জয়তী রায়



#বাক্য এবং আমাদের জীবন#

ভগবান বুদ্ধদেবের কাছে একজন এসেছেন, বসেছেন, প্রশ্ন করছেন আর নিজের পা নাড়িয়ে চলেছেন। ভগবান বললেন," তুমি কি জানো তোমার পা তুমি নাড়িয়ে চলেছো?" লজ্জা পেয়ে পা শান্ত করেন প্রশ্নকর্তা। ভগবান বলেন," আগে শরীর সম্বন্ধে মন সম্বন্ধে সচেতন হও, সব প্রশ্নের উত্তর পাবে। "
জীবনে বাক্যের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে গিয়ে তথাগতর উপরের বাণীর যথার্থতা পরে বোঝা যাবে। তার আগে এক বিখ্যাত উক্তির উল্লেখ করি----" words have energy and power with the ability to help, to help, to hurt, to harm, to humillate, and to humble. ( yehuda Berg). 

আলোচনা বিশাল কলেবর দেবার মধ্যে লেখকের যোগ্যতা নির্ভর করেনা, অযথা কচকচি বিরক্তি আনে মাত্র। তাই খুব সংক্ষেপে জীবনে বাক্যের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরার চেষ্টা করছি। 

আমরা সকলেই রোজকার জীবনে শান্তি খুঁজে ফিরি। যদি একশো লোক কে প্রশ্ন করা হয়,"

" এই যে আছেন কেমন? " ৯৯ জন বলবে --" আর বলবেন না। একটা না একটা ঝামেলা চলছেই।!" কথা হলো, ঝামেলা ব্যাপারে বাক্যের গুরুত্ব অসীম। আবার ঝামেলা সরিয়ে এক ঝকঝকে দিন আপনাকে উপহার দিতেও পারে সেই বাক্যই।

বাকশক্তি, কথা বলার শক্তি, ইশ্বরের এক অতুলনীয় দান। কথা কেবল কথার কথা নয়, সে যে এক ব্রহ্মশক্তি, শব্দ ব্রহ্ম তা আমরা সকলেই প্রায় ভুলে থাকি। ভুলে যাই জিভ কে সংযত না করতে পারলে জীবনভর তা নিয়ে আফসোস করতে হবে। 

কত বন্ধু বিচ্ছেদ, কত পারিবারিক মনোমালিন্য, কত সুন্দর সু মধুর সম্পর্ক, কত হই হই আনন্দ -- এক কথার আঘাতে বিষ হয়ে যায় সব। যাকে ছাড়া দিন শুরু হতোনা, যাকে মেসেজ না করলে মনে হতো আকাশে বুঝি আলো ফোটেনি , যার মুখ মনে পড়লে কাজে জাগত নতুন প্রাণ, তাকে দেখলে ভেতর তেতো হয়ে যায় আজকাল--কেন হয় এমন? এমন হাজারো উদাহরণ ছড়িয়ে রয়েছে জীবনের আনাচে কানাচে। তদন্ত করলে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে অপরাধী দেখা যাবে মুখের কিছু কথাকে। হয়তো সারাজীবন মনে হবে " না বললেই হতো!" এমনকি খুব বড়ো লোকসান হয়ে যায়, যা কিন্তু জীবন দিয়ে পূরণ করতে হয় অনেক সময়।

বাক্যের আমোঘ শক্তি। কথাই ভাগ্য তৈরী করে। ভালো করে, মন্দ করে। সচেতনভাবে ইশ্বরপ্রদত্ত্ব এই শক্তি ব্যাবহার না করলে বহু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। 

কথা ভাগ্য তৈরি করে? খুব আশ্চর্য মনে হলেও একটু অঙ্ক কষে দেখলে যুক্তির যথার্থতা প্রমান হবে। 

রোজকার জীবনে একটু খেয়াল করলেই দেখা যায়, কখনো কখনো আমরা অবশভাবে, অচেতন ভাবে অভ্যাসের কাছে নিজেকে ফেলে দিয়ে কটু কথা, পীড়া দায়ক কথা বলে অন্যকে দুঃখ দিয়ে ফেলি। কেবল মজা করবার প্রবনতায় এমন কথা বলি, যার ফলে সামনের প্রাণ হয়তো ক্ষত বিক্ষত হয়ে গেলো। তীর ধনুক থেকে বেরিয়ে গেলে তাকে কি ফিরিয়ে আনা যায়? তেমনি কথাও ফিরিয়ে নেওয়া যায়না। তিক্ত অভিজ্ঞতা বাড়তেই থাকে। একজনের কাছে যা মজা, অন্যের কাছে তা হয়তো সাজা-- এই ব্যাপারটা মাথায় রাখা দরকার। “ ওতো ভেবে চিন্তে কথা বলতে পারিনা। তাহলে তো সবসময় বানিয়ে কথা বলতে হয়” এরকম মন্তব্য অথবা “ আমি স্পষ্ট কথা বলি।” সে স্পষ্ট কথায় কেউ কষ্ট পেলে কি করার আছে? যদি বলি, সুন্দর কথা দিয়েও দুর্দান্ত আড্ডা হয়! যদি বলি কষ্ট দেওয়া স্পষ্ট কথা না বলেও সত্যি বলা যায়? শুধু বলার স্টাইল বদল করে নিতে হয়। আফসোস! মানুষ নিজের মন শরীর সম্বন্ধে সচেতন নয় বলেই বাক্যের লাগাম পরানোর কৌশল জানে না।

কথা বা বাক্যের দুটি জাত। ইতিবাচক আর নেতিবাচক। নেতিবাচক কথা, অন্যের সম্বন্ধে পরুষ বাক্য বা কটুক্তি বেশিরভাগ জীবনে নিয়ে আসে অনেক ধরনের সমস্যা। পরীক্ষা করে দেখবেন, সমগ্র বায়ুমণ্ডলে এই নেতিবাচক কথার অশুভ তরঙ্গ খেলা করে,অন্যকে প্রভাবিত করে। সহজ কাজ ভারি মনে হয়। শরীর খারাপ লাগতে শুরু করে। টক্সিন জমা হতে থাকে,এবং সুস্থ শরীর ক্রমশ রোগী হতে শুরু করে। বহু সময় দেখা গেছে এক ছোট্ট কথার খোঁচা ভুলতে না পেরে মানসিক রোগীতে পরিণত হয়েছে এক সুন্দর মানুষ। 

জীবন বড়ো মুল্যবান। তাকে যত্ন করে, জল হাওয়া দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে জানতে হয়। ইতিবাচক কথা জীবনের মরা গাঙ আনন্দের জোয়ারের জলে ভরিয়ে তুলতে পারে। অনেক সময় দুটো নরম কথা, সহানুভুতি এবং ভালোবাসার কথা তাপিত হৃদয়ে আশার সঞ্চার করে। হেরে যেতে যেতে ঘুরে দাঁড়িয়ে সমস্যার মোকাবিলা করে মানুষ। " আমিও পারি" এই বোধ জেগে ওঠে। শুনতে অবাক লাগতে পারে, কিন্তু বিশ্বাস করতেই হবে যে, শব্দ ব্রহ্ম, শব্দ মন্ত্র। শব্দ সব পারে। ধংস এবং সৃষ্টি দুটোই নির্ভর করে শব্দের সঠিক ব্যবহারের ওপর।

কাকে কি বলছি সে কথা এবং ভাষার উপরে দৃষ্টি আরো সজাগ হোক। কথা আনন্দের উৎস হয়ে উঠুক। যে কোনো আলোচনায় নিজেকে অবশ ভাবে জুড়ে না দিয়ে সচেতন ভাবে, কি বলছি,কি শুনছি সার্বিক কল্যানের জন্য তার প্রভাব কি হতে পারে, সেটা একটু ভাবা যেতে পারে। কেউ যদি নেতিবাচক সমালোচনায় পরিবেশ দূষিত করে ,তার মোড় ঘুরিয়ে ইতিবাচক পথে আনার চেষ্টা করা যেতে পারে।

মনে হতে পারে, কথা এতো ভেবে চিন্তে বলা সম্ভব হতে পারে কখনো? খুব কঠিন কাজ সন্দেহ নেই। কিন্তু , আজ থেকে গভীর ভাবে লক্ষ্য করে দেখলে দেখা যাবে যে, সুন্দর কথা মনের ভারসাম্য রক্ষা করে। ক্রোধে অস্থির হয়ে খারাপ কথা বলে ফেলে, নিজের মন ক্ষতি গ্রস্থ হয় সবচেয়ে বেশী।

ফিরে আসি তথাগতর চরণতলে। নিজের শরীর মন সম্বন্ধে সচেতন হয়ে দেখি, অহংকার ঘিরে ধরছে কি আমাকে? অহংকারের চশমা পরে জগৎ দেখলে সবসময় মনে হবে আমার কথাই সত্য। বাকি সমস্ত ভুল। তার ফলে কথার ঝাঁপি খুলে বসবো অন্যের সমালোচনা করতে। এক সময় খেই হারিয়ে নিজেই দাঁড়াবো মন খারাপের কাঠগড়ায়।

মানুষ মাত্রেই সুখ চায়, শান্তি চায়, কিন্তু এই চাওয়া বেশির ভাগ মানুষের জীবনে অতৃপ্ত থেকে যায়। ভাগ্যের দোহাই দিতে থাকি আমরা। কিন্তু, বহুসময় এই ভাগ্য তৈরি করে মনের নেগেটিভ ভাবনা, যার প্রতিফলন ঝরে পড়ে মুখের কথায়।

তাই অকারণ দোষ বাইরের জগৎকে না দিয়ে নিজের মন আর মুখ চিনি বরং। পাড়া প্রতিবেশী সবাই কে চিনি, সবার সব রহস্য জানি, অথচ সবচেয়ে অচেনা হলো আমার মন। জন্ম থেকে মৃত্যু -- এই যাত্রা পথের মাঝের সময় হলো জীবন। 

জীবন সুন্দর হয়ে , পূর্ণ হয়ে ওঠার জন্য শব্দ একটি বড়ো অস্ত্র। শেষ করি ,পরিচিত এক প্রবাদ দিয়ে---

words have the power to build up or tear down.”





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.