⤺‘একলব্য’
স্তব্ধ অরণ্যে শব্দ ওঠে সাঁই সাঁই শন্ শন্
আশ্চর্য এ কোন্ বালক দুঃসহ তপে মগন্!
ব্যাধ রাজা হিরণ্যধনুর পুত্র একলব্য নাম
তিরন্দাজী শিখতে গিয়ে গুরুগৃহে পেল না স্থান।
নিষাদ কুলের ছেলে অন্ত্যজ জাতি
কলঙ্কিত করে যদি রাজ-কূল খ্যাতি!
ব্যাধপুত্র একলব্য, নির্নিমেষ চেয়ে দেখে—
রাজার ছেলেরা সব অস্ত্রবিদ্যা শেখে।
গুরুর চরণধূলি আশিষ মাথায়
কালো ছেলে অভিমানে ফিরে যায়।
অনেক দিন নাকি অল্প দিন, কে জানে
অরণ্যের বনস্পতি সময় না গণে।
একলব্য বেড়ে ওঠে ঋজু শাল গাছ
কঠোর সাধনায় সে সিদ্ধব্রত আজ।
ঈশ্বর এক, পিতা এক, গুরু একজনই হয়
দ্রোণাচার্য গুরু তার, মনে এই দৃঢ় প্রত্যয়।
গড়েছে মাটির গুরু-মূর্তি অরণ্যের নির্জনে
নিয়ত অভ্যাস করে যতনে একমনে।
***
রাজপুত্রদের হাসি গল্পের অবসরে
অজ্ঞাতকুলশীল এক সারমেয় এসে পড়ে।
সুকৌশলে কণ্ঠরোধ, মুখে তার গাঁথা পাঁচখানি তীর,
চমক লাগে সবার, এ কাজে পটু কোন্ লক্ষ্যভেদী বীর!
আছে এ রাজত্বে অর্জুন ভিন্ন কোন্ জন
জানা চাই সেটা, দ্রোণ অধীর হন।
খোঁজ পাওয়া গেল, সেই সে নিষাদ ছেলে
তীরন্দাজীতে অজেয় হয়েছে আপন মনোবলে।
অভিমানে অর্জুন
টান মেরে ফেলে দেয় ধনুর্গুণ।
কথা হয়েছিল শ্রেষ্ঠ বিদ্যা যত
দ্রোণ তাকে শেখাবেন চুক্তিমতো।
দ্রোণ বলেন, ‘অর্জুন, তুমিই থাকবে শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর
যে প্রতিজ্ঞা করেছি তার হবে না নড়চড়।’
ধীর পায়ে গেলেন অরণ্যের নির্জনে
যেখানে একলব্য তীর ছোঁড়ে এক মনে।
গুরুকে দেখেই চরণে লুটায় নিষাদ রাজার ছেলে
দ্রোণ বললেন, ‘দক্ষিণা বিনা বিদ্যা কেমনে নিলে?
গুরুদক্ষিণা দিতে হবে তোকে নাহলে বিদ্যা ব্যর্থ।’
‘গুরুর চাওয়াই শেষ কথা মানি, জানি না অন্য স্বার্থ!’
নিষাদ-পুত্র এমত বাক্য জানায় নতশিরে,
সুস্থির অতি বালক শিষ্য একলব্য ধীরে।
গুরুর আদেশের প্রতীক্ষায়
সহিষ্ণু বীর একলব্য দাঁড়ায়,
ঋজু শাল গাছ সম সাহসে অটল
দীর্ঘশ্বাস লুকান গুরু, প্রতিজ্ঞা অবিচল।
অর্জুন প্রিয় শিষ্য, সে রবে শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর
চির-কলংক শিরে বয়ে নিয়ে, হৃদয়ে রেখে পাথর।
অতএব শোনালেন নিষ্ঠুর বিধান
‘ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুল করো মোরে দান,
এই মোর গুরুদক্ষিণা—
অন্য কিছু নেই প্রার্থনা!’
নিষাদ জাতির অন্ত্যজ ছেলে স্বাভিমানী একলব্য
নিস্পন্দ হয়ে মাথা পেতে নিল অমোঘ ভবিতব্য।
নিথর অরণ্য কোল পেতে নিল ‘গুরুদক্ষিণা কাব্য’
এখনও চলেছে সেই প্রহসন ‘অর্জুন-একলব্য’।
![]() |
সুমনা সাহা |
সুচিন্তিত মতামত দিন