প্রোজ্জ্বলকে গুম হয়ে বসে থাকতে দেখে সুনীল বলে উঠল, - কি প্রোজ্জ্বলদা, আজ মাথা নীচু করে চুপচাপ বসে আছেন কেন, শরীর ঠিক নেই?
- নারে ভাই, এই বয়সে শরীর যে রকম থাকা উচিত সেই রকমই আছে, মেজাজটা ঠিক নেই।
- মেজাজের আবার কি হল?
- আজ হাঁটতে আসার একটু আগে নাতি দাদু হাঁ করো বলে আমার মুখে একটা চকোলেট দিয়ে বলল, “স্কুলে আমার একটা ফ্রেণ্ডের আজ বার্থডে ছিল, আমাদের সবাইকে টফি দিয়েছে, তুমি একটা খাও।“ সেটা বউমা দেখতে পেয়ে আমাকে “বাবা, আপনার হাই সুগার আপনি চকলেট খাচ্ছেন?” বলেই নাতিকে বকাবকি শুরু করে দিলেন।
- প্রোজ্জ্বলদা, আপনার হাই সুগার? আপনি তো প্রায়ই এখানে আমাদের সাথে চিনি দেওয়া চা-ই খান।
- বাড়িতে আমি চিনিছাড়া চা-ই খাই।
গঙ্গার ধারে থানার সামনের অর্ধবৃত্তাকার বসার জায়গার বেঞ্চগুলো বিকাল পাঁচটা থেকে সাড়েছটা পর্যন্ত বৃদ্ধবৃদ্ধাদের সান্ধভ্রমণে এসে বসার জন্য যেন অলিখিতভাবে সংরক্ষিত। শিবদাস, সমীর, প্রোজ্জ্বল, বীরেন, বঙ্কিমদা, আর সন্দীপন রোজ এমনই একটা বেঞ্চে এসে বসেন। এদের মধ্যে বঙ্কিদার বয়স আশির ওপর, আর বাকি সবারই বয়স পঁয়ষট্টি থেকে পঁচাত্তরের মধ্যে। নাতি নাতনীদের কথা, শরীর স্বাস্থ্য, পেনসন, রাজনীতি সবই গল্পের মধ্যে থাকে। শিবদাস তার হাতের ছোট্ট ব্যাগ থেকে গজা বার করে সবাইকে দিয়ে বলল,
"জগন্নাথদেবের প্রসাদ খান, ছেলে বউমা পুরী গিয়েছিল"।
- আপনি গেলেন না?
- না ভাই, আমি সেই আশি সালে গিয়েছিলাম, তারপর আর যাওয়া হয়নি।
বীরেন বলল, - আজ তো বঙ্কিমদা এখনও এলেন না?
- আজ বোধ হয় বঙ্কিমদার শরীরটা ভাল নেই।
বেঞ্চের সামনে রেলিং এ হেলান দিয়ে সমীর দাঁড়িয়েছিল, সে বলল, - ওই বেঞ্চের ঘোষদাকে তো কদিন ধরে দেখছি না। উনি কি ব্যাঙ্গালোরে ছেলের কাছে গেছেন?
- আপনি তো গত সপ্তাহে দুদিন আসেননি, তাই জানেন না। উনি এখন ওপরে চলে গেছেন। গত শুক্কুর বার ব্যাঙ্গালোর থেকে ছেলে এসেছিল, পরের দিন সন্ধ্যায় ছেলের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে হঠাত শরীরটা কেমন করছে বলে রাস্তাতেই বসে পড়ে খুব ঘামতে থাকলেন। সঙ্গে সঙ্গে চোখে মুখে জল দিয়ে হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তারবাবু দেখে বললেন “সব শেষ হয়ে গেছে, ম্যাসিভ হার্ট এ্যাটাক।“
- ভাগ্য ভাল মশাই, কোন কষ্ট পেতে হল না। মনে হয় যমরাজকে ম্যানেজ করার খুঁটির জোর ছিল।
সামনের বেঞ্চের হরিদা দাসদাদের গ্রুপটা এখনও আসেনি, একজোড়া তরুণ তরুণী এসে ওখানে জড়াজড়ি করে বসে আছে। সিভিল ড্রেসের একটা পুলিশ ওদের কাছে এসে বলল, - এই তোমরা এখানে বসে কি করছিলে? এখানে বয়স্ক মানুষরা সব বসে আছেন আর তোমরা ওনাদের সামনে অসভ্যতা করছ? চলো থানায় চলো।
- কি করেছি আমরা?
- কি করছিলে আমার ক্যামেরায় তোলা আছে, এখন থানায় চলো।
- জানেন, আমার মামা এখানকার মেয়র।
- আরে চল এখন থানায়, আগে এই মামারবাড়ি চল, তারপর তোর মেয়র মামার কাছে যাবি।
- আরে ওই দেখুন বঙ্কিমদা আসছেন, লাঠিতে ভড় দিয়ে কেমন টুকটুক করে আসছেন। ওনার বাঁহাতে কি একটা প্যাকেট রয়েছে মনে হচ্ছে, উনিও হয়তো প্রসাদ ট্রসাদ কিছু আনছেন।
বঙ্কিমদা এসে বৃদ্ধাসনে ওনাদের পাশে বসলেন। সকলের কৌতূহলী দৃষ্টি বঙ্কিমদার হাতের প্যাকেটে। বঙ্কিমদা বসে কয়েক মিনিট বিশ্রাম নেবার পর প্যাকেট থেকে বার করে সবার হাতে একটা করে প্যাঁড়া দিয়ে বললেন, -মিষ্টি খান, আমার নাতনি কলগার্লের কাজ পেয়ে ওর প্রথম রোজগারের টাকায় মিষ্টি এনেছে।
নাতনি কলগার্লের কাজ পেয়েছে বলে বঙ্কিমদা মিষ্টি খাওচ্ছে শুনে সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করে মুখ টিপে হাসছেন। শিবদাস একটু ঠোঁটকাটা মানুষ, উনি বঙ্কিমদাকে বললেন, - দাদা, কলগার্লের কাজ নয়, আপনার নাতনি হয়ত বলেছে কলসেন্টারে সে কাজ পেয়েছে, আপনি ভুল শুনেছেন।
- আপনি মশাই সবজান্তা, আমার নাতনি কি কাজ করে সেটা আমি জানি না, আপনি জানেন, যত্তো সব।
- না দাদা রাগ করবেন না। আপনার হাতে প্যাকেট দেখে ভাবলাম আমাদের জন্যে প্রসাদ ট্রসাদ কিছু আনছেন, তা কলগার্লের প্রসাদই চলবে। কলগার্ল জিন্দাবাদ, বঙ্কিমদা জিন্দাবাদ।
![]() |
সঞ্জীব সিনহা ssanjibkumar@gmail.com |
সুচিন্তিত মতামত দিন