃত নয় । তাই এমন কোন কেস আনবেন না , যেখানে কাজ করাটা অসুবিধা হয় । 

-না , আমি আমার ছেলের জন্য এসেছি । আমার ছেলের খুব বিপদ একমাত্র আপনিই পারবেন উদ্ধার করতে ।

-আপনি আগে বসুন । এই খাটে বসুন । 

ত্রিনয়নদা বিছানা থেকে নেমে , ইজি চেয়ারে গিয়ে বসল । বুঝলাম, এই পরিচিয় দৃশ্য মানেই নতুন আত্মার সন্ধান পেতে চলেছি আমরা । মানে, আরেকটি অপশক্তির মুখোমুখি হতে চলেছি আমরা ।

-দেখুন আমার দু’জন সাকরেদ আছে মুমিন আর বেদ । আপনি এদের সামনেই সব কিছু খুলে বলুন । চিন্তা নেই, আমরা গোপনীয়তা লঙ্ঘন করিনা । 

বয়স্ক লোকটি পকেট থেকে রুমাল দিয়ে কপাল আর গাল মুছে , ত্রিনয়নদার দিকে তাকিয়ে বললেন- আমার নাম, রাজারাজ তিওয়ারি। উত্তর কলকাতায় আমাদের একটা বনেদী বাড়ি রয়েছে । তিনপুরুষের শঙ্খের ব্যবসা । বিদেশেও আমাদের তৈরি শাঁখ, শাখা, পলা রপ্তানি হয় । বড়বাজার , রাধাবাজার আর শ্যামবাজারে আমার দোকান আছে । বাবার বাবা মানে আমার ঠাকুরদা এই ব্যবসা শুরু করেছিলেন । আমার বাবা তারপর আমি এই ব্যবসায় লক্ষ্মীর মুখ দেখেছি । 

ত্রিনয়নদা মাথার এলোমেলো চুল গুলোকে ঠিক করে বলল – দেখুন প্রথমেই বলে রাখি আমি ওঝা, তান্ত্রিক বা মন্ত্রপূত তন্ত্রসিদ্ধ সন্ন্যাসী নই। তাই ব্যবসার লাভের জন্য যদি এসে থাকেন , তাহলে আর কথা এগিয়ে লাভ নেই । সময় আপনার আর আমার দু’জনের কাছেই মূল্যবান ।

-না , ঘটক বাবু । আপনাদের জেনারেশনের নই বলে আমাকে এতটা অজ্ঞ ভাবছেন! আমি জানি আপনারা প্রেতসন্ধানী তদন্ত করেন । এই কলকাতায় যে কয়েকটি হাতেগোনা এজেন্সি রয়েছে, আপনি তাদের মধ্যে সেরা। নেগেটিভ এনার্জি নিয়ে আপনার অনেক আর্টিকেল রয়েছে। স্যার আমি হতে পারি ষাট , আমার ফেসবুক প্রোফাইল আছে । তার এতটা বুড়ো ভাববেন না । আপনার সম্বন্ধে সব জেনেই আমি এসেছি এখানে । আমি যে বিপদের মধ্যে রয়েছি তা পুলিসের কর্ম নয় । প্রাইভেট গোয়েন্দার কাজ নয় । এমনকি আপনি ছাড়া আর কেউ সফল হবে বলে মনে হয় না । 

ত্রিনয়নদা হেসে ফেলল । -আপনি বুঝলেন কেমন করে আমি এই কাজে ব্যর্থ হবনা ।

-ত্রিনয়ন বাবু , আপনি ব্যর্থ হলে ভাবব আমার ভাগ্যই পরিহাস করল । একমাত্র ছেলেটা শেষ হয়ে গেল । আর বাঁচাতে পারলাম না ! 

-দেখুন কে বাঁচবে আর কে বাঁচবে না তা সবসময় আমাদের হাতে থাকে না । না আমি কখনই সব কিছু ভাগ্যের হাতে দেওয়ার পক্ষে নই । এটাও সত্যি অদৃশ্য কিছু...

-হ্যাঁ এই দৃশ্যহীন ভয়ই এখন আমাকে তাড়া করে চলেছে ।

এই সময় ঘরে চারকাপ চা নিয়ে ব্রজদা ঘরে ঢুকল । আমাদের চা দিয়ে চলে গেল । ভদ্রলোক বলা শুরু করলেন - একমাসে আমার ছেলে কেমন যেনও পাল্টে গিয়েছে ! 

-যেমন ?

-তাহলে প্রথম থেকেই শুরু করছি । ওকে একবছর আগে আমি পড়াশুনোর জন্য ব্যাঙ্গালোর পাঠিয়ে দিয়েছিলাম । একমাস হলও ফিরেছে । শুরুতে আমাদের সাথে বেশ কথা বলত । তারপর ধীরে –ধীরে যেনও পাল্টে যাচ্ছিল । 

-কেমন ? আপনার ছেলের স্বভাব কেমন ছিল ? 

-হাসিখুশি । শিক্ষিত মার্জিত । আর সবসময় নিজের মতামতকে বেশি গুরুত্ব দিত ।

-এখন ?

-কথা বলেনা । নিজের জন্য একদম আলাদা ঘর নিয়েছে ।

-নিয়েছে মানে ?

-বাড়ির একটা অপেক্ষাকৃত ছোট ঘুপচি মতন ঘর । বন্ধই ছিল । এই ঘরে একা থাকতে শুরু করে। কোন ছবি রাখতে চায়নি । শুধু তাই নয়, আমাদের সাথে খুব একটা কথা বলেনা । এড়িয়ে –এড়িয়ে থাকে । পারিবারিক অনুষ্ঠানে যায়না , জোর করলে ছাড়া –ছাড়া ভাব । ইদানীং সকলের সামনেই আমাকে থ্রেট করেছে ।

-কি ?

-বলেছে , সে আমাকে দেখে নেবে ।

ত্রিনয়নদা চুমুক দিয়ে কাপ নামিয়ে বলল – রাগারাগি ?

-না , আমি জানিনা । তবে আমার উপরেই রাগ । বেশ বুঝতে পারছি ।

-কিন্তু এতে তো সাইকোলজিক্যাল সমস্যাও হতে পারে ?

-ঘটনা এরপর ঘটল । একদিন সকালে দেখলাম খোকার ঘরে যাওয়ার সিঁড়ির মুখেই শিবুলালের মৃতদেহ ! 

-মানে ?

-হ্যাঁ , পুলিস পোস্টমর্ডাম করে বলেছে , স্বাভাবিক মৃত্যু । আচমকা স্নায়ুর চাপে হার্টে আঘাত আসে । সেখান থেকেই হার্টএটাক হয়েছিল । 

-তারপর ?

-পুলিস এর হাত থেকে রেহাই পেলেও , তারপর থেকেই কেমন যেনও খোকার ঘরের চারপাশটা অদ্ভুত এক নির্জনতা ঘিরে থাকত । সিঁড়িতে আলোর ব্যবস্থা করলেও তা একদিন অন্তর খারাপ হয়ে যায় । বাড়ির কাজের লোক কোন না কোন ভাবে আহত হয় । আবার আমি নিজেও ইদানীং বুঝতে পারছি একটা অদ্ভুত গা ছমছম পরিস্থিতি । নিজের চেনা পরিবেশ একটু –একটু করে পাল্টে যাচ্ছে ! আমি বুঝতে পারছি বাড়িতে কিছু একটা খারাপ হচ্ছে । আর এই খারাপের জন্যই অনেক কিছু করেছি । শেষে আপনার কথা শুনলাম । আপনি যে সোসাইটিতে আগের মাসে বক্তৃতা দিয়েছিলেন । আমি সেখান থেকেই আপনার ঠিকানা পেয়েছি । ওই সোসাইটিতে আমার কোম্পানি ডোনেশন দেয় । 

ত্রিনয়নদার হাত ধরে ভদ্রলোকটি বললেন – স্যার , আমার ছেলেকে বাঁচিয়ে দিন । 

ঘড়িতে রাত সাড়ে নটা । পাক্কা আশি মিনিট লোকটি আমাদের সাথে আছেন । আমি বেশ বুঝতে পারছি , মুখে অসহায়তার ছাপ । ত্রিনয়নদা লোকটির হাত ধরে বলল - একদিন সময় নিচ্ছি । ফোন নম্বরটা বেদকে দিয়ে যাবেন । আমাকে ভাবতে দিন ।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন – আমি আপনার ফোনের আশায় থাকব ।

আমরা ভদ্রলোককে এগিয়ে দিলাম । গলির মুখেই ওনার চারচাকা দাঁড়িয়ে ছিল । বলে গেলেন , আমাদের থেকে ফোন গেলেই এখানে গাড়ি পাঠাবেন ।

ঘরে ঢুকেই দেখলাম , আলো বন্ধ । অন্ধকার ঘরের জানালার দিকে দাঁড়িয়ে আছে ত্রিনয়ন দা । সামনে ইজিচেয়ারটায় আলো এসেছে । জানালার ধার ঘেঁষে বড় গাছ , সেখানে ল্যাম্পপোস্টের আলো এসেছে , সেই আলোর দিকে তাকিয়ে আছে ।

আমি হাই তুলে , হাতদুটো মাথার পিছনে রেখে বললাম –মুমিন বাড়ি চলে গিয়েছে । 

ত্রিনয়নদা বলল – তুই একদিন বাদে ওনাকে জানিয়ে দিবি । কাল সকাল দশটায় মুমিনকে নিয়ে আয় । কেসটা নিয়ে কথা আছে ।

আমার সামনে ত্রিনয়নদা । তার সামনে জানালা। জানালার ওইদিকে বড় জামগাছ , পাশে ল্যাম্পপোস্ট । আমার চোখ এই সব কিছু ছাড়িয়ে যতটুকু দেখছি , ফাঁকা আকাশের দিকে । ঘন নীল আকাশের বুকে নক্ষত্র ! অগুনতি । মনে হচ্ছে কেউ , টুনি বাল্বের জাল বিছিয়েছে। 

!!২!!

সকাল আটটার সময় যোধপুর পার্ক গার্লস স্কুলের সামনে , সাদা রঙের চারচাকা দাঁড়িয়েছে । আমি , মুমিন , আর ত্রিনয়নদা উঠে বসলাম । দুদিনের জন্য জামা কাপর কাপড় আর আমাদের তদন্ত সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি ভর্তি ব্যাগ নিয়েছি । 

গাড়ি গড়িয়াহাট ছাড়িয়ে এগিয়ে চলেছে । ড্রাইভার কামাল খান । আমি বিড়লা মন্দিরের দিকে তাকিয়ে আছি । যদিও এখন সকাল আটটা কুড়ি , সূর্যের মিষ্টি আর হাল্কা আলো এসে পড়েছে মন্দিরের চাতালে । এর মধ্যেই অনেক লোক জড়ো হয়েছে । আমি দেখছিলাম , এখন পুজো আসতে একমাস বাকী । এই শহর উৎসবের রাতগুলোতে কেমন ভাবে পাল্টে যায় ! অনেক লোক কোত্থেকে চলে আসে । তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখতে -দেখতে ত্রিনয়নদার অনেক কথার উপস্থিতি টের পাই । যেমন , আসল আনন্দ আত্মার আনন্দ । এই আনন্দের ক্ষমতা অসীম । 

কানে এলো । ত্রিনয়নদা বলছে - কামাল বাবু , আপনার কথা রাজারাজ বাবু আমাকে জানিয়েছেন । আপনি ওনার খুব বিশ্বস্ত সাথী । 

-বলতে পারেন ।

-তা কত বছর এই পরিবারের সাথে যুক্ত ? 

-স্যার বলতে পারেন , আমার বয়েস এখন পঁয়তাল্লিশ । কুড়ি বছরে দাদার রথের সারথি হই ।

-মানে ?

পিছনে ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন - গাড়ির ড্রাইভার । তার থেকেও বেশি বিশ্বস্ত সহায়ক । আপনারা দাদার খুব কাছের গেস্ট । আমাকে পাঠালও । অন্য কেউ হলে , দাদার বাকি ড্রাইভার ছিল। 

সিগন্যালে গাড়ি থেমেছে । আমাদের গাড়ি মৌলালিতে । ত্রিনয়নদার সাথে কথা বলতে –বলতে , আমরা কামাল খানের বাড়ি , পরিবার সম্বন্ধে জানলাম । উত্তরপ্রদেশে এক কৃষক পরিবারের ছেলে । কলকাতায় ভাগ্য অন্বেষণে এসেছিলেন। এখানে চোখে পড়ে রাজারাজ বাবুর । তাঁর বয়েস তখন মাত্র পঁয়ত্রিশ । প্রায় সমবয়সী না হলেও, তাদের পরস্পরের প্রতি সম্পর্ক হতে দেরী হয়নি । বাড়িতে একছেলে আর মেয়ে আছে । দুজনেই গ্রামের বাড়ি ।

সিগন্যাল ছাড়তেই আমরা এগিয়ে গেলাম ।

শ্যামবাজারের গলিতে ঢুকতেই গাড়িটা এতক্ষণ যেই গতিতে ছিল , তা থেকে অনেকটাই কমিয়ে দিল । গাড়িটা বেশ কয়েকটা পাক খেয়ে একটা বাড়ির সামনে এসে থামল । গাড়ি থেকে নামতেই , দেখলাম রাজারাজ এগিয়ে এলেন । বললেন – আসুন , আজ আপনাদের জন্যই আমি গদিতে যাইনি ।

ত্রিনয়নদা বলল - আমাদের জন্য আজকের দিনে আপনার ব্যবসার ক্ষতি হলও ।

-একদম নয় । আমিতো উল্টোটা বলব, আপনার জন্য আমি আজকের দিনে ছুটি পেলাম । আসুন । 

আমরা তিনতলা বাড়ির ভিত্রে ভিতরে ঢুকে চাতালে গিয়ে দাঁড়ালাম। ছাদে কাপড় শুখাতে দিয়েছে । আমাদের ব্যাগ গুলো আমাদের কাছেই । জামাকাপড়ের ব্যাগ আমার পীঠে । যন্ত্রপাতির ব্যাগ মুমিন নিয়েছে । কামাল খান আমাদের দিকে এগিয়ে এলো । 

রাজারাজ বাবু বললেন – শোন , এনাদের ঘরটা দেখিয়ে দে । আমি বৈঠকখানায় আছি । 

আমরা বাড়ির তিনতলায় বাঁদিকে তিনটে ঘরের পর একটা ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। জায়গাটা অপরিচ্ছন্ন। অবশ্য ত্রিনয়নদার পরামর্শেই পরিষ্কার করেনি । ঘর খুলতেই যতটা দেখলাম নোংরা নেই । 

কামাল খান আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল – আপনারা গিয়ে মুখ হাত ধুয়ে নেবেন। ভিতরেই এটার্চ বাথরুম আছে । আপনাদের ঘরের একদম প্রথমেই অনন্তরাজের ঘর ।

আমি বললাম – রাজারাজের ছেলে ?

-হ্যাঁ । আমিই একঘণ্টা বাদে আসব । আশা করছি আপনাদের মুখ ধোয়া হয়ে যাবে ।

ত্রিনয়নদা বলল – কামাল , আপনাকে আসতে হবে না । আমিই রাজারাজ বাবুকে ফোন করে দেব । উনি লোক পাঠিয়ে দেবেন ।

কামাল বলল - আমার অসুবিধা ছিল না। তবে আপনাদের ইচ্ছা । 

আমরা খেতে বসেছি । পাথরের টেবিলে । আমাদের খাবার পরিবেশনা করা হয়েছে । এখন দুপুর দুটো । বৈঠকখানার ঘরে তেমন কথা হলনা । রাজারাজ বাবুর স্ত্রী আমাদের সাথে এসে খুব বেশি কথা বললেন না । তার মুখে আতঙ্ক দেখতে পাচ্ছি । এই বাড়িতে কাজের লোকেরা বেশ মার্জিত এবং অনুগত । দক্ষিণ কলকাতায় ঘরের কাজেরলোকেরা নিজে থেকে এসে পরিচয় করতে ইচ্ছুক, কথা বলেন । উত্তর কলকাতায় কিন্তু অনেকটাই সংযত । আমার মনে হলও , বনেদী বাড়ির বেশ কিছু নিয়মের মধ্যে , এটাও যে তারা বাড়ির কাজের লোক আর মালিকের ভিতরকার অদৃশ্য সীমারেখা কখনই মুছে দিতে রাজি নন । এটাও তাদের পরম্পরাগত ভাবনা । খাওয়ার টেবিলে খুব একটা কথা হল না । 

ছাদে পায়চারি করছিলাম আমরা । ত্রিনয়নদা আমার কাছে এসে বলল – বেদ এখন পর্যন্ত কি কি নোটিশ করলে । মানে গুরুপূর্ণ বিষয় । 

আমি বললাম - দাদা , প্রথমত এই বাড়ির কাজের লোকেরা ভীষণ কম কথা বলেন । রাজারাজের স্ত্রী নিজেও মনে হচ্ছে তেমন খুশি নন । যে ঘরটাতে রয়েছি , গোটা জায়গাটাই থমথমে । বাড়িতে সব কিছু থাকলেও কেমন একটা ছাড়াছাড়া ভাব । 

-আর কিছু ?

-কামাল খান , রাজরাজা তিওয়ারির খুব কাছের । 

-আর কিছু ? 

এমন সময় মুমিন বলল – আমি বলব ?

-হ্যাঁ বলও ।

ত্রিনয়ন দা পাথরে তৈরি বেষ্টনীতে হাত রেখে উল্টো দিকে তাকিয়ে আছে । বলল –আমি শুনতেই চাইছি ।

-দাদা , প্রথম দিন রাজারাজ আমাদের যত কিছু বলেছেন। আজ এতক্ষণ পর্যন্ত যতটা কথা হয়েছে , নতুন কিছু জানতে পারলাম না । শুধু এতটুকু বুঝলাম কামাল খান খুবই কাছের মানুষ ।

আমি দেখলাম ত্রিনয়নদা চুপ করে দূরের দিকে তাকিয়ে দেখছে । আমি বললাম -কিছু বলবে না । 

-আমার মনে হচ্ছে ওরা কিছু লুকিয়ে যাচ্ছে । কেননা ছেলেটাকে নিয়ে কামাল কিছুই বলল না । বাড়ির বাকী সদস্যরাও চুপ ! যে জায়গায় আমরা রয়েছি , ওনার ছেলের ঘর পেড়িয়েই যেতে হবে । আশা করছি সন্ধ্যায় যখন ফিরব , নিশ্চই দেখা পাবো । রাতে মুমিন যান্ত্রিক কোন সমস্যা যেনও না থাকে । 

!!৩!!

বিকেলের দিকে আমরা বাড়ির পিছনের বাগানে ঘুরছিলাম । ত্রিনয়নদা আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে । বলল - কিছুক্ষণ বাদেই আলো নিভে আসবে । এই বাড়ি আরও নিস্তব্ধ , বিচ্ছিন্ন হয়ে উঠবে । 

পিছনে আমরা দুটো ঘর দেখলাম , একটার জানালা ভাঙা । 

ত্রিনয়নদা আমার দিকে তাকিয়ে বলল – বেদ তুমি আর মুমিন ঘরে গিয়ে ব্যবস্থা করে এসো । মনে রাখবে ক্যামেরাটা অন থাকবে । আমরা যখন থাকব না তখন রেকর্ড হবে । 

-দাদা আমাদের ঘরে অন রেখে হবে কি ? 

-না আমি আমাদের ঘরে রাখবার কথা বলছিনা আমাদের ঘর থেকে রাজারাজের ছেলের ঘরের মুখ পর্যন্ত নিরাপদ ভাবে রাখতে হবে । এই ক্যামেরায় আমরা আজকের রাতের সমস্তটাই রেকর্ড করব । এই বাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে রাত এগারোটায় । আশা করছি বারোটার পর থেকেই আমরা ই এম এফ মিটার দিয়ে স্পিরিটটার লোকেশন চিহ্নিত করতে পারব । বেদ এগুলো করতে কত সময় নেবে ?

মুমিন বলল – দুঘণ্টা দাও ।

-ঠিকাছে , এখন ছটা বাজল ।

শাঁখের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি । আমি বললাম – নটা পর্যন্ত বাইরে খোঁজখবর নিয়ে , তারপর দশটায় ডিনার । 

-রাজারাজের ছেলের সাথে কথা বলতেই হবে । উনি আটটায় আসবেন । আমার মনে হয়না কিছু লাভ হবে । তাও জিজ্ঞেস করতেই হবে । আজ সে থাকবে বলেই রাজারাজ বাবু আমাদের ডেকেছেন । 

পাড়ায় এই বাড়ির বেশ সুনাম আছে । শুধু তাই নয় এই বাড়ি নিয়ে কেউ তেমন মুখ খুলতে চাইল না । তবে রাজারাজ বেশ ধনী এবং ক্ষমতাবান । নিজের খরচে পাড়ার অনেক সমাজসেবা মূলক কাজে তার হাত আছে । আমরা সন্ধ্যাবেলা পিঁয়াজি আর মুড়ি খেয়ে ফিরছি । সিঁড়িতে দেখলাম কামাল খান আমাদের বললেন – দাদা আপনাকে ফোন করেছিল , ত্রিনয়ন বাবু । আপনি মনে হয় ফোন দেখেননি । 

ত্রিনয়নদা পকেট থেকে ফোন বের করে দেখল – রাজারাজ বাবুর চোদ্দটা মিস্ ডকল ! 

-ক্ষমা করবেন । আমরা আসলে চারপাশটা একটু ঘুরছিলাম । ছিঃ । লজ্জা লাগছে ।

-অত খারাপ ভাববেন না । আসলে আমাদেরই উচিত ছিল আপনাদের সাথে থাকা । 

-উনি আছেন ?

-সে ঠিকাছে । আপনি আসুন । ত্রিনয়নদা আমাকে আর মুমিনকে পাঠিয়ে দিয়ে , বলল –আপনি ওদের নিয়ে যান । আমি এক্ষুনি আসছি ।

আধ ঘণ্টা বাদেই দেখলাম ত্রিনয়নদা ঘরে এসে ঢুকল । বাড়ির একতলায় খোলামেলা ঘরে রাজারাজ আর আমরা বসে আছি । জলখাবার এসেছে । 

লুচি আর আলুরদম । সাথে রসগোল্লা । খেতে –খেতে আমরা গল্প করলাম । ত্রিনয়নদা তেমন কথা বলছিল না । 

আমরা বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠব । দাদা থেমে গেল । বলল – বেদ , মুমিনকে ই এম এফ মিটারটা । বুঝলি , এই দিক দিয়েই এনার্জির এরিয়া শুরু। আমি নিজে উঠতে আর নামতে টের পেয়েছি। একটা ভারী হাওয়া আমাদের পিছনেই আছে। ক্ষতি করবেনা । সাবধান । 

আমরা উঠছি একটা একটা করে সিঁড়ি , আর বুঝতে পাচ্ছি তিনজন নয়, অদৃশ্য কেউ আছে । মিটারের কাটার তীব্রতা , মানে হাতে যে যন্ত্রটা আছে । মুমিন আরা আমি তাকিয়ে দেখলাম নির্ণায়ক কাটা সবুজ রঙের ঘরের থেকে লাল রঙের ঘরের দিকে যাচ্ছে । এটা স্পষ্ট এখানেই সেই অতৃপ্ত আত্মার অবস্থান রয়েছে ! পুরো জায়গাটা অন্ধকার। ত্রিনয়নদা বলল –নামবার সময় বাল্বটা জ্বলছিল। এখন দেখি কেটে গিয়েছে ।

আমরা আমাদের ঘরের দিকে যাওয়ার আগেই দেখলাম , রাজরাজার বাবুর ছেলের ঘরে লাল আলো জ্বলছে । 

ঘরের কাছে এসে টোকা মারলাম । তিনবার টোকার পর , দরজা খুলে যেতেই , আমরা অবাক ! কোন হরর সিনেমার ডার্ক রুমও এর থেকে কম রহস্যময় হয়। একটা অদ্ভুত বিষণ্ণতা ভরে রয়েছে। লাল হাল্কা আলো ছড়িয়ে রয়েছে, যেনও গ্লাস থেকে লিকার গড়িয়ে গিয়েছে ! ঢুকতেই চোখে কেমন একটা ঝিমুনি ভাব ঝাপটা মারল । 

অগোছালো বিছানা , তার উপর শুয়ে আছে রাজরাজার ছেলে। গোটা ঘর নোংরায় ভরা। জিনিস পত্র ছড়িয়ে। আমরা টের পাচ্ছি আমাদের হাতের আত্মা নির্ধারক যন্ত্রটির সূচক স্থির হয়ে আছে । মানে আত্মা এখন , স্থির হয়ে এই ঘরেই রয়েছে । 

ত্রিনয়নদা ছেলেটির পায়ের কাছে বসল ।

কিছুক্ষণ তাকিয়ে ত্রিনয়ন দা বলল - আপনি লোকেশ ? 

ছেলেটির মাথা ভর্তি চুল । মুখ ঢেকে গিয়েছে । বলল – এই সব কথা না বলে রহস্যটা ফাঁস করুন ।

-মানে ?

-আমি জানি, সে আছে । আপনি জানেন সে আছে। আমি জানি। আমার সাথে আছে। আপনার সাথে নেই ।

আমরা কিছুই বুঝতে পারলাম না। 

ত্রিনয়নদা বলল – সেই রহস্য জানতে আমরাও চাই ।

ছেলেটি এইবার ত্রিনয়নদার দিকে চোখ তুলে বলল – এই বাড়িতে সে আছে। আমি চাইনা সে চলে যাক। তারা তাকে নিয়ে গিয়েছে । সে আসে । আমার কাছে । আমিও তাকে রেখে দেব ।

-সে কে ?

-সেই সে । সে কে ? 

-আমাদের বলুন । 

-সে আমার । আমি দেখি । সে সাথে থাকে । আমিই । 

ঘরের বাইরে দেখলাম ছায়া । ভিতরে এসে কামাল খান বলল – খাবার দিতে বলব ?

রাত দশটা বাজে । ত্রিনয়নদা বলল – আমার পেট ভরা । তোরা খাবি ? 

এমনিতেই বাইরে আর সন্ধ্যার আহারে পেট ভরে গিয়েছে। আবার আজ রাতে জাগতে হবে । স্নায়ুর খেলা চলবে । মুমিনের হাতের যন্ত্রটার সূচকটি লাল রঙের ঘরে যেতেই বুঝতে পারলাম, আত্মা কোন কারনে আমাদের উপস্থিতি সহ্য করতে পাচ্ছে না । দেখলাম ছেলেটি মুমিনের দিকে তেড়ে গেল। কামাল এসে ধরতেই , ছেলেটি বলল - চলে যাও । লজ্জা করছেনা ! 

কামাল তাকিয়ে আছে চোখের দিকে । 

ত্রিনয়ন দা বলল - থাক এখন আমরা পাশের ঘরে যাচ্ছি । 

আমরা থেকে বেড়িয়ে যেতেই , দড়াম শব্দ করে বন্ধ করে দিল দরজা । 

রাতে আমরা দরজা খুলেই গোটা ঘরে হাল্কা লাল আলোর ব্যবস্থা করেছি । ক্যামেরা এত অল্প আলোতেও সমস্তটাই রেকর্ড করে নেবে । আমরা ভীষণ ভাবে সজাগ । কেন জানি আমার লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেল ! 

ত্রিনয়নদা ফিসফিস করে বলল আমার কানে - বুঝলি এই বাড়িতে রহস্য আছে । সে রহস্য আমাদের জন্যই অপেক্ষা করে রয়েছে । এই আত্মাটি এখনো প্রেতাত্মা হয়নি । তবে রিস্ক থেকেই যায় । 

মুমিন ,আমি আর ত্রিনয়নদা খাটের পিছন দিকে বসে রয়েছি । দাদার হাতে আত্মার গতিবিধি বুঝে উঠবার যন্ত্র । সারা বাড়ি এখন অন্ধকারে ডুবে রয়েছে । নিস্তব্ধতা শক্ত পাথরের মতন চেপে বসল । টের পাচ্ছিলাম রাতের নিষ্ঠুর নীরবতা ক্রমশই ভাঙছে । বুকে কেমন একটা কষ্ট টের পেলাম ! না ভয়ের নয় । তাহলে ? আত্মাটা আমাদের অনুভূতিকে প্রভাবিত করছে ! 

আমরা নিজেদের নিঃশ্বাস শুনতে পাচ্ছি । আমরা কিছু দেখতে পাচ্ছিনা , অথচ মনে হচ্ছে কেউ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে ! 

টের পেলাম আত্মা আমাদের ঘরে নেই । আর সে এই ঘরে আসতেও চায়নি । ফাঁকা পেয়ে এসেছে । ত্রিনয়নদা বলল – মুক্ত আত্মা । মানে সে এই সব জায়গা আগে থেকেই পরিচিত । আমাদের এখন দেখতে হবে আত্মাটা কোথায় যেতে চাইছে ? মুক্ত বলেই সে তার পরিচিত জায়গাতে ঘুরছে । আর নির্দিষ্ট সময় শেষে পুরানো জায়গায় ফিরবে । আমরা সবাই বাসা খুঁজি । পৃথিবীতে সব প্রাণীরই বাসার প্রতি মোহ থাকে । আত্মা সেই স্থানেই ফিরবে , অথচ তাকে পরিচিত জায়গায় একটা উদ্দেশ্য নিয়েই আসতে হচ্ছে। এই উদ্দেশ্য আর পরিচিত জায়গার সাথে তার ফিরে যাওয়ার জায়গার অঙ্ক কষে সমাধান করতে পারলেই , এই রহস্যের সমাধান হবে । আমার মনে হচ্ছে , রাজারাজের কাজের লোকটি আচমকাই এমন এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল । সেখান থেকেই হার্টএট্যাক হয়েছে । সকলের নার্ভ সমান থাকে না ।

এটা সত্যি , যারা ভাবেন ভূত বলে কিছু নেই তারা ঠিকই ভাবেন । ভূত আসলে অতীত । মৃত মানুষের আত্মা হচ্ছে তেমনই চলন্ত অতীত ; সে ভূত নয় । এই অনুভূতি এতটাই খাঁটি যে শুধু বর্ণনা পড়ে কিছুই টের পাওয়া যাবে না । 

আমরা তিনজনেই খুব সন্তর্পণে দেখলাম - ঘরের পাশে যে বন্ধ তালা দেওয়া ঘর রয়েছে , সেখানে যেতেই , ত্রিনয়নদার হাতে ধরে রাখা যন্ত্রের সূচকটি থেমে গিয়েছে ! 

ত্রিনয়নদা বলল - বুঝলি এই আত্মা , সারা বাড়ি ঘুরেছে এমনটা নয় । আসলে সন্ধ্যা সাতটা থেকে এই রাত মানে তিনটে পর্যন্ত সক্রিয় থাকে। তারপর সে নিস্তেজ হয়ে যায় । এই আত্মার সাথে রাজারাজ ছেলে আর এই ঘরের যোগাযোগ রয়েছে । এখন এই রহস্যের সাথে ছেলেটির আমার কাছে থাকা --- কথা গুলোর কোন যোগাযোগ রয়েছে ? যদি থাকে তাহলে কালকের দিনে আমাদের কাছে অনেক রহস্য উন্মোচনের সম্ভাবনা রইল । 

!!৪!!

-কামাল খান , আমি চাই তুমি সত্যি কথা বলবে । এর জন্যই তোমাকে এখানে একা ডেকেছি ।পাশের ঘর খুলতে হবে ।

-মানে ?

কামাল খানের গলায় উত্তেজনা । তারপর গলা নিস্তেজ হতেই , বলল – দাদা রাজী হবেন না। 

-কেন এমন বলছেন ? আমি এই মাত্র আপনাকে কথাটা বললাম । জিজ্ঞেস না করেই আপনি বললেন কী ভাবে ? আগে জানান । 

-আমি জানি । 

-দেখুন , যেটা বললাম করুন । এখন এইসব কথা বলবার সময় নেই ।আপনি বিনা প্রয়োজনে এতো কথা বলছেন । 

-প্রয়োজনটা আপনার । তাতে এই বাড়ির নিয়ম ভাঙতে পারব না ।

-নিয়ম ! পুরানো ঘরের দরজা খোলার সাথে নিয়মের সম্পর্ক আছে ?

-দেখুন , দাদা বাবুর কথা অমান্য মানে তাকে অসম্মান করা । এটা নিয়মের বাইরের কাজ । উনি আমার কাছে আল্লা ।

-আপনার কাছে উনি যাইহোক না কেন । আমার কাছে আমার কাজটাই আসল। এখানে সখের জন্য আসিনি । আপনার দাদাবাবুই টাকা দিয়েছেন , আমাকে ভাড়া করেছেন এই কাজের জন্য । আপনি যেমন নিজের দায়িত্বে অবহেলা করেন না । তেমনই আমিও পছন্দ করি না । আর আমার দায়িত্বের মধ্যেই কাজটি পড়েছে । সময় নষ্ট না করে খুলুন ।

-কিছুতেই না । 

ত্রিনয়ন দা ডান হাত দিয়ে কপালের উপর নেমে আসা চুল গুলোকে টেনে, হাসতে -হাসতে বলল – স্বীকার করলেন! মানে এতো তাড়াতাড়ি! 

কামাল খান দাঁড়িয়ে গেলেন । বললেন – বাজে না বকে ফুটুন এখান থেকে । আপনার পাওনা দাদা মিটিয়ে দেবেন।

-দেখুন , আপনি বা আপনার দাদা আমাকে এখানে এনেছেন সমস্যার সমাধানের জন্য । আপনার অতীতের কোন রহস্য ওই ঘরে বন্দী রয়েছে । এইখানে রাতে যে অতৃপ্ত আত্মা আপনাদের ঘুমোতে দেয়না , সেই আত্মার অতীত ওই ঘরেই রয়েছে । আর আপনি ভালো করে জানেন । লাভ নেই , কিছুই লুকিয়ে রাখতে পারবেন না । 

কথাটা শুনেই , খাটের উপর কামাল খান ধপ করে বসে পড়লেন । মুখ শক্ত বিষণ্ণ । ত্রিনয়নদা বলল

-আপনি আরও অনেক কিছুই জানেন । আমার মনে হচ্ছে চেপে যাচ্ছেন ।

কামাল খান নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন 

-দেখুন আমার চেপে যাওয়ার মতন কিছুই নেই । এটা একটা অভিশপ্ত জায়গা । বাড়িটায় কেউ তুক করেছে ।

-সত্যি ! আমার আগে কাউকে ডাকেননি কেন ?

-অনেককেই ডেকেছি ।তারা কেউই অভিশাপ মুক্ত করতে পারেনি । দাদার ছেলে , সেও এই অভিশাপে যুক্ত হয়ে পড়ল । 

-অভিশাপ এমনি আসেনা । তাকে ডেকে আনতে হয় । আপনারাও ডেকেছিলেন । আমার কাছে খুলে বলুন । কর্মফল ভোগ করতে মানুষকে অন্য জন্মে যেতে হয়না । এই জন্মেই সে পায় । 

-আমরা কোন অন্যায় করিনি ? বলেই কামাল খান চুপ করে গেল ।

ত্রিনয়নদা হাসল । এখন জানলা দিয়ে রোদ এসে পড়ছে । সারারাত আমাদের একটা ধকল গিয়েছে । তাই মুখ ধুয়ে , চা খেয়ে , কামাল খানকে আমাদের ঘরেই ডেকে নিয়েছিলাম । রাজারাজ বাবুর ছেলে ঘরেই আছে । সে পুরো উন্মাদ বলব না । তবে এটা ঠিক , সে সুস্থ নয় ।

ত্রিনয়ন দা বলল - কামাল আপনাকে পাশের ঘরের দরজা খুলতেই হবে । সেই ঘরের ভিতর শুধু যে এই বাড়ির গোপন রহস্য আছে , তা নয় । আপনার দাদার একমাত্র ছেলের ভবিষ্যৎ লুকিয়ে রয়েছে । আমি জানিনা , আপনারা কি করবেন । তবে আমাকে এত টাকা দিচ্ছেন , অথচ রাজারাজ বাবুর ছেলের জন্য কিছু করতে পারব না ! আপনার দাদাকে গিয়ে বলুন । 

কামাল আচমকাই মুখে হাত দিয়ে কেঁদে ফেললেন । ত্রিনয়নদা মাথায় হাত বুলিয়ে বলল - দেখুন দোষ করলে শাস্তি পেতেই হয় । তাই বলছি পালিয়ে থেকে লাভ নেই । সব খুলে বলুন ...... 

কামাল খান কাঁপা গলায় বললেন - 

মুনিয়া বলে একটি মেয়ে এই বাড়িতেই থাকত । দাদার ছেলের থেকে বছর দুয়েক ছোট । দাদা তাঁর ছেলেকে ব্যবসায় মনোযোগী করে তুলবার জন্য পাত্রী দেখা শুরু করেন । সে ছেলে নাছোড় বান্দা , এখন দায়িত্ব নিতে চায়না । সে পাত্রী দেখতে যাবেনা বলল । সন্দেহটা হচ্ছিল , আশঙ্কা করেছিলাম শেষ পর্যন্ত সত্যি হলও !

-মানে ?

-মুনিয়া আর দাদাবাবুর সম্পর্ক আছে । শুধু তাই নয় , এক রাতে আমি নিজের চোখে তাদের একবিছানায় দেখি । 

-তারপর ?

-সেই রাতের তিনদিন বাদে , দাদা তার ছেলেকে ডেকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন । উনি ছেলের বারংবার পাত্রী দেখতে না যাওয়ার ব্যাপারটাতেই ধরে ফেলেছিলেন । 

-ছেলেটি অস্বীকার করেছিল ?

মুচকি হেসে কামাল বললেন – তাহলে ভালোই হত । তা না হয়ে দাদার বিপক্ষে গিয়ে বলল , মেয়েটিকে সে বিয়ে করবে । প্রস্তাব রাখল ! শুধু তাই নয় , মুনিয়াকে না পেলে সে নিজেই এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে । 

-তারপর ? 

-কথাটা দাদার কানে পৌঁছায় । সে আমাকে দায়িত্ব দেয়।

ত্রিনয়ন দা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে শুনছিল । এখন খাটে এসে বসল ।পিছনে আমরা বসে আছি । আর সামনের চেয়ারে কামাল খান । এইসময় চুপ করে ছিলেন । বললেন – বাবু আমি তাকে মারতে চাইনি ।

-মানে !! 

আমিও চমকে উঠলাম ! 

-আমি তারপর মেয়েটিকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করেছিলাম । এরমধ্যে দাদাবাবু তাঁর ছেলেকে কলকাতার বাইরে পাঠিয়ে দেন । একদিন রাতে , মেয়েটিকে আমি অনেক বোঝানোর চেষ্টা করি । সে বোঝেনি । শেষে রেগে গিয়ে নিজেকে সামলাতে না পেরে , হাতের কাছে ছুরি দিয়ে গলায় কোপ বসিয়ে দিলাম ! 

-মানে ?

-হ্যাঁ , তখন ছিল এই সন্ধ্যা ছটা । সিঁড়ির তলায় অন্ধকারে আমাদের মধ্যে কথা হয় । আমার হাতে সবজী কাটার চাকু ছিল । বুঝতে পারিনি এমন হবে । আমি ওকে তাড়াতাড়িতে নিয়ে এসে এখন যেই ঘরে দাদাবাবুর ছেলে আছেন , সেই ঘরেই বিছানার উপর শুইয়ে দিলাম । গলা দিয়ে গলগল করে রক্ত ছুটছে ! মুখ , বুক , পেট এমন কী চাদর পর্যন্ত ভিজে গেলো । বাঁচাতে পারলাম না । 

- বডিটা ?

-স্যার , আমি ডাক্তার ডেকেছিলাম। দাদার পরিচিত , ফ্যামিলি ডাক্তার । সে বলে দিল মুনিয়া আর নেই। তারপর দাদাকে সব বলেদিলাম । মেয়েটার মৃতদেহটাকে গভীর রাতে , কালো জং ধরা বাক্সে ঢুকিয়ে রাখলাম । বাক্সটা আপনাদের পাশের ঘরে রেখে , দরজায় তালা দিয়ে রাখলাম । চাবিটা আমার কাছেই । 

ত্রিনয়নদা বলল – কামাল চলুন পাশের ঘর থেকে লাশটা উদ্ধার করি । আমি নিশ্চিত লাশটা ওখানেই আছে । মেয়েটির আত্মা সেই ঘরেই রয়েছে । খুনটা হয়ত সিঁড়ির নীচেই হয়ে থাকবে । আচমকাই । তাই এনার্জি গোটা এরিয়ায় নিজেকে খুঁজতে থাকে । রাজারাজ বাবুর ছেলের সাথে তার সম্পর্ক গভীর ছিল । তাই খুব সহজেই নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে । আরেকটা কথা আপনি একটা সত্যি এখনো বলেননি । সেই দিন গাড়িতেও চেপে গিয়েছিলেন । 

আমরা অবাক হয়ে কামালের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম ।ত্রিনয়নদা বলল 

-মুনিয়া আপনার মেয়ে । আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি, এখানে আপনার সাথে আপনার মেয়েও থাকত । রাজারাজের ছেলে একবছর ব্যাঙ্গালোর ছিল । সেই সময়ে এই কাণ্ডটা ঘটান । ওরা ছোটবেলার বন্ধু বিয়েতে মত দিতেই পারতেন ।

কথাটা শুনেই , কামাল খান রেগে গেলেন । বললেন – আমাদের সম্পর্ক খুব ভালো । তাই বলে আলাদা ধর্মের ছেলে মেয়ের বিয়ে মেনে নেব ! বাপ হয়ে মেয়েকে অন্য ধর্মের হাতে দেব ? রাজারাজও পাক্কা হিন্দু । সে কেনই বা আমার মেয়েকে নেবেন ?

-সেটা ওদের দুজনের হাতে ছেড়ে দিতেন । মাঝখান থেকে দুটো ভবিষ্যৎ নষ্ট করে ফেললেন । এটা ঠিক ? দেখুন অন্যায় করলে শাস্তি পেতেই হবে । আশা রাখছি নিজের অন্যায় স্বীকার করে নেবেন । আপনাকে আর দরজা খুলতে হবেনা । পুলিশ এসেই ভাঙবে । 

ত্রিনয়নদা বারান্দায় এসে ফোন করল । লোকাল থানাকে খবর দিল । 

পুলিশ এসে দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকল । একটা লম্বা জং ধরা লোহার কালো বাক্স দেখলাম । খুলতেই ভিতরে প্রায় গুঁড়ো হয়ে ধুলো হয়ে আসা কঙ্কাল । কালো বাক্সের আড়ালে এতোদিন যে পাপ আত্মগোপন করে ছিল , আজ যেনও তা দিনের আলো দেখেছে ! মেয়েটি এখনো মুক্তি পাবেনা ? মনে হচ্ছে , আত্মার মুক্তি আসন্ন । 

ত্রিনয়নদা বাক্সের ভিতর তাকিয়ে বলল – মেয়েটির কঙ্কাল । এই ঘরেই মেয়েটির আত্মা বন্দী হয়ে রয়েছে । এই বাক্সটি নিয়ে যান । রাজারাজের ছেলে একবছরের জন্য বাইরে চলে যায়, অসম্পূর্ণ ডিগ্রী নিয়েই ফিরে আসে । এর মধ্যেই মেয়েটিকে খুন হয় । এরপর লোকেশ এইখানে এসেছিল , আর মেয়েটির আত্মা তাকে নিয়ন্ত্রিত করতে শুরু করে । ধীরে –ধীরে মেয়েটি প্রভাব বিস্তার করে । মেয়েটির আত্মা লোকেশকে নিজের করবার জন্যই ঘুরে বেড়ায়। এই কালো বাক্সটিই হচ্ছে মেয়েটির অতৃপ্ত অনুভূতির উৎস স্থল। ভারতীয় প্রেত দর্শন বলছে , এই অপূর্ণ অনুভূতিই আত্মাকে প্রেতাত্মায় পরিণত করে । 

!!৫!!

আমরা নিজেরাই ক্যাব বুক করে নিলাম । গাড়ি ছুটছে । আমি বললাম – ভারী অদ্ভুত ! মালিকের এতো কাছের যে তার জন্যই এই খুন । এখনো আমাদের মধ্যে ধর্ম নিয়ে মূর্খামি রয়ে গিয়েছে !

ত্রিনয়নদা বলল – ব্যাপারটা অত সরল নয় । কামাল খান নিজের মালিকের প্রতি পুরোটাই আত্মসমর্পণ । ধর্মীয় কারনে এই বিয়ে , কামাল খানকে সমাজের কাছে ছোট করত । আবার মালিকের চোখেও বিশ্বাস ঘাতক হয়ে যেত । শুধু তাই নয় , এত কিছু করে সে কি পেত ? মানে মুনিয়াকে যে কয়েক বছর পর রাজারাজের ছেলে ছুড়ে ফেলে দেবে না সে দায়িত্ব কে নেবে ? ভেবে দেখো , একজন পিতা নিজের মেয়ের জন্য শান্তিপূর্ণ জীবন খোঁজে । দুজনের বাড়িতেই সমস্যা রয়েছে । বেদ তোমার মনে হয়না খুবই জটিল ?

মুমিন বলল – রাজারাজ মনে হয়না ছাড় পাবেন । কামাল খান এর শাস্তি হবে । কিন্তু ছেলেটা । 

ত্রিনয়নদা বলল – পুলিশ রিপোর্ট আসতেই , বাক্সটাকে অন্যত্র সরিয়ে নেবে । ছেলেটাও অন্যত্র চলে যাবে । আমার মনে হচ্ছে , মেয়েটির আত্মা ধীরে – ধীরে নিজের শক্তিকে রূপান্তরিত করতে পারবে । আসলে আচমকাই খুন হয়ে যাওয়ায় নিজের অস্তিত্বকে মেনে নিতে পারছিল না । যে কাজের লোকটি খুন হয় বা মারা যায় , তা আচমকাই মেয়েটার অশরীরী উপস্থিতি টের পেয়ে । এই জায়গায় নতুন করে পজিটিভ এনার্জি প্রবেশ করাতে হবে । 

আমাদের ক্যাব এগিয়ে চলেছে । আশা রাখছি বাড়ি তিনটের মধ্যেই ফিরতে পারব । এখন দুপুর দুটো । 


chakrabortypinaki50@gmail.com


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.