কাজে এতটা অমনোযোগী হলে তো কোম্পানী লাটে উঠে যাবে। আর তো তিনটে মাস। একটু মন দিয়ে কাজটা করুন, নাহয় ছুটি নিয়ে বাড়িতে বসে বিশ্রাম নিন।
বড়োবাবুর কথাগুলো মাথা নীচু করে হজম করে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন অতীনবাবু। আজকাল কি যে হয়েছে, সঠিকভাবে কিছুই যেন মনে রাখতে পারেন না। অথচ যে সমস্ত কথাগুলো মনে রাখতে চান না, সেই কথাগুলো দিনরাত পাক খায় মাথার মধ্যে। আজ বত্রিশ বছর এক কোম্পানীতে কাজ করে, শেষ অবধি তারিখ ভুল লেখার জন্যও কথা শুনতে হলো!
ফাইলে তারিখগুলো ঠিক করে লিখতে গিয়েই খেয়াল হয় অতীনবাবুর। আজকের দিনেই চলে গিয়েছিল মেয়েটা। অন্যবছর সুপর্ণাই মন্দিরে গিয়ে একটু পুজো দিত মেয়েটার নামে, যাতে ওর নতুন জীবনটা স্বাভাবিক হয়। এইবছর সুপর্ণাও নেই, চলে গেছে আজ সাড়ে আটমাস হলো।
আজ বহুদিন পর মেয়েটার কথা মনে পড়ল। বাড়িতে সুমির নাম নেওয়াও বন্ধ। ছেলে-বৌমা পছন্দ করে না। ওরা চায়না সুমির সামান্যতম স্মৃতির ছায়াও ওর মেয়ের ওপর পড়ুক। সুমির একটা ছবি অবধি নেই বাড়িতে। সুপর্ণা মাঝে মাঝে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদত। যতই হোক মা তো! কান্না তো অতীনবাবুরও পায়। কিন্তু বাবাদের কাঁদতে নেই, বুকে পাথর বেঁধে সব সহ্য করতে হয়। সুমি পেটে থাকাকালীন একবার এক হিজড়েকে কোন সাহায্য না করেই দরজা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল সুপর্ণা। ওর মনে একটা ধারণা জন্মেছিল, সেই পাপেই মেয়েটা অমন সৃষ্টিছাড়া মানসিকতার হয়েছিল। চিরকাল একটু পড়াশুনোর অভ্যেস অতীনবাবুর। সুমির সমস্যাটা নিয়ে জানার জন্য কলেজস্ট্রীটে বই খুঁজতে গিয়েও কি কম বিদ্রুপ সহ্য করতে হয়েছিল! বই পড়েই জেনেছিল, এই সমস্যার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও হয়। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি স্বাভাবিক চাহিদার বদলে সমচাহিদা কোন রোগ নয়। কারও কারও জীবনে সেই চাহিদাটুকুও স্বতঃস্ফূর্ত স্বাভাবিক। অতীনবাবু বুঝেছিলেন, সুমি কোন পাপ বা রোগের স্বীকার নয়। কিন্তু সেটা কাউকেই বোঝাতে পারেননি। সুমি ওর এক বন্ধুর দিদির সাথে সারাজীবন কাটাতে চেয়েছিল। ছাপোষা মধ্যবিত্ত সামাজিক মানুষ, সুমির সিদ্ধান্তটাকেও মেনে নিতে পারেননি। সুমি আত্মহত্যা করেছিল। ডায়েরীতে লিখে গিয়েছিল, সেই মেয়েটিকে ছাড়া ওর পক্ষে বেঁচে থাকাটাই অসম্ভব। তার থেকে ওর কাছে মৃত্যুও ভালো। মনে মনে হিসাব করেন অতীনবাবু। দশ বছর হলো নেই মেয়েটা। অজান্তেই চোখের কোণ দুটো জলে ভরে ওঠে।
আকাশের মতিগতি বোঝা দায়। এই মেঘলা তো এই পরিষ্কার। একটু আগেও পরিষ্কার আকাশ ছিল, হঠাৎ টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। অফিস টাইমের প্রত্যেকটা বাসেই ভিড়, একটু ভদ্রভাবে দাঁড়ানোর জায়গা পাওয়াই ভাগ্যের ব্যাপার। তুলনামূলক একটা ফাঁকা বাসে উঠে একটা বসার জায়গাও পেয়ে যান অতীনবাবু। মনে মনে নিজের ভাগ্যকেই একটু তারিফ করে নেন।
বাসের সবাই যেন বিশেষ কিছু আলোচনায় ব্যস্ত। ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করেন অতীনবাবু।
সমকামিতা আজ ভারতবর্ষে আইনি স্বীকৃতি পেল।
চোখ ফেটে জল আসছে অতীনবাবুর। কেন দশটা বছর আগে এই আইন হলো না, মেয়েটাকে অকালে মরতে হতো না তাহলে....
রাস্তা জুড়ে অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা আনন্দ করছে। যেন একটা উৎসবের আমেজ। এরা কি প্রত্যেকেই সমকামী! ছেলেমেয়েগুলোকে মনে মনে আশীর্বাদ করেন অতীনবাবু। ওরাও সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন পাক এবার, সমাজের অনেক গঞ্জনা সহ্য করে এসেছে এতদিন।
আজ একটু প্রতিবাদী হতে ইচ্ছা করছে অতীনবাবুর। বাস থেকে নেমে কিনে ফেললেন একটা ফুলের মালা আর একটু মিষ্টি। বাড়িতে আজকাল ইলেকট্রিক ধূপ জ্বলে, তাতে না কোন গন্ধ, না কোন ধোঁয়া। শুধু একচিলতে লাল আলো। এক প্যাকেট সুগন্ধী ধূপও কিনলেন। আজকের দিনটা সত্যিই অন্যরকম।
বাড়ি ফিরে স্নান সেরে আলমারী থেকে সুমির ফটোটা বের করলেন দশবছর পর। টেবিলে রেখে, মালা পরিয়ে, জ্বেলে দিলেন একগোছা ধূপকাঠি। বৌমাকে এক প্লেট চাইলেন। বৌমা তো সব দেখে অগ্নিমূর্তি। এসব কি ভণ্ডামি শুরু হলো, দাঁড়ান আপনার ছেলেকে ফোন করছি।
কারও কোন কথাতেই কান দিলেন না অতীনবাবু। মনের ভালোলাগাটুকু আজ নষ্ট করতে নারাজ তিনি। সুমি কোন পাপ বা অন্যায় করেনি, আজ আইন তা মেনে নিয়েছে। ছেলেবৌমার অশান্তিকে আর ভয় পাবেন না।
পাঁচবছরের নাতনি মিন্তিকে নিজের কাছে ডেকে হাতে মিষ্টি দিতেই দারুণ খুশি সে।
মিষ্টি দিচ্ছ যে, আজ কি গো দাদান? সবকিছুতে প্রশ্ন পাকাবুড়ির।
আজ উৎসব। হেসে উত্তর দিলেন অতীনবাবু।
কিসের উৎসব!!!!
সত্যি তো কি জবাব দেবেন অতীনবাবু? আজ কিসের উৎসব!!!!
ও দাদান, বলো আজ কিসের উৎসব।
একটু ভেবে জবাব দিলেন অতীনবাবু, আজ "ভালোবাসার উৎসব"।
banabithipatra00@gmail.com
খুব ভালো লিখেছ বীথি।
উত্তরমুছুনসুচিন্তিত মতামত দিন