নিবেদিতা ঘোষ মার্জিত

আমোদিনীঃ স্থবিরা
শরীরের ভিতরে যত গুলি নল রহিয়াছে,তাহার অধিক বাহির হইতে তাহার দেহে নল গুঁজিয়া রাখা হইয়াছে। উহাই তাহাকে বাঁচাইয়া রাখিয়াছে। তাহার দেহ হইতে বিকট গন্ধ বাহির হইয়া থাকে। অবগুণ্ঠন দিয়া যেমন নববধূর সৌন্দর্য লোভাতুর পুরুষের দৃষ্টিপাত হইতে রক্ষা করা হইয়া থাকে,সেইরূপ নানান প্রকার সুগন্ধ দিয়া দুর্গন্ধটিকে আবরণ করিবার চেষ্টা হইয়া থাকে। আজ আমোদিনী কে কেহ দেখিতে আসিবে। তাহার কারনে সুগন্ধের প্রয়োগও অতিরিক্ত হইয়াছে। আমোদিনী কে যিনি দেখিতে আসিলেন তিনি বহুকাল পূর্বে আমোদিনীর নিকট শিক্ষা গ্রহন করিয়াছেন। ভদ্রলোক আমোদিনী কে দেখিয়া বাক রহিত হইলেন। রুমালে কপাল স্থিত ঘাম মুছিয়া বলিলেন,“ আমরা দিদিকে পুরস্কার টি দেবো স্থির করেছি। কিন্তু এভাবে কি দেওয়া যাবে?”

আমোদিনীর মধ্যম কন্যা বলিল, “ টাকা দেবেন না কি ঐ মানপত্র”। ভদ্রলোক বলিল, “ টাকা তো একটু দেওয়া হবে। কিন্তু মিডিয়া কে আনা যাবে না বড্ড খারাপ অবস্থা ম্যাডামের।” আমোদিনী কে দেখিতে ভালো লাগিবে না। তাই ভদ্রলোক চিন্তায় পড়িলেন। ফোনে কাহার সহিত নিম্নস্বরে কথা কহিলেন। কনিষ্ঠা কন্যা হতাশ হইল। সে বলিল ,“ মার প্রচুর ছবি আছে ,ওগুলো দিয়ে মিডিয়া কে বলবেন ওগুলো ব্যাবহার করতে। টাকা টা আমাদের খুব দরকার”। গলা আরও নামিয়ে বলিল, “ আসলে আমার দরকার”।

গৃহের সর্বত্র উৎকৃষ্ট গ্রন্থে ঠাসা। আমোদিনীর ন্যায় মহিলা ভ্রমন অভিজ্ঞ বাঙলা দেশে খুব একটা নাই। একাধারে পুরাত্বতের বিদগ্ধ পন্ডিত সে, অন্যধারে ভ্রমন সংক্রান্ত রচনাকার। হিমালয় সে গভীর ভাবে চিনিয়া লইতে চাহে। বহু দুর্গম স্থানে সে একাকী ভ্রমন করিয়াছে।যে সব স্থান মানুষ একরাত্রি কাটাইয়া আত্মীয়স্বজন কে গর্বিত হইয়া গল্প করিয়া থাকে, আমোদিনী সেই স্থান গুলিতে মাসাধিক কাল কাটাইয়া তাহাকে পরিপূর্ণ জানিবার চেষ্টা করিয়া থাকে।তাহার বীরত্ব ,মেধা আর অভিজ্ঞতা তাহার লেখনী কে আরও সতেজ করিয়া ছিল। গুণীজনের কাছে তাঁর লেখা নিছক ভ্রমন কাহিনী হইয়া ছিল না। তাহার অধ্যাপক স্বামীর সহিত তাহার বড় মধুর সম্পর্ক।অর্থকষ্ট তাহাদের ছিল না। উভয়ের উপার্জন আর সামাজিক অবস্থান অত্যন্ত উচ্চদরের 

জীবন যাপনের সংজ্ঞা হইয়া উঠিয়াছিল। অধ্যাপনা করিয়া, ভ্রমন করিয়া, সাহিত্য রচনা করিবার সাথে তিনখানি কন্যাসন্তান কে পালন করিতেছিল আমোদিনী। অতি ব্যাস্ততার সহিত তাহার এই খড়স্রোতে বহিয়া যাওয়া কালে তৃতীয় কন্যার প্রতি স্নেহ থাকিলেও পালনের যে কুশলী দক্ষতার প্রয়োজন হইয়া থাকে তা আমোদিনী করিয়া উঠিতে পারেনি। অন্য দুই কন্যা সবালম্বী হইয়া উঠিল । তাহাদের উপযুক্ত বিবাহ হইল। জীবন সুখের ও হইল। কিন্তু কনিষ্ঠা টি বড় দুর্বল। সে পরিশ্রমী নয়। তাহার নিজের কোনরূপ পরিচিতি হইল না। আমোদিনী তাহারে বহু অর্থ দিয়াছিল। সে বুটিকের ব্যাবসায় তাহা খোয়াইল। সিরিয়াল করিতে গিয়া বহু অদ্ভুত বন্ধু জুটাইল। তাহাদের একজন কে বিবাহ করিল। সিরিয়ালের গল্পের ন্যায় তাহা নানান নাটকীয় মুহূর্ত তৈরি করিল। বিচ্ছেদ আসিল। এই ঘটনায় নানান অপমানে আমোদিনীর স্বামী অত্যন্ত অসুস্থ হইয়া পড়িল। টানাপোড়েন চলিতে লাগিল। আমোদিনী হিমালয় ভুলিল। ক্যামেরা ভুলিল। কলম খাতা ভুলিল। বিবাহ বিচ্ছিন্না কন্যার যন্ত্রণা আর অতি সজ্জন স্বামীর গভীর অসুখ ভিন্ন তাহার মস্তিস্কে আর কিছুই রহিল না।কন্যা তাহার মনের কষ্ট ভুলিতে দামী পোশাক আর সুগন্ধি কিনিতে লাগিল।আমোদিনীর স্বামীর চিকিৎসা কঠিন হইতে কঠিন তর হইতে লাগিল। আমোদিনী জনিতে পারিল না তাহার অর্থ শক্তি ক্রমশ কমিয়া আসিতেছে। 

আমোদিনী স্বামীকে হারাইল। তাহার সহিত তাহার

জীবনের প্রতি ভালোবাসা চলিয়া গেল।সে খাইতে ভুলিল। নিদ্রাহীন রহিল। তাহার মন কষ্ট হইতে বাহির হইয়া আসিতে দীর্ঘ সময় লাগিল। তাহার এই এই সকল বিপদের মধ্যে তাহার অধ্যাপনার অবসর আসিয়া উপস্থিত হইল। ইহার মধ্যে কনিষ্ঠা কন্যা তাহার নানান অদ্ভুত খেয়ালে সঞ্চিত সকল অর্থ কখন নষ্ট করিয়া ফেলিয়াছে তাহা জানিতে এবং অনুধাবন করিতে গিয়া আরও কষ্টের সন্মুখিন হইল।

আমোদিনী কেবলে শরীরে বাঁচিয়া আছে। আসলে তাহাকে বাঁচিয়া থাকিতে হবে। তাহাকে শ্বাস ফেলিয়া চলিতে হইবে। সে কোন কালে হিমালয় চষিয়া আসিয়াছে তাহা তাহার আয়া জানে না।আয়া তাহার পা সোজা করিয়া দিয়া ,চিৎ করাইয়া চাদরে আবৃত করে। ডায়পার বদলাইবার সময় মনে মনে চরম গালাগালি দিয়া থাকে। কনিষ্ঠা কন্যা তাহাকে ঠিক করিয়া অর্থ দিতে চাহে না। নল বাহিত হইয়া জীবনীশক্তি লইয়া আমোদিনী বাঁচিয়া রহে। তাকে তাহার কনিষ্ঠা কন্যার জন্যে বাঁচিয়া থাকিতে হইবে।পেনসন ভিন্ন আর তাহাকে কি দিতে পারে আমোদিনী। 

niveditaghosh24@gmail.com


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.