বিনোদনের সাত দশকের বৃত্তান্ত বলতে গিয়ে আগের দুটি পর্বে বাঙালির বিনোদনের দুটি প্রধান দিক থিয়েটার ও সঙ্গীতের কথা বলেছি । এবার শেষ পর্বে চলচিত্রের কথা ।
আমাদের সংগীতের ক্ষেত্রটি স্বাধীনতার আগেই তার শক্তি অর্জন করেছিল । চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রটি তেমন নয় । বলা যেতে পারে আমাদের চলচ্চিত্র শিল্প তার শক্তি অর্জন করেছিল স্বাধীনতার পরে - বিশ্ব চলচ্চিত্র শিল্পের আসরে এক পংক্তিতে বসার মত শক্তি । গর্ব করার মত অনেক উপাদান সে দিয়েছেও বাঙালিকে এই স্বাধীনতা-উত্তর সত্তর বছরে । অথচ আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের কোন তাপ-উত্তাপ প্রাক-স্বাধীনতা পর্বের চলচ্চিত্রে পড়েছিল এমন বলা যাবে না । পড়া সম্ভবও ছিল না ব্যবসায়িক সার্থে নিয়ন্ত্রিত এই শিল্পমাধ্যমে । স্বাধীনতা আন্দোলনের আবেগ ঘেরা দুটি ছবি আমরা পেয়েছিলাম স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে ১০৫১তে (‘ভুলি নাই’ এবং ‘বিয়াল্লিশ’) ।
সাতচল্লিশে দেশ যখন স্বাধীন হল বাংলা সবাক চলচ্চিত্রে বয়স মাত্র ১৫ বছর আর আগের ১৩ বছরের নির্বাক যুগের হিসাব ধরলে সাকুল্যে বাংলা চলচ্চিত্রশিল্পের বয়স ছিল মাত্র ২৮ বছর । স্বাধীনতার আগের ১৫টা বছর ছিল বাংলা চলচ্চিত্রে ডালপালা ছড়ানোর কাল । বাংলা চলচ্চিত্রশিল্পের নিতান্ত শৈশবে এমন দুজন উদ্যোগী মানুষ এসেছিলেন যারা মূল স্রোতের সিনেমাশিল্পে স্থায়ী অবদান রেখে গিয়েছেন । একজন ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় বা ডিজি, অপর জন বীরেন্দ্রনাথ সরকার ।
ধীরেন্দ্রনাথ ছিলেন অভিজাত বংশের সন্তান । রবীন্দ্রনাথের কন্যা মীরা ছিলেন তাঁর বৌদি অর্থাৎ দাদার স্ত্রী । নির্বাক যুগ থেকে নভেম্বর ১৯৭৮এ মৃত্যু পর্যন্ত ডিজি ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পের সর্বজন শ্রদ্ধেয় মানুষ । নিজামের হায়দরাবাদ আর্ট স্কুলের মর্যাদাময় অধ্যক্ষের পদ ছেড়ে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন চলচ্চিত্র শিল্পে । ধীরেন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন চলচ্চিত্রকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যেতে, গিয়েও ছিলেন । ধীরেন্দ্রনাথের মানস গড়ে উঠেছিল শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে । ওখান থেকেই এন্ট্রান্স পাশ করেছিলেন । ধীরেন্দ্রনাথের বিরাট অবদান চলচ্চিত্র নির্মাণে বাঙালির প্রভাবের প্রসার । বস্তুত তার সংস্থা বাংলা সিনেমার নির্মাণে উদ্যোগ নেওয়ার ফলেই বাংলা চলচ্চিত্রে ম্যাডান কোম্পানীর একাধিপত্য স্তিমিত হতে শুরু করে এবং চলচ্চিত্রের সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে বাঙালি আধিপত্য বিস্তারের সূচনা হয় । আধুনিক মননের মানুষ ধীরেন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন চলচ্চিত্রের অভিনয়ে মেয়েরা আসুক । সেকালে এটা খুব সহজ ছিল না সামাজিক নিষেধকে অগ্রাহ্য করা, যার জন্য অপবাদও কম সইতে হয়নি তাঁকে । এটা তাঁর কথার কথা ছিল না । নিজের স্ত্রী রমলা ও কন্যা মনিকাকে সিনেমায় নামিয়েছিলেন সামাজিক নিষেধের বেড়া অগ্রাহ্য করে । বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পের বেড়ে ওঠায় অসামান্য অবদান ছিল ধীরেন্দ্রনাথের । দুই প্রবাদপ্রতীম চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব প্রমথেশ বড়ুয়া ও দেবকী কুমার বসু তাঁর হাত ধরেই সিনেমায় এসেছিলেন । তাঁর সময় থেকে বিত্তবান বাঙালি ব্যবসায়ীরাও চলচ্চিত্রশিল্প সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠেন ।
লন্ডন থেকে সিভিল ইঞ্জিনীয়ারিং পাশ করে সে যুগের প্রখ্যাত ব্যারিষ্টার স্যার নৃপেন্দ্রনাথ সরকারের পুত্র বীরেন্দ্রনাথ সরকার কলকাতায় ফিরে চলচ্চিত্র সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে চলচ্চিত্রশিল্পে বিরাট কর্মযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন । কলকাতা, বর্ধমান ও হাওড়ায় মোট ৬টি প্রেক্ষাগৃহের নির্মাণ ছাড়া বাংলা চলচ্চিত্রশিল্পের ক্ষেত্রে বীরেন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ অবদান ‘নিউ থিয়েটার্স’ স্টুডিওর নির্মাণ ও পরিচালনা । ১৯৩০এর ১৯শে সেপ্টেম্বর পথ চলা শুরু করে নিউ থিয়েটার্স, সেই থেকে আজও প্রায় শতবর্ষের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বাংলা চলচ্চিত্রশিল্পের প্রাণকেন্দ্র হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে । আর শুধু বাংলা ছবিই বা কেন এক সময়ে হিন্দি ছবির নির্মাণও এখান থেকেই হত । দেবকী বসু, প্রমথেশ বড়ুয়া, কানন দেবী, সায়গল, পঙ্কজ মল্লিক, রাইচাদ বড়াল, কৃষ্ণচন্দ্র দে, পৃথ্বিরাজ কাপুর, দুর্গা খোটে, ছবি বিশ্বাস, পাহাড়ী সান্যাল, তুলসী চক্রবর্তী, কমল মিত্র প্রমুখ কত স্মরণীয় শিল্পীর উত্থ্বান হয়েছে নিউ থিয়েটার্স থেকে তার ইয়ত্তা নেই । বাংলা চলচ্চিত্রের নির্মাণ ও বিকাশে ধীরেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলীর সঙ্গে একই মর্যাদায় উচ্চারিত হয় বীরেন্দ্রনাথ সরকারের নাম ।
আবার ওই সময়ে – চল্লিশের দশকের শেষ পর্বেই বাংলা চলচ্চিত্রশিল্প নিয়ে সমান্তরাল সিনেমা-ভাবনারও সূচনা হয়েছিল । গত শতকের চল্লিশের দশকটা ছিল বাংলার সারস্বতভূমির মহা সৃজনকাল । কথাসাহিত্যে তিন বন্দ্যোপাধ্যায় – তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, মানিক, কবিতায় জীবনানন্দ দাস, বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, নৃত্যকলায় উদয়শঙ্কর, সঙ্গীতে শচীনদেব বর্মন প্রমুখ উজ্বল জ্যোতিষ্কদের পাশে শম্ভু মিত্র, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরীর মত নবীনদের দীপ্তিতে আলোকিত বাংলার সারস্বতভূমি, শিল্প-সাহিত্য-সংগীতের সৃজনভূমিতে নতুন চেতনা ও বোধের স্পর্শ, যদিও বাংলা চলচ্চিত্রে এই নবচেতনা ও বোধের ছোঁয়া তখনও লাগেনি । তখনকার বিশ্ব চলচ্চিত্রের সঙ্গে ভারতীয় সিনেমার মানের কোন তুলনাই হয় না। চলচ্চিত্র যে এক শক্তিশালী শিল্পমাধ্যম, এর যে জীবনের সাথে যোগ থাকতে পারে, জীবনের মূল সত্যকে যে চলচ্চিত্র স্পর্শ করতে পারে এই সত্যটা সেই সময়ের চলচ্চিত্রকারদের ছিল না । স্বাধীনতা-উত্তর কালে বাংলা চলচ্চিত্রে এই বোধের স্পর্শটাই আমাদের প্রথম প্রাপ্তি । ১৯৪৮এ কলকাতার ইংরাজি দৈনিক ‘দি স্টেটসম্যান’এ প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে সত্যজিৎ রায় লিখেছিলেন “দি র-মেটেরিয়াল অফ সিনেমা ইজ লাইফ ইটসেলফ । ইট ইজ ইনক্রেডিবল দ্যাট আ কাউন্ট্রি দ্যাট হ্যাস ইনস্পায়ার্ড সো মাচ পেইন্টিং এন্ড মিউজিক এন্ড পোয়েট্রি শুড ফেইল ট মুভ সিনেমা মেকার । হি হ্যাজ ওনলি টু কিপ হিজ আইস ওপেন” (উদ্ধৃতি সূত্র :’সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্রে ও নেপথ্যে’/অসীম সোম) । মূল স্রোতের সিনেমার পাশে সমান্তরালয় সিনেমা নির্মাণের সূচনা দেখলাম পঞ্চাশের দশকে ।
ইতিমধ্যে ১৯৪৩এ বিশ্বভারতীর চিত্রকলা শিক্ষা শেষ না করে কলকাতায় ফিরে এসেছেন সত্যজিৎ রায় । ১৯৪৭এর অগস্টে সমমনা চলচ্চিত্রপ্রেমি বন্ধু চিদানন্দ দাশগুপ্ত, হরিসাধন দাশগুপ্ত, বংশী চন্দ্রগুপ্ত প্রমুখদের নিয়ে গঠন করেন ‘ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি’ । সেখানে বিশ্বখ্যাত সিনেমাগুলি সংগ্রহ করে দেখতেন সিনেমা শিল্পের নানান দিক সম্পর্কে নিজেদের সমৃদ্ধ করতেন । বিজ্ঞাপন সংস্থা ডি যে কীমারএ চাকুরী কালীন লন্ডনে ‘দি বাইসাইকেল থিফ’ দেখে সত্যজিৎ স্থির করেন চলচ্চিত্র নির্মাণ করবেন। পথের পাঁচালীর কিশোর সংস্করণ ‘আম আঁটির ভেপু’ প্রকাশ করবে সিগনেট, তার ছবি আঁকার কথা সত্যজিতের । লন্ডন থেকে ফেরার পথে জাহাজে বসে ছবিগুলি আঁকলেন, আর এই ছবিগুলিই হল ‘পথের পাঁচালী’র এক একটি দৃশ্যের ফ্রেম - পথের পাঁচালীর প্রকৃত চিত্রনাট্য । তার পরের বৃত্তান্ত তো ইতিহাস । সমস্ত প্রকুলতা জয় করে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অর্থানুকুল্যে নির্মাণ করলেন ‘পথের পাঁচালী’ – নির্মাণ করলেন ভারতীয় চলচ্চিত্রশিল্পের নতুন ইতিহাস । মুক্তি পেল ভারতীয় চলচ্চিত্রে এতাবৎ কালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবদলিল ‘পথের পাচালী’ ১৯৫৫র এপ্রিলে নিউইয়র্কে এবং অগস্টে কলকাতায় ।
এই সময় থেকেই বানিজ্যিক বা মূল স্রোতের পাশাপাশি ‘সমান্তরাল সিনেমা’র কথা বলতে শুরু করলাম । পঞ্চাশের দশকেই বাংলা সিনেমা পেলো ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেনকে । চল্লিশ-পঞ্চাশ দশকে সাহিত্যে যেমন তিন বন্দ্যোপাধ্যায় – বিভূতিভূষণ –তারাশঙ্কর - মানিক , পঞ্চাশ-ষাটের থিয়েটারে যেমন শম্ভূ মিত্র- উৎপল দত্ত- অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়,বাংলা চলচ্চিত্রেও তেমনই স্বাধীনতা-উত্তর সত্তর বছরের সেরা প্রাপ্তি সত্যজিৎ, ঋত্বিক ঘটক ও মৃণাল সেন । এঁদের সব নির্মাণ বানিজ্যিক সাফল্য পায়নি সত্য কিন্তু কে অস্বীকার করবে ভারতীয় চলচ্চিত্রকে বিশ্বের চলচ্চিত্রের আসরে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে এদের অসামান্য অবদান ! সত্যজিৎ চলে গেছেন ১৯৯২এ, মৃণাল সেন ৯৪ বছরেও আমাদের মধ্যে আছেন । শেষ ছবি ‘আমার ভুবন’করেছেন ২০০২এ । কিন্তু ঋত্বিক ঘটক যেন অনাবিষ্কৃতই থেকে গেলেন মাত্র ৫১ বছর বয়সে নিজের অমন সৃষ্টিশীল জীবনের ‘অপচয়’ ঘটিয়ে । ১৯৫২ থে ১৯৭৪ এই দীর্ঘ সময়ে মাত্র সাতটি ছবি নির্মাণ করতে পেরেছিলেন । কোন প্রযোজক এগিয়ে আসতেন না তাকে দিয়ে ছবি করাতে । ১৯৬৫তে ‘সূবর্ণরেখা’ দর্শক আনুকুল্য পাবার পরেও তাকে নয় বছর বসে থাকতে হয়েছিল । ১৯৭২এ ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ করার পর শেষ ছবি করেন ১৯৭৪এ ‘যুক্তি তক্ক আর গল্প’ ১৮৭৪এ । নিজের তাবৎ শিল্পকর্মের মধ্যে ঋত্বিকের অন্বেষণ ছিল এক ‘শিল্পভাষা’র যা দিয়ে মানুষের কাছে পৌছানো যায় । লিখেছিলেন
“... এ ভাষা জন্মাইতে পারে শুভ্র উত্তাপময় প্রেরণা হইতে । সে প্রেরণা, মনে হয়, পেশাদার বায়োস্কোপের লোকের দ্বারা হইবে না । ... খুব খানিকটা না রাগিলে, খুব ভালো না বাসিলে, খুব না কাঁদিলে, এ আদিম ভাষা কোথা হইতে উঠিবে” ? (ঋত্বিক পত্নী সুরমা ঘটকের ‘ঋত্বিক’ গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত) ।
বহুচর্চিত ‘সমান্তরাল সিনেমা’র বাইরে যে দুজন চিত্রনির্মাতার কাজ বাংলার চলচ্চিত্র শিল্পে স্মররণীয় হয়ে আছে, থাকবেও তাঁরা হলেন তপন সিংহ ও তরুণ মজুমদার । দুজনেই জানতেন সংস্কৃতিমনা বাঙালির রুচি কেমন সিনেমায়, অথচ জনরুচির সিনেমা নির্মাণে তাঁদের কেউই চলচ্চিত্র জীবনে কোন সমঝোতা করেছেন এমন জানা যায় না । দুজনেই সিনেমাই মূলত সাহিত্যনির্ভর । তপন সিংহ সেলুলয়েডে এনেছেন রবীন্দ্রনাথ থেকে বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর, বনফুল, সমরেশ বসু, রমাপদ চৌধুরী, শঙ্কর, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখের গল্প, তেমনই তরুণ মজুমদারও মনোজ বসু, বিমল কর, বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর, বনফুল প্রমুখের কাহিনী চিত্রায়িত করেছেন । তপন সিংহ’র দীর্ঘ ষাট বছরের চলচ্চিত্র জীবনে ১৯৫৪তে ‘অঙ্কুশ’ থেকে শেষ ছবি ’আনোখা মতি’(হিন্দি) পর্যন্ত ৬টি হিন্দি সহ মোট বিয়াল্লিশটি ছবি নির্মাণ করেছেন যার মধ্যে একটাও এমন ছবি নেই যা প্রযোজককে মুনাফা দেয়নি । চলচ্চিত্র বোদ্ধারা নিশ্চিতভাবেই স্বীকার করবেন যে স্বাধীনতা-উত্তর ‘মেইনস্ট্রিম’ বা মূল স্রোতের সিনেমায় এতাবৎকালের সর্বশ্রেষ্ঠ চিত্র নির্মাতার মর্যাদা পাবেন তপন সিংহ । তাঁর কাবুলিওয়ালা(১৯৫৭), ক্ষুধিত পাষাণ (১৯৬০), ঝিন্দের বন্দী (১৯৬১) জতুগৃহ (১০৬৪) হাটে বাজারে(১৯৬৭), আপনজন ( ১৯৬৮), সাগিনা মাহাতো (১৯৭০), আতঙ্ক (১৯৮৬), হুইলচেয়ার (১৯৯৪) স্বাধীনতা-উত্তর সত্তর বছরের কয়েকটি সুপারহিট ছবি । তরুণ মজুমদারের সিনেমার সহজ রসায়ণ ছিল ভালো গল্প ও মন ছোঁয়া গান । এই রসায়ণে নির্মিত পলাতক (১৯৬৩), আলোর পিপাশা(১৯৬৫), বালিকা বধু (১৯৬৭), শ্রীমান পৃথ্বিরাজ(১৯৭৩), ফুলেশ্বরী(১৮৭৪), গণদেবতা(১৯৭৮), ভালোবাসা ভালোবাসা, দাদার কীর্তি, আলো (২০০৩) দেখতে দর্শক টিকিট কাউন্টারে ভিড় করেছে । সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল এই ত্রয়ীর সমকালেই আর একজন চিত্রনির্মাতা রাজেন তরফদার এখন প্রায় বিস্মৃতির আড়ালে চলে গিয়েছেন । অথচ পঞ্চাশ-ষাটের দশকে বাংলা চলচ্চিত্রের নবচেতনার কালে সতজিৎ-মৃণালদের সঙ্গে এক বন্ধনীতে উচ্চারিত হত রাজেন তরফদারের নাম । মাছ-মারাদের জীবন নিয়ে ‘গঙ্গা’ তার সাড়াজাগানো ছবি ১৯৬০এর নভেম্বরে মুক্তি পেয়েছিল । ১৯৫৭তে প্রথম ছবি ‘অন্তরীক্ষ’ও ব্যতিক্রমী ছবি হিসাবে সমাদৃত হয়েছিল । ১৯৭৬এ ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনায় নির্মাণ করেন ‘পালঙ্ক’ । ১৯৫৭ থেকে ১৯৮৭ এই তিন দশকে মাত্র সাতটি সিনেমার নির্মাণ করেছিলেন রাজেন তরফদার ।
সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল এই ত্রয়ীর বিছানো পথে আরো কয়েকজন তরুণ চিত্রনির্মাতা সমৃদ্ধ করেছেন স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা চলচ্চিত্রকে । সত্তর দশকে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত আশির দশকে গৌতম ঘোষ, উৎপলেন্দু চক্রবর্তী, নব্বইএর দশকে অকাল প্রয়াত ঋতুপর্ণ ঘোষ প্রমুখ । তাঁদের অনেক ছবি দেখতে দর্শক টিকিট কাউন্টারে ভিড় করেছেন, আন্তর্জাতিক সম্মান অর্জন করেছে এবং ভালো বাংলা সিনেমার ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে । চলচ্চিত্র বোদ্ধারা চলচ্চিত্র বিষয়ক আলোচলায় সত্যজিৎ -ঋত্বিক-মৃণালকে আলোকিত করেই থেমে যান, কিছুটা গৌতম ঘোষ ও বুদ্ধদেব দাসগুপ্ত, অপর্ণা সেন আসেন তাঁদের আলোচনায় । অনালোকিত থাকেন মেইনস্ট্রীম সিনেমার নীরেন লাহিড়ী, অগ্রদূত, অর্ধেন্দু মুখার্জী, পীনাকী মুখার্জী, অরবিন্দ মুখার্জী, অসিত সেন, অজয় কর, সুশীল মজুমদার, কার্তিক চট্টোপাধ্যায়, হরিদাশ ভট্টাচার্য, পিযুষ গাঙ্গুলী, পরিচালক বিকাশ রায়েরা । স্বাধীনতা পরবর্তী সময়কালে, বাংলা চলচ্চিত্রশিল্পের বেড়ে ওঠায় এদের অসামান্য অবদান রয়েছে । এদের চলচ্চিত্র দেখতে বাঙালি প্রেক্ষাগৃহের টিকিট কাউন্টারে দীর্ঘ লাইন দিয়েছে, বিনোদিত হয়েছে । একটি নিবন্ধের পরিসরে কত জনকেই বা ছোঁয়া সম্ভব ! তবু এইসব ছবিগুলি আমাদের মূল স্রোতের সিনেমায় অবিস্মরণীয় হয়ে আছে । পিনাকী মুখার্জী পরিচালিত ঢুলি (১৯৫৪), চৌরঙ্গি (১৯৬৮) অগ্রদূতের অগ্নিপরীক্ষা (১৯৫৪), সবার উপরে (১৯৫৫), সাগরিকা (১৯৫৬) পথে হল দেরি(১৯৫৭), কার্তিক চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত চন্দ্রনাথ (১৯৫৭), অজয় কর পরিচালিত হারানো সুর (১৯৫৭), সপ্তপদী( ১৯৬১),সাত পাকে বাঁধা (১৯৬৩), চিত্ত বসুর ছেলে কার (১৯৫৪), মায়ামৃগ, বন্ধু, সুশীল মজুমদারের পুষ্পধনু (১৯৫৯), হসপিটাল(১৯৬০), লাল পাথর (১৯৬৪), অসিত সেন পরিচালিত চলাচল(১৯৫৬), পঞ্চতপা(১৯৫৭), দ্বীপ জ্বেলে যাই(১৯৫৯), উত্তর ফাল্গুনী (১৯৬৩, মমতা(১৯৬৬), সুধীর মুখার্জী পরিচালিত শাপমোচন (১৯৫৫), শেষ পর্যন্ত, দুই ভাই(১৯৬১) যাত্রিকের ‘কাঁচের স্বর্গ’, ‘স্মৃতিটুকু থাক’ নীরেন লাহিড়ীর ‘ইন্দ্রাণী’(১৯৫৮), ‘রাইকমল’, হরিদাশ ভট্টাচার্যর ‘সন্ধ্যা দীপের শিখা’ (১৯৬৪), কমললতা (১৯৬৯),নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের ‘অদ্বিতীয়া’(১৯৬৮), সলিল দত্ত পরিচালিত স্ত্রী, সরোজ দে পরিচালিত ডাকহরকরা, বিজয় বসু পরিচালিত আরোগ্য নিকেতন, বিকাশ রায় পরিচালিত ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ (১৯৫৯), কেরী সাহেবের মুন্সী, অরবিন্দ মুখার্জীর ‘ধন্যি মেয়ে’(১৯৭১), ‘অগ্নিশ্বর’(১৯৭৫), সুনীল ব্যানার্জীর ‘দেয়া-নেয়া’(১৯৬৩) এমন কত ছায়াছবি আমাদের স্মৃতিতে উজ্বল হয়ে আছে ।
আশি ও নব্বই দশক থেকে বাংলা সিনেমায় লক্ষ্যণীয় শূন্যতা এলো । ছবির কাহিনী অভিনয়, সঙ্গীত – সব ক্ষেত্রেই শূন্যতা । পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর এই ত্রিশ বছরে বাংলা ছবির বানিজ্যিক সাফল্যের রসায়ণ ছিল সাহিত্যনির্ভর চিত্রনাট্য, হেমন্ত, মান্না, সন্ধ্যা শ্যামল মিত্রদের গান আর রোম্যানটিক অভিনয় । উত্তমকুমার, ছবি বিশ্বাস, অনিল চট্টোপাধ্যায়, বিকাশ রায়, পাহাড়ী সান্যাল, বসন্ত চৌধুরী, কালী বন্দ্যোপাধ্যায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অনুপ কুমার, সুচিত্রা সেন, অনুভা গুপ্তা, ছায়া দেবী, অরুন্ধতি দেবী, সুপ্রিয়া চৌধুরী, সাবিত্রি চট্টোপাধ্যায় মত শক্তিশালী অভিনেতা-অভিনেত্রীর অভিনয়, পরিচালকের শিল্পরুচি ও মধ্যবিত্ত বাঙালির মন ছোঁয়া গানের প্রয়োগ এই রসায়নেই বাঙালি সিনেমা হলে ভহিড় জমাতো । অনেক দুর্বল কাহিনীর ছায়াছবি শুধুমাত্র উত্তমকুমারের অভিনয় গুণে বানিজ্যিক সাফল্য এনে দিয়েছে কিংবা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, মান্নাদে’র গানের প্রয়োগের গুণে প্রযোজক লাভের মুখ দেখেছে । ১৯৬২তে মোটর দুর্ঘটনায় নিহত ছবি বিশ্বাস ও ১৯৭৪এ পাহাড়ী সান্যালের চলে যাওয়ার অভাব সামলে উঠতে পেরেছিল বাংলা ছায়াছবি, কিন্তু জুলাই ১৯৮০তে উত্তমকুমারের চলে যাওয়াটা সামলাতে পারলো না । তার আগেই ১৯৭৯তে অন্তরালে চলে গেলেন সুচিত্রা সেন । এই দুজনের অভাব পুরণ করার মত কেউই থাকলেন না বাংলা সিনেমায় । তারপর একে একে চলে গেলেন অনেকেই । অশিতিপর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এখনও তাঁর অভিনয় দিয়ে বাংলা সিনেমাকে সমৃদ্ধ করছেন বটে, কিন্তু একা আর কতটুকু টানবেন ধুঁকতে থাকা বাংলা সিনেমাকে ! প্রসেনজিৎ, চিরঞ্জিত, ঋতুপর্ণা, পাওলি দামরা উত্তম, সূচিত্রা, সাবিত্রিদের উচ্চতাকে অতিক্রম করতে পারবেন এমন কথাও বলা যাচ্ছে না । ১৯৭৬এ চলে গেলেন সঙ্গীত পরিচালক নচিকেতা ঘোষ, ১৯৭৭এ অনিল বাগচী, গীতিকার প্রণব রায়, ১৯৮৬তে গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, ১৯৮৭তে পরিচালক রাজেন তরফদার, অভিনেতা বিকাশ রায় ও সুরকার-গায়ক শ্যামল মিত্র আর ১৯৮৯তে তাঁর চুয়ান্ন বছরের সংগীত সফর শেষ করে চলে গেলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় । বাংলা চলচ্চিত্র নির্মাণে এঁদের শূন্যতা সহজে পুরণ হবার নয়, হয়নিও ।
আবার নব্বই থেকেই বাংলা চলচ্চিত্রের ঘুরে দাঁড়ানোর সংকেতও পাওয়া গিয়েছিল । ২০১৩তে অকাল প্রয়াত ঋতুপর্ণ ঘোষ এই পর্বের সাড়াজাগানো চিত্র নির্মাতা । ১৯৯২এ তাঁর প্রথম ছবি ‘হীরের আংটি’র পর ‘১৯শে এপ্রিল’(১৯৯৪), ‘দহন’ (১৯৯৭), ‘উৎসব’(২০০০), ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’ (২০০৮),‘আবহমান’ (২০০৯) প্রভৃতি যেমন বানিজ্যিক সাফল্য পেয়েছে, তমনই নানান রাষ্ট্রীয় সম্মানও অর্জন করেছিল । প্রভাত রায়, রাজা সেন প্রমুখও এই পর্বে বেশ কিছু বানিজ্যসফল সিনেমা নির্মাণ করেছেন । বাংলা সিনেমাশিল্পের সার্বিক সংকটের মধ্যেও এই শতকের দুটি দশকে বেশ কিছু তরুণ চিত্রনির্মাতা সুরুচিসম্পন্ন ও বানিজ্যিকভাবে সফল সিনেমা নির্মাণ করছেন । গত দশ বছরে আরো বেশ কয়েকটি ভালো বাংলা সিনেমা আমরা পেয়েছি । আবহমান, ইতি মৃণালিনী, জাতিস্মর, মুক্তধারা, ল্যাবরেটরি, রামধনু, গল্প হলেও সত্যি, চাঁদের পাহাড়, নাটকের মত, রাজকাহিনী, শুধু তোমারই জন্য, বিসর্জন, বেলাশেষে প্রভৃতি বক্স অফিস আনুকুল্য পেয়েছে, কেউকেউ রাষ্ট্রীয় সম্মাননাও পেয়েছেন । একটা হিসাবে দেখছি কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের ‘চাঁদের পাহাড়’(২০১৩) ব্যবসা করেছে ১৬.৫৩ কোটি টাকার, সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ‘মিশর রহস্য’(২০১৩) ৮.৫ কোটি, ‘রাজকাহিনী’ ৬.৭ কোটি, ‘জুলফিকার’ ৮.৫ কোটি, নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ‘প্রাক্তন’ ব্যবসা করেছে ৮.৫ কোটির । এটা বাংলা সিনেমা শিল্পের একটা ইতিবাচক দিক নিশ্চিতভাবেই । তবুও, কমলেশ্বর মুখার্জী, রাজ চক্রবর্তী, সৃজিত, শিবপ্রসাদদের কাজের মূল্যায়ন করার সময় এখনও আসেনি । এদের মধ্যে কাউকেই সত্যজিৎ, তপন সিংহ, মৃণাল সেন, তরুণ মজুমদারের বিকল্প ভাবা যাচ্ছে না ।
বেশ কিছু ভালো এবং ব্যবসায়িকভাবে সফল সিনেমা আমরা পাচ্ছি ঠিকই কিন্তু তা বাংলা চলচ্চিত্রশিল্পের সাম্প্রতিক অবস্থার একটা অতি খন্ড চিত্র মাত্র । এদের ছবিগুলো প্রায় সবই শহুরে এলিট দর্শকদের মাথায় রেখেই নির্মিত, তাদের সমাজের কথা, তাদের অন্তর্দ্বন্দ্বই এইসব ছবির কাহিনীসার, সাধারণ মানুষের যাপনচিত্র তাদের পারিবারিক হাসি-কান্না, বিষাদ-বিপন্নতার গল্প তেমনভাবে পাই না এই সব ছবিতে । এখনো সাধারণ বাঙালি সিনেমাপ্রেমিক সিনেমাকে ‘বই’ বলে, যার অর্থ বইয়ের মতই নিটোল গল্প চায় সিনেমার মধ্যে । তপন সিংহ নেই, তরুণ মজুমদার ছবি করার জন্য প্রযোজক পাচ্ছেন না, (অনেকদিন পর তরুণ মজুমদার অতি সম্প্রতি ‘ভালোবাসার বাড়ি’ নামে একটা ছবি করেছেন) প্রভাত রায়ও ছবি করতে পারছেন না । হিন্দি সিনেমা ও টেলিভিশনের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে সিনেমা হলগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, ১১০০ সিনেমা হলের মধ্যে এখন সাকুল্যে ৪০০টি প্রেক্ষাগৃহ রয়েছে সারা বাংলায় । বাংলা ছবি চালিয়ে হল মালিকের ঘরে মুনাফা ঢোকেনা যে ! অভিনয় শিল্পীরা পেটের দায়ে মাথামুন্ডুহীন টেলিসিরিয়ালে কাজ খুঁজছেন । গাদা গাদা তৃতীয় শ্রেণীর মুম্বাই ছবি বাংলায় ডাবিং করে বাজারে ছাড়ছেন সিনেমা ব্যবসায়ীরা । এখনও কলকাতার ভালো ছবি করিয়েদের উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য মুম্বাই, চেন্নাই ছুটতে হয় । টালিগঞ্জের জীর্ণ ল্যাবরেটরি আর মোটেই ভরসা জোগাতে পারছে না তাদের । বাংলা সিনেমা ধুঁকছে আর তামিল ছবি ‘বাহুবলী’ কোটি কোটি টাকার বানিজ্য করে যাচ্ছে । বাংলা সিনেমাশিল্প ধুঁকছে – বয়সের ভারে নয় মৌলিক সৃষ্টির অভাবে । স্বাধীনতা-উত্তর সত্তর বছরের শেষে পৌঁছে আমি বাংলা চলচ্চিত্রশিল্পের এই চেহারাই দেখছি ।
সুচিন্তিত মতামত দিন