অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী

পুজোর বাতাস বহে
পুলের নিচ দিয়ে কুলকুল করে বয়ে চলেছে ভাদ্র মাসের জল। পরিস্কার কাঁচা জল। জলের নিচ অবধি দেখা যায়। সেখানে নরম মাটি কামড়ে বসে রয়েছে তিনটি গেঁড়ি। কালকে এরা ছিল না। বদলে আমি দেখেছি এক জলঢোঁড়া চকচকে রুপালি একটি পুঁটিকে মুখে ধরে জ্যাঙ্গালের তকতকে জল সাঁতরে যাচ্ছে দূর মাঠের গহীন জলের দিকে। পুলের উপর শুয়ে হাত বাড়ালে সেই জল ছোঁয়া যায়। যা মানুষের ঘর-বাড়ি-উঠোন ডুবিয়ে দিতে দিতে কোথায় নেমে যায়, কে জানে! পুলের উপর বসে জলের সেই উদ্দাম ও গম্ভীর চলা দেখতে দেখতে ভাবি সোনা মিস্ত্রির কথা। 

জল টপকে আসে সোনা মিস্ত্রি। আমাদের এলাকার দুর্গা ঠাকুর গড়ার কারিগর। সে মা দুর্গার মুখ ছাঁচে ফেলে বানায় না। নিজের হাতে তৈরি করে। এক তাল নরম আধ শুকনো কাদামাটি নরুন দিয়ে একটু একটু করে কাটতে কাটতে মায়ের মুখ সে বানিয়ে ফেলে। তার জন্যই সোনা মিস্ত্রির এত কদর। সে বলেছে তার নিজের হাতে গড়া মা দুর্গার একটি মুখ আমাকে বানিয়ে দেবে। আর তাই আমার এত অপেক্ষা তার গমনাগমনের পথ এই পুল ধারে। সেখানে বসে জল টপকে আসা সোনা মিস্ত্রি কেবল জলেরই গল্প করে যায়। বলে, ‘এবার আর রেহাই নেই। তাদের গ্রাম চলে যাবে জলের তলায়। এত বিস্টি হচ্ছে যে বলার নয়। আকাশে বিস্টি মাটিতে বিস্টি। মাটিতে যদি কেবল বিস্টিই থাকে তবে মানুষ থাকে কেমনে?’

‘তোমার গ্রাম তো সোমরপুর? সেখানে কি নদী আছে?’

‘সেখানে নদী নাই গো, নদী আছে দূরে। সে বন্যার উপচায়। পাড় ভাঙ্গে। অন্যবার জল আসে বটে কিন্তু সে এসে থেমে যায় গেরামের আগে অবধি। যারা ভিন দেশ থেকে। বর্ডার টপকে আসে, তারা নদীর পারে বসত করে, তারা ডুবে যায়। কিন্তু এবার? আশ্বিনের দুই তারিখে মহালয়া, ভাদ্দের ঘোর তখনও কাটবেনে। আর ভাদ্দর হল বন্যার মাস। এবার পুজোতে দেখবে, আকাশ রোজ তার মুখ খুলে রাখবে।’

তাই কি আসে না সোনা মিস্ত্রি? জল তাকে ঘিরে নিল, নদী তাকে তুলে নিল নিজের কোলে-কাঁখে? তাই সে জল বায়, জলেরই মূর্তি গড়ে? জলের ঘর তার, জলেরই বাড়ি। তাহলে এতগুলো গ্রামের মূর্তি গড়ার যে বায়না সে নিয়েছে, তার কি হবে? পুজো কি এবার তাহলে হবে না?

আমি আস্থির হয়ে উঠি। অন্য সব ছেলেরা যতই সারাদিন তার সামনে বসে থেকে নানা কাজে সাহায্য করুক, আমার দাদু দুর্গা মায়ের পুজো করে; তাই মিস্ত্রির সঙ্গে ছিল আমার আলাদা খাতির। আমি তাই রাস্তায় বসে থাকি। দিন পাঁচ সাত হয়ে গেল, সোনা মিস্ত্রি কাত হয়ে থাকা সাইকেলটা চেপে এ পথ দিয়ে আর যায় না। দাদু বলছিল, ‘দেখ, হয়ত জল উঠেছে।’

এই সময় দেখি একটা গাড়ি যায়। তাতে সব আমাদের গ্রামের লোক। মধু বেলেল, নিমে কাঁড়ার, গোবেন শীট, তারক, বাঁটলে-ফকির-। সঙ্গে হরিদেবপুরের, বাজেশোলার কিছু জন। ৪০৭ গাড়িতে নানা মালপত্তর। আমার সামনে গাড়িটা ঘ্যাঁচ করে দাঁড়িয়ে গেল। ড্রাইভার সিটে বসে আছে ফদা। বললে, ‘খোকন, এই ভর দুপুরে এখানে একা একা কি করিস? জানিস না বন্যার সময় ছেলেধরারা বেরোয়?’ 

গোবেন শীট উপর থেকে হাঁক মারল, ‘গাড়িতে উঠে আয়।’

‘কোথায় যাবে তোমরা?’

‘সোমরপুর। সোনা মিস্ত্রির গ্রাম। তার গ্রাম ডুবে গেছে। আমরা সেখানে খাবার-দাবার দিতে যাচ্ছি। আর যাচ্ছি মিস্ত্রিকে তুলে আনতে। যে চালাতে ও ঠাকুর গড়ে সেখানেই খড়ের চালাঘর করে ওকে আমরা রেখে দেব।’ 

এর পর কি আর কোন কথা থাকে? উঠে পড়লাম। হুস করে গাড়ি চলতে থাকল। মোরাম ধোয়া রাস্তা। দু’ ধারের ধূ ধূ মাঠ এখন জলের কবলে। কেবলি জল আর তাতে সাদা বক উড়ে বেড়ায়। রাস্তার ধারে কাশফুল ফোঁটার চেষ্টায় উন্মুখ। আকাশের মেঘ যেন পাট পচানি জলের মেঘ। কত পাট কতদিকে বন্যার টানে ভেসে গেল, কে জানে। 

গতকাল জলার মনসার পুজো দিয়ে ভাদ্দর মাস শুরু হল। আজ ভাদ্দরের দুই তারিখ। পরের দুই তারিখে মহালয়া। পুজোর বাতাস যেন ভাদ্দ পড়লেই বইতে শুরু করে—সে পুজো আশ্বিনের যবেই হোক না কেন। ভাদ্দর পড়লেই বাতাস নিজে নিজেই ঢাক বাজায়। মনের ভেতর গুড়গুড়। 

গাড়িতে কাত হয়ে দাঁড়িয়ে জানা গেল বড় বড় নদীতে জল ছেড়েছে, চারিদিক ভেসে গেছে। কার্তিক মিস্ত্রির গ্রাম এখন বন্যার কবলে। সে যে যে গ্রামে ঠাকুর গড়তে আসে, আমাদের ছোটচৌঘরা, পাশের বড়চৌঘরা, মুকুন্দপুর, জগরামপুর, হরিদেবপুর—সব গ্রামের ঠাকুর এক চালাতেই তৈরি হয়। তারপর গ্রামে গ্রামে চালান যায় ভ্যানে করে। সোমরপুর জলের তলায় এই খবরে সকল গ্রাম মিলে তখন সিধান্ত নেয়, একটা গাড়ি ভাড়া করে ত্রাণ পৌঁছে দেবে। 

তখন কেঊ এক বস্তা মুড়ি দেয়। কেউ খেতের ফসল, চালের শাক, জমির কচু-আলু-বেগুন-পটল, গাছের আমড়া দেয়। গয়লারা দেয় টিন ভরতি ছানা আর দুধ। তখন ফদা বললে, গাড়ি আমার আছে, আমি দেব।

সোনা মিস্ত্রির গ্রাম অবধি গাড়ি গেল না। রাস্তা কাটা। তাতে কী? আমরা গাড়ি একপাশে রেখে হাতে হাতে মালপত্র বয়ে নিয়ে যেতে থাকলাম। এক হাঁটু জল। তাই ভেঙ্গে আমরা গ্রামের দিকে যেতে থাকলাম। পিছু পিছু আসে একট কুকুর দুটি শালিক। দূরের বকেরা জলে বাঁধা গরুর পিঠের উপর দাঁড়িয়ে আমাদের দেখে। 

গ্রামের কাছাকাছি পৌঁছতেই এক বিশাল কদমগাছের নিচে জড়ো হওয়া কিছু গ্রামবাসী আমাদের দেখে ফেলে। তখন তারাই জলকাদা ভেঙ্গে মাল বইতে আসে আর বলে, ‘বানভাসির পর এই প্রথম আমাদের গ্রামে কেউ ত্রাণ দিতে এল।’ 

নিমে কাঁড়ার তখন বললে, ‘আমরা কিন্তু এমনি এমনি আসিনি। আমরা কার্তিক মিস্ত্রিকে ধরে নিয়ে যেতে চাই। ওর থাকা খাওয়ার দায়িত্ব আমাদের। বদলে ও আমাদের মূর্তিগুলি গড়ে ফিনিশ করে দেবে। দিন পনের হল, তার কোন খবর নেই, কোন যোগাযোগ নেই। এদিকে প্যান্ডেল করতে হবে—।’ 

তখন গ্রামবাসীরা মলিন মুখে জানাল, ‘এই জল-বাজারে সেটা তো ভাল প্রস্তাব। কিন্তু মিস্ত্রি আর এখানে নেই। আর সে কোথায় আছে, কি খাচ্ছে কেউ জানে না।’ 

কিন্তু সে গ্রামছাড়া হল কেন? তার তো কোন পিছুটান নেই। ছিল ওই এক মেয়ে, তাকেও বিয়ে দিয়ে দিয়েছে এক বছর হল। নানা গ্রাম ঘুরে ঘুরে নানা পুজোর মূর্তি গড়ে সম্বৎসর তার যা ইনকাম তাতে একার চলে যাবে আরামে। তবে গ্রাম ছাড়া হবার দরকার কেন পড়ল তার? সে যে গেছে তা কি একবারেই গেছে? ফেরার কি কোন পথ নেই? অনেকদিন আগে সে বোম্বেতে গিয়েছিল মূর্তি গড়তে। এবারইও কি তাই গেল? তাহলে এতগুলো গ্রামের পুজো সম্পন্ন হবে কি করে?

গ্রামবাসীরা জানাল, না, ব্যাপারটা তা নয়। ওর যে এক মেয়ে ছিল, তা জান। অনেক লেখাপড়া দিয়েছে, কলেজ পাশ দিয়েছে। আমাদের ঘরের মেয়েদের এই এক বিপদ, বেশি লেখাপড়া করলে পাত্র জোটান মুশকিল। মেয়েটা নিজে দেখেই বিয়ে করল এইট পাশ পাত্রকে। বিয়ের আগে পাত্র ছিল একরকম, বিয়ের পর হল অন্যরকম। সে মেয়েটাকে কিছুতেই পড়তে দেবে না। এদিকে মেয়ের সখ আরও পড়বে, পি এইচ ডি করবে, কলেজে পড়াবে। এই নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে ঝামেলা হত নিত্য। শেষে একদিন মেয়েটাকে ওরা আসিড খাইয়ে মেরে দিল। বলল, আত্মহত্যা। তখন জানা গেল, ও পোয়াতি ছিল। গর্ভের শিশুও মারা গেল মায়ের সাথে। সেই থেকে কার্তিক নিরুদ্দেশ। তার ঘরখানা দুয়ার খোলা অবস্থাতেই পড়ে আছে।’ 

আমরা তার ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। মাটির ঘর, মাটির দেওয়াল, মাটিরই জানালা। তার গাছের গায়েও মাটি লেপা। বোঝা যায় সোনা মিস্ত্রি মাটিকে ভালবাসত খুব। হয়ত ওর মেয়েটাও ছিল মাটির। পুজোরই আগে তাই সে মাটিতে মিশে গেল। 

তার ঘরের ভেতর জল। ভেতরে আসবাব তেমন কিছু নেই। একটা ছোট চৌকি ও আলনা। উঁচু তাকের উপর গোল গোল কাদার তাল রাখা। কেউ একজন বললে, ‘এই সেই কাদা, যা দিয়ে মিস্ত্রি মুখ বানায়।’ 

তার ঘর থেকে বেরুচ্ছি, এক খনখনে বুড়ি বসে ছিল পাশের বাড়ির দাওয়ায়। জানা গেল, সম্পর্কে সে মিস্ত্রির খুড়ি। আমাকে ডেকে বললে, ‘তুমি কে গা ছেলে? আমাদের জন্যি নিজের ঘরে খাবার নে এলে? কোন গেরামে বাড়ি তুমার?’ 

শুনে বুড়ি বললে, ‘তোমার দাদু কি মা দুগগার পুজো করে? তোমার নাম তবে খোকন?’ 

আমি অবাক হয়ে বললুম, ‘হ্যাঁ।’

বুড়ি তখন মাড়ি বার করে এক গাল হেসে বললে, ‘ওমা, দেখ কান্ড! আমার ভিটের সামনে দিয়ে তুমি হেঁটে গেলে আর আমি চিনতেই পারলুম নি গা! তোমার জন্যে যে আমার ঘরে একটা জিনিস আছে। কেতো যেদিন নিরুদ্দেশে চলে যায়, সেদিন এটা দিয়ে গেছিল। দাঁড়াও, নে আসি।’

বুড়ি তড়বড় করে ঘরে ঢুকে গেল। হাতে করে নিয়ে এল মা দুর্গার রঙহীন মাটির মুখ। আমার হাতে দিয়ে বললে, ‘সোনা যেদিন চলে গেল, সারারাত জেগে এটা বাইনেছে। যাবার আগে আমাকে বলে গেল তোমার কথা। বলে, পুজোর বাতাস বইলে আর এখেনে থাকতে পারব না খুড়িমা। এটা তুমি তাকে দিও। আমি তাই ঠায় জেগে রই, কখন তুমি আসো। সোনা আমাকে বলে গেছিল, তুমি একদিন ঠিক আসবেই আসবে এটার জন্য। আজ আমি দায়মুক্ত হলুম। যাও, নিয়ে যাও একে।’ 

আমি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মা দুর্গার মুখটি দেখতে লাগলুম। মস্ত এক তৃতীয় নয়ন ফুটে আছে কপালে। আমাকে ঘিরে থাকা সকলের চোখ ওই তৃতীয় নয়নের দিকেই। 

নিমে কাঁড়ার স্বগক্তির মতন বলে, ‘এমন মুখই তো ফি বছরই করে সোনা মিস্ত্রি। আমরা মায়ের তৃতীয় নয়ন দেখে মোহিত হই। মেয়েরা গলবস্ত্র হয়। আহা, কি মুখ! মিস্ত্রি সব ভুলে গেলেও আমাদের গ্রামকে সে ভোলেনি। যাবার আগে সে কি উপহার তুলে দিয়ে গেছে, দেখ! এই মুখই আমাদের প্রতিমার মুখে এবার শোভা পাবে। কেবল কোথা থেকেও একটা পোটো যোগাড় করতে হবে।’ 

এক গ্রামবাসী বললে, ‘মা দুর্গার মুখ বটে এটা, তবে দেখায় যেন তপতীর মত। আহা, বড় কষ্ট পেয়ে মারা গেল সোনার অমন ফুলের মত মেয়েটা!’ 

নানা কথা বলাবলি করতে করতে আমরা গাড়িতে উঠে পড়লাম। গাড়ি চলতে শুরু করল। আমাকে নামিয়ে দিল পুলের সামনে। 

গোবেন বললে, ‘এখন মুখটা তুই ঘরে নিয়ে যা। আমরা পরে তোর থেকে নিয়ে নেব।’ 

চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। গা শিরশিরে জলকণা মিশ্রিত বাতাস দিচ্ছে। বেলা পড়ে আসছে। বকেরা জলরাশি থেকে উড়াল দিচ্ছে। গোধূলিহীন ভাদ্রর সন্ধে একটু বাদেই ঝুপ করে চলে আসবে। তার ভেতর কেবল জল প্রবাহের শব্দ। গাছের পাতারা হলুদ হয়ে খসে পড়ছে সেই জলে। 

পুলের উপর শুয়ে পড়লাম। আস্তে আস্তে হাত বাড়িয়ে দিলাম প্রবল স্রোতের দিকে। জলছোঁয়া লাগতেই গাটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। হাতটা ছেড়ে দিলাম। স্বচ্ছতার ভেতর তৃতীয় নয়ন গলে গিয়ে আকাশের এক কোণে স্থাপিত হল। পুজোর বাতাস দিলেই সে কাঁদতে শুরু করবে।

আমি দ্রুত বাড়ির দিকে পা চালালাম। 

aniruddhachakraborti900@gmail.com 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সুচিন্তিত মতামত দিন

নবীনতর পূর্বতন