শুভব্রত কোথায় আছে এখন? জানতে বড় ইচ্ছা করছে অনুসূয়ার। রাত এখন দেড়টা। চোখ থেকে সব ঘুম কে যেন চুরি করে নিয়েছে। বিছানায় শুয়ে থেকে কোন লাভ নেই বুঝে মিনিট দশেক আগে ইজিচেয়ার নিয়ে জানলার ধারে বসেছে। জানলার পর্দা সরিয়ে দিয়েছে। বাইরেটা বড্ড অন্ধকার। মেঘ করেছে। আকাশে একটা তারাও দেখা যাচ্ছে না। গাছের পাতাগুলো যেন প্রাণহীন হয়ে পড়েছে। দমবন্ধ করা একটা আবহাওয়া। অনুসূয়ার মনের অবস্থাও একইরকম। অদ্ভুত বিষণ্ণ লাগছে আজ নিজেকে। বড় একলা,বড় অতৃপ্ত। শুভ...শুভব্রতও কি এতটাই বিষণ্ণ? অনুসূয়াকে পেয়েও হারিয়ে ফেলে এতটাই নিঃসঙ্গ? এই ক’মাসে কখনো ভেবে দেখেনি অনুসূয়া। নিজেকে নিয়ে ভাবতেই ব্যস্ত ছিল বড্ড,ছকে বাঁধা জীবনে ঘড়ির কাঁটার সাথে নিজেকে বেঁধে ফেলেছিল। পাছে একটা অলস মুহূর্তেও না পায়,আকণ্ঠ ডুবে গিয়েছিল ব্যস্ততায়। দিনের শেষে ক্লান্ত শরীর আর মনে চিন্তাগুলো হানা দেওয়ার মতো অবকাশ পেত না। আজও তো যথেষ্ট ক্লান্ত অনুসূয়া তবুও আজ মাস ছয়েকের মধ্যে প্রথম কেন,কেন সেইসব ভালোবাসার কথা মনে পড়ে গেল?
তিয়াশা ও ঘরে ঘুমোচ্ছে। বড্ড খুশি আজ ও। হওয়াই স্বাভাবিক। দিদিভাইকে অনুজের ব্যাপারে এত সহজে রাজি করে ফেলবে স্বপ্নেও ভাবেনি ও। হস্টেল থেকে দিদিভাইয়ের কোয়ার্টারে আসার পথেও বেশ ভয় করছিল। দিদিভাই কেমন যেন বদলে গেছে। তিয়াশার চোখ এড়িয়ে যতই খুশি থাকার অভিনয় করুক দিদিভাই,তিয়াশা ঠিক জানে কোথাও গোপন একটা গভীর কষ্ট আছে দিদিভাইয়ের। মানে জানার চেষ্টা করবে,সে সাহস হয়নি। তিয়াশার কাছে অনুসূয়া দিদিভাইয়ের মত নয় ঠিক। বছর ছয়েকের ছোট বড় হলেও তিয়াশার দিদিভাই দিদি আর মায়ের মাঝামাঝি কেউ একজন। যাকে ভয় করে,আবার কখনো কখনো বন্ধুর মতো মনে হয়। অকপটে মনের কথা বলে ফেলতে গিয়েও কোথাও যেন থেমে যেতে হয়। সবটা যেন বলা যায় না। একটা গণ্ডীর মধ্যে থেকে তিয়াশার সাথে মেশে অনুসূয়া। গণ্ডীটা ওর নিজেরই স্থির করা। তিয়াশা তাই সবসময় সতর্ক থাকে কখনো লক্ষণরেখা ডিঙিয়ে ফেলল কিনা। দিদিভাইয়ের মেজাজ মর্জিটাকে খুব ভালোভাবেই বোঝে তিয়াশা। মুড ভালো থাকলে তবেই আব্দারগুলো করে ও,যখন আর একটু ছোট ছিল মনে মনে দিদিভাইয়ের নজরদারী থেকে বাঁচার প্রার্থনা করত। আর ছ’মাস আগে দিদিভাই সত্যিই যখন কলকাতা ছেড়ে বাইরের হাসপাতালে চাকরি নিয়ে নিল তখন বেশ ক’রাত ঘুমাতে পারেনি ও। পড়াশুনা ছেড়ে দিদিভাইয়ের সাথে চলে যাবে বলেও ফেলেছিল একদিন। মা তিয়াশা যখন খুব ছোট তখনই চলে গেছেন। বছর দেড়েক আগে বাবাও। দিদিভাই চলে গেলে একা বাড়িতে কি করে থাকবে একথা বলে ভেবেছিল দিদিভাইয়ের মত বদলাতে পারবে,ভুল ভেবেছিল। তিয়াশার জন্য হোস্টেলের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল অনুসূয়া। তখন থেকেই বুঝেছিল ও দিদিভাই একা থাকতে চায়। সবাইকে এড়িয়ে। একেবারে একা। অর্থ উপার্জনের অজুহাতটা নেহাতই মেকি বুঝে নিতে কষ্ট না হলেও আগের ছুটিতে এখানে এসেও আসল কথাটা জানতে পারেনি। পরীক্ষা শেষ করে এবার লম্বা ছুটিতে এসেছে তিয়াশা। অনুজের বাড়ি থেকে বিয়ের চাপ দিচ্ছে জেনেই কিছুটা মরিয়া হয়েই পরশুদিন রাতে খেতে বসে দিদিভাইকে অনুজের কথা বলেছিল ও। একটা কথাই বলেছিল দিদিভাই, “পি.জি. করবি না তাহলে?”
“ও বাড়ি...মানে ওর বাবা বলছিলেন করতে দেবেন...”
কোনক্রমে বলেছিল তিয়াশা। অনুসূয়া অদ্ভুতভাবে হেসেছিল। অর্থহীন হাসি। তিয়াশা কোন তল পায়নি তার।
“আগামীকাল আমার সময় নেই,পরশু ওকে পারলে এখানে এসে আমার সাথে দেখা করতে বলিস।”
অনুজ এসেছিল আজকে। দিদিভাই রাজি হয়েছে। এমনকি আগামীমাসে রেজাল্ট বেরোবার আগেই বিয়েটা হয়ে গেলে ভালো হয় অনুজের এমন অনুরোধও হেসে মেনে নিয়েছে। অনুজ স্কলার। প্ল্যাব পাশ করে ফেলেছে। দুমাস পরেই ইউ.কে যাবে। ভিসা ক’দিনের মধ্যেই এসে যাবে। সেইসব কথাই হিসেবি অনুজ বারবার করে বলছিল দিদিভাইকে। পাত্র হিসাবে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করার জন্য। তিয়াশার কোথায় যেন খারাপ লাগছিল। দিদিভাই অনায়াসে অনুজের মতোই বিদেশে পাড়ি দিতে পারত। আর কেউ না জানুক তিয়াশা জানে ওর মতো উচ্চমধ্য মেধা নয় দিদিভাইয়ের। ও যদি এম.বি.বি.এস করতে পারে তাহলে দিদিভাই নেহাত এম.ডি. তে থেমে যাওয়ার মতো নয়। তবুও থেমে গেছে। কার ভবিষ্যৎএর কথা ভেবে? উত্তরটা তিয়াশার ভালোভাবেই জানা। অনুজের উল্লাসের মধ্যে “পি.জি করবি না তাহলে?” এই কথাটা বারবার কানে বাজছিল তিয়াশার। কতবড় স্বপ্নভঙ্গের হতাশা ছিল কথাটার মধ্যে তার উপলব্ধি মনটাকে এক মুহূর্তের জন্য ভারাক্রান্ত করে তুলেছিল। কিন্তু ভালো লাগার ঢেউটা এতই প্রবল ছিল যে ভুলে যেতেও সময় লাগেনি।
টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালাল অনুসূয়া। জার্নাল নিয়ে বসল একটা। পড়ায় মন বসাতে চাইল। পারল না। অদ্ভুত হতাশা অনুভব করছে আজ ও। তিতিরটা এরকম করে বসবে...নিজে ওকে পি.জি এন্ট্রান্সের জন্য তৈরী করবে ভেবেছিল। সবে একুশ ওর। বছর তিনেক অনায়াসে ট্রাই করতে পারত। অনুজও ততদিনে ফিরে আসত। এত তাড়াহুড়ো কেন করল অনুজরা বুঝতে পারেনি অনুসূয়া। বুঝতে চাইবেও না। যে যা চায় তাকে তা দিয়ে দিলেই জটিলতা কমে যায়। আর কোন জটিলতা চায় না অনুসূয়া। গত দুবছর যে জটিল আবর্তে জড়িয়ে পড়েছিল তারপর...আর নয়। বাবার জমানো টাকাগুলোর সদ্ব্যবহার হবে এবার। প্রত্যেকটা টাকাই যে অনসূয়ার উচ্চতম শিক্ষার জন্য ছিল জানে ও। কিন্তু বাবা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর...ডানা মেলার স্বপ্ন পুড়িয়ে ফেলেছিল অনুসূয়া। ঠিক যেমন ছোট্টবেলা থেকে নিজের পড়াশুনার বাইরে পাওয়া একটা মুহূর্তও নিজের জন্য ব্যবহার করেনি-অনায়াসে তিতিরকে দিয়ে দিয়েছে তেমনি নিজের বিদেশ যাওয়ার ছাড়পত্রটাকে বেমালুম লুকিয়ে ফেলেছিল। বাবার একমাত্র স্বপ্নটাকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে কোনক্রমে আশায় বুক বেঁধেছিল যদি তিতির পারে...ক’বছর পর হলেও। সেই আশাও আজ শেষ হয়ে গেল। অনুজকে তিতির চেনেনি। কিন্তু অনুসূয়া চিনতে ভুল করেনি। তিতিরের নজর এড়িয়ে অনুজ বলেছিল
“বাবা বলেছেন বাকি কথাগুলো দিদিভাই আপনি ওর সাথে বলে নেবেন।” অনুসূয়া সম্মত হয়েছিল। নিজের মনেই একবার হাসল অনুসূয়া। বিয়ের জন্য অনুজের পরিবারের তাড়াতাড়ির কারণটা এবার কিছুটা হলেও স্পষ্ট ওর কাছে। ভালোই...অনুসূয়ার বাবার স্বপ্ন যদি অনুজের বিমানের জ্বালানী হয়...ক্ষতি কি? কিন্তু ওর তিতির ভালো থাকবে তো? নিজের মনেই চমকে উঠল অনুসূয়া।
অনুসূয়াকে না জানিয়ে চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছিল শুভব্রত। কোন একজনের সাথে বনছে না এমন তুচ্ছ কারণে। এই হঠকারিতায় খুব রেগে গেলেও রাগ প্রকাশ করেনি অনুসূয়া। শুভব্রত আনপ্রেডিক্টেবল...জেনেও তো ওকেই ভালোবেসেছিল। এইধরণের সমস্যা আসবেই...মনের কোথাও যেন অজানা আশঙ্কা ছিলই। সব উদ্যম আরো যেন হারিয়ে ফেলেছিল শুভব্রত। অনুসূয়ার মনে এই গাছাড়া ভাবটাই কাঁটার মতো বিঁধছিল। উদয়াস্ত পরিশ্রম করে দু-দুটো সংসারকে চালাতে হচ্ছিল ওকে। শুভব্রতর চোখে তার জন্য সহানুভূতি দেখতে চায়নি অনুসূয়া,একটু সাহায্য চেয়েছিল। প্রথম প্রথম মিষ্টি কথায় বোঝাতে গিয়ে ছিল ওকে। মাসখানেক পর থেকে তিক্ততার প্রকাশ হতে থাকল। শুভব্রত বেশ কয়েকদিন অনুসূয়ার খোঁটাগুলো সহ্য করেছিল। কিন্তু কবে যেন মান অভিমানের সীমা ছাড়িয়ে ইগোর লড়াই হয়ে গেল ব্যাপারটা। “আত্মা বিক্রি করে আমি কাজ করতে পারব না।” জানিয়ে দিয়েছিল শুভব্রত। “তাহলে কি করবে? আমিও তো কাজ করছি...এভাবে বসে থাকলে কি পারা যায়...” “তোমায় পারতে হবে না।” “শুভ...একটু বোঝ...” “তুমি কি চাও আমি আত্মহত্যা করি?” এরপর কথা চলে না। শুভব্রতর মনের যন্ত্রণা অনুসূয়া ছুঁয়েও যেন ছুঁতে পারেনি। আর তারপরেই...অনুসূয়া নিজের মধ্যে কারোর উপস্থিতির সম্ভবনা টের পেয়েছিল। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল ওর। যে আসছে তাকে রাখতে গেলে বিয়ে ছাড়া কোন উপায় নেই। কিন্তু এই অর্থনৈতিক অবস্থায় সংসার পাতাকে অবাস্তব আর হাস্যকর বলে মনে হয়েছিল ওর। অনুসূয়া কাজ করলে তবেই তিনজনের জীবন চলবে...এ অবস্থায় চতুর্থ জনকে আনার সময় কোথায় পাবে ও? বেসরকারী চাকুরে বাবা সব রেখে গেছেন তা বিপদের সময়ের জন্য। তাতে তিতিরের সমান অধিকার। এই সামান্য সঞ্চয়ে হতে দেওয়ার কথা ভাবতেও পারে না ও। চাকরিটা যদি সরকারী হতো তাহলেও ভাবা যেত। বেসরকারী নার্সিংহোম-জব সিকিউরিটি নেই-শুভব্রতর চালচুলো নেই-এই অবস্থায় কি করে ওর সন্তানকে এনে কষ্ট দেবে অনুসূয়া? শুভব্রতকে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল অনুসূয়া। খবর পেয়েই আকাশে খুঁটি দিয়ে বিয়ের চিন্তা শুরু করে দিয়েছিল। খুব আশ্চর্য হয়েছিল অনুসূয়া। শুভব্রতর অপরিণামদর্শীতায় মনের মধ্যে বিষণ্ণতার নিম্নচাপ জমে উঠেছিল। শুভব্রতর অবিমৃশ্যকারিতায় বিবমিষা পেয়েছিল। এই খবর কোথায় ওকে উপার্জনের পথে ঠেলে দেবে তা না একমুখ হাসি নিয়ে মাস দেড়েকের সব তিক্ততা ভুলে ও বলেছিল,
“এবার থেকে তোমাকে দুটো সংসার চালাতে হবে না। বিয়েটা হয়ে গেলে তিতিরও আমাদের সাথেই থাকবে।” নিছকই হাল্কা চালে বলা কথাটা অনুসূয়াকে বাক্যহীন করে দিয়েছিল। এতটা নিশ্চেষ্ট শুভব্রত? শুভব্রত এগিয়ে এসেছিল। অকুণ্ঠিত ভাবে আবার আগের মত করে বুকের মধ্যে টেনে নিয়েছিল অনুসূয়াকে। কানে কানে বলেছিল,
“বিয়েতে আগেরবার রাজি হওনি কেন এখন বুঝি আমি। তিতিরকে ফেলে থাকতে পারবে না তাই তো? পাগলি,একথাটা আমাকে বলতে পারোনি? আমি কি বাধা দিতাম? দিদির মতো করে নয়, মায়ের মত করে বড় করেছ ওকে। জামাইবাবুর মতো করে নয়,দাদার মতো করে ওকে আশ্রয় তো দিতে পারতাম।” অনুসূয়াকে আবারও মুগ্ধ করেছিল শুভব্রত। এত নরম মন মানুষটার...কিন্তু।
সিদ্ধান্তটা একাই নিয়েছিল অনুসূয়া। নিজের ভালোবাসার ফসলকে ঘরে তোলার আগেই বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়েছিল ও। সেদিনের কথাটা আর কক্ষনো মনে করেনি ও। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল যেন। দমবন্ধ করা চাপা একটা কষ্ট কান্নার আকার নিয়ে বুকের ভেতর দলা পাকিয়ে উঠলেও কোনক্রমে মনটাকে শক্ত করেছিল ও। যা সম্ভব নয় তাকে নিয়ে ভাবার কোন মানে হয় না। পাগলটাকে সব বুঝিয়ে বললে বুঝবে ভেবেছিল। চাকরির দরকার একটা,ওর জন্য,নিজের জন্যও। সব ঠিক চললে এবারের ইউপিএসসিতেই পেয়ে যাবে। তারপর শুভকে আর অপেক্ষা করাবে না। ঘর বাঁধবে। তিতিরকে ওদের কাছেই রাখবে। বছর দুয়েক সরকারী চাকরি আর চেম্বারে পায়ের তলার জমিটা শক্ত হয়ে গেলে নিজের বাড়ি,নিজের গাড়ি-ধাপগুলোকে অতিক্রম করে নিয়ে আসবে ওকে...ওর ভালোবাসার ফসলকে,কষ্টবিহীন পৃথিবীতে।
নিজের চোখদুটো মুছল অনুসূয়া। কিছু কিছু স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। নিজের অন্তরে তাকে অনুভব করার স্বপ্নটাও হয়তো...দীর্ঘশ্বাস ফেলল ও। শুভব্রতর চোখদুটোর কথা মনে পড়লেই শিউরে ওঠে ও। চেনা পরিবেশ,পরিস্থিতি,মানুষজন সবার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে অনুসূয়া...নাকি ঐ চোখদুটোর থেকে পালাচ্ছে। ধিক্কার,ঘৃণা,অবিশ্বাস মেশানো চোখদুটো বারবার মনে করিয়ে দিত অনুসূয়া নিজের সন্তানের খুনি। স্বপ্নের মধ্যেও চোখদুটোর হানাদারি আটকাতে না পেরে কলকাতা ছেড়েই পালিয়েছে ও। ছ’মাস ধরে অনবরত অক্লান্ত পরিশ্রমে সব কিছু থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল ও। কিন্তু আজ আবার...তিতিরও ওকে ছেড়ে চলে যাবে। যেমন শুভব্রত মিশে গিয়েছিল অজানায়। খোঁজার চেষ্টা বৃথা জেনে অনুসূয়া চেষ্টা করেনি ওকে ফিরিয়ে আনার। আজ একটা সত্যিকে বোঝে ও। শুভব্রতর কাছে কেন সন্তান এতটা মূল্যবান ছিল যে অনুসূয়াকে এভাবে শাস্তি দিয়ে চলেছে-আজ অনুসূয়া হয়তো তা জানে। নিজের বাবার কাছে থেকে যে ভালোবাসা পায়নি শুভ নিজের সন্তানকে তার দ্বিগুণ ভালোবাসায় ভরিয়ে দিতে চেয়েছিল ও। নিজেকে উজাড় করে দিতে চেয়েছিল স্নেহের সম্পর্কে। অনুসূয়া ওকে সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছিল...আর এটা অমার্জনীয় অপরাধ ওর কাছে। শুভব্রত জীবনে অনেক কষ্ট পেয়েছে। ঈশ্বর যেন ওকে শান্তি দেন। মনে মনে প্রার্থনা করল অনুসূয়া।
তিতিরের জন্য অনেককিছু হারিয়েছে অনুসূয়া। এতে তার বিন্দুমাত্র খেদ নেই। তবে আজ ওর মনে কষ্টটা হচ্ছে কেন? ও যা পেয়েও পায়নি তিতির তা পেয়ে যাচ্ছে বলে কি হিংসা হচ্ছে অনুসূয়ার,বুকের ভেতরটা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে? কষ্ট একটা হচ্ছেই তা নিজের ভাগ্যের জন্য। তিতিরকে হিংসা করার কথা যে স্বপ্নেও ভাবতে পারে না ও। উঠে দাঁড়াল অনুসূয়া। তিতিরের ঘরে যাবে। তিতির এখন যেন অনেক দূরে সরে গেছে ওর থেকে। দোষটা ওরই,একা থাকার ভূতটা চেপে বসেছিল...সম্পর্কটার মধ্যে যেটুকু সহজভাব ছিল তার অনেকটাই উঠে গেছে। কদিনই বা তিতির ওর কাছে থাকবে আর? মাসখানেক। এই ক’দিনে পুরোনো নৈকট্যকে ফিরে পেতে চায় ও। যেকোন মূল্যেই।
তিয়াসার পাশে ফিরে বসল অনুসূয়া। অঘোরে ঘুমাচ্ছে। ঘুমোলে পুতুলের মতো লাগে ওকে। মুখ থেকে চুলগুলোকে আস্তে করে সরাল অনুসূয়া,কপালে হাত বুলিয়ে দিল একটু। গালে ঠোঁট আলতো করে ঠেকিয়ে একটু আদর করল যেন। কখন যে মেয়েটা এত বড় হয়ে গেল বুঝতেই পারেনি অনুসূয়া। নিজের জীবনসঙ্গী বেছে নিয়ে চলে আসবে এটা তো কল্পনার অতীত ছিল। উঠে চলে আসছিল অনুসূয়া। হঠাৎ হাতে টান অনুভব করল,
“আর একটু থাকো না দিদিভাই। কতদিন পর...” অনুসূয়া বসল,
“কি কতদিন পর?”
“আদর করলে।” অনুসূয়া হেসে ফেলল,
“ঘুমাস নি?”
“তুমি আসতে জেগে গেলাম”
“তাহলে চলে যাই আমি।”
“ইস্...তুমি এখন আমার কাছে শোবে। তোমার ঘুম আসছে না জানি।” অবাক হল অনুসূয়া,
“কি করে জানলি?”
“আমাকে ছেড়ে তুমি থাকতে পারো না দিদিভাই। তাহলে এখানে একা থেকে নিজেকে কষ্ট দাও কেন?”
“অভ্যাস করছি। মাসখানেক পরে তুই চলে যাবি তো...তখন যাতে কম কষ্ট হয়। আমাকে নিয়ে তো আর যাবি না।”
“তুমি এরকম করলে আমি যাবোই না।” অভিমানের সুরে বলল তিয়াশা,
“আর অনুজ বেচারার কি হবে?”
পরিবেশ হাল্কা করার জন্য বলল অনুসূয়া,
“জানিনা যাও,তুমিও না...”
“রাগ হলো? অনুজের নামে একটু কিছু বললেই রাগ হয়?”
“অনুজের যা হবে হবে। আমি তোমাকে কষ্ট কিছুতেই দেব না। তুমিই তো আমার সব দিদিভাই।” অনুসূয়াকে জড়িয়ে ধরে বলল তিয়াশা।
“আমার উপর রাগ করেছ না?”
“কেন রে পাগলি?”
“এত তাড়াতাড়ি বিয়ের ঠিক হল বলে। ওরা...”
“ঠিক আছে রে বাবা,আমি মেনে নিয়েছি তো।”
“আমি পি.জি করবই,তুমি দেখো...তোমার ইচ্ছাটাকে নষ্ট হতে দেব না আমি।” অনুসূয়া হাসল, “স্বপ্ন তো অনেক ছিল তিতির,ছুঁতে পারলাম কই? এটাও না হয় আর একটা অধরা স্বপ্ন হয়েই থাক।” তিয়াশা চুপ করে গেল। বেশ কিছুক্ষণ পর মুখ খুলল,
“দিদিভাই?”
“হুঁ বাবু।”
“তুমি প্ল্যাবে পেয়েও যাওনি,না?” চমকে উঠল অনুসূয়া
“কে বলল তোকে?”
“কেউ বলেনি,এক্ষুনি তুমিই বুঝিয়ে দিলে। আমার জন্য এরকম কেন করলে তুমি?” অনুসূয়া হাসল,
“ওখানে যেতে অনেক টাকা লাগত। বাবার জমানো টাকা সব খরচ হয়ে যেত উপরন্তু লোন করতে হত। ওখান থেকে আমি কিছু পাঠাতেও পারতাম না। তুই পড়তিস কি করে?”
“আমি না পড়লেও কিছু হতো না। কিন্তু তুমি...”
“তিতির...!” গম্ভীর গলার বলল অনুসূয়া
“তুমি আমায় খুব ভালোবসো না দিদিভাই?”
“এটাও বলতে হবে? পাগল একটা।”
“আমায় একটা কথা বলবে?”
“বল্।”
“সত্যি করে বলবে তো?”
“হুঁ।”
“তুমি কাকে ভালোবাসো দিদিভাই?”
“মানে?”
চমকে উঠল অনুসূয়া
“তোমাকে কেউ খুব কষ্ট দিয়েছে। বুঝি আমি। সে কে দিদিভাই,তাকে ভুলে যাও না কেন তুমি?”
“তিতির তুই একদিনে খুব বড় হয়ে গেছিস দেখছি।”
“বলো না গো...”
“আছে একজন।”
“কে?”
“কেউ একজন...সে সবার থেকে আলাদা...পাগলা হাওয়া...আমার ভালোবাসার বাঁধা পড়ে দুদণ্ড দাঁড়িয়েছিল...আবার আমার ভুলেই...থাক্ ওসব কথা।”
“তোমার কষ্ট হলে বলো না।”
চোখ ভরা জল নিয়ে বলল তিয়াশা। অনুসূয়া বুঝতে পেরে ওর চোখ মুছিয়ে দিল,
“অনুজের বাবা কবে আসবেন কিছু বলেছে ও?”
“বলছিল...কাল বা পরশু...তোমার কবে হবে?”
“কাল রবিবার কাল কেই বলে দে।”
“বাবার আবার আসার কি দরকার ছিল?”
“এটাই নিয়ম,সোনা। আসতে হয়। আমি এসে তো তোর ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম। চলে যাই তাহলে।”
“আমি ঘুমাচ্ছি। তুমি শুধু থাকো।”
কয়েকমুহূর্তের জন্য বাক্যহীন হয়ে পড়েছিল অনুসূয়া। শুভ...শুভব্রতই তো? অনুজের বাবার সাথে?
“তিয়াশা একে তো তুমি চেনো”
“একদিন দেখেছি দাদাকে...ও বাড়িতে।”
“হ্যাঁ। অনুসূয়া আপনার সাথে আলাপ করিয়ে দিই...ডাক্তার শুভব্রত ব্যানার্জ্জী আমার বড় ছেলে।”
বসার ঘরের সোফায় বসতে বসতে বললেন ক্ষিতিশ বাবু, সমস্ত পৃথিবীটা চোখের সামনে যেন দুলছিল অনুসূয়ার। শুভব্রতর সৎ ভাই অনুজ। আকারে ইঙ্গিতে শোনা সেই মমতাশূন্য অসমদর্শী প্রতিহিংসাপরায়ণা সৎ মায়ের একমাত্র সন্তান। শুভব্রতর সাথে তো একটুও বনে না ওদের। তবে... “কি হল অনুসূয়া...” কোনক্রমে নিজেকে সামলে নিল অনুসূয়া।
“নমস্কার শুভব্রতবাবু...”
শুভব্রতর দিকে তাকাল ভালো করে। অনেক বদলে গেছে। ঝকঝকে জামাকাপড় ক্লিন শেভড্,
“নমস্কার।”
“শুভ...বিড়লায় আছে। ক’মাসেই বেশ নাম হয়েছে। দুহাতে পয়সা আনছে।”
আত্মাবিক্রি করে ফেলেছে শুভব্রত?
“বাবা...!”
শুভব্রত থামিয়ে দিল।
“তোমরা কথা বলো আমি দেখি তিয়াশা কি করছে।”
উঠে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল শুভব্রত। তিতির মিষ্টির প্লেট সাজাতে গেছে।
“যা বলছিলাম...অনুজ বলেছে নিশ্চয়...”
আবার অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল অনুসূয়া। অনুজ নীতিগতভাবে একদম খারাপ। শুভর মুখেই কথাটা শুনেছিল ও।
“স্বার্থপর,হিংসুটে নীচ থেকে নীচ কাজগুলোও অনায়াসে স্বার্থের জন্য করতে পারে...” এমনটাই বলেছিল কোন একদিন। আর আজ তার বিয়ের জন্যই...মানুষটা এতটাই বদলে গেল?
“আজ্ঞে?” সম্বিৎ ফিরল অনুসূয়ার।
“দেনাপাওনার কথাটা?”
“ওঃ...বলুন।”
“তিতির...” ডাকটা শুনে চমকে উঠল তিয়াশা।
“দাদা আপনি?”
“কেন? আসতে পারিনা?”
“না মানে ডাকনামটা জানলেন কি করে?”
“অনুজ বলতে পারে না?”
“অনুজ তো নামটা জানেই না...এটা তো শুধু দিদিভাই ডাকে।”
“তাহলে দিদিভাই আমাকে বলেছে।”
সুন্দর করে হেসে বলল শুভব্রত, “আর এ নামে শুধু অনু নয়...আমিও তোমাকে ডাকি। ঠিকই করে রেখেছিলাম যেদিন প্রথম দেখা হবে সেদিনই এই নামে ডেকে চমকে দেব। প্রথম দেখার দিন তোমায় অনুজের প্রেমিকা হিসাবে চিনেছিলাম। আজ অনুর বোন হিসাবে চিনলাম...আমার চেনা সম্পূর্ণ হল।”
“আপনি...”
“দাদাকে কেউ আপনি বলে না।”
“দিদিভাই...”
“ঠিকই ধরেছ। দিদিভাই যার কথা ভেবে শুধুই কষ্ট পায় আমিই সেই।”
সারা দুনিয়ার বিস্ময় যেন তিয়াশাকে ঘিরে ধরেছিল, “জেনেও তুমি...দিদিভাইকে এত কষ্ট দাও?” চোখের জল প্রাণপণে সামলে বলল তিয়াশা।
“নিজেও কষ্ট পাচ্ছি যে রোজ...যে জীবন নিজে কখনো বাঁচতে চাইনি কৃত্রিমতা ভরা ভালোবাসা শূন্য সেই ঘৃণিত জীবন যান্ত্রিকভাবে বেঁচে চলেছি প্রতি মুহূর্তে...”
“কোন জীবন?”
শুভব্রত হাসল, “ক’দিন পরে নিজেও বুঝবি। ওঃ হো...তুই বলে ফেললাম...বলতে পারি তো রে?”
“কেন নয়? দাদা...”
“কি?”
“তুমি দিদিভাইকে সব ভুলে নিজের করে নিতে পারো না?”
চমকাল একটু শুভব্রত, “তুই সব জানিস?”
“না,দিদিভাই শুধু বলেছে ও কোন একটা ভুল করেছে...”
“ভুলটাকে মানে ও তাহলে? ওর কাছে কখনো কখনো ঠিকটা ভুল আর ভুলটা ঠিক হয়ে যায় তো...”
“এত অভিমান তোমার?”
দীর্ঘশ্বাস ফেলল শুভব্রত, “যাকে জীবনের থেকেও বেশী ভালোবাসা যায়,অভিমান তো তার উপরেই হয়... যাকে ঘিরে ভাঙাচোরা ছিন্নভিন্ন জীবনটাকে সাজিয়ে তুলতে শুরু করেছিলাম...সে যদি...ধর,অনু যদি তোকে হঠাৎ করে দূরে সরিয়ে দেয়...তোর অভিমান হবে না?” তিয়াশা হাসল, “দূরে সরিয়েই তো দিয়েছিল। নিজেকে...বাকি সবার কাছ থেকে...এমনকি আমার কাছ থেকেও...আমার অভিমান হলেও আমি জানি,ভালোবাসা দিয়ে সব দূরত্বকেই মেটানো যায়।” শুভব্রত নিজের চুলের মধ্যে হাত চালাল, “হয়তো...আবার এমন কোন কোন দূরত্ব আছে তা এ জীবনে মেটার নয়।”
“দাদা আপনি আগে তো ওবাড়িতে থাকতেন না...” হঠাৎই বলল তিয়াশা।
“অনুজও সেভাবে আপনার কথা...”
শুভব্রত হাসল, “স্বাভাবিক। আমি ওর স্টেপ ব্রাদার,পরিবারের আদরটা আমার খুব একটা সহ্য হয়নি ছোট থেকেই...সুযোগ পেয়েই পালিয়ে বেঁচেছিলাম ওদের কাছ থেকে...ভেবেছিলাম অনুকে নিয়ে ঘর বাঁধব...অনুর তোকে নিয়ে দেখা স্বপ্নগুলো পূরণ করতে ওর পাশে থাকব...তা আর হল কই?”
“অনুজের মা...এরকম?” আস্তে আস্তে বলল তিয়াশা।
“তোরও মা হতে যাচ্ছেন। তুই বুঝিস কেমন।”
“তুমি এ বিয়েতে খুশি নও?”
শুভব্রতর চোখে শুকনো হতাশাকে পড়ে ফেলল তিয়াশা।
“উত্তরটা সহজ নয়। তুই যদি অচেনা কেউ হতিস। তাহলে তোর ভালোবাসার সার্থকতায় মনটা ভরে যেত। কিন্তু তুই তো আমার অনেকদিনের চেনা...অনুর মুখে তোর সব কথা এত শুনেছি যে...তোকে নিজের থেকে আলাদা ভাবি না। এই বয়সে অনেক জিনিস ভালো লাগে তিতির...রঙিন মনে হয়...আর তোর দিদি বা আমি তোর চাওয়া খেলনা তোকে না দিয়েও থাকতে পারব না...তবে খেলনাবাটির বাইরেও একটা জীবন আছে...তার কথাটাও মনে রাখা উচিৎ...”
“তিতির!”
দিদিভাইয়ের গলা শুনতে পেল তিয়াশা।
“দিদিভাই ডাকছে...তোকে”
“তোমার মিষ্টিটা...”
“রেখে যা এমনিতেও গলা দিয়ে নামবে না।” তিয়াশাকে অবাক করে করে বলল শুভব্রত।
“কি ভাবছ?”
অনুসূয়ার গলা শুনে চমকে উঠল শুভব্রত।
“কততে রফা হল?” সরাসরি প্রশ্ন করল শুভব্রত।
“কত টাকায় গুণধর ছোট ছেলেকে বেচলেন ক্ষিতিশবাবু?”
“তুমি জানো? জেনেও...”
“হুঁ জেনেও এসেছি। একটা পরিবারকে হাড়িকাঠে গলা দিতে দেখে যে পৈশাচিক আনন্দ হয় সেটা মিস্ করব না ভেবেছিলাম।”
“কি আনন্দ পেলে?”
“ডোজটা কড়া হয়ে গেল। চামড়াটা তুমি যতটা চেয়েছিলে ততটা মোটা এখনও করতে পারিনি।”
“এভাবে নিজেকে নষ্ট করছ কেন?”
“ধ্বংসস্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে ধবংসকর্ত্রীর এমন প্রশ্ন?”
“শুভ প্লিজ” অনুসূয়ার চোখে জল এসে গিয়েছিল।
“আজকের দিনে আর শাস্তি দিও না আমায়।”
“বাবা কোথায়?”
“এখানে কোন এক পুরনো বন্ধুর বাড়ি আছে বললেন...ওখানে গেছেন। দুপুরে এখানে খাবেন।”
“মরার উপর খাঁড়ার ঘা। তিতির জানে?”
“কি?”
“জানি না আমি কি করব...মা ছিল না,তিতিরকে মানুষ করতে তাও কোথাও হোঁচট খাইনি কখনো...বাবা চলে গেলেও...কোন অভাব বুঝতে দিইনি ওকে...কিন্তু আজ যেন মনে হচ্ছে অভিভাবকের বড্ড দরকার আমার। যে প্রয়োজনে শক্ত হবে। স্পষ্ট ভাষায় তিতিরকে বলবে,
“অনুজ বড় ছোট তিতির। তুই ওকে চেন। ও তোর যোগ্য নয়। ভালোবাসায় দরদস্তুর করে যে তার সাথে তোর বিয়ে হতে আমি দেব না। আমি নিজেও এই কথা ক’টা বলতে চেয়েও বলতে পারছি না। তিতির যেন দু তিন দিনেই বড্ড বড় হয়ে গেছে। মা হলে হয়তো শাসন করতে পারতাম...কিন্তু দিদি তো...যদি ভুল বোঝে...” এতগুলো কথা মনের মধ্যে কোথাও যেন ঘুরপাক খাচ্ছিল,টুকরো টুকরোভাবে। প্রকাশ পাওয়ার মতো জমাট বাঁধছিল না। শুভকে পেয়েই...দীর্ঘশ্বাস ফেলল অনুসূয়া। শুভব্রতর মনে তখন ঝড় উঠেছে। প্রত্যেকটা রক্তবিন্দু বিদ্রোহ করে উঠে চেঁচিয়ে বলতে চাইছে,
“অনু আমি তো আছি,তোমার অবলম্বন।” প্রত্যেকটা নিঃশ্বাস অনুসূয়ার কানে কানে বলতে চাইছে, “তিতিরের ভালোর জন্য...একটু শক্ত হও অনু।” কিন্তু গলাটা কে যেন চেপে রেখেছে। অভিমান,স্বার্থপরতা না জন্মদাতার ঋণ সঠিক ভাবে তা জানে না শুভব্রত। কিন্তু না বললে নিজের চোখেই বড্ড ছোট হয়ে যাবে ও। অনুজ তিয়াশাকে উপরে ওঠার সিঁড়ির ধাপ হিসাবে ব্যবহার করে স্বার্থ মিটিয়ে যখন ফেলে দেবে-সেদিন নিজেকে কিভাবে মাফ করবে ও? ভালোবাসা অনুভূতিটার কোন মূল্যই যে ওর কাছে নেই তা শুভব্রত যথেষ্ট ভালো করেই জানে।
“এবারও তিতিরকে লুকিয়েই আত্মত্যাগটা সারবে?” অনুসূয়ার ঘরে বসে প্রশ্নটা করল শুভব্রত।
“জেনেই বা কি করবে?” “তাও ভালো...ভাগ্যিস বলোনি...এটা তো আমার কর্তব্য”
অনুসূয়া হেসে ফেলল।
“এতটা মহানও আমি নই শুভ...আঙ্কল কি করে বললেন, ‘তোমাদের বিষয় সম্পত্তির ভাগগুলো আমি বুঝে নেব। তিয়াশা তো ছোট...’
আমার বোনকে আমি...ঠকাবো?”
“অনুজ বা মা শিখিয়ে দিয়েছে হয়তো।”
“অনুজের চরিত্র কেমন?”
“ভেজা বেড়াল একটা। সাতঘাটের জল খাওয়া।” তাচ্ছিল্যের সুরে বলল শুভব্রত।
“তবে তিতিরই কেন?”
“এতটা নরম জমি আর কোথাও পায়নি হয়তো। ঘরে পুরে রাখতে সুবিধা হবে।”
“আঙ্কল যে পড়তে দেবেন বলেছেন?”
“পাগল! ও বাড়িতে আন্টি যা বলবেন তাই হবে। আন্টি নিখরচার এমন চাকরানী হাতছাড়া করবেন কেন?”
“তিতির ভালো থাকবে না বলো?”
“সাতলাখ টাকায় কেউ কখনো সুখ কিনতে পেরেছে বলে আমার জানা নেই। তুমি পারলে দেখো...”
“তুমি ওকে আগলে রাখতে পারবে না?”
শুভব্রত হাসল, “আমি? আগলে রাখার মতো অধিকারটাই তো তুমি আমাকে দিলে না। এতটা অযোগ্য আমি...এত অবাঞ্ছিত আমার সন্তান...”
“ভুল করেছিলাম আমি...”
“আমাকে ভালবাসতে তো? জানি,এখন দেখো কেমন বদলে গেছি আমি,তুমি যেমন চাও তেমন হয়ে গেছি। অর্থের অভাব কখনো হবে না আর। মনটাকে কবর দিয়ে দিয়েছি যে। এখনকার শুভব্রতকে পছন্দ তো তোমার অনুসূয়া?” অনুসূয়া চুপ করে থাকল,
“জানি পছন্দ। তবে তোমার মতো সাধারণ সরকারী চাকুরেকে আমার স্ট্যাটাসের সাথে মানাবে কি?”
“বিবেকটাকে একেবারে নিলাম করে দিয়েছ?”
“নইলে জীবন নিয়ে সওদা করছি কি করে? লোকের দুঃখের আগুনে নিজের বেডরুমের উষ্ণতা বাড়াতে শিখে গেছি আমি...কিছুটা পথ আরো যেতে হবে...তোমার খুশির জন্য তা-ও করব আমি।”
দরজার টোকা শুনে চমকে উঠল অনুসূয়া। শুভব্রতও। তিতির...
“কিছু বলবি?” নিজেকে সামলে নিয়ে বলল অনুসূয়া অদ্ভুতভাবে হাঁপাচ্ছিল ও। শুভব্রত বুঝল,
“আয় বস্, কি হয়েছে তোর?” বসল তিয়াশা।
অনুসূয়া সাহস দিতে গায়ে হাত রাখল, “কি হয়েছে তিতির? বলো...শুভব্রতবাবু কি ভাবছেন বলো তো?”
তিয়াশা হাসল, “দিদিভাই আর লুকিয়ো না...আমি জানি...”
শুভব্রত বলল, “আমি ওকে আমাদের দুজনের কথা অনেকটাই বলেছি অনু।”
অনুসূয়া চোখ নিচু করল, “থ্যাংকস। আমাকে মিথ্যার বোঝার হাত থেকে বাঁচাবার জন্য...ধন্যবাদ।”
“দাদা...তুমি অনুজকে বলে দিও এ বিয়েতে আমার মত নেই।” কেটে কেটে শান্ত গলায় বলল তিয়াশা।
“তিতির কিন্তু অনুজকে তুই...”
দিদিভাইকে থামিয়ে দিল তিয়াশা,
“ভালবাসতাম। কিন্তু মুহূর্ত আগে পর্যন্ত। তোমাদের সব কথা শুনে ফেলেছি আমি। ভালোবাসার বেসাতিতে আমি নেই।”
দ্বন্দ্বে পড়েগিয়েছিল অনুসূয়া, “তিতির আমার কথা ভেবে পিছিয়ে যাস না তুই...আমি টাকা জোগাড় করেই রেখেছি।” অনুসূয়ার দিকে তিরস্কারের চোখে তাকাল তিয়াশা, “তুমি সত্যিই অনেক দূরের হয়ে গেছ দিদিভাই। আমি তোমার খুব বোঝা বল? তোমার আর দাদার মাঝেও চলে এসেছিলাম না জেনেই। তা বলে জেনেশুনে আমাকে আগুনে ঠেলে দেবে?
শুভব্রত কথা বলল এবার, “তিতির তোর দিদি চায়নি এ বিয়ে হোক...কিন্তু তোর পছন্দ...”
“ছোটবেলায় যদি আমার ইচ্ছামত বৃষ্টির জলে ভিজি...ভিজতে দিতে দিদিভাই? রং করা বুড়ির চুল খেয়েছিলাম বলে আমাকে খুব আদর করেছিলে বলো? ক্লাস নাইনের অষ্টমীতে বন্ধুদের সাথে সারারাত ঠাকুর দেখার বায়নাটা হাসিমুখেই রেখে ছিলে তাই না?”
“তখন তুই ছোট ছিলিস তিতির...নিজের ভালো বুঝতিস না...”
“এখন খুব বুঝি। তাই তো এরকম একটা ভুল করলাম। পার্থক্য একটাই...ক’দিন আগে ভুল করলে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য তুমি ছিলে,আর আজ...আজ সত্যিই অনাথ তাই না দিদিভাই?”
অনুসূয়া কিছু বলতে পারল না।
“তুমি নিজের মেয়ে হলে এরকম করতে পারতে?”
শুভব্রত হঠাৎই রেগে গেল, “কি যা-তা বলছিস তুই? নিজের প্রত্যেকটা সুখ যে তোর জন্য অনায়াসে ত্যাগ করেছে তাকে...”
তিয়াশা হাসল,
‘দিদিভাইকে তুমি এখনও কতটা ভালোবাসো দেখলে তো?”
থমকাল শুভব্রত।
“আমি তোমাদের মাঝে আর আসব না। নিজের পায়ে দাঁড়াব। তোমাদের বিব্রত করব না। তোমরা শুধু আমাকে দূরে ঠেলে দিও না...” নীচু গলায় বলেই চলেছিল তিয়াশা। অনুসূয়া জানে এখন কি করতে হবে। তিতিরকে নিজের বুকের মধ্যে টেনে নিল ও।
“সরি। আমার মানা করা উচিৎ ছিল। কিন্তু নিজে যে কটা সিধান্ত নিয়েছি জীবনে পরিণামে কাউকে না কাউকে,কিছু না কিছু হারিয়েছি। কিন্তু তোকে হারাতে পারব না আমি। তাই সাহসটা ঠিক করে উঠতে পারিনি।”
শুভব্রত তিয়াশার হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে এল,
“সাহসটা আমার তরফ থেকে আসা উচিৎ ছিল। কিন্তু সম্পর্কটা এতই ছিন্নভিন্ন ছিল যে...”
“ছিল? এখন জুড়ে নিয়েছ তো?”
শুভব্রত হাসল, “কিছুটা। বাকিটা একজনের উপর নির্ভর করছে...” অনুসূয়া অবাক হয়ে তাকাল
“মিথ্যা সান্ত্বনা দিচ্ছ কেন শুভ?”
“মিথ্যা নয় অনু...দুজনেই তো অনেক কষ্ট পেলাম...”
“এই শুভব্রতকে আমি ভালোবাসি না।”
“জানি,তোমার শুভকেই পাবে তুমি। তবে একটা শর্তে...যদি তিতির নিজেকে আমাদের মধ্যেকার বাধা আর কোনওদিন না ভাবে। তোর জন্যই আমরা কাছে এলাম। দেখলি তো...”
“কষ্ট পাবি না তো তিতির নিজের সিধান্তের জন্য?” সাবধানী গলায় বলল অনুসূয়া।
“মেকি জিনিস ভেঙে গেলে কষ্ট পাওয়া ঠিক কি?”
“অনুজের থেকে অনেক ভালো কেউ তোর যোগ্য সোনা,অনুজ নয়।”
“জানি, আর আমার ভালো বোঝার জন্য আমার দিদিভাই আর জাম্বো তো আছেই।”
শুভব্রত হাসল “জাম্বো ডাকটা মন্দ নয়,মঞ্জুর হল।”
কথার নাটকীয়তায় তিনজনেই হেসে উঠল।
দিদিভাই ঘুমিয়ে পড়েছে। তিয়াশা জানে। আজ ওর ঘুম আসছে না কিছুতেই। পরশুদিন জাম্বো আর দিদিভাইয়ের রেজিস্ট্রি। অনুজ ফোন করেছিল। যাচ্ছেতাই রেগে আছে। ফোন কেটে দিয়েছে তিয়াশা। সিমটা চেঞ্জ করে নেবে। অনুজ কি করছে এখন? জানতে বড্ড ইচ্ছা হল তিয়াশার। জেনেই বা কি লাভ? কিছু কিছু জিনিস না জানাই ভালো। কাল ও যেখানে দাঁড়িয়েছিল আজ সেখানে দিদিভাই? কষ্ট হচ্ছে কি তিয়াশার? হিংসা? নাঃ,শুধু মনখারাপ একটা। দিদিভাইয়ের কাছে যাবে ও এখন। পরশু থেকে তো...।
Tags:
গল্প