আব্দুল মাতিন ওয়াসিম

আধুনিক আরবি উপন্যাস ও   নাজিব মাহফুয
আরবি। বিশ্বের একটি কালজয়ী ভাষা। বর্তমানে, প্রায় আটাশটি দেশের সরকারী ভাষা। বিশ্বে দশ মিলিয়নেরও অধিক লোক এ ভাষায় কথা বলে। সম্মিলিত জাতীপুঞ্জের কার্যালয়ে ব্যবহৃত ছয়টি ভাষার একটি। অন্যান্য সাহিত্যের ন্যায় আরবিও বিপুল সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময়। কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, কাব্যনাট্য, পথনাটিকা, রম্যরচনা সবই রয়েছে। আরবিতে উপন্যাসকে রেওয়ায়াহ্‌ আর ঔপন্যাসিককে রেওয়ায়ী বলা হয় ।

মধ্যযুগে যখন বিশ্বের প্রায় সকল ভাষায় কবিতার দোর্দণ্ড প্রতাপ বিরাজমান, ঠিক তখনই স্রোতের বিপরীতে গিয়ে আরবরাই বিশ্বকে উপহার দিয়েছিল আল্‌ফো লায়লা ও লায়লা (একসহস্র রজনী ও একরজনী), যা ‘আরব্য রজনী’ নামে অধিক পরিচিত। এই সাহিত্য সম্পদটি বিশ্বের বহু ভাষায় অনূদিত; এমনকি রূপোলী পর্দায় অভিনীতও। অনেকে মনে করেন, এরই বৈচিত্র্যময় সিন্দ্‌বাদ, আশ্চর্য প্রদীপের মালিক আলাদীন অথবা আলীবাবা ও চল্লিশ চোর–এর বিস্মৃত গল্প-পথ ধরেই জন্ম নেয় আধুনিক ছোটগল্প ও উপন্যাস। তবে উভয়ের উপজীব্য ভিন্ন। আরব্য উপন্যাস হল দৈত্য-পরী ও রাজাবাদশাহদের বর্ণনা। আর আধুনিক ছোটগল্প ও উপন্যাস হল মানুষ ও সমাজের প্রতিচ্ছবি। তবে মধ্যযুগীয় এই গল্পগুলিতেও কেন্দ্রীয় চরিত্রের ব্যাপ্তি ও গল্প উপস্থাপনের সাবলীল শৈলী পরিলক্ষিত হয়।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, আধুনিক অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাসের জনক ইব্‌নু তুফাইল একজন আরব। তিনি তাঁর ‘ফিলোসোফাস আটোডিডাক্টাস’ (আরবি নাম- হাই ইব্‌নু ইয়াক্‌যান) উপন্যাসের নায়ককে এক নির্জন মরুভূমিতে একাকী ছেড়ে দিয়েছিলেন। তাঁর অনুকরণ করেই পরবর্তী সময়ে ড্যানিয়েল ডিফো (Daniel Defoe)-র ‘রবিন্সোন ক্রুসো’ (Robinson Crusoe) ও রুডইয়ার্ড কিপ্লিং (Joseph Rudyard Kipling)-র বিখ্যাত ‘দ্য জাঙ্গল বুক’ (The Jungle Book) রচিত হয়। তবে, আর্থ-সামাজিক উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে আরবরা চিরঋণী থাকবে ফরাসী সাহিত্যের নিকট। কেননা, আরবি ভাষায় আধুনিক ভাবধারার উপন্যাস রচনা শুরু হয়েছিল মিসরীয়দের ফরাসীদের সংস্পর্শে আসার ফলে। প্রথম দিকের প্রয়াসগুলি ছিল অনুবাদের হাত ধরে। পরবর্তীতে তা নিজস্বতা লাভ করে এবং উত্তরোত্তর তার শ্রী বৃদ্ধি ঘটতে থাকে; আর নাজিব মাহফুযের হাত ধরে নোবেলে সমৃদ্ধ হয়। 

তিনি অর্থাৎ নাজিব মাহফুয, ১৯৮৮-তে তাঁর সুলাসিয়্যাতুল-ক্বাহেরাহ’ (কায়রো ট্রিলজি) উপন্যাসের জন্য নোবেল পেলে বিশ্বসাহিত্য প্রথমবারের মতো গুরুত্ব সহকারে আধুনিক আরবি উপন্যাসের উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। নাজিব মাহফুযের পূর্বে, আরবি ঔপন্যাসিকগণ ও তাঁদের রচনাসমূহ বর্ণনাযোগ্য সাফল্য ও বিশ্বসমাদর লাভ করতে সক্ষম হয়নি। এর প্রধান কারণ কী ছিল? এ বিষয়ে কিছু সাহিত্যবোদ্ধা মনে করেন, সেই কথাশিল্পীরা আরব্য উপন্যাসের প্রচলিত ধারা থেকে নিজেদেরকে পৃথক করে স্বতন্ত্ররূপে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হননি । তবে আন্‌-নাহ্‌দ্বাহ আল্‌-‘আরাবিয়্যাহ (নিউ লিট্যারারি মুভমেন্ট/আরবি রেনেসাঁ)-র নামে কিছুজন পাশ্চাত্য দর্শন ও ধ্যান-ধারণাকে আরবিতে আত্মস্থ করতে আরম্ভ করেন। তাই বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশকই আধুনিক আরবি উপন্যাসের সূচনাকাল বলে অধিকাংশের ধারণা। এ সময়ে রচিত উপন্যাসগুলির উপাদান ও উপজীব্য ছিল– ঔপনিবেশিক শোষণ, জাতীয়তাবাদ, নারীবাদ, নির্বাসন, অভ্যুত্থান ও যুদ্ধ। আর উক্ত বিষয়সমূহকে কেন্দ্র করে আধুনিক আরবি উপন্যাস রচনায় মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন অনেকে। যেমন— 

ইলিয়াস খুরি (জন্ম ১৯৪৮, লেবানন)। নাজিব মাহফুজের পর আধুনিক আরবি উপন্যাসের জগতের বহুল চর্চিত একটি নাম। তাঁর উপন্যাসগুলি অনূদিত হয়েছে বিশ্বের বহু ভাষায়। ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত আল্‌-জাবাল আস্‌-সাগীর (দ্য লিটল মাউন্টেন) তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস। এ উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে লেবাননের বিভীষিকাময় গৃহযুদ্ধের কথা। এছাড়া রিহ্‌লাতু গান্দী আস্‌-সাগীর (দ্য জার্নি অফ্‌ লিটল গান্ধী, ১৯৮৯-এ প্রকাশিত) তাঁর আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস। এই উপন্যাসে গান্ধীর মতো অহিংস চিন্তার নেতারা গ্রাম থেকে অভিবাসী হয়েছেন বৈরুত শহরে। তবে বাবুশ্‌ শাম্‌স (গেট অফ্‌ দ্য সান, ১৯৯৮-এ প্রকাশিত) ইলিয়াস খুরির সবচেয়ে জনপ্রিয় উপন্যাস। এই উপন্যাসের নায়ক এক ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু। যে ১৯৪৮ সালের নাক্ব্‌বা যুদ্ধের পর থেকে লেবাননে বসবাস করছে। পরবর্তীতে মিসরীয় পরিচালক ইউস্‌রি নাস্‌রুল্লাহ্‌ উপন্যাসটির ওপর ছবি তৈরি করে বিপুল জনপ্রিয়তা এনে দেন ইলিয়াস খুরিকে। খুরির অন্যান্য উপন্যাসেও উঠে এসেছে মানুষের আচরণের রক্ষণশীলতা ও রাজনীতির কথা। উপন্যাস-বর্ণনায় তিনি প্রমিত আরবিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। 

এধরণের উপন্যাস রচনায় মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন ফিলিস্তিনের খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী ঔপন্যাসিক এমিল হাবিবি (১৯২২ – ১৯৯৬)-ও। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস আল্‌-ওয়াক্বায়েউল্‌ গার্‌বিয়্যাতু ফি ইখ্‌তিফায়ি সায়ীদ আবিন্‌ নাহাস আল্‌-মুতাশায়িল (দি সিক্রেট লাইফ অব সাঈদ : দি পেসঅবটিমিস্ট, ১৯৭৪-এ প্রকাশিত)। এই উপন্যাসটি ইসরায়েলের অভ্যন্তরে বাস করা আরবিভাষী সায়িদের জীবনচিত্র। এই উপন্যাসে ইসরায়েলের অভ্যন্তরে বাস করা আরবিভাষীদের সঙ্গে ইহুদিদের সহাবস্থানের কথা বর্ণীত হয়েছে। এই উপন্যাসটির জন্যই এমিল হাবিবি ১৯৯০-এ পিএলও-র আল্‌-ক্বুদ্‌স এবং ১৯৯২-এ ইসরায়েলের দ্য প্রাইজ অফ্‌ ইসরায়েল ফর লিটারেচার পান। 

আব্দুর্‌ রাহ্‌মান মুনিফ (১৯৩৩–২০০৪)-ও আরবি উপন্যাসের জগতে একটি উল্লেখযোগ্য নাম। তিনি লিখেছেন ১৫টি উপন্যাস। তাঁর মুদুনুল্‌ মিল্‌হি (সিটিজ অফ্‌ সল্ট, ১৯৮৭-এ প্রকাশিত) উৎকৃষ্ট আরবি উপন্যাসগুলির একটি। আরবের বেদুইন সংস্কৃতির সঙ্গে আধুনিক তেলসমৃদ্ধ সংস্কৃতির সংঘাত চিত্রিত হয়েছে এ উপন্যাসে। এডওয়ার্ড সাঈদের মতে, এটি আরবি সাহিত্যে সিরিয়াস ধারার একমাত্র আধুনিক উপন্যাস, যেখানে তেলকে ঘিরে বিদেশীদের লোলুপ দৃষ্টি এবং তেল পাওয়ার পর আরববিশ্বের বদলে যাওয়ার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। 

সুন্‌আল্লাহ্‌ ইবরাহিম (জন্ম- ১৯৩৭) একজন বামপন্থী ঔপন্যাসিক। তাঁর বামপন্থী আদর্শ তাঁর উপন্যাসেও ব্যক্ত হয়েছে। তিনি ১২টি উপন্যাস লিখেছেন। উপন্যাসের ঘটনা তিনি ভিন্ন রকমে ব্যক্ত করেন। বিশেষ করে প্রথম পুরুষে; অনেকটা সংবাদপত্রের রিপোর্টের আদলে। সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক দিক থেকে শক্তিধর দেশগুলো কীভাবে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির অর্থনীতিকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছে, একথাই ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর উপন্যাসগুলির মাধ্যমে। তাঁর লেখা শারাফ্‌ (অনার, ১৯৯৭-এ প্রকাশিত) সেরা একশটি আরবি উপন্যাসের তালিকায় তৃতীয়। 

তাইয়েব সালিহ (১৯২৯ - ২০০৯) সুদানি ঔপন্যাসিক। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস মাওসামুল্‌ হিজ্‌রাতি ইলাশ্‌ শিমাল (সিজন অফ্‌ মাইগ্রেশন টু দি নর্থ, ১৯৬৬-এ প্রকাশিত)। ২০০৬-এ আরবি সাহিত্য আকাদেমি এই উপন্যাসকে 'বিশ শতকের সেরা আরবি উপন্যাস' স্বীকৃতি দিয়েছে। ঔপনিবেশিক শোষণ তাঁর উপন্যাসের অন্যতম বিষয়। খার্তুমের এক উপজাতির লাওয়ারিশ শিশুর কলোনিতে বেড়ে ওঠার ইতিহাস, কাম এবং প্রতিশোধ স্পৃহার গল্প এটি। 

এছাড়া আলজেরিয়ান ঔপন্যাসিক আহ্‌লাম মুস্‌তাগানমি (জন্ম ১৯৫৩)-র বিখ্যাত উপন্যাস যাকেরাতুল্‌ জাসাদি (মেমোরি অফ্‌ দ্য ফ্ল্যাশ, ১৯৯৩-এ প্রকাশিত)-এ ঔপনিবেশিক শোষণ এবং আলজেরিয়ার মুক্তিসংগ্রাম বর্ণিত হয়েছে। বিখ্যাত সিরিয়ান ঔপন্যাসিক হানা মিনাহ্‌ (জন্ম ১৯২৪)-র উপন্যাসগুলি সামাজিক বাস্তবতা ও শ্রেণীসংগ্রামকে কেন্দ্র করে রচিত। আধুনিক আরবের অন্যতম ঔপন্যাসিক তাওফিক আল্‌-হাকীম (১৮৯৮ - ১৯৮৭)-র উস্‌ফুরুম মিনাশ্‌ শার্‌ক্ব (এ স্প্যারো ফ্রম দি ইস্ট, ১৯৩৮-এ প্রকাশিত) এধরণের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপন্যাস। এঁদের পাশাপাশি আধুনিক আরবি উপন্যাস লিখেছেন বা লিখে চলেছেন এমন ঔপন্যাসিকদের মধ্যে মি যিয়াদাহ্‌ (১৮৮৬-১৯৪১), যাকারিয়া তামার (জন্ম ১৯৩১) ও আব্বাস মাহ্‌মুদ আল্‌-আক্কাদ (১৮৮৯-১৯৬৪) অন্যতম।

তবে আধুনিক আরবি উপন্যাসের এই যে বিশ্বব্যাপী সমাদর তার অনেকটাই এসেছে নাজিব মাহফুযের হাত ধরে। তিনি এবং তাওফিক্ আল্‌-হাকিমই সর্বপ্রথম আধুনিক আরবি উপন্যাসে 'অস্তিত্ববাদ'কে নিয়ে এসেছিলেন। তাঁর জন্ম ১১ ডিসেম্বর ১৯১১-তে, মিশরের কায়রো মহানগরীর প্রাচীন এলাকা জামালিয়্যার একটি ধার্মিক পরিবারে। অংক ও বিজ্ঞান নিয়ে লেখাপড়া শুরু হলেও স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন দর্শন নিয়ে ১৯৩৪ সালে। লেখাপড়া শেষ করে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। বহু গুরুত্বপূর্ণ উচ্চতর পদ অলঙ্কৃত করে ১৯৭১ সালে অবসর নেন। বিয়ে করেন ১৯৫৪ সালে ৪৩ বছর বয়সে। তিনি সারা জীবনে বিদেশ ভ্রমণ করেছেন মাত্র তিন বার, তা-ও চিকিৎসার জন্য। লেখালেখি শুরু করেন ছাত্রজীবনে তিনের দশকের মাঝামাঝিতে। প্রথম উপন্যাস আবাসুল্‌ আক্বদার (নিয়তির নিষ্ফলতা) প্রকাশিত হয় ১৯৩৯ সালে। তাঁর উপন্যাসের সংখ্যা ৩৫, ছোটগল্প ২২৩টি এবং ছোটগল্পের সংকলন ১৯টি। এছাড়া রয়েছে একটি আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ, ৭টি নাটক, ২৬টি চিত্রনাট্য এবং অসংখ্য প্রবন্ধ-নিবন্ধ। তাঁর উপন্যাস এবং গল্প নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে ৩০টিরও অধিক। এছাড়া ১৯৭১ সাল থেকে মৃত্যুর কিছুদিন আগে পর্যন্ত নিয়মিত সাপ্তাহিক কলাম লিখেছেন, যা একই সঙ্গে আরবিতে আল্‌-আহরাম-এ এবং ইংরেজিতে আল্‌-আহরাম উইকলিতে প্রকাশিত হয়েছে। পরবর্তীতে এসব কলাম নিয়ে একটি বই বের হয় ২০০১ সালে। দেশে-বিদেশে সমান জনপ্রিয় ও সম্মানের অধিকারী তিনি। অসামান্য সাহিত্যকৃতির জন্য তাঁকে বহু দেশী-বিদেশী পুরস্কারে পুরস্কৃত করা হয়। এমনকি ১৯৮৮ সালে তাঁকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মৌলবাদীদের হাত থেকে তিনিও নিস্তার পাননি। ১৯৯৪ সালে, বিরাশি বছর বয়সে, কায়রো শহরে নিজ বাড়ির কাছেই আক্রন্ত হন তিনি। পিছন থেকে এসে তাঁর গলার কাছে ছুরি বসায় আততায়ীরা । প্রাণে বেঁচে গেলেও ঐ আক্রমণের ফলে পাকাপাকিভাবে জখম হয় তাঁর ডান হাতের স্নায়ু। একটানা কয়েক মিনিটের বেশি আর লিখতে পারেতেন না। তিনি আক্রান্ত হয়েছিলেন ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত উপন্যাস আওলাদু হার্‌রাতেনা (আমাদের বসতির ছেলেরা, ইংরাজি অনুবাদের নাম- চিলড্রেন অফ্‌ জেবেলাবী)-এর জন্য। অবশেষে ২০০৬ সালের ৩০ আগস্ট কায়রোতে এই মহান সাহিত্যিকের মৃত্যু হয়। 

তাঁর একটি কালজয়ী সৃষ্টি হল 'সুলাসিয়্যাতুল-ক্বাহেরাহ্‌’ (কায়রো ট্রিলজি/ কায়রোর তিনকাহন, ১৯৫৬-৫৭তে প্রকাশিত)। এই উপন্যাসটিকে তিনি তিন ভাগে বিভক্ত করে লিখেছেন। তিনটি ভাগের যথাক্রমে নামকরণ করেছেন- 'বায়নাল্‌-ক্বাস্‌রাইন’ (প্যালেস অফ্‌ ওয়াক/ দুই প্রাসাদের মাঝে), 'ক্বাস্‌রুশ্‌-শাওক্ব’ (প্যালেস অফ্‌ ডিজায়ার/বাসনার প্রাসাদ) এবং 'আস্‌-সুক্কারিয়্যাহ’ (সুগার স্ট্রিট/সুগার সরণি) এই অসাধারণ সৃষ্টির জন্যই তিনি ১৯৮৮ সালে, সাতাত্তর বছর বয়সে, সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার পান। আরব দুনিয়ায় তাঁর জনপ্রিয়তা অনেক আগে থেকেই ছিল, তবে নোবেল পাওয়ার পর তাঁর পরিচিতি আরও সুদূরপ্রসারী হল । স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, প্রথম যে দিন তাঁর নাম শুনি, তা ছিল ঘৃণা মিশ্রিত কলেবরে। তবে ধীরে ধীরে অন্যান্যদের ন্যায় আমিও তাঁর মুগ্ধ পাঠকে পরিণত হই। বর্তমানে আমি তাঁর উপন্যাসে সামাজিক ইস্যুগুলি নিয়ে গবেষণার কাজও করছি। 

উল্লেখ্য যে, এই উপন্যাসত্রয়ী তাঁকে বালজাক, ডিকেন্স, টলস্টয় এবং গলসওয়ার্থির সমপর্যায়ে উপনীত করেছে। কায়রো শহরের একটি বৃহৎবৃত্ত ও স্বচ্ছ্বল পরিবারকে ঘিরে তাঁর এই অনন্য সৃজন। রাস্তার নাম আন্‌-নাহ্‌সিন, সেই ব্যস্ত পথের ধারে বহুদিনের পুরনো এক দোকান। মালিক আহ্‌মাদ আব্দ আল্-জাওয়াদ। ছিলেন স্বশিক্ষিত। জীবনের অভিঘাতে স্কুলের গন্ডি পার করতে পারেননি। তবে ক্রেতা থেকে বন্ধুবান্ধব সকলে তাঁর বাক্ চাতুর্যে মুগ্ধ ছিল। পেশায় ব্যবসায়ী ছিলেন, তবে তাঁর সামাজিক পরিচিতির গন্ডি কায়রোর উচ্চপদস্থ আমলা, সফল আইনজীবী ও সম্পন্ন ভূস্বামী পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ছিল। নিজ বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী ও ক্রেতাদের নিকট তিনি সদাপ্রসন্ন ও কৌতুকপ্রবণ এক ব্যক্তিত্ব। কিন্তু শহরের অন্য প্রান্তে, বায়নাল্-ক্বাস্‌রাইন্ সরণিতে নিজ গৃহে স্ত্রী-পুত্র-কণ্যাদের নিকট ভিন্ন রকমের; সেখানে তিনি উদাসীন স্বামী, নিষ্ঠুর পিতা, দায়িত্বশীল, কিন্তু কঠোর গৃহকর্তা। 

বড় বড় ঘর, কড়িবর্গার ছাদ, পুরনো আমলের ভারী আসবাবে ঠাসা একটি বাড়ীতে আব্দ আল্ জা্ওয়াদ ও তাঁর পরিবারের বসবাস। সে বাড়ীটিতে একতলা-দোতলা, প্রশস্ত উঠোন, উঠোনের ধারে কুয়োতলাও রয়েছে — তাছাড়া আরও আছে একটি ঝুল বারান্দা, চতুর্দিক ঢাকা, কাঠের জাফরির উপর বিচিত্র নক্সায় ঘেরা। সেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে, জানালার খড়খড়ি এক চিলতে ফাঁক করে, বাড়ির মহিলারা দেখে নিচের রাস্তায় প্রবাহমান জনস্রোত, আরও দেখে কায়রো শহরে ফুটন্ত সকাল, মন্থর দুপুর, কোলাহল-মুখর রাত্রির আনাগোনা। তাঁরা দেখে শুধুই দেখে সেই মোহময় বাইরের জগৎকে, যে জগতের প্রত্যক্ষ অংশীদার বা সাক্ষী হওয়ার কোন অধিকার তাঁদের ছিল না। তাই আয়েশা, খাদিজার গোপন দীর্ঘ নিঃশ্বাসে ভারী হয়ে ছিল সেই পর্দানশীন ঝুল বারান্দাটি। 

দুই মেয়ে আয়েষা ও খাদিজা, স্ত্রী আমিনা, তিন ছেলে ইয়াসিন, ফাহমি আর কামাল – এই হল আহমাদ আব্দ আল-জাওয়াদের পরিবার। এদের ছোটবড় সুখ-দুঃখগুলি নিয়ে পরতে পরতে গড়ে ওঠেছে কায়রো ট্রিলজি। পরিবারের জ্যেষ্ঠ পুত্র ইয়াসিন আব্দ আল্ জা্ওয়াদের প্রথম পক্ষের সন্তান; তবুও সে সৎমা আমিনার আপ্লুত স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়নি। পরিবারের আর চারটি ছেলেমেয়ের মতই, তার উপরেও বর্ষিত হয় আমিনার সস্নেহ সেবাযত্ন। যৌবনে পদার্পণ করে সে পাশের বাড়ির সুন্দরী, ষোড়শী মরিয়মের সাথে প্রণয়ে আবদ্ধ হয়, কিন্তু তাঁর রাশভারি পিতা কিছুতেই মরিয়মের সঙ্গে তাঁর বিয়ে দিতে রাজি হননি। তার পর থেকেই ইয়াসিনের জীবন হয়ে দাঁড়ায় অলীক সুখের হাতছানিতে বিভ্রান্ত, বিমূর্ত এক ট্র্যাজেডি । প্রেমহীন বিবাহে আবদ্ধ হতে হয় তাঁকে। কামতাড়িত হয়ে অসংযত যৌনতার কাছে বার বার আত্মসমর্পণ করে নিজের সাথে লড়াইয়ে হেরে যায় সে। একের পর এক শারিরীক সম্পর্ক তাকে যোগায় শুধুই সাময়িক উত্তেজনার খোরাক। প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর নানা ওঠাপড়ার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয় তাঁর অতৃপ্ত জীবন। 

অন্যদিকে প্রৌঢ়ত্ব পার করে বার্ধক্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায় আয়েষা ও খাদিজা দু-বোনই । প্রথম যৌবনে, খাদিজা ছিল গৃহকর্মনিপুনা; কিন্তু লাবণ্যহীণা এবং মুখরা এক যুবতী। পাড়াপড়শির ধারণা, তার বরাতে ভাল বর জুটবে না। ঐ রকম কৃষ্ণবর্ণ রূপহীনাকে কোন ভালো ছেলে বিয়ে করবে? কিন্তু যৌবনোত্তর জীবনে স্বামী ও দুই ছেলে নিয়ে খাদিজারই সংসার ছিল ভরাট ও স্বচ্ছ্বল। অপরদিকে রূপসী আয়েষার রূপ বয়সের সাথে সাথেই বিদায় নিয়েছে। স্বামী ও সন্তানের মৃত্যুর পর তার জীবন জুড়ে এখন নিরন্ধ্র তমসা। সে ফিরে এসেছে মা-বাবার কাছে। পারিবারিক ট্র্যাজেডির স্মৃতি তাকে তাড়া করে মুহুর্মুহু। এক অদ্ভুত অতৃপ্তি সাঙ্গ করে সে ঘুরে বেড়ায় এঘর থেকে সে-ঘর। মাঝে মাঝে নিজের মনেই বিড়বিড় করতে থাকে। গভীর রাত্রে আয়েষার ঘর থেকে ডুকরে ওঠা কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় বৃদ্ধা আমিনার। 

আহমাদ আব্দ আল-জাওয়াদের ছোট ছেলে কামাল। তিনটি উপন্যাসজুড়ে তাঁর উপস্থিতি বেশ উজ্জ্বল। খুব সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, শৈশব ও কৈশোর অতিক্রম করে তার বড় হয়ে ওঠার কথা। তাঁর পরিণত মানুষ হয়ে ওঠার চিত্রায়ন বেশ মনোগ্রাহী। তাঁর জীবনে পূর্ণতা-অপূর্ণতার দোলাচল, অকৃতার্থ প্রেমের অভিঘাত অত্যন্ত গভীর মমতায় তুলে ধরা হয়েছে। আর এরই দরুন ফুটে উঠেছে এক পরিব্যপ্ত মানবিকতা বোধ, যা কায়রো ট্রিলজি-কে কালজয়ী সাহিত্যের মর্যাদা দিয়েছে । অনেকের নিকট, এই উপন্যাস-ত্রয়ীর স্থান বিশ্বসাহিত্যের সেরা সম্পদগুলির সাথে এক আসনে ।

অনেক সমালোচকই মনে করেন, নাজিব মাহফুয কামালকে নিজের আদলে গড়েছিলেন। বাস্তবে এই উপন্যাস ত্রয়ী আত্মজীবনীমূলক। এক্ষেত্রে সমালোচকদের যুক্তি এই যে, কায়রোর যে জামালিয়া অঞ্চলে ঔপন্যাসিকের জন্ম সেখানেই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় পরিবারটির আদি বাসস্থান। তাছাড়া কায়রো ট্রিলজির কাহিনীর শুরু ১৯১৯ সালের কোন একটি সময় থেকে। অনেকে অবশ্য বলেন কাহিনীর সূত্রপাত ১৯১১ সাল থেকে, মাহফুযের জন্মের বছর।

নাজিব মাহফুযের আরও একটি জনপ্রিয় উপন্যাস হল সার্‌সারাতুন ফাওক্বান্‌ নীল (চিট্‌চ্যাট অন্‌ দ্য নাইল, ১৯৬৬)। এই উপন্যাসে উঠে এসেছে যৌনতার কথা। লেখক সমাজতন্ত্রের জয়গানও গেয়েছেন এই উপন্যাসে । উপন্যাসের নায়ক আনিস যাকি সহধর্মীনির প্রতারণা ও জামাল আব্দুল্‌ নাসেরের অপশাসনের অভিশপ্ত বাস্তবতা থেকে পালাতে আশ্রয় নেয় হাশিশের। সঙ্গে পায় রাজাবের মত কিছু যুবকদের নীল নদ লাগোয়া এক পানশালায়। এভাবেই উপন্যাসটিতে ফুটে উঠেছে সেনাশাসক জামাল আব্দুল্‌ নাসেরের কুশাসনের কথা; যে কারণেই নাসেরের পর ক্ষমতায় এসে আনোয়ার সাদাত উপন্যাসটি নিষিদ্ধ করে রেখেছিলেন বহু দিন। 

নাজিব মাহফুজের আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস আওলাদু হার্‌রাতেনা (চিলড্রেন অব জেবেলাবী, ১৯৫৯)। বিশ্বাস এবং কার্যকারণের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, সেটা এই উপন্যাসে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক। জেবেলাবীর সন্তান, উত্তরাধিকার ও শত্রুদের মধ্যকার যে সম্পর্ক ও ঘটনাপ্রবাহ, তা-ই তুলে ধরা হয়েছে উপন্যাসটিতে। জেবেলাবী একই সঙ্গে ধনাঢ্য ও ক্ষমতাশালী একজন ব্যক্তি, যিনি অসৎ উপায়ে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেন। নিজের লোকজন ও পাঁচ পুত্রসন্তানের ওপর তিনি সব সময় সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে ও কর্তৃত্ব করতে পছন্দ করেন। পাঁচ ছেলের মধ্যে সম্পদ দেখভালের দায়িত্ব দেন সবচেয়ে ছোট ছেলে আদহামকে। সম্পত্তির জন্য পরবর্তী সময়ে বড় ভাই ও বউয়ের দ্বারা প্রতারিত হন আদহাম। তবে সবকিছুর ওপরই জেবেলাবীর কর্তৃত্ব বজায় থাকে। তবে ধর্মের অবমাননার অভিযোগে ব্লাসফেমি আইনে লেবানন ব্যতীত পুরো আরব বিশ্বে উপন্যাসটি নিষিদ্ধ হয়েছিল। এ উপন্যাসে জেবেলাবীর সন্তানরা একই সঙ্গে বিশ্বাস রেখেছে ইহুদি, খ্রিস্টান এবং ইসলাম ধর্মে। 

নাজিব মাহফুযের অন্যান্য উপন্যাসগুলিতেও ঘুরে-ফিরে এসেছে মূলত কায়রোর নাগরিক জীবনের নানা দ্বন্দ্ব। কায়রোর আধুনিকায়নে সমাজব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে নানান ধরণের সংঘাত; এছাড়া পশ্চিমা মূল্যবোধের আগমনে আরব মূল্যবোধের বিলুপ্তির যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল সে-সব কথাই তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর একাধিক উপন্যাসে। 

আব্দুল মাতিন ওয়াসিম
matin.cu@gmail.com


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.