কাব্যগ্রন্থ- আলোছায়া মায়াময়
কবি- সমীরণ চক্রবর্ত্তী
প্রকাশক- বই টার্মিনাস
আলোচক- শৌভিক রায়
লাবণী বর্মনের প্রচ্ছদে বই টার্মিনাস থেকে প্রকাশিত হয়েছে সমীরণ চক্রবর্তীর 'আলোছায়া মায়াময়' কাব্যগ্রন্থটি। মোট চব্বিশটি কবিতা রয়েছে গ্রন্থটিতে। পেপারব্যাক সংস্করণের গ্রন্থটির প্রচ্ছদ, কাগজ ও মুদ্রণ ঝকঝকে।
এই কাব্যগ্রন্থের মাত্র চব্বিশটি থেকে কবি হিসেবে সমীরণ চক্রবর্তীকে নির্দিষ্ট কোন ঘরানায় ফেলা যাচ্ছে না। কেননা কিছু কবিতা নাগরিক জীবনের যন্ত্রণা, গতানুগতিকতা, একঘেয়েমি, স্বার্থপরতা, অর্থহীন প্রতিযোগিতাকে তুলে ধরেছে যেমন, তেমনি কিছু কবিতা লিরিকধর্মী, অন্ত্যমিলে সুন্দর প্রকাশ।
'নাগরিক আকাশে', 'মেট্রোতে মৃত্যুর অপেক্ষায়', 'হাইওয়েতে বিকল', 'তিলোত্তমার আর এক সকাল', 'এঁদোগলির মুখে', 'বৈবাহিক উড্ডয়ন', 'স্বপ্ন সাজাই শহর ছেড়ে', 'বসের গুঁতোয় ম্লান' ইত্যাদি শব্দবন্ধ শহুরে কবিকেই প্রকাশ করছে। সহজ সরল ভাষায় কবি তার দেখাকে প্রকাশ করেছেন। এই সরল প্রকাশই হয়তো কবির সম্পদ। অযথা সাঙ্কেতিকতার মোড়কে এমন কিছু বর্ণনা করেন নি যা সাধারণ পাঠককে স্পর্শ করতে পারে না। তাই সহজবোধ্য হয়ে ওঠে 'পথের কোনো ঘর থাকে না', 'একথালা ভাত', 'স্বপ্নেরা লাশকাটা ঘরে', 'শোষণ যন্ত্র', 'সম্প্রীতি', 'অসহায় তিলোত্তমা' সহ অন্যান্য কবিতাগুলি।
'বেলা শেষের গানে', 'মেঘ পিয়নের চিঠি', 'রঙিন পালক', 'বৃষ্টি-প্রেম', 'ভেজা স্মৃতি' ইত্যাদি কবিতায় অন্ত্যমিলে কবি কখনো নস্টালজিক, কখনো আবেগময় হয়ে ওঠেন-
'সেই যে আমার প্রিয় মানুষগুলি
সকাল সন্ধ্যে থাকত আমায় ঘিরে,
আর আসেনা বিস্মৃতির এই পথে
তারার দেশে কবেই গেছে ফিরে।'
বা
'জাপটে ধরে প্রথম চুমু
এঁকেছিলে ঠোঁটে
আকাশজুড়ে এক লহমায়
হাজার তারা ফোটে।'
এরকম উদাহরণ বেশ কিছু কবিতায় পাওয়া যায়। আদ্যন্ত রোমান্টিকতায় ভরা এই কবিতাগুলি পড়তে ভাল লাগে।
'সুন্দরবনের সুন্দরী' আপাতভাবে সুন্দরবনের বলে মনে হলেও এই কবিতাটিতে কবি বর্তমান সমাজের এমন একটি দিককে তুলে ধরেছেন যা সত্যিই চিন্তার- 'মৈথুন দাগ বড়ই বেয়াড়া/ আর্তনাদের সাদা বিছানায়' এমনই এক উচ্চারণ যা মনে করায় মানুষের ধর্ষকাম চরিত্রকে। 'শান্তিহীন দার্জিলিং' কবিতাটিও বর্তমান সময়ের একটি দলিল। 'কথায় কথায় রাত কেটে যায়' কবিতাটিতে কথোপকথনের আঙ্গিক ব্যবহার করা হয়েছে। মন্দ নয় কবিতাটি।
যে কবিতার নামে কাব্যগ্রন্থের নামকরণ সেই 'আলোছায়া মায়াময়' একদম শুরুতে। ছয়টি পর্বে বিভক্ত দীর্ঘ কবিতাটিতে উত্তর আধুনিক কবিতার বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আমার মনে হয়েছে এই কবিতাটিতে কবি তার দীর্ঘ যাত্রাকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। আমরাও তো কখনো 'নেমে যাই পুকুর ঘাটে'। নাব্যতা হারাই জীবনের। 'বিষাদের বৃষ্টি' মাখি জীবনপথে। তবু 'সেভাবে কাছে আসনি' জীবনকে 'হাতটা বাড়িয়ে দিই একটু একটু করে'। আর 'লিপিবদ্ধ করি ভালোবাসা আর দূরত্বের সমানুপাতিক সূত্রখানি।' জীবন যদি ভালোবাসা হয় তবে জীবনের নানা না-পাওয়াই তো দূরত্ব।
এই না-পাওয়ার যন্ত্রণা আর জীবন থেকেই তো উৎসারিত হয় কবিতা!
সুচিন্তিত মতামত দিন