শ্রী গোপী

গণমানুষের কবি।
“দেয়ালে দেয়ালে 
মনের খেয়ালে 
লিখি কথা,
আমি যে বেকার 
পেয়েছি লেখার 
স্বাধীনতা…”

বাংলা সাহিত্যের মার্কসবাদী ভাবধারায় বিশ্বাসী এবং প্রগতিশীল চেতনার অধিকারী তরুণ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যর অনুকাব্যের এদু’টি লাইন তার গঠিত বাক্য, তার সুখশ্রাব্য উচ্চারিত ধ্বনি আজও  সমাজ সংস্করণে বক্তব্য প্রধান  মানবিক ভাবধারায় মুক্তমনা সাহসী এবং স্পস্টবাদী কবিদের উদ্বুদ্ধ হতে উজ্জীবিত করে তোলে।

তথাপি, সমাজে ঘটে চলা ধর্ষণ, নারী লাঞ্ছনা যখন প্রতিদিনের শিরোনাম, শিশু শ্রমিক, ভ্রুন হত্যা আমাদের অভ্যাসে, জাতপাতের নামে উলঙ্গ করে দেওয়া শিক্ষার হাল আত্মস্থ না হলেও বাধ্য বাধকতায় ধাতস্ত, মেধা হত্যা থেকে স্বজন পোষণ, দমন পীড়ন যেখানে মূলত সভ্য শাসন, রাজনীতি আদর্শের না হলেও স্তাবকতায় যেখানে অপরিহার্যের, সংবিধান - প্রণীত আইন - প্রশাসক ... ভাবনায় কতটা রক্ষক! , ভোগরোগ এর ক্রমবর্ধমানে যেখানে দুর্নীতি, বিচ্যুতি, হুজ্জুতি এখন উৎসবের চেহারায়, অবাধে অযোগ্যতায় সর্বত্র লুটপাটের ব্যপকতা, সেখানে আজকের দিনে সমাজ, নাগরিকের প্রভুত উন্নতি সাধনে - মাঝে মাঝে এই সময়ের সাহিত্য চর্চা, সাহিত্য আন্দোলন, সাহিত্য সম্মান, সাহিত্য অনুরাগীদের নিরঙ্কুশ নীরবতায় - ব্যক্তি ভাবনায় মনে হয়, অসংখ্য অনলাইন পত্রিকা, সোশ্যাল নেটওয়ার্ক, মুদ্রিত সঙ্কলন - পত্রিকায় এতো লেখালেখি, প্রকাশিত সেইসব লেখা আত্মগরিমায় হলফ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ হয়তো মনের খেয়ালে বেকারের স্বাধীনতাই, অথবা চিত্তবিনোদনের অভিপ্রায় যা কোনও মানুষের কাজে আসে না, এমন কি সমাজের ক্ষেত্রেও না।  আবার ক্ষণমাত্র অনুভব হয়, হয়তো কাজে আসে। 

নচেৎ, ক্ষণজীবীতা যে কেবল ক্ষণজীবী প্রভাই ছড়ায় না, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য। কেননা পরাধীন দেশের দুঃখ দুর্দশাজনিত বেদনা এবং শোষণ মুক্ত স্বাধীন সমাজের স্বপ্ন, শোষিত মানুষের কর্ম জীবন এবং ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্য আমরণ সংগ্রামই ছিল তাঁর কবিতার মূল প্রেরণা। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের মতো যাবতীয় শোষণ বঞ্চনার বিপক্ষে তাঁর ছিল দৃঢ় অবস্থান। তিনি তাঁর কবিতার মধ্য দিয়ে দূর করতে চেয়েছিলেন শ্রেণী বৈষম্য। মানবতার জয়ের জন্য তিনি সব সময় লড়াকু ভূমিকায় অবতীর্ণ থেকেছেন। 

আমরা অবগত তাঁর লেখনী প্রভাবিত হতো তাঁর সাম্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গী ও সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির অভিজ্ঞতা থেকে। চারপাশের মানুষকে নিয়ে তাঁর যে প্রত্যক্ষ উপলব্ধি ছিলো, তাই তিনি লিপিবদ্ধ করতেন কাগজে। অনুভূতিগুলো ছিল এতই প্রখর, প্রকাশ করতে গিয়ে তাঁর কলম হয়ে উঠতো যেন তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর। তাঁর কবিতার ছন্দ, ভাষা, বাক্যে রচনাশৈলী এতই সহজ, এতই সরল, এতই প্রাণবন্ত যা সাধারণ মানুষের কাছে খুব দ্রুত গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। 

 কবি সুকান্তের সমস্ত জীবনটাই ছিল কবিতার সাথে একাত্ম। তাঁর আগুন-ঝরানো কলমে ফুটে ওঠে যেন বিদ্রোহের গান-

হে সূর্য
তুমি আমাদের উত্তাপ দিও—
শুনেছি, তুমি এক জ্বলন্ত অগ্নিপিন্ড,
         তোমার কাছে উত্তাপ পেয়ে পেয়ে
একদিন হয়তো আমরা প্রত্যেকেই এক একটা জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ডে 
        পরিণত হব!
তারপর সেই উত্তাপে যখন পুড়বে আমাদের জড়তা,
          তখন হয়তো গরম কাপড়ে ঢেকে দিতে পারবো
          রাস্তার ধারের ঐ উলঙ্গ ছেলেটাকে।
আজ কিন্তু আমরা তোমার অকৃপণ উত্তাপের প্রার্থী।।


ন্য একটি কবিতায় দায় দায়িত্ব বোধ দুঃখের গভীর অনুভবে লিখলেন – 

রানার ! রানার !
এ বোঝা টানার দিন কবে শেষ হবে ?

রাত শেষ হয়ে সূর্য উঠবে কবে ?
ঘরেতে অভাব; পৃথিবীটা তাই মনে হয় কালো ধোঁয়া,
পিঠেতে টাকার বোঝা, তবু এই টাকাকে যাবে না ছোঁয়া ...।


বাংলা সাহিত্যের দিকপাল রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, দিজেন্দ্রলাল রায়, জীবনানন্দ দাশসহ সে সময়ের বড় বড় কবি সাহিত্যিকের সময়কালে তাঁর কর্ম, তাঁর ধর্ম, তাঁর বয়সকে এমনকি তাঁর  জীবনকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে তাঁর প্রতিভা, মেধা ও মননের পরিণত ভাবনা। যা বিস্ময়কর।

স্বাভাবিক ভাবেই মার্কসবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য গণমানুষের আস্থাশীল কবি হিসাবে বাংলা সাহিত্যে খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে স্বতন্ত্র স্থান করে নেন। তাঁর কবিতা পাঠককে সাহসী করে, উদীপ্ত করে, আশাবাদী করে তোলে। তাই তো তিনি আজও গণমানুষের কবি। 

আজ এই দিনে ১৯২৬ সালের ১৫ই আগস্ট বাংলা ১৩৩৩ সালের ৩০শে  শ্রাবণ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য জন্মগ্রহণ করেন। জন্মদিনে গণমানুষের কবিকে বিনম্র প্রণাম।




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.