বিগত কয়েক বছর কিঞ্চিৎ লেখালিখির সুবাদে বিভিন্ন সাহিত্যসভা বা সাহিত্যকেন্দ্রিক বিনোদনের আসরে উপস্থিত থাকার সুযোগ ঘটেছে। সভাগুলোয় বিশিষ্ট ব্যক্তিরা আগে ভাগে দীর্ঘ বক্তব্য রেখে বা নিজেদের রচনা পাঠ করে প্রস্থান করেন। অবিশিষ্টদের কাছ থেকে তাঁদের কিছু শোনা বা জানার থাকে না। সন্ধ্যের অনুষ্ঠানে দূরাগত ও মহিলাদেরও একটু ‘আগে ছেড়ে দেওয়া’ হয়। ঘোষক/ঘোষিকা, আয়োজক পক্ষের গুটিকয় মানুষ, সভাপতি, মাইকম্যান এবং দিনের শেষে উদ্বৃত্ত জনাকয় কবি সাহিত্যিক ছাড়া অনুষ্ঠানের শেষ পর্ব বিশেষ কেউ দেখে না। খাওয়া দাওয়ার আয়োজন থাকলে অবশ্য অন্য কথা। যাইহোক, অনুষ্ঠানের শুরুতে থাকে উদ্বোধনী সঙ্গীত, মধ্যে মধ্যে গান, শ্রুতি নাটক, আলোচনা ইত্যাদি। আর শেষের কথা তো শুরুতেই বললাম। ছোটবেলায় স্কুলে শিখেছিলাম, যেকোনও অনুষ্ঠানের শেষে জাতীয় সঙ্গীত (আসলে জাতীয় মন্ত্র) গাইতে হয় ‘সাবধান’এ দাঁড়িয়ে। সেই শিক্ষা বিদ্বজ্জন সভায় পরিত্যাজ্য। আমারও প্রথম দিকে মাথাতে আসেনি, সাহিত্য সভার সাথে দেশাত্মবোধের কোনও যোগ থাকতে পারে।
কিন্তু ভাবনাটা গুলিয়ে গেল ডায়মন্ড হারবারে এক গোষ্ঠীর আয়োজনে ২০১২-তে ইলিশ উৎসবে যোগ দিতে গিয়ে। অনুষ্ঠান শুরু হল “আমার সোনার বাঙলা/আমি তোমায় ভালোবাসি” উদ্বোধনী সঙ্গীত দিয়ে। গায়িকার সযত্ন পরিবেশনে বেশ আবিষ্ট হয়েই শুনছিলাম সবাই। হঠাৎ বাংলাদেশ থেকে আগত দুই মহিলা কবি উঠে এসে গান থামিয়ে সমবেতদের হুকুম করল, যেহেতু এটা বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত, সকলকে উঠে দাঁড়িয়ে শুনতে হবে। দু-একজন একটু গাঁইগুঁই করলেও আদেশ পালিত হল। একজন বেয়াড়া মানুষ কেবল ‘আমার কাছে এটা রবীন্দ্রসঙ্গীত, যা বসে শুনলেই বেশি উপভোগ করতে পারব’ বলে বসে থেকে গানটি শেষ হবার পর উঠে দাঁড়িয়ে করতালি দেয়। স্বদেশের জাতীয় সঙ্গীতকে ওভাবে মাঝপথে থামিয়ে দেওয়া কতটা সঙ্গত জানিনা; তবে গানের তাল আবেদন ভঙ্গ করেও ঐ দুই মহিলা পররাষ্ট্রে আমন্ত্রিত হয়ে এসে যে সাহসিকতা, আত্মমর্যাদা ও দেশপ্রেমের পরিচয় রাখল, তার প্রশংসা না করে পারি না। সেই সাথে মনটা আত্মগ্লানিতে ভরে যায় আমাদের দেশের বঙ্গবাসীদের আপন দেশের মাটিতে দাঁড়িয়েও প্রতিবাদ প্রতিক্রিয়াহীন অমেরুদণ্ডী সমর্পণের জন্য।
এমনিতেই ওদেশ থেকে আসা সাহিত্যিক পদবাচ্যই নয়(হুকুম কর্ত্রীদের একজন) এমন ব্যক্তিকেও পদক, স্মারক, পুষ্পস্তবক, মানপত্র, উত্তরীয় ইত্যাদি প্রদানের মাধ্যমে পর্যাপ্ত সম্মান জানানোর পরও তার প্রতিক্রিয়া, বক্তৃতা, রচনাপাঠের জন্য যথেচ্ছ সময় ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল যা হয়েই থাকে। এদেশের নন-সেলিব্রিটি কবিদের করতালি দিয়ে বঙ্গালী উপভাষার মিশ্রণে কথিত বক্তৃতাকে স্বাগত জানানো ছাড়া বিশেষ কিছু করার ছিল না। ভিআইপি স্লটের ফাঁকেই সামান্য সময় প্রার্থনা করে নিজের সংক্ষিপ্ত কবিতা পরিবেশনের পর আমি বলেছিলাম, ‘আমন্ত্রিত কবি বন্ধুদের দেশাত্মবোধের আন্তরিক প্রশংসা করে আমি প্রস্তাব রাখছি অনুষ্ঠান শেষ যেন হয় “জনগণমন” দিয়ে এবং যথাযোগ্য সম্মান সহকারে। জয় হিন্দ।’ উত্তরে আয়োজক তথা ঘোষকের বিদ্রূপ ভেসে আসে, ‘অনুষ্ঠান রাত বারোটা পর্যন্ত চলবে। জনগণমন নিয়ে চিন্তা নেই।’ বলা বাহুল্য সকলেরই ট্রেন ধরে সেদিন ফেরার তাড়া ছিল, রাত বারোটার অনেক আগেই অনুষ্ঠানের সপাপ্তি যখন ঘটে তখন জনগণ গাওয়ার মতো এপারের জনগণ বিশেষ কেউ হাজির ছিল না। তবে সমবেত এদেশীয় কবি সাহিত্যিক সতীর্থরা অনেকেই আমায় করতালি সহ অভিবাদন জানিয়ে বুঝিয়ে দেন, আমার বক্তব্য ছিল তাদেরও মনের কথা।
উক্ত আয়োজকের বক্তব্য ‘জনগণমন’তে সিন্ধুর কথা উল্লেখ আছে, যা এখন পাকিস্তানে। সুতরাং গানটির জাতীয় সঙ্গীত হওয়ার যোগ্যতা নেই। প্রসঙ্গত আমাদের ‘জাতীয় মন্ত্র’ই জাতীয় সঙ্গীত বলে পরিচিত। জাতীয় সঙ্গীত ‘বন্দে মাতরম’ সম্প্রদায় বিশেষের আপত্তির ফলে জাতীয় মন্ত্র বা স্তোস্ত্র ‘জনগণমন’-র অবতারণা করতে হয়েছিল। প্রস্তর যুগের কিছু প্রাগৈতিহাসিক নিদর্শন ছাড়া ভারতের ইতিহাস শুরুই হয়েছে যে সিন্ধু সভ্যতার আলোচনা দিয়ে, যে নদটির কিছু অংশ এখনও ভারতের(কাশ্মীর?) বুকেও বইছে, যে সিন্ধু থেকেই হিন্দু, হিন্দুস্তান, ইন্দাস, ইন্ডিয়া শব্দগুলির উৎপত্তি; তার নাম ভারতের মানচিত্র থেকে মুছে ফেলতে হবে? ১৯৪৭-এ অগণিত মানুষের রক্তপিচ্ছিল পথ বেয়ে ভারতের অঙ্গহানি ঘটিয়ে সেই প্রদেশটির বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়াটাই ভারতের জাতীয় পরিচয়ের নিয়ামক হবে? আমাদের বেদমন্ত্রে যে সাতটি পবিত্র নদ-নদীর বা সপ্তসিন্ধুর উল্লেখ আছে তারা হল গঙ্গা, যমুনা, সিন্ধু, সরস্বতী, গোদাবরী, নর্মদা ও কাবেরী। অথচ সম্প্রদায় নির্বিশেষে এইরকম বিদেশী রাষ্ট্রতোষী প্রবণতা পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যাগুরু বাঙালী সাহিত্যিককূলের, যার প্রতিফলন বারবার বিভিন্ন সাহিত্য সভায় দেখা যায়, বিশেষত যেখানে বঙ্গভাষী প্রতিবেশী রাষ্ট্রের কেউ আমন্ত্রিত থাকেন।
১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ভারতীয় সেনা হস্তক্ষেপ ছাড়া সফল হতেই পারত না। ২৫ মার্চ থেকে ১৫ই ডিসেম্বরের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধকালে ৩০ লক্ষের বেশি মানুষ, মুলত হিন্দু বাঙালি মারা গিয়েছিল তার মধ্যে। যদিও উইকিপেডিয়া ও অন্যান্য লিখিত সূত্র কম করে দেখালেও বাংলাদেশের কিছু গবেষক যেমন মোহম্মদ নাজমুল হক-এর মতে অন্তত ১০ লক্ষ নারী ধর্ষিত হয়েছিল পাকিস্তানি পাঞ্জাবি সেনার হাতে। শুধু ধর্ষণ নয় যে পৈশাচিক পদ্ধতিতে তাদের নির্যাতন ও হত্যা করা হোত, তার নজির বোধহয় পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। সেই সময় পশ্চিমবঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটিও গড়ে ওঠে, সরকারিভাবেই এদেশের অনেক সৈনিক পাকিস্তানী সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে। ১৯৫২-তে ভাষা আন্দোলনে শহিদের তালিকায় শুধু মুসলমান বাঙালির নাম দেখা গেলেও পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু বাঙালিদের আত্মদান ছিল না ভাবাটা কষ্টকল্পিত, বরং অনেক বেশি ও ব্যাপক হারে অত্যাচারের স্বীকার হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়। ২৫ মার্চ মুজিবর রহমানকে গ্রেপ্তার ও গণহত্যা দিয়ে যে পাকিস্তানি সেনা আগ্রাসন শুরু হয়েছিল, মুক্তিযোদ্ধারা টানা নয় মাস লড়েও তাদের প্রতিহত করতে পারেনি, বরং ক্রমশ হীনবল হয়ে পড়ছিল। ভারতীয় সেনারা ৩রা ডিসেম্বর বাধ্য হয়ে ময়দানে নামারফ ১৩ দিনের মধ্যে ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণ করে। ভারত ও ভুটান ৬ই ডিসেম্বর প্রথম সার্বভৌম দেশ হিসাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। ভুটানের তারবার্তা আগে পৌঁছলেও অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকেই প্রথম স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির সম্প্রচার, যার কুটনৈতিক গুরুত্ব অনেক বেশি। তাছাড়া বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভই করেছে ভারতের সৌজন্যে। সুতরাং স্বাধীন বাংলাদেশকে নিয়ে ভারতীয়দের গর্ববোধ, বিশেষ করে ভারতীয় বাঙালিদের বাড়তি আবেগ থাকাটা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু এই আবেগের আতিশয্যে আমরা প্রায়শ নিজেদের রাষ্ট্রীয় পরিচয়টি বিস্মৃত হই যেন।
বাংলাদেশে কবিতা উৎসবে যোগ দিতে গিয়ে দেখেছি তারা নিজেদের জাতীয়তাবাদী কার্যক্রম অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে এবং সমস্ত বিদেশী আমন্ত্রিতদেরকেও সেই অনুষ্ঠানে শামিল করে। আবার পশ্চিবঙ্গের এক একটি অনুষ্ঠানেও বাংলাদেশের দেশাত্মবোধক সঙ্গীত, একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে আবেগমন্দ্রিত কবিতা, বঙ্গবন্ধুর নামে জয়ধ্বণি, তাঁকে নিয়ে লেখা গান কবিতার স্রোতে সত্যিই ভুলতে বসি, কলকাতার বাংলা অ্যাকাডেমি ভারতবর্ষে, আমরা ভারতীয়। মনে হয় বাংলাদেশটাই বুঝি আমাদের দেশ।
বস্তুত বাংলাদেশ তো আমাদেরই (ছিল)। এমন মনে হওয়াতেও হয়ত গলদ থাকে না যদি পররাষ্ট্রস্তুতির পাশাপাশি সেই রাষ্ট্র গঠনে আমাদের রাষ্ট্রের অবদানটাও স্মরণ করা হয়। ১৯৭১-এর রক্তক্ষয়ী দিনগুলোতে আমাদের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে সরাসরি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন বলেই ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি তথা রাষ্ট্রটির জন্ম। অথচ এমনও দেখেছি, ভারতের মাটিতে বাঙালি বিদ্বজ্জন সভায় মুজিবরের নামে জয়ধ্বণি ওঠে, মুজিব তথা বাংলাদেশের ত্রাণকর্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নামটি উচ্চারিতও হয় না। প্রায় চল্লিশ বছর পর দেরিতে হলেও বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কিন্তু ভারতের প্রাক্তন ও প্রয়াত প্রধানমন্ত্রীকে মরণোত্তর ‘বঙ্গবন্ধু’ সম্মান জানিয়েছেন। যদিও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ভারতের পক্ষে অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছিল কারণ শুধু কোটি খানেক শরণার্থীর প্রবেশ নয়, ভারতের পশ্চিম সীমান্তে পাকিস্তান বিমান হামলাও শুরু করে দেয়। কিন্তু বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোটা আমাদের পক্ষে আত্মঘাতীই বলা যায়, কারণ বিপুল লোক ও সম্পদ ক্ষয়ের বিনিময়ে আমরা পেলাম একটির বদলে দুটি শত্রু প্রতিবেশী – একটি ক্ষুব্ধ (পাকিস্তান) ও একটি ‘কৃতজ্ঞ’(বাংলাদেশ)!
পাকিস্তানী মুসলমানদের অমানুষিক অত্যাচারে, উর্দু নিয়ে জবরদস্তিতে শুধু হিন্দু নয়, লক্ষ লক্ষ বাঙালি মুসলমানও ভারতমুখী হয়েছিল আশ্রয়প্রার্থী হিসাবে। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, উত্তর-পূর্বাংশ তথা সমগ্র ভারতবর্ষই বাড়তি জনসংখ্যার চাপে, জমি জবরদখলের জঙ্গীপনায় জেরবার। তবু আমরা আশ্রয় দিয়েছি; কিছুদিনের জন্য নয়, পাকাপাকি। এর খানিকটা যদি স্থানীয় ভোটব্যাংক তৈরীর অভিসন্ধিতে হয়েও থাকে, মূলত ছিল কিন্তু মানবতার খাতিরে। শ্রীমতী গান্ধী বারংবার রাষ্ট্রসংঘকে আবেদন জানান বিহিতের জন্য। বোঝান, ভারত যুদ্ধ চায় না, কিন্তু তার নাড়িছেঁড়া পেটের শত্রু (পাকিস্তান) ভারতের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিচ্ছে কারণ কোটি কোটি শরণার্থীকে জায়গা দিতে গিয়ে ভারতীয় জমি ও অর্থনীতি দুটোই সংকটাপন্ন হয়ে উঠছে। নিপীড়িত পূর্ব পাকিস্তানী বাঙালী যারা এক সময় ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হতেই চেয়েছিল, তাদের বাঁচাতে গিয়ে ভারত তাদের মুক্তিযুদ্ধে শামিল হয় নিজের সম্পদ ও জনসম্পদ ক্ষয় করে। সীমান্তে প্রহরা কড়া করে শরণার্থীর স্রোতে বাঁধ দেয়নি। হয়ত দিলেই ভারতের পক্ষে মঙ্গল ছিল। বাংলাদেশের অত্যাচারিত জনতার প্রতি সহানুভূতি না দেখালে আকিস্তান ভারত আক্রমণ করত না। জনসংখ্যার এই বিস্ফোরণ (যার জন্য শরণার্থী প্রবেশ, অনুপ্রবেশ ছাড়াও আগত সম্প্রদায় বিশেষের জন্ম নিয়ন্ত্রণে অনীহাও দায়ী), অর্থনৈতিক সংকট এবং একটি শত্রুভাবাপন্ন রাষ্ট্রের সাথে চির শত্রুতা এগুলোয় জর্জরিত হতে হোত না। এই শত্রুতার ফলে এখনও আসমুদ্র হিমাচলে নাশকতা, লোকক্ষয়, জনজীবনে ভীতি। আর একটি যুদ্ধ এড়াতে ভারত একের পর এক নিরীহ জনতা থেকে সেনা জওয়ান বলি দিয়ে যাচ্ছে। আর বিস্ময়করভাবে সন্ত্রাস দমনে আন্তর্জাতিক মহলকে কিছুটা পাশে পেলেও দেশবাসীর কাছ থেকে সমর্থন আদায়টাই উত্তোরত্তর কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
‘রাজাকার’দের মুণ্ডপাত আদতে একটি নারা, স্লোগান। তারাও বাংলাদেশী যারা দেশের সার্বভৌমত্বের বদলে পাকিস্তান ও উর্দুভাষীদের অধীনতা চেয়েছিল। কিন্তু তারা যে দেশটির হয়ে চরবৃত্তি করে, স্বদেশবাসীর ওপর অত্যাচার চালায়, সেই দেশটির প্রতি স্বাধীন বাংলাদেশের মনোভাব কী? ধর্মীয় কারণে ও ভারত-বিরোধিতার প্রশ্নে তারা কিন্তু আসলে মিত্র। Islamic fraternity-র এতটাই শক্তি যা বন্দুকের নল ঘুরিয়ে দিতে পারে। তাই শুধু ভারতের কাশ্মীর বা পশ্চিম প্রান্ত থেকে নয়, নাশকতাকামী জঙ্গী অনুপ্রবেশ ঘটে ভারতবর্ষের পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব সীমান্ত দিয়েও, বাংলাদেশের মাটিতেও গড়ে ওঠে পাকিস্তানী জঙ্গীদের শক্ত ঘাঁটি, ভারতীয় পাকিস্তানপন্থী উগ্রবাদী আবদুল করিম টুন্ডারা বাংলাদেশেও পেয়ে যায় নিরাপদ আশ্রয়। ‘জামাত’-এর তৎপরতা ছাড়াও বাংলাদেশে হিন্দু নিধন ও হিন্দু মেয়েদের সম্মানহানি করে নৃশংস উপায়ে হত্যা এখন নিয়মিত ঘটনা। বর্ধমানে অসাবধানে বোমা বিস্ফোরণে বাংলাদেশি জঙ্গিদের আস্তানা ধরা পড়ার যেমন বাংলাদেশ উল্টে ভারতে জঙ্গীরা আশ্রয় পাচ্ছে বলে অভিযোগ করায় কেন্দ্র সরকার একটু নড়েচড়ে বসার করে দিয়েছিল, তেমনি ‘গুলশন’ কাণ্ডে সাদা চামড়ার পশ্চিমিদের রুষ্ট করে নেহাত বিপাকে পড়ে হাসিনা সরকার সন্ত্রাস দমনে ভারতের পাশে থাকার ভান করছে। এই দ্বিচারিতার মধ্যে ভারতীয় বাঙালিদের নির্লজ্জ বিদেশী তোষণ ও খোসামোদি আমায় শুধু লজ্জিত নয়, আতঙ্কিতও করে।
ওদেশের আতিথেয়তা নাকি অতুলনীয়। আমিও একবার ওখানে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তার প্রশংসাই করব মুক্তকণ্ঠে। তবে অতিথিপরায়ণার চাইতে আশ্রয়দাত্রী সাহায্যদাত্রীর ভূমিকা বড় বৈ ছোট মনে করব না। কতজনকে আর কত কারণে আশ্রয় দেবে এই পোড়া দেশ? ১৯৪৭-এ কাটা ঘায়ে নুনের ছিটের মতো কোটি কোটি ক্ষত-বিক্ষত উদ্বাস্তুর পুনর্বাসন, ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় পুনরায় শরণার্থী পালন, চীন তীব্বত আক্রমণ করে অধিকার করে নিলে বৌদ্ধ শরণার্থীর স্রোত সামলানো, বাংলাদেশ থেকে খেদানো চাকমা শরণার্থীর ভিড়কে আশ্রয়দান, প্রতিদিন হিসাবহীন অনুপ্রবেশকারীদের পাকাপাকি রেশন কার্ড, ভোটার কার্ড, সম্পত্তিক্রয়ের অধিকার প্রদান__!! বাংলাদেশের বিরাঙ্গনা শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন নিজের দেশের স্বার্থে প্রয়োজনে অমানবিক হতে হয়। সে দেশে মুসলিম মৌলবাদীদের আক্রমণে পর্যুদস্ত হয় চট্টোগ্রাম, কক্সবাজার অঞ্চলের অগণিত রাখাইন বৌদ্ধ; যার প্রতিক্রিয়ায় আজ সামরিক শাসনাধীন ব্রহ্মদেশ থেকে উৎখাত হচ্ছে রহিঙ্গা বা মুসলিম রাখাইনরা। বাংলাদেশ সরকারেরই নৈতিক দায়িত্ব ছিল রহিঙ্গাদের পুনর্বাসন দেওয়া বা অন্তত শরণার্থী শিবির খুলে দেওয়া। তা কিন্তু সে করেনি; সোজা তাড়িয়ে দিয়েছে ভারতীয় সীমান্তে। মানবতায় দরাজ আমরা আবার খুলে দিয়েছি শরণার্থী শিবির, হোম এবং বাধ্য হয়ে হয়ত বা কারাগারও -আমাদেরই সম্পদের বিনিময়ে, নিজেদেরই অসুবিধায় ফেলে। আমরাও কি পারতাম না যে দেশ নিয়ে এত আবেগাপ্লুত হই, তাদের অনুসরণে নারী, শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সহ ঐসব উদ্বাস্তুদের আশ্রয়দানের দায়িত্ব এড়াতে?
না, পারি না বলেই আমরা ভারতীয় যে দেশের মোট জাতীয় উৎপাদন উন্নত পশ্চিমী দেশগুলোকে টেক্কা দিলেও মুদ্রাস্ফীতি বিপদসীমার ঊর্ধ্বে, মুদ্রার মূল্য আন্তর্জতিক বাজারে ক্রমশ পতনশীল; পারি না বলেই ভারতীয় বাঙালি যারা হীন প্রাদেশিকতার শিকার হয়ে আসামের বরাক উপত্যকায় কাছাড়-শিলচর সহ সর্বত্র রক্তাত্ত হয়েও ১৯৬১র ১৯শে মের শহিদদের ভুলে ২১শে ফেব্রুয়ারি নিয়ে অধিক উন্মাদনা দেখায়। হয়ত আসামের বঙ্গাল খেদা নিয়ে খুঁচাখুঁচি সংকীর্ণ প্রাদেশিক আবেগের পরিচায়ক ও জাতীয় একতার পরিপন্থী হবে বলেই এই বিস্মরণ, যেখানে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে সম্মান জানানোয় কোনও ঝুঁকি নেই। হয়ত আমাদের ভাষাগত পরিচয় ও রাষ্ট্রীয় পরিচয় এক নয় বলেই এই দিশাহীন অবস্থান; এফএম রেডিওগুলোতে উদ্ভট মিশ্রভাষার ভাষার আধিপত্য। হয়ত ভাষার কারণেই আমরা পর রাষ্ট্রের সঙ্গে এতটা একাত্মবোধ করি। এমনকি তথাকথিত সাম্যবাদী দলও নিছক রাজনৈতিক মতাদর্শগত কারণে এমন শত্রু প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে সমর্থন করে গেছে ও যাচ্ছে যে আমাদের দেশের সার্বভৌমত্বকে বার বার আক্রমণ করেছে। বর্তমানে এই দেশটি নিজের কূটনৈতিক দোসর হিসাবে বেছে নিয়েছে জন্মসূত্রে ভারতের শত্রু এক সন্ত্রাসকামী দেশকে। চীন পাকিস্তানকে ভারত বিরোধিতায় সমর্থন করছে বলেই কি এক দলের চোখে বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গী আফজল গুরু, বুরহানরা স্বাধীনতা সংগ্রামী শহিদ প্রতিভাত হচ্ছে আর দেশের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সেনা ও সরকারকে ঘাতক মনে হচ্ছে? যে বাঙালি জাতি বৃটিশ শাসনকালে ভারতের জাতীয়তাবোধ গঠনে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল আজ সেই জাতিই জাতীয়তার শত্রু হয়ে উঠছে। ধর্মীয় কুসংস্কার দূরীকরণে যে বাঙালি অবিভক্ত দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছিল আজ তারাই তালিবানদের সমর্থক হয়ে উঠছে! এমন কিম্ভূত জাতীয়তাবোধ যে দেশের নাগরিকদের, সে দেশ বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ নিশ্চই হতে পারে, কিন্তু ঐক্যে হতদরিদ্র থেকে যায়।
সূত্র:
1.[4]https://en.wikipedia.org/wiki/Rape_During_Bangladesh_Liberation_War#cite_note-FOOTNOTEMukherjee201268-4
2.[6]https://en.wikipedia.org/wiki/Rape_During_Bangladesh_Liberation_War#cite_note-FOOTNOTED’Coasta201108-6
3. Against our Will: Man, Women and Rape, pg 83
4. নাজমুল হকের ফেসবুক পোস্ট
5. বিভিন্ন সাহিত্যসভায় উপস্থিতি যার স্থান কাল নোট করে রাখা নেই
6. স্বাধীনতা উত্তর ভারতের ইতিহাস।
7. এই সময়ের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম
sriparna405@gmail.com
সুচিন্তিত মতামত দিন