পর্ব ৩
সম্ভবত আর্য জাতিসত্ত্বা বলতে যে বহিরাগত তত্ত্বটিতে এতদিন ধরে ঐতিহাসিকদের নির্ভরতা ছিল সেটি এখন নিরসনের পথে । এই ভূখণ্ডের উত্তর পশ্চিমাংশ জুড়ে যে যাযাবর জাতি ক্রমান্বয়ে বাসস্থান পরিবর্তন করে করে শেষ পর্যন্ত সরস্বতী অববাহিকায় থিতু হয়েছিল তাদেরই আমরা আর্য বলি । ঊষর বন্য পরিবেশে থাকতে থাকতে এই যাযাবর গোষ্ঠীগুলির মানুষজন রুক্ষ্ম স্বভাবের হয়ে পড়েছিল । স্বভাবে নম্রতা ছিলোনা বললেই চলে। ক্রমাগত যুদ্ধবিবাদের ফলে তাদের স্বাভাবিক ক্রুরতা ভীষণ বেশি ছিল। বন্য পশুকে এরা ব্যবহার করতে শিখেছিল । বুনো ঘোড়াকে বশ মানিয়ে তাইতে সওয়ার হয়ে এরা ভূখণ্ডের মধ্য থেকে পূর্ব ও দক্ষিণ প্রান্তের স্থিতিশীল সম্পন্ন জাতিগুলিকে আক্রমণ করত । শান্তিপ্রিয় ও সম্পন্ন সেসব মানুষ যুদ্ধবিমুখ ছিল । বহির্বানিজ্যে উন্নত মানুষজন পারস্পরিক সম্পর্কে ক্ষমতা বা প্রভুত্ব নয় , সৌহার্দ্য রক্ষা করতে জানত । কারণ তাইই ছিল তাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মূল কারণ । ফলে ধারালো অস্ত্রের সামনে , দুরন্ত গতির অশ্বারোহীর সামনে তারা হার স্বীকার করল । নিহত হলো । লুণ্ঠিত হলো । আর এই যাযাবর নৃশংস গোষ্ঠীগুলিই প্রথম বিজিত পক্ষের নারীদের লুণ্ঠন ও ধর্ষণের দ্বারা প্রতিরোধ ব্যর্থ করতে শুরু করে । বস্তুত তেমন অকাট্য পাথুরে প্রমাণ হাতে না থাকলেও কিছু কিছু ঘটনার উল্লেখ করলে বোঝা সম্ভব । দাস বা শুদ্র বলে আর্যরা যাদের চিহ্নিত করত তারা ত বিজিত গোষ্ঠীর মানুষ ছিল । এই দাসেদের বা বন্দীদের কাজ ছিল সমাজের বাকি তিন বর্ণের সেবা । কেমন সেবা ? শুদ্র নারী যদি নিজের স্বাধীন অবস্থানে কোনও কুলের প্রধানাও হয়ে থাকেন , আর্য দলপতির দ্বারা বিজিত ও ধর্ষিত হয়ে তাঁর প্রধান কর্ম বা শাস্তি হয়ে দাঁড়ালো পুরুষের শয্যায় যাওয়া । সে পুরুষ গোষ্ঠীপতি স্বয়ং হতে পারে বা তার অতিথিও হতে পারে । বৈদিক সাহিত্যে এমন ভূরি ভূরি কাহিনী ছড়িয়ে আছে , যেখানে গৃহে আগত ঋষি , যিনি কিনা ব্রহ্মজ্ঞ বেদজ্ঞ ইত্যাদি ইত্যাদি , তাঁর সেবার জন্য এক বা একাধিক নারী কামনা করবেন । সুন্দরী , পীনবক্ষা, গুরুনিতম্বিনী নারী দর্শনে তাঁরা এমন কামার্ত হয়ে পরেন যে যেখানে সেখানে রেতঃপাত ঘটে যায় সেইসব উর্দ্ধরেতা ঋষির । নারী তাদের কাছে স্খলিত রেতর আধার মাত্র । কামনার উপশম মাত্র । মানুষ নয় ।
ফিরে আসি পূর্ব প্রসঙ্গে । যারা ভাবছেন আর্যরা তো সাংঘাতিক বিদগ্ধ , পণ্ডিত , ও ধর্মবেত্তা, তাঁরা এমন অসভ্য হীন কর্ম কেন করবেন ? তাদের বলি , মেধার উৎকর্ষ থাকলেই যে চারিত্রিক উৎকর্ষ থাকবে এমনটা নাই হতে পারে । বিশেষ করে আর্য ধারণায় নারীকে যখন অবমানব ভাবাটা চেতনায় গেঁথে গিয়েছে । সুতরাং পণ্ডিত ও ধার্মিক একই সঙ্গে ধর্ষক ও পীড়ক । এরকমই আরেকটি ঘটনাকালের সাক্ষী কি আমরা ইতিহাসে পাইনি ? যখন ইসলাম শাসকের দল উত্তর পশ্চিম প্রান্ত ধরে ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছিল । ইতিহাসের পাতা ভরে আছে অজস্র নারীর হত্যা ধর্ষণ ও লুণ্ঠনে । কখনো কোনও সুলতান দয়াপরবশ হয়ে বেগম করেছেন পরধর্মের নারীকে । সে বিচ্ছিন্ন ঘটনা । আসলে এটি যুদ্ধনীতি । নারীকে পদদলিত করে অধিকার করতে পারলে দুটি উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয় । একটি প্রজনন অপরটি সম্ভোগ । প্রজননের দ্বারা নিজ গোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ে । যুদ্ধে লড়বার লোক বাড়ে । আর সম্ভোগ ত ক্ষমতা প্রদর্শনের সেরা উপায় ! ফলত দেখা গেলো , এমন শত শত গোষ্ঠীর হয়ত কুলমাতৃকা ছিলেন যে নারী তিনিই পীড়িত হলেন । উপরন্তু তাঁর সম্পদ ও ভূমি গ্রাস করা হলো ।
ভারতের মাটিতে ঋক বেদের রচনা শুরু হয়েছিল আনুমানিক খ্রীষ্টপূর্ব দ্বাদশ শতাব্দীর আশেপাশে । আর সর্বাপেক্ষা অর্বাচীন সুক্তটি রচিত হয় খ্রীষ্টিয় পঞ্চম শতকে । অর্থাৎ বৈদিক যুগের ব্যপ্তি সতেরো থেকে আঠেরো শতক ।
এই গেলো প্রাচীন অধিবাসীদের পরাজয়ের অষ্পষ্ট ইতিহাস এবং মাতৃতন্ত্রের অবসানের প্রহর । পূর্ব ও দক্ষিণের দুর্গম (পর্বত ও দুরন্ত নদনদী দ্বারা বিচ্ছিন্ন ) অঞ্চলগুলি অবশ্য তখনও অগম্য ছিল । ফলত আর্য সভ্যতার প্রভাব এসব অঞ্চলে সমকালে প্রায় ছিলোনা বললেই চলে ।
একবার ঋক বেদ ঘাঁটি বরং। দেখতে পাচ্ছি একটি প্রাচীন রচনা। যেখানে ঊষাকে এক সুন্দরী সুসজ্জিতা রমণী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। হাস্যমুখী বধূ যেমন স্বামীর সামনে নিজের রূপ উন্মোচন করে তেমনি ঊষা তাঁর রূপ উন্মোচন করেন। তাঁকে বলা হয়েছে নির্লজ্জা । সমাজে নারীর বিচরণের ক্ষেত্রে কি তবে তখনই একরকম নিষেধাজ্ঞা শুরু হয়ে গিয়েছিল ? লজ্জার ধারণাই বা এলো কিভাবে ? এবং কেন ? শরীর ঢাকতে মানুষ যে পোষাকের ব্যবহার শুরু করে সে ত শীত গ্রীষ্ম থেকে বাঁচতে ! প্রাকৃতিক কারণেই । তবে লজ্জা নিবারণের প্রশ্নটি কবে থেকে উঠল ? বিশেষত নারীর ক্ষেত্রে ? পুরুষ যদি যৌবনবতী নারীকে দেখে কামাতুর হয়ে পড়ে তবে সে দোষ নারীর । সেটিই তার লজ্জা । অতএব আচ্ছাদন দাও । লজ্জা নিবারণ করো । শুধু সেই পুরুষের সামনে নগ্ন হও যে তোমাকে অধিকার করেছে ।
anindita.gangopadhyaya@gmail.com
সুচিন্তিত মতামত দিন