পাশের কাঁচা রাস্তা থেকে পাকা রাস্তায় একটি মেয়ে সাইকেল চালিয়ে আসছে শনশন। মাথায় খোঁপা পরনে শাড়ি। কাছে আসতেই ঘামে চকচক মুখখানি চোখে পড়ল। সেদিনও এমনটাই দেখতাম। প্রায় আমার বয়সী একটু বড় হবে হয়তো, সাইকেল চালিয়ে আসত রোজ বিকেলে। সেই রুবি ছাড়িয়ে আনন্দপুর ছাড়িয়েও ভেতরের গেরাম থেকে , সাইকেলের দুধারে বিরাট দুটো নাইলনের থলে ঝুলত, পেটমোটা। মাসি বলত তাকে সব্বাই। চৌকো মত মুখ তায় কোঁকড়া চুলে খোঁপা বাঁধা। তেল গড়িয়ে পড়ছে এক্কেবারে। প্রথম যখন দেখি তার ভরা জৈবন। তেল গড়িয়ে পড়া রগের পাশে ঠিক মধ্যিখানে গোল সিঁদুরের টিপ। এগরোলের দোকান দিল মাসি। পাড়ার রমরমা বাজারের ঠিক চার মাথার মোড়ে সে দোকান এক বিল্ডিং এর পাঁচিল ঘেঁষে। সরকারী দেওয়াল রে বাবা! সেখেনে নো ট্যাক্স নাথিং। স্রেফ দখল করলেই হল। তা বাজারের সব দোকানী কি অন্য কিছু করে? সে বাজারও তো সরকারী পাঁচিলের ধার ঘেঁষে বসে। দোকানিরা হাত পা মুখ ধোয়, চান করে ছপছপ করে সবই কোয়ার্টারের ফিরি জলের কলে। ফুটপাথের ব্যবসায় একটা সুবিধা ট্যাক্স দিতে হয় না। তাই সরকারী কর্মচারীদের ট্যাক্সের টাকায় গড়া কোয়ার্টারের সুবিধা নিলে মোটমাট দাঁড়ায় সুখের ব্যবসাতেই। দেবার মধ্যে লোকার পাট্টির মাসিক চাঁদা, কখনও বা সাপ্তাহিক। তা সে রেটও ট্যাক্সের তুলনায় ঢের কম। আমাদের মাসির আর আলাদা করে বিবেক কুটকুট করার জায়গাই নেই।
ঠিক বিকেল চারটেয় চলে আসে সে, একতাল ময়দা নিয়ে। থলেয় আরও থাকে সস্তার তেলের টিন, বেলন চাকি ঝুড়ি শোশা পেঁয়াজও আরো টুকিটাকি। মাসি শশাকে শোশাই বলত। ওটাই ঠিক উচ্চারণ। মাসকাবারি ডিমের খুচরো ডিলার ক্রেট করে ডিম দিতে আসে বিকেলে। সেখান থেকে সাজিয়ে পিরামিড বানিয়ে ফেলা ছোট্ট টিনের চালার খুপরি এগরোল কর্নারে। বছরের পর বছর সে বেচে এগরোল। পাশেই গোবিন্দ মুদির দোকান থেকে মাছের চপ কাটলেট রোলের দোকানে টার্ন করে গেল কতবার। মাসির কিন্তু ওই এক এগরোল আর চিকেন রোল। ছোট্ট টুকরো করে মুরগি রেধে আনত একটা মাঝারি বাটি ভর্তি। পাশের বস্তির লোকেরা সারাদিনের একশ দিনের কাজ শেষে মদ খাবার জন্য কখনও চাট কখনও চিকেন রোল নিয়ে যেত। মাসি চুরি করে কানেকশন টেনে আনা তারে লাইট জ্বালিয়ে একমনে রোল গড়ে যেত। নাটকের দলের মহড়া থাকলে মাঝে মাঝে মাসিকে বলতাম রোল নেব। যেদিন নেবার কথা সেদিন ঠিক সাড়ে তিনটেয় চলে আসত মাসি। তারপর একমনে পনেরটি কুড়িটি রোল একমনে বানিয়ে ভরে রাখত ঠোঙায়। আমি স্রেফ টাকা মিটিয়ে সে প্যাকেট নিয়ে দৌড়। জীবনের অঙ্গ হয়ে গেছিল মাসি। আমরাও তার। কাজের ফাঁকে ফাঁকে পাশে দাঁড়ানো ফুচকাওয়ালার সঙ্গে গল্পগুজব। একটু যেন টানই গড়ে উঠেছিল। অবিশ্যি ডাকটি ছিল- ও ফুচকাওলা, এট্টু ইদিকে এসো দিকি নি। দুটি পেঁয়াজ শোশা কেটে দাও না। হাত দুটো জোড়া এদিকে খদ্দের সামলাতে পাচ্ছি নি গো। আশ্চর্য ম্যাজিকে ফুচকাওয়ালাও তার রেগুলার খদ্দের মিটিয়ে একমনে খোসা ছাড়িয়ে যেত পেঁয়াজের পর পেঁয়াজ, বিশাল আকারের সেসব। মাসির বড় স্বপ্ন ছিল ছেলেকে নিয়ে। খেয়ে না খেয়ে তাকে পড়াচ্ছিল। রামকিস্নোর কোন একটা আস্রমে দিইছিল ছেলেকে। মাতাটা তো পোস্কার, সে ছেলেকে সাধুরা নিয়েও নিয়েছিল। পুরো ফিরি নয়। তবু যা লাগত সে মাসি গতরে খেটেই পড়াত। আশ্চর্য স্বামীর বিরুদ্ধে কোন নালিশ নেই তার। এ এক আশ্চর্য মানসিকতা দেখি এই শ্রেণীর মেয়েদের মধ্যে। কারো স্বামী রিকশা টানে কেউ খেতমজুর বা কেউ আর পাঁচটা টুকিটাকি। রোজগারের টাকা কারো যেত মদে কারো জুয়ায় আর সামান্য কিছু জনের চিটফান্ডেও। তবে সোয়ামি তারে ফেলে আর এট্টা বিয়ে বসে নি, সেটাই এদের কাছে সৌভাগ্য ঢের। তাই খেতে না পেলেও নালিশ নেই কোনো। বরং যে ভাবে হোক ছেলেকে মানুষ কত্তে পাল্লে সোয়ামি ইস্তিরিতে আরাম করার স্বপ্ন তার।
- ও মাসি ছেলে কোন ক্লাসে উঠল?
- একগাল হেসে কেলাস এইটে গো।
একদিন হাসি হাসি মুখে বলল দশ পেরিয়ে বারো ক্লাসও শেষ ছেলের।
- যাক এবার তোমার সুসার হবে। ছেলে রোজগার করবে, মা বাপকে দেখবে।
- এখনই কী দরকার বউদি! আরো কিছু পড়ালেখা করুক না। আমি তো আছি। না হয় ওবলা দোকান দেবখন। ছেলেটা মানুষ তো হতে হবে।
তোমার তো শরীর ভেঙে যাবে মাসি। এত খাটো আবার রাতেও তো বাড়ি গিয়ে রেঁধে তবে খাও বারোটার সময়। সাইকেল টানা মাল পত্তর আবার রান্না... মাসির শরীর টিকটিক চলতে থাকে স্বপ্নে বিভোর।
মাঝে বেশ ক’বছর বড় ওলোট পালোট ব্যস্ততায় কেটেছে। মাসির দোকানে একেবারেই যাওয়া নেই। সেদিন ট্যাক্সি থেকে নেমে খুচরো ভাঙাতে দোকানে গেলাম। টাকা মিটিয়ে দেখি মাসির চোখ বসা। একমনে মাথা নিচু করে ময়দা ডলছে। সন্ধ্যে সাতটা ভরা বিক্রির সময়। মাখা ময়দা শেষ, এখন আবার মাখছে।
- ও মাসি এমন শরীর ভেঙ্গেছে কেন গো?
- ওই অম্বলের গ্যাসের ব্যাথা। তাপ্পর দাইড়ে দাইড়ে এখন আর পারি না।
- তোমার পারার দরকার কি? ছেলে মানুষ হয়েছে সাধুদের কাছে। এখন নিশ্চয় লায়েক হয়েছে। ছেলেই তো দেখবে।
মাসি একমনে কাজ করছে। বুঝলাম কিছু বলতে চায় না।
গোবিন্দর কাছ থেকে একদিন খাবার নিতে গিয়ে দেখি ঝাঁপ বন্ধ।
- ও গোবিন্দ মাসির কী খবর? ঝাঁপ বন্ধ কেন গো?
- জানেন না বউদি? মাসি তো গেল শনিবার গেছে।
- মানে? কোথায় গেছে?
- ওপরে বউদি।
- সেকী!!! কী হয়েছিল?
- বুক ব্যাথা। ইস্ট্রোক বউদি। কত করে বলেছি এত কাজ করেন না আর। এইবেলা বিস্রাম নেন। তা কে শোনে কার কথা! বুকে না কি ব্যাথাই হত মাঝে মাঝেই। গ্যাসের ব্যাথা ভেবে কোন টিটমেন করায় নি। শনিবার রাত করে রান্না সেরে খেতে গিয়েই মাটিতে পড়ে গেল। তারপর সবাই চিচকার করে লোক ডেকে হাঁসপাতাল যেতে না যেতেই শেষ। ছেলেটাও অমানুষ। ভাল চাকরি করে বড় কোম্পানিতে। ভাল মাইনে। মা বাপকে দেখে না। বউ নিয়ে রাজারহাটে চলে গেছে। বড় কোম্পানি।
ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলোয় ফুচকাওয়ালা মাথা নাড়িয়ে হেসে হেসে ফুচকা দিচ্ছে খদ্দেরদের। আলু খোসা ছাড়িয়ে তেঁতুল জল মেখে... ওর পেঁয়াজ ছাড়ানোর মুখটা মনে পড়ে গেল দুম করে। আবার চেয়ে দেখলাম মুখটার দিকে। দিব্যি হাসি মজাকে খদ্দের মাতাচ্ছে সে। এত বছরের মাসি-র কথা যেন জানাই নেই তার। পিচ রাস্তায় জল ছপছপ ইতস্ততঃ। বিকেলেই বৃষ্টি হয়ে থেমেছে। জল সরলেও এদিকে ওদিকে এখনও জল। ফুলওয়ালা সন্ধ্যের পশরা সাজালো এই। কাল বেস্পতিবার। আমসরা বেলপাতা নেবে অনেক খদ্দের। বালতিতে ভেজানো গোলাপ পদ্ম সঙ্গে রঙে চোবানো জারবেরাও।
এ বাজারে আজ মাসি নেই।
jayakc2004@yahoo.co.in
সুচিন্তিত মতামত দিন