সারাক্ষণ জড়িয়ে থাকলেও তুমি এক দুর্বোধ্য রহস্যের মত। ঘিরে থাকো অথচ ছুঁয়ে দেখতে চাইলে ছুটে পেরতে হয় দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ, উত্তর থেকে দক্ষিণ, মাটি থেকে আকাশের সীমানা পর্যন্ত। ধরা যায়না আপন করে্, ঠিক যেমন করে ধরতে চাই। আজ কিছু জবাব চাইবো তোমার কাছে। প্রিয় স্বদেশ, তার জটিল জীবনযাত্রা আর ততোধিক জটিল সভ্যতাকে নিয়ে অনেকগুলি প্রশ্ন জমে গেছে আমার। মুখোমুখি দুদণ্ড বসে তারই কিছু সাজিয়ে দেব তোমার সামনে আর অপেক্ষা করব উত্তরের। হে সময়, এড়িয়ে যেওনা।
তুমি কি শুধু সরলরেখা ধরেই বয়ে চলেছ নিরন্তর নাকি আরও কিছু দাবি তোমাকে মেটাতেই হয় সে সব জানতে চাইবোনা। আসলে তোমাকে আদ্যোপান্ত পড়ে নিতে চাই সঠিক উচ্চারণে। কোন অলৌকিক বিষয়ে কৌতুহল নেই আমার। নিজের জন্মের মুহূর্তে যে সময় আমাকে ঘিরে ছিল আলো বাতাস আর সমস্ত গ্রহ নক্ষত্র তিথি পল অনুপল নিয়ে, সেই সময়ের প্রতি আমার আগ্রহ নেই। আমার বর্তমান কোন কোন গিরিখাত থেকে ছুটে আসা হাওয়াদের স্রোতে ভেসে যাচ্ছে অবিরাম কিম্বা আমার ভবিষ্যৎ কেমন সঙ্গীতের মূর্ছনায় আনমনা হয়ে ছুটে যাবে কোন পাতাঝরা বনপথে তা নিয়েও আমার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। সেসব না হয় থাকুক সাজানো ড়্রয়িং রুমে, হাতের রেখায়, কপালের ভাঁজে, তুলোট কাগজে আর বানানো সফটওয়্যারে। আমি সেই সময়কে সামনা সামানি পেতে চাই যে গাছ থেকে মাটিতে আপেল পড়ে যেতে দেখেছে অনাদিকাল থেকে। যে নদীর একপাড়ে দাঁড়িয়ে থেকে অন্য পাড়কে বলেছে তোমাকে একটু ভাঙতে চাই। আবার চুপি চুপি কোন মগ্ন কবির কাছে এসে কানে কানে বলেছে আমাকে তোমার পাণ্ডুলিপি দাও।
হে রহস্যময় সময়, আদি অন্তহীন নিরবচ্ছিন্ন বয়ে চলা মহাকাল। হাতের মুঠোয় ধরতে পারিনা বলে কি পালিয়েই বেড়াতে পারবে চিরকাল! তাহলে এত অপূর্ণতার দায় কে নেবে? মানুষ ভালো নেই এখন। তাদের মুখে অনেক রকম দুঃখের ঝিলিক। চেহারাতে চাপা অস্থিরতা। অনেকের মনে ক্রোধ। হৃদয়ে ব্যথা। কিন্তু মুখে কুলুপ। ভয়? আতংক? আসলে চারদিকে যা ঘটছে তাতে নিশ্চিন্ত নেই কেউ। অসহিষ্ণু হয়ে যাচ্ছে মানুষ। দেশের এক এক প্রান্তে এক একরকমের অস্থিরতা। আমরা তো জেনে এসেছি এতকাল সভ্যতা সহিষ্ণুতা শেখায়, সহবত শেখায়, উন্নত হবার মেরুদণ্ডটা সোজা আর শক্ত করে দেয়। সভ্যতা তো সভ্যতাই শেখায়। তাহলে এতো অ-সভ্যতা কেন! এত অসহিষ্ণুতা! এতো হিংসা! এমন তো নয় যে শুধু একটা চোরাস্রোতই বয়ে যাচ্ছে সবার চোখের আড়ালে, কেউ টের পাচ্ছেনা। প্রকাশ্যেই তো চলছে সব! অসভ্যতা, হিংসা, মারামারি, খুনোখুনি সব। রক্তের প্রতি এত ভালোবাসা কবে থেকে এলো মানুষের! অতি তুচ্ছ কারণে খুন হয়ে যাচ্ছে মানুষ। একবারও মনে থাকেনা সম্পর্কের কথা, মানবিকতার কথা। সামান্য কারণে একজনকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার দর্শন কি করে এত ব্যাপক হয়ে নেমে এলো জীবনে! ক্ষমতার লোভ? অনেক কিছু অর্জন করার প্রলোভন? বন্ধুত্বের সম্পর্কের মধ্যেও ঢুকে যাচ্ছে বিষ। জায়গা নিচ্ছে হিংসা, অকারণ রেষারেষি। নেমে আসছে সম্পর্কের অন্ধকার। ঘটে যাচ্ছে অপরাধ। অতি তুচ্ছ কারণে। আর সবগুলোই কেমন যেন দ্রুত ঘটে যাচ্ছে। ধরা পড়তে পারে জানে, চরম শাস্তিও হতে পারে জানে। তবু ঘটে যাচ্ছে। তাহলে কি তারা এগুলো জানেই না? অন্যের অনিষ্ট করা পাপ, কারও জীবন কেড়ে নেওয়ার অধিকার কারও নেই, সেটা আরও বড় পাপ। এই নীতিবোধ কি তাদের শেখানো হয়নি? সৌজন্য, সম্মান, ভালোবাসা, সম্পর্ক, শ্রদ্ধা, মূল্যবোধ সব অবান্তর হয়ে পড়ে থাকছে পথের একপাশে। মূল্যহীন। অপ্রাসঙ্গিক।
আমি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চাই সেইসব অনাচার, অধঃপতন আর নৈতিকতার নির্মম অবসান যেগুলি জীবনকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে অন্য এক অন্ধকারের দিকে। কথা তো ছিল ভ্রাতৃত্বের বন্ধন আর সম্পর্কের উষ্ণতায় ভরে থাকবে সংসার। মায়া মমতায় ভরা এই জীবজগতে সবাই সুখে থাকবে, আনন্দে থাকবে। সবার সব সাধ হয়তো মিটবেনা, তবু একটু আরাম, একটু নিশ্চয়তা, এটুকু তো আশা করতেই পারে মানুষ। ভালো থাকার স্বাধীনতাও কেন এখনো অর্জন করতে পারলনা সবাই? এত বছর পরেও? চারদিকে শুধু বেপরোয়া অনাচার, মিথ্যাচার আর ক্ষমতা প্রদর্শন। এ কোন জনগোষ্ঠী! প্রকাশ্যেই প্রদর্শিত হচ্ছে উল্লাস যার পিছনে কোন সদর্থক ঘটনা নেই। কিছু জয় করে আসার গরিমা নেই। শুধু ধ্বংস আর বিপর্যয় ডেকে আনা পেশিশক্তির আয়োজন।
মুখগুলি চলে যাচ্ছে মুখোশের আড়ালে। চেনা যাচ্ছেনা আসল মানুষটিকে। ভাষায় ব্যবহারে বেরিয়ে আসছেনা অন্তরের আসল রূপটি। অসততা আর সীমাহীন লোভ অনেককেই টেনে নিয়ে যাচ্ছে গিরিখাতের অন্ধকারে। যাদের হাতে ক্ষমতা, তারা জনতাকে বঞ্চিত করে হাতিয়ে নিচ্ছে সুখ, ঐশ্বর্য। খুব দ্রুত অনেক অর্থ চাই। আরও চাই, আরও। নীতিহীন বল্গাহীন দৌড়ে জিততে গিয়ে অনেক পিছনে পড়ে থাকছে মনুষ্যত্ব আর মূল্যবোধের ধারণাগুলি। অন্যদিকে অনাহারে অপুষ্টিতে মরে যাচ্ছে মানুষ। শুধুমাত্র কোন প্রত্যন্ত গ্রামেই নয়, খোদ রাজধানীর বুকেও। প্রান্তিক মানুষগুলির দায় নিতে কেউ রাজি নয়। তাদের দুঃখটুকু শুনবার বা বুঝে দেখবার কেউ নেই। কমে যাচ্ছে পাশে দাঁড়ানোর প্রতিবেশী। জীবনের চলমান স্রোতে জেগে উঠছে নতুন নতুন চর। অবক্ষয়ের, অসহিষ্ণুতার, অসুন্দরের। সেখানে বাসা বাঁধছে অসাধু আগন্তুক। বিচ্ছিন্নতার, বিপথগামীতার। এক গর্ত থেকে আর এক গর্তের ঘূর্ণিতে পড়ে পাক খেতে খেতে খণ্ডিত জীবনের যে অমৃত তাদের পান করতে হচ্ছে তার স্বাদ বড় তিক্ত। কিন্তু নিঃশব্দ গলাধঃকরণ ছাড়া তারা নিরুপায়। তোমার মনে রাখা দরকার এইসব।
এত বছর হয়ে গেল, এতগুলো বছর। কথা ছিল মানুষ নিজের দেশে নিজের মত স্বাধীন নাগরিক হয়ে ভাল থাকবে। ভ্রাতৃত্বের হাত আড়াল করবে পাশের জনকে উটকো বিপদ আপদ থেকে। আমরা অবশ্যই স্বাধীন, কিন্তু মাঝখানে গড়ে উঠেছে অনেকগুলো দেওয়াল। কারা তুলছে সে দেওয়াল সন্দেহ ঈর্ষা ঘৃণার মসলা মাখিয়ে দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। পায়ে পায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে অনেকগুলো বাধার শিকল! যাতে চাইতে না পারি, এগিয়ে যেতে না পারি, এমনকি ভাবতেও না পারি। অথচ কথা ছিল জীবনে জীবন যোগ হবে। যে আনন্দধারা বয়ে যাচ্ছে ভুবনে সেই ধারায় অবগাহন করবে প্রতিটি মানুষ। অনাবিল মুক্তি, হাসি আর আনন্দের উদযাপনে শেষ পর্যন্ত জয়যুক্ত করবে জীবনকেই।
তুমি কি উত্তর দাও সেই কৌতূহল নিয়েই এসেছি তোমার কাছে। তোমার স্রোতের বিপরীতে চলতে চায় যারা, তোমার চাকাকে ঘুরিয়ে দিতে চায় উলটো দিকে, তাদের অভিপ্রায়ে কতটা মদত আছে তোমার তা জানা দরকার। অনবরত পাল্টে যাচ্ছে মূল্যবোধ, ভালোবাসার মানে, ব্যক্তি স্বাধীনতার সংজ্ঞা। তোমার প্রশ্রয় কতটা জানতে চাই। আদি অনন্তকাল ধরে অবিরাম চলতে থাকার মাঝেও কখনো কখনো মনে হয় যেন তুমিও থেমে আছ। যেন মহাবিশ্বের কেউ টেনে ধরেছে তোমাকে পিছন থেকে। কখনও মনে হয় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছ বিষণ্ণতা সঙ্গে নিয়ে। অথচ মায়া আর বিদ্বেষ দুটিই জেগে থাকে তোমার ইঙ্গিতের অপেক্ষায়। অপরাজিত ম্যাজিকের দক্ষতায় কোন কার্যসিদ্ধি অভিপ্রেত তোমার? আমার উত্তর চাই।
![]() |
তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় tarasankar.b@gmail.com |
সুচিন্তিত মতামত দিন