ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

মুক্তি উৎসব
সে এক সুন্দর স্বাধীনতার গল্প আজ বলব। রাস পূর্ণিমার দিনে ব্রজের গোপিনীরা যে স্বাধীনতার আস্বাদ পেয়ে ছুটেছিলেন কৃষ্ণের কাছে।কৃষ্ণের জন্য রাধিকা বা ব্রজগোপিনীদের যে তীব্র অনুরাগের কথা ভক্তিশাস্ত্রে পাই তাকেই আদ্যোপান্ত জীবনের আদর্শ করার কথা ভাগবতের ছত্রে ছত্রে বর্ণিত। একটি মত অনুসারে ব্রজের গোপিনীরা নাকি পূর্বজন্মে ছিলেন মুনিঋষি। পরের জন্মে বৃন্দাবনে নাকি তাদের অবির্ভাব হয় কৃষ্ণের সঙ্গে লীলা রূপ মায়ায় জীবনযাপন করার জন্য‌ই। কৃষ্ণের সঙ্গে গোপিনীদের এক একজনের এক এক রকমের সম্পর্কের কথা বর্ণিত আছে ভাগবতে। কেউ কৃষ্ণের মধ্যে লক্ষ্য করেছিলেন পতিভাব। কেউ বন্ধুভাব। কেউ সহশিল্পীর মত করে নৃত্য-গীতবাদ্যের অংশীদার ভেবেছিলেন তাঁকে । আধ্যাত্মিক ভক্তিবাদের সর্বোত্কৃষ্ট অনুভূতির কথাই বারেবারে উঠে এসেছে রাসলীলায়। 

এই রাস কি আসলে? স্বর্গ, আধ্যাত্মিক ভাবনাচিন্তা, ভগবান সব সরিয়ে রাখলেও রাসের অর্থ যথেষ্ট তাতপর্যপূর্ণ আমাদের সংসারে। ভগবানের সঙ্গে অপার্থিব লীলাই শুধু নয়। পার্থিব জগতের স্ত্রীপুরুষের বন্ধুভাব বা প্রেমভাবের মিলনরসে অবগাহন। ঠিক যেমন আমাদের গেটটুগেদার বা অন্যান্য বন্ধুদিবসে হয়ে থাকে। আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে এক স্বাধীনতার বাতাবরণে নিজেকে মেলে ধরা। মুক্ত বিহঙ্গের মত একটি বিশেষ দিনযাপন করে নতুন করে বাঁচা। 

এও এক স্বাধীনতা। তা স্কুলের সরস্বতীপুজোই হোক বা কলেজের নবীনবরণ। তাই ভাগবতেও রাসলীলাকে মুক্তিদায়িনী বলা হয়। ভক্তির সঙ্গে মুক্তি রসের এক অপূর্ব মিশ্রণ ঘটে। তাই এ স্বাধীনতা অতুলনীয়। 

রোজকার একঘেয়ে জীবনযাত্রা থেকে বেরিয়ে একটু অন্যরকম ভাবে দিনযাপন। স্বাধীনতার আনন্দে ডুব দিয়ে প্রতিমুহূর্ত কে উপভোগ করা। যিনি রাসলীলা কে ভক্তের সঙ্গে ভগবানের মিলন ভেবে খুশি থাকেন তাঁকে ভাবতে দিন। কারণ ভাগবতেই আছে কৃষ্ণ নিজেই নাকি তাঁর সমস্ত ঐশী শক্তি দিয়ে, হৃদয়ের ঐশ্বর্য দিয়ে, মাধুর্য দিয়ে তাঁর গোপিনী ভক্তদের সঙ্গে রাসলীলায় সামিল হয়েছিলেন। ভাগবত বলছে নিজের একান্ত আপন ভক্তদের সঙ্গে এহেন দিনযাপনের এক বিশেষ অর্থ আছে। 

এ যেন জাগতিক সংসারে কোনও খ্যাতিমান ব্যাক্তির নিজের নিকট বৃত্ত বা ফ্যান ক্লাবের সঙ্গে হৃদয়ের আদানপ্রদান। আর তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে মুক্ত বিহঙ্গের মত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসে ধরা দেওয়া। হ্যাঁ, ঠিক এমনি হয়েছিল গোপিনীদের অবস্থা। এক টুকরো স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছিলেন তাঁরা। 

আর কৃষ্ণ নাকি নিজের ছল চাতুরীর দ্বারা তাঁদের আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। গোপিনী বন্ধুরাও যেন বাঁচলেন মুক্তি পেয়ে। বৃন্দাবনে যমুনার তীরে বাঁশির শব্দে সম্মোহিত করলেন কৃষ্ণ। আনন্দে আত্মহারা হয়ে গোপিনীরা ছুটলেন সেই বাঁশির পেছন পেছন। আর তাঁরাই ছুটলেন যারা কৃষ্ণের নিকট বৃত্তের বন্ধু, স্বজন।

ভাগবত বলল পরমাত্মার সঙ্গে জীবাত্মার মিলন। আমরা না হয় বলি মেয়েদের এক টুকরো স্বাধীনতার কথা। ভাগবত বলল ভগবান এবং ভক্তের অনির্বচনীয় মিলনোত্সব এই রাস। আমরা বলি বন্ধুর ডাকে বন্ধুর আত্মসমপর্ণ। গেটটুগেদার, পার্টি এসব তো মনগড়া শব্দ। কৃষ্ণের নাকি দাহিকাশক্তি ছিলেন এইসব গোপিনীরা। আমরা না হয় বললাম অনুপ্রেরণাদাত্রী কিম্বা সাপোর্টার। আর তা ভাবলেই কিন্তু জাগতিকভাবে চূড়ান্তভাবে সফল এই সর্বজনবিদিত কার্তিকপূর্ণিমার রাস এক মুক্তি উৎসব রূপে। 

রাসপূর্ণিমার দিন আকাশের গায় পূর্ণচন্দ্র তখন সবে বিকশিত। বকুল, যূথী, জাঁতি পুষ্প সবে পাপড়ি মেলছে। কুঞ্জবনে বাঁশির শব্দে সেই পরম এবং চরম মুক্তির আস্বাদ পেলেন ব্রজভূমির গোপিনীরা। কেউ গোরুর দুধ দুইতে ব্যস্ত। তা অসম্পূর্ণ রেখেই তিনি ছুটে গেলেন কৃষ্ণের ডাকে সাড়া দিয়ে। কেউ দুধ জ্বাল দিচ্ছিলেন। ঘর থেকে বেরুনোর তাড়ায় উথলে উঠল তাঁর দুধ। কেউ খিচুড়ি রান্নায় ব্যস্ত ছিলেন। তলা লেগে পুড়ে গেল সেই খিচুড়ি তার চরম অমনযোগে। সব ফেলে রেখে যেতে হবেই তাঁদের । কেউ স্বামীকে দফতরে পাঠানোর জন্য দেখভাল করছিল। যে যেমন অবস্থায় ছিল ঠিক তেমন অবস্থায় সবকিছু ফেলে রেখে ছুটল সেই বাঁশীর পিছুপিছু।

চুলোয় যাক্‌ সংসার! রসাতলে যাক স্বামী-পুত্র! 
"রইতে নারে, বাঁশীতে ডেকেছে যারে' 

নিশির ডাক শুনেছেন তাঁরা । মুক্তি চাই তাঁদের। রোজরোজ সংসারের একঘেয়ে রোজনামচা । রাস তো মোটে একবার।  কোনোও এক গোপিনী মা তাঁর শিশুটিকে পরম স্নেহে দুধ দিচ্ছিলেন। অভুক্ত শিশুর চীৎকার উপেক্ষা করেই তিনিও সেই অবস্থায় ছুটলেন। কেউ চন্দন দিয়ে অঙ্গরাগ করতে ব্যস্ত ছিলেন। একজন পরছিলেন কাজল। কেউ মালা গাঁথছিলেন মন দিয়ে। অর্ধসমাপ্ত রেখেই ছুটে গেলেন দয়িতের টানে। কৃষ্ণের ডাকে বস্ত্র, অলঙ্কার নিখুঁত র‌ইল না। কেউ পরিধেয় বসন পরেছিলেন। উত্তরীয় নিতে ভুলে গেলেন। এক কানের কুন্ডল পরা হয়েছিল। অন্যটি না পরেই দৌড়ে গেলেন। 

"কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো, আকুল করিল মনপ্রাণ' 

চুলোয় গেল তাঁদের আত্মীয় পরিজন সেবা, সংসার ধর্ম, সন্তান পালন। তাঁরা তখন দেহ গেহ সব বিস্মৃত হয়ে কৃষ্ণে আবিষ্ট, তদগত চিত্ত। যেন একটু হবে স্পর্শসুখ। বহু প্রতিক্ষীত একটুকু ছোঁয়া লাগা স্মৃতি নিয়ে ফিরে যাবেন আবার রোজকার গৃহকাজে।

তাঁদের সকলের দেরী হয়ে গেল ঘরে ফিরতে। দীর্ঘায়ত হল সে রাত। নক্ষত্রমন্ডলও রাস দেখতে দেখতে বিস্মৃত হল অস্ত যেতে। 

একেই বুঝি বলে মুক্তি। এ এক অপূর্ব স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছিলেন গোপিনীরা। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে রাস যেন এ যুগের ডেটিং কিম্বা বন্ধুর আমন্ত্রণে বিশেষ গেট টুগেদার । একটা ভীষণভাবে পজিটিভ বার্তা বয়ে আনে আমাদের জগত সংসারে ।যুগে যুগে এমন রিফ্রেশড হওয়ার আয়োজন চলে আসছে।  

indira.mukerjee@gmail.com

Previous Post Next Post