কৃষ্ণা রায়

আমার স্বদেশ এবং   একটি স্বাধীনতা দিবস


আবার ১৫ অগাস্ট এল বলে। শ্রাবণের এই সময়টা বড় অদ্ভুত, ভরা বর্ষায় আচ্ছন্ন রোম্যান্টিক অনেক অনুভূতির পাশাপাশি একটা গোল গোল ভাবনা ঠিক গোপন সস্তি দেয়। আমাদের পূর্বজদের অনেক লড়াই এর পর কষ্টে পাওয়া স্বাধীনতা দিবসটি এখনো অক্ষত আছে , ক্যালেন্ডারে হাসি হাসি ছুটিমুখ নিয়ে। তার উদযাপনে, কত গান , কবিতা, পথ নাটিকা, বক্তৃতা। সেদিন শুরু থেকেই আকাশ বাতাস মুখরিত হবে কোটি কোটি কথায়, দশক দশক পার করে কি পেলাম , কি পেলাম না, কবর খুঁড়ে তার তাত্ত্বিক আলোচনায়। বাড়িতে বয়স্ক প্রিয়জনের মধ্যে যারা স্বাধীনতা দিবসের প্রত্যক্ষদর্শী, তারা আবার নতুন উৎসাহে সেই উজ্বল দিনটার স্মৃতি হাতড়াবে, বাড়ির কর্ম-সহায়িকা মেয়েটি আহ্লাদ করে সেদিনের জন্য বাড়তি ছুটি চাইবে। আপনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হলে আপনাকে পতাকা তোলার মত মহৎ কাজটি করতেই হবে। সহকর্মীদের হাজিরা দেওয়ার জন্য নোটিশ বার করতে হবে। অথচ স্কুল কলেজে মাস্টারমশাই দিদিমণির দল ব্যাজার মুখে বলবে, ওইদিন পতাকা তুলতে না এলেই কি নয়? কেউ কেউ এর জন্য আপনার কাছে কম্পেন্সেটরি ক্যাজুয়াল- লিভের ডিম্যান্ড করতে পারে। সকাল বেলা কোন কোন পাড়ায় প্রভাত ফেরি বেরোবে, কচি-কাচারা ড্রাম বাজিয়ে দেশাত্মবোধক গান গাইবে, মাংসের দোকানের সামনে লম্বা লাইন, বাজারে বাহারি সবজি উপছে পড়বে, হোটেল , রেস্টুরেন্ট গমগম করবে মানুষের আনাগোনায়। তারপর বিকেল সন্ধ্যে জুড়ে কত রকমারি অনুষ্ঠান। মাইকের প্রা্ণঘাতী শব্দ মূর্ছনা , হাঁপিয়ে ওঠার মতই। স্বাধীনতার উদযাপন শ্বাসরোধকারীই বটে।

এই কি তবে আমাদের স্বাধীনতা দিবসের বার্ষিক ডায়েরি ? এরই জন্য ইতিহাস লিখে গেছে এত রক্ত , ঘাম , হত্যা, বলিদান, যৌবনের অপচয়ের কথা? স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতের সন্তান আমরা। আমরা জন্ম থেকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাগরিক। আমরা অনেক ডিগ্রি ধারণ করেছি, তবু যথার্থ স্নাতক হয়নি আজো। মনের মল ত্যাগ করে যে স্নান সেই আশ্চর্য মূল্যবোধের ধারাস্নানের দীক্ষা আমাদের হয়নি। মনে পড়ছে কয়েক দশক আগে স্কুলে পড়ার সময় অত্যন্ত ঋজু স্বভাবের এক শিক্ষয়িত্রী ১৫ই অগাস্টের আগের দিন স্কুলের সব চেয়ে বড় ব্ল্যাক বোর্ডে গোটা গোটা হরফে লিখে দিতেন ,”তোমরা যদি স্বাধীন দেশের নাগরিক বলে নিজেদের মনে করে থাকো, তবেই আগামী কাল বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে উপস্থিত থেকে দিনটির বিশেষত্ব জেনে নিও, শিখে নিও তার মর্যাদা। মুক্তির মন্দির - তলে আত্মবিসর্জনকারী সেই দেশপ্রেমিকদের সততা যেন তোমাদের আজীবন পথ চলার গৌরব ভরা পাথেয় হয়ে থাকে। “ সেই ভয়ানক হুঁশিয়ারি উপেক্ষা করার সাহস কৈশোরে আমাদের ছিলনা। আজ এই গত যৌবনের দিনেও নয় । দিনটিকে ব্রত পালনের মত শুদ্ধতায় ভরিয়ে দিতেন তিনি। 

জানিনা, এখনো এ প্রজন্মের ছাত্র ছাত্রীদের জন্য এমন কত পথ প্রদর্শক আছেন । আমরা তো ভাবনার দৈন্যে ক্রমশ পরাধীন হয়েই চলেছি। আমরা মেরুদন্ড বেঁকিয়ে শুধু নিজের টুকু পেয়ে সন্তুষ্ট , প্রতিবেশির প্রয়োজনে সন্তানকে এগিয়ে দিইনা, তাদের শেখাইনা অন্য মানুষের জন্য একটু ছোট খাটো ত্যাগ  স্বীকার করে নিতে। আমরা তাদের দিতে চাই শুধু আরাম -স্বাচ্ছন্দ্য ঘেরা শৈশব , নিখাদ নিরাপত্তা মোড়া কৈশোর আর সফল কেরিয়ারে বাঁধানো সবচ্ছল যৌবন । তারপর হয়তো কোন এক দুঃসহ মুহূর্তে আবিষ্কার করি সন্তানকে যদিও লাইফ ইন্সিওরেন্স ভাবিনি কখনো, তবু ওরা আরেকটু কম স্বার্থপর হলে হৃদয়ের ভাঁড়ার এতটা শূন্যময় লাগতনা। স্বজনকে ভাল না বাসলে স্বদেশ নামক নিরাবয়ব বস্তুকে ভালবাসা যায় নাকি? এখন আমাদের সবদেশ প্রীতির সৌরভ অবশ্য খুঁজে পাওয়া যায় আন্তর্জাতিক খেলা উৎসবের সময়, স্বদেশের গিরি শৃঙ্গ অভিযানে আর আনন্দে জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে ওঠা অমল কিশোর-কিশোরী কন্ঠে। ভয় হয় স্বদেশ চেতনা হয়তো জেগে উঠবে আগামী কোন এক রুক্ষ নিরাপত্তাহীন দিনের প্রান্তে, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে ভয়ঙ্কর এক যুদ্ধ অথবা অনিবার্য এক বিশ্বযুদ্ধের আগে । ততদিন ১৫ই অগাস্ট বাঁচুক অসঙ্গত ব্যভিচারে।


কৃষ্ণা রায়
কৃষ্ণা রায়
krishna.roy@rediffmail.com

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.