লাভা পৌঁছে..
রিশপের পরবর্তী অংশ....
নরম বিছানার উষ্ণতা ছেড়ে গরম চায়ে চুমুক আর কাচের জানালার ওপারে অবাধ উন্মুক্ত প্রকৃতির অকৃপণ হাতছানি,সত্যিই কি উপেক্ষা করা যায়? বেশ ঠান্ডা কিন্তু রিশপে তখন। হোটেলের উন্মুক্ত লনে চাদরে নিজেকে ঢেকে গুটি গুটি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে সকালের ঝকঝকে রোদ গায়ে মাখতে কি যে সুখ, আহা! সব থেকে আনন্দ হলো কোনো কাজের তাড়া নেই। শুধু অর্ডার করো আর ঘুরে বেড়াও দু’চোখে মাখতে থাকো প্রকৃতির রং! মাঝে মাঝে ফাঁকা জায়গা দেখে দু’হাত ছড়িয়ে প্রকৃতিকে আলিঙ্গন জানিয়ে বলো, “তুমি সুন্দর, আমি ভালোবাসি”।
“টিক টিক সময়টা বয়ে যায়...” এখানে নিজের গাড়ি না থাকলে সিন্ডিকেটের কোনো গাড়ি ভাড়া করতে হয়। একটা গাড়ি ঠিক করে দিল হোটেল থেকেই। হোটেলের ম্যানেজার আমাদের সাথেই যাবেন হোটেলের মালপত্র আনতে শহরে। রিশপের নিজস্ব কোনো বাজার নেই। সারা সপ্তাহের সামগ্রী এক সাথেই এনে রাখতে হয়। ঠিক সাড়ে দশটায় আমরা রিশপ ছেড়ে বেড়িয়ে পড়লাম লাভার পথে। এবার গাড়ি অন্য পথে যাচ্ছে। আবার পাহাড়ি পথের কোণে কোণে অজানার সন্ধান করতে করতে দুপুরের দিকে এসে পৌঁছালাম লাভা। ঘিঞ্জি, বেশ নোংরা হোটেল চত্বরটা। ‘আরে এতগুলো হোটেল কোথাও তো জায়গা মিলবেই’... কত্তা এই কথা বলতে বলতেই গাড়ি থেকে নেমে হাঁটা লাগালো সামনের দিকে। একটাতে ঢুকেও পড়লো। আমি আর পাপা গাড়িতে বসে হ্যাংলার মত তাকিয়ে তাকিয়ে রাস্তার লোক দেখছি আর তিনি তখন একটার পর একটা হোটেলে ঢুকছেন আর বেরোচ্ছেন। মুখে একরাশ চিন্তা নিয়ে কিছুক্ষণ বাদে ফিরে এলেন তিনি... ‘ নাহ্, কোন হোটেল খালি নেই!’
এতগুলো হোটেল একটাও খালি নেই! চোখ আমার কপালে উঠে গেল। এদিকে গাড়িওয়ালা ছটফট করছে। জিনসপত্র নিয়ে একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে চারিদিকে তাকাতে লাগলাম। আরে, ঐ তো ! এত বড় হোটেল নিশ্চয় জুটে যাবে জায়গা। যাও দিকি একবার। ছুটলেন কত্তা, ফিরেও এলেন। কেউ নেই, তবু ফাঁকা নেই!
মানে?
মানে আবার কি, বড় বড় ট্যুরিস্ট সংস্থার সাথে চুক্তি করা আছে। দেওয়া যাবে না আমাদের।
লে হালুয়া! চোখ গোলগোল, কপালে ভাঁজ! রাগে কটমট করে তাকালাম কত্তার দিকে। এই জন্যই বলে ছেলেদের বুদ্ধিতে চলতে নেই। গোমড়া মুখে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে চোখ আটকালো আরেকটু ভিতরের দিকে ... ‘ ইউনিক ইন’। বেশ বড় তো হোটেলটা। কত্তাকে বললাম যাও তো ঐ টাতে।
অবশেষে বিজয়ীর হাসি মুখে নিয়ে ফিরে এলেন তিনি। জুটেছে জায়গা, তাও বেশ ভালো জায়গা। একটা দেওয়াল এখানেও কাচের। এসে বললো, ‘ দুটো ঘর দেখাবে, তোমার কোনটা পছন্দ দেখো’।
এতক্ষণ একটা জুটছিল না, এখন অপশনও পাচ্ছি। যাই হোক বেঁছে নিলাম যাকে, সেখান থেকে মনাস্ট্রীটা কি সুন্দর দেখা যাচ্ছে! পিছনে পাইন বনের জঙ্গলের কোলে মেঘ জমে আছে থোকা থোকা। একটু জল মেখে তাজা হয়ে হাঁটতে বেরোলাম হোটেল থেকে। কিছুটা হেঁটে মোড়ের মাথায় একটা রেস্টুরেন্ট দেখে ঢুকে পড়লাম। চাউমিন দিয়ে পেট ভরিয়ে হাঁটা শুরু করলাম মনেস্ট্রীর পথে। পথের পাশে সুদৃশ্য কাপের সমাহার দেখে মন যেন ভরে উঠলো, মস্তিষ্কের দৃশ্যপটে বাড়ির কাপগুলোর ছবি ক্রমশ ফিকে হয়ে যেতে লাগলো। দোকানের কাপগুলো আমাকে যেন প্রবল আকর্ষণে হাতছানি দিতে লাগলো। স্রোতের টান থেকে আমিও প্রাণপণ বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছি। পকেটের কথা ভাবতে হবে তো। ট্যুরের একেবারে শেষ দিনে পকেটের আর কত ওজন থাকতে পারে! ...না না , ভাববেন না তাই বলে কিছুই নিই নি। তিনটি সুদৃশ্য লাল রঙের কাপ,একটি সাদার উপর নক্সা করা চা তৈরির কাপ, দু’খানা চটি, একটা মাফলার, একটা কত্তার ঐ যাকে বলে ঘরে পড়ার ট্রাউজার, সেটা আবার পশুপতি মার্কেটের জিনিস।ঐ এক পিসই ছিল। ছেলের একটা ডান্ডার মত পেনসিল। বেশ অনেক কিছুই কিনেছি কিন্তু!
যাইহোক লাভাতে ঐ বিকেল টুকুই বরাদ্দ। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম মনাস্ট্রীতে। মনাস্ট্রীর চারপাশে একটা রাস্তা ঘেরা। সেই পথেই প্রবেশ করতে হয় ভিতরে। রাস্তার বামদিকে পাঁচিলের ওপাশে খাদ আর ডানদিকে মনাস্ট্রী। কিছুদূর অন্তর অন্তর কালো পোশাকে বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে আছে কমান্ডোরা। কোনো ভি.আই.পি আসার কথা আছে, তাই এতো সাজ। একটা হালকা কুয়াশার চাদর পাতলা পরতে হঠাৎ নেমে এলো আমাদের গায়ে, ছুঁয়ে গেল! একটা ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠলাম। অপূর্ব কারুকার্যে সাজানো! সুন্দর স্নিগ্ধ পরিবেশে মনটাও তাজা হয়ে উঠলো। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যার পথে হাঁটছে সময়! কুয়াশারাও ক্রমে ঘন হয়ে নিচে নেমে আসছে। ফিরে এলাম হোটেলে। একটা ছোট্ট রুমে, আমরা তিনজন ঐ কুয়াশাদের মত ঘনীভূত হয়ে। বাড়ির বাইরে থাকার এই এক বিচিত্র স্বাদ! বাড়িতে এমন ঘনীভূত হয়ে থাকা যায় না!
ফিরতে হবে বাড়ির পথে। সকালে ঘুম থেকে উঠতেই মনে হলো কথাটা। মনটার ওজন যেন একটু বেশি লাগছে। শেয়ারের গাড়িতে শিলিগুড়ি যেতে হলে হয় সকাল ছ’টা বা আটটা। এত কিসের তাড়া! ট্রেনতো সেই রাত ন’টায়! হোটেল থেকে একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে দিল। সাড়ে বারোটায় বেরিয়ে পড়বো আমরা। ড্রাইভারকে বললাম, ভাই এমন কোনো রাস্তা নেই, যেখানে শুধু দু’ধারে প্রকৃতি পাবো? ড্রাইভারদা বললেন, একটা ঘুর পথ আছে কিন্তু রাস্তা ভালো। আর একটা সহজ পথ কিন্তু রাস্তা খারাপ। আমি বললাম, প্রকৃতির পথে যাবো।
গাড়ি চলতে শুরু করলো গরুবাথানের পথে। শুরুতেই বেশ ভাঙা রাস্তা। কিছুটা এগিয়ে যাওয়ার পরই শুরু হলো সবুজের বাহার। সরু রাস্তার কখনও ডানদিকে কখনও বামদিকে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে সেজে আছে এলাচ গাছ। বেশ অনেকটা সময় গড়িয়ে যে পথে এলাম, সেটা সবুজ কচি চা বাগানের মাঝ দিয়ে গিয়েছে। ড্রাইভার দা বললেন, আপার ফাগু। কি অপরূপ! পাহাড়ের গা কেটে রাস্তা আর স্তরে স্তরে নেমে গিয়েছে সবুজ চা গাছের বাগান। সবুজ আর সবুজ আর সবুজ! কি শান্তি! চোখ জুড়ে মুগ্ধতা। মাঝে মাঝে সরু কান্ডের গাছ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। যতদূর চোখ যাচ্ছে, সবুজ রঙের ঢেউ ঢেকে ফেলেছে যেন পৃথিবীটাকে। সরু নিঃসঙ্গ রাস্তা শুয়ে আছে বুক পেতে। দূরে সবুজের ঢেউএর মাঝে দাঁড়িয়ে আছে গাছে ঘেরা একটা গোলাপি বাড়ি, আমরা ছুটে চলেছি, পথ পিছনে পড়ে থাকছে।লোয়ার ফাগু পেরিয়ে আবার সরু রাস্তা ধরে ছুটতে থাকা। মূর্তিনদীর শুকনো সরু জলধারা বয়ে যাচ্ছে। পাশে একটা চায়ের দোকান। গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়লো। এই দোকানের বৌদি’র চা নাকি খুব সুন্দর। অনেক লোকজন চারপাশে। শুটিং চলছে কোনো এক অজানা বাংলা সিনামার। সেটার লোকজন বসে আছে এখানে ওখানে। রাস্তায় নায়ক একটা হুডখোলা লাল জিপ চালাচ্ছে,ক্যামেরা চলছে। আরে, শান্তিলাল না! বেশ অনেকটা দূরে তো! বোঝা যাচ্ছেনা। ক্যামেরায় জুম করলাম। না ফটো তুললাম না। আমার আবার সেলেব দেখে আদিখ্যেতা আসে না। তবে অমিতাভ হলে একটা ফটো তোলার চেষ্টা করতাম দূর থেকে। কি হবে, ক্ষণিক পরেই যার কাছে আমার অস্তিত্বের কোনো চিহ্ন থাকবেনা, তার সাথে ফটোতুলে? ক্যামেরা চলছে চলুক ওদের আমরা চললাম সামনের পথে...।
ক্রমশ এগিয়ে যাওয়া শিলিগুড়ির পথে। কত নামের একেকটা জায়গা পিছনে ফেলে পৌঁছালাম একটা চেনা নামের পথে। ‘গাজলডোবার জঙ্গল’ কি অনবদ্য এই নীরবতা! একলা রাস্তা, নিঝুম বিকাল।একটাও মানুষ নেই পথে, শুধু দু’ধারে মাথা তুলে সোজা দাঁড়িয়ে আছে ঘন গাছের জঙ্গল। অসংখ্য পাকা অতসী ফুলের বীজ হাতে নিয়ে বাজালে যেমন হবে, এই লাখ লাখ বীজ। ঝনঝন বেজে চলেছে একসাথে। শুধু এই আওয়াজে ভেসে আসছে নীরব দাঁড়িয়ে থাকা জঙ্গলের বুক ভেদ করে। আওয়াজটা যেন নিঃসঙ্গতাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। বুকটা কেমন ধু ধু করছে। আমরা একা ছুটে চলেছি, পেরিয়ে যাচ্ছি গাজলডোবা জঙ্গল, পেরিয়ে যাচ্ছি তিস্তা ব্রিজ...... একটা মন কেমনিয়া বিষাদ বাঁশির সুর শোনা যাচ্ছে....ঐ তো শোনা যাচ্ছে সে সুর!
লিখেছ ভালো,--- আরও অনেক কিছুই লিখতে পারতে অবশ্য । আসলে ছোট বেলার থেকে অনেক গুলো দিন এদিকেই কাটালাম । শুধু পড়াশুনোর, আর বাইরের চাকরির সময়টা বাদ দিয়ে ,। তাই কিছু টিপস দিতে পারতুম । রিশপ ভারি সুন্দর জায়গা,---- কিন্তু সময় চাই, আর রেস্ত ও চাই আশপাশের কিছু জায়গা দেখবার জন্য ।
উত্তরমুছুনআবার যদি ইচ্ছে হয়,--- এসো তখন । অনেক ভালো থেকো ।
Until then, have a nice time,--- Good Bye ..... সমুদ্রস্নাত
হ্যাঁ জানা রইল
উত্তরমুছুনতখন পরিচয় ছিল না... এবার গেলে জেনে নেব
সুচিন্তিত মতামত দিন