নিলয় সরকার

সংক্রান্তির লোকায়ত পরব "ঘেঁটু"
ঝরাপাতার মর্মরিত বনবিথীকায় তখন বেজেছে শীতের সমাপ্তি সঙ্গীত ! বাতাসের হিমেল .স্পর্শতায় তখন নব বসন্তের উষ্ণ উচ্ছ্বাস ! বনানীর সীমাহীন প্রান্তরে প্রান্তরে তখন শুরু হয়ে গেছে নব হরিতের সমারোহ ! শিমুলের লাল ফুলে ছেয়ে গেছে মেদুর বনাঞ্চল ! এসে গেলো আবির গুলালে রাঙানো যৌবনের দিন ---উৎসবের দিন ! সেদিনের দিনশ্রান্ত অবসন্ন গোধূলি সন্ধ্যায় কোনও একদিন জোৎস্নার নির্লিপ্ত শুভ্রতা বুকে নিয়ে উঠে আসতে দেখবেন একদল শিশুকে, কাঁধে তাদের নিরালম্ব ভার ! কলাগাছের 'বাসনা' দিয়ে সাজানো মূল কেন্দ্রে অনেকটাই পাল্কির মতন শ্বেত-শুভ্রজ্বল চলমান এক আলোকবর্তিকা, সাদা ঘেঁটুফুলের মুঠো মুঠো পুষ্পরাশিতে সাজানো যেন এক জীবন্ত লৌকিক রথ ! জোৎস্নার স্বপ্নিল বাতায়নে সেই ছন্দায়িত রথ ছোট ছোট শিশুদের হাতের দোদুল দোলায় হয়তো আপনার বাড়ির অঙ্গনে গিয়েই হাঁক পারবে ---

"ঘেঁটু যায় ঘেঁটু যায়,খোস পালা
আয়রে ঘেঁটু নড়ে, যষ্ঠিকাঁধে করে
যে দেবে মুঠো মুঠো, তার হবে হাত ঠুঁটো
যে দেবে পালি পালি, তার হবে টেঁপো গালি
যে দেবে কুলো কুলো, সে পাবে সোনার ধুলো
যে দেবে মড়াই মড়াই, তার দুয়ারে সোনার চড়াই
যে দেবে থালা থালা, তাঁর হবে সোনার বালা

দিনটা ফাল্গুনের সংক্রান্তি ! ঐ দিনটাই ঘেঁটুর পুজো ! ঘেঁটু ঠাকুর হলো গিয়ে খোস, পাঁচরা, চুলকানি প্রভৃতি চর্মরোগের দেবতা, ঘেঁটু দেবতার মাহাত্ম্য প্রচারে ভক্তেরা কোথাও কোথাও গান বাঁধেন একটু অন্য ভাবে....

"সে বছর খোস হয়েছে শ্রীরামচন্দ্রের গায়
(দোহার)....ও মরি হায় হায় হায়
সে বছর খোস হয়েছে লক্ষণের গায়
(দোহার)......ও মরি হায় হায় হায়
কৌশল্যা, সুমিত্রারানী, এঁরা কেঁদে কেঁদে পাগলিলী
দশরথ, নৃপমণি ভূমিতে লোটায়
(দোহার)....ও মরি হায় হায় হায়
তখন মন্ত্রী বলে শুন রাজা
করো তুমি ঘেঁটুর পূজা
আপদ বালাই দূরে যাবে
যম যন্ত্রণা মম যন্ত্রণায়

প্রসঙ্গতঃ বলে রাখা ভালো যে এ লোকায়ত উৎসব ছড়িয়ে আছে হুগলী ও উত্তর চব্বিশ পরগনায় ! বলে রাখা ভালো এ উৎসব মুলতঃ নিম্নবিত্ত প্রান্তিক সম্প্রদায়ের মাঝেই সীমায়িত ! লোকবিশ্বাস এ উৎসব প্রায় ১৫০ বছরের প্রাচীন ! শোনা যায় সেকালে বংশবাটি(বাঁশবেড়িয়া)র রাজা নৃসিংহদেবরায়ের রাজপাট গঙ্গার অপরপার এ উত্তর চব্বিশ পরগনা পর্যন্ত বিস্তৃতি পায় ! কালক্রমে এই লোকসংস্কৃতি ও লোকাচার দুপারের কর্ষণজীবী সম্প্রদায় সমূহে ছড়িয়ে পরে !

পুরাণে ঘেঁটুঠাকুর শিবের অনুচর কিন্তু প্রবল বিষ্ণুবিরোধী ছিলেন ! তাঁর অপর নাম ঘণ্টেশ্বর বা ঘন্টাকর্ণ ! ফাল্গুন সংক্রান্তির ভোরবেলা বাড়ীর দরজার সামনে গোবরলেপে কুলোর ওপর একটা কালিমাখা হাঁড়ি উপুড় করে রেখে ঐ হাঁড়িতেই দু-ঢেলা গোবরে ও গিঁটেকরি দিয়ে চোখ গড়ে , তারপর ঘেঁটুফুল দিয়ে হয় পুজো ! পুজো মানে ঘেঁটুঠাকুরের কিছু গান গাওয়া ব্যাস ! পুজো শেষে মূর্তিসূচক পোড়া হাঁড়ি লাঠি দিয়ে পিটিয়ে ভেঙ্গে ঐ লাঠিতেই কলার বাসনা দিয়ে পাল্কির মত ঢুলিগড়ে ঘেঁটু ফুল দিয়ে সাজিয়ে, জোৎস্নারাতে বেড়িয়ে পরে মাঙ্গনের দল যা প্রাপ্তি হলো তাই দিয়েই হয় পরের দিনের বনভোজন উৎসবের সমাপ্তি।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.