২২শে মে আমরা মিজোরামের মামিত জেলার লেঙপুই এয়ার পোর্টে। দুপুর ১টায় নেতাজী সুভাষ টার্মিনাস থেকে এয়ার ইন্ডিয়ার AI-711 ফ্লাইটে করে এই মাত্র এসে পৌঁছেছি মিজোরামের একমাত্র ডোমেস্টিক এয়ারপোর্টে। রাজধানী আইজল থেকে ৩২ কিমি দূরে। ছিমছাম গোছানো ছোট্ট এই এয়ারপোর্টে প্রতিদিন কলকাতা থেকে Air India ও গৌহাটি থেকে Jet Airways এর বিমান যাতায়াত করে। সপ্তাহে তিনদিন ইম্ফল থেকেও বিমান আসে লেঙপুই-এ। ১৯৯৫ সালে এই এয়ারপোর্ট নিমার্নের কাজ শুরু হয়। শেষ হয় ১৯৯৮ সালে। ১৯৯৮সালের আগে আইজলের নিকটতম এয়ারপোর্ট ছিল শিলচর। ২০৫ কিমি দূরে।
এয়ারপোর্টে নেমেই ILP করিয়ে নিতে হয় ভারতের অন্য রাজ্য থেকে আগত ট্যুরিস্টদের। ILP র জন্য দরকার হয় ২কপি পাসপোর্ট সাইজ ছবি সহ যে কোন সচিত্র পরিচয় পত্রের অরিজিনাল ও জেরক্স।
হাতে টাকা নেই। এয়ারপোর্টে থেকে বেরিয়ে এসে সোজা এ-টি-এম এ ঢুকলাম টাকা তুলতে। অনেকক্ষন ঘরঘর শব্দ হলো। টাকাটা ডেবিট ও হলো কিন্তু হাতে পেলাম না কিছুই। দশ হাজার টাকা! নেহাত কম নয়। বিপত্তি দিয়েই শুরু হলো মিজোরাম ভ্রমণ......
চিত্রব্যাঘ্র পদনখচিহ্নরেখাশ্রেণী/ রেখে গেছে ওই পথপঙ্ক-'পরে,/ দিয়ে গেছে পদে পদে গুহার সন্ধান।
লুসাই ভাষায় “মিজো” শব্দের অর্থ স্থানীয় অধিবাসী আর “রাম” শব্দের অর্থ ভূখন্ড। অর্থাৎ মিজোরাম হলো মিজোদের ভূখন্ড। ২১০৮৭ বর্গকিমি স্থান জুড়ে মিজোরাম ভারতের ২৫তম অঙ্গরাজ্য। এই রাজ্যের জনঘনত্ব খুবই কম। ৫২জন প্রতি বর্গকিমি। এই রাজ্যের পূর্বদিকে মায়ানমার আর পশ্চিমদিকে বাংলাদেশের সীমারেখা। এই রাজ্যের মোট আয়তনের ৯১% অরণ্যে আবৃত। মিজো উপকথা অনুসারে অতীতের কোন এক সময় মিজো পূর্বপুরুষেরা বার্মা-চীন সীমান্তের সিংলুং বা চিংলিংসাং-এ বাস করত। যা ছিল চীনের ইয়ালুং নদীর তীরে ছিনলুং সভ্যতা। যে সভ্যতার উত্তরাধিকার মিজোরা পেয়েছে তাদের পূর্বপূরুষদের কাছ থেকে। যদিও এই ইতিহাসের ভিত্তি কেউ জানে না। জানে শুধু সবুজ পাহাড় জঙ্গল আর সীমান্তের নিস্তব্ধ একলা নদী।
উত্তরে অসম ও মনিপুর, পূর্বে ও দক্ষিণ-পূর্বে ব্রহ্মদেশ। পশ্চিমে বাংলাদেশ আর ত্রিপুরা রাজ্য। নীলচে পাহাড়, সবুজ উপত্যকা আর মেঘ দিয়ে ঢাকা মিজোরাম রাজ্য। আগে তিনটি জেলা – আইজল, লুঙলেই আর চিম্পটুইপুই নিয়েই গঠিত ছিল। কিন্তু বর্তমানে তিনটি জেলা ভেঙে আটটি জেলা গঠিত হয়েছে। --- আইজল, চাম্ফাই, কোলাশিব, নঙটলাই, লুঙলেই, মামিত, সাইহা ও সারছিপ
মিজো ভাষায় ডিল কথার অর্থ হ্রদ। মিজোরামের দক্ষিণের জেলা সাইহা থেকে আরো দক্ষিণে ১০০কিমি দূরে পালাক ডিল মিজোরামের সবচেয়ে বড় হ্রদ। এছাড়া ট্যাম ডিল, রি ডিল ও রেঙডিল আরো তিনটি উল্লেখযোগ্য হ্রদ। যদিও রি ডিল মায়ানমারে অবস্থিত। তথাপি পাসপোর্ট ছাড়াই শুধুমাত্র সচিত্র পরিচয় পত্র ও ILP দেখিয়ে মায়ানমারের রি ডিল হ্রদ দেখে দিনে দিনেই ফিরে আসা যায়।
পুক কথার অর্থ গুহা। মিজোরাম মানেই গুহার রাজ্য। ভূমিকম্প, প্লেট টেকটনিক মুভমেন্ট ও চুনাপাথরের দ্রবণ কার্যের ফলে মিজোরামে সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য গুহা। প্রচীন সভ্যতায় এই গুহাগুলিতেই গড়ে উঠেছিল মিজো পরিবার । ধীরে ধীরে পরিবার থেকে গোষ্ঠী। পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তের মত এই গুহাগুলি নিয়ে মিজোরামে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য উপকথা। এই গুহাগুলি মিজোরামের অতীত কালের সাক্ষী। এই গুহাগুলিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল মিজোরামের প্রচীন সভ্যতা। বেশ কিছু গুহায় পাওয়া গেছে মানুষের হাড়গোড়। যা থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে এই সভ্যতার মানুষেরা মৃতদেহ গুলিকে গুহার ভেতরেই সমাধি দিত।
থেনজল থেকে সোজা পূর্ব দিকে ২৫কিমি গেলেই মারপারা । আসতে হবে বুয়ারপুই হয়ে। মারপারা জনবসতির কাছে পুকজিং’ই হলো মিজোরামের সবচেয়ে বড় গুহা। এই গুহা নিয়ে মিজোদের মধ্যে একটি গল্পগাথা প্রচলিত আছে। মুয়ালজাভাটা, যিনি কিনা একজন প্রচীন শক্তিশালী মিজো মানুষ। তিনিই নাকি এই গুহা বানান। মিজো ভাষায় “মুয়ালজাভাটা” শব্দের অর্থ হলো সেই ব্যক্তি, যিনি কিনা একদিনে জঙ্গলের একশটি রেঞ্জ কেটে সাফ করতে পারেন। আসলে জঙ্গল কেটে সাফ করেই মিজোদের চাষবাস। এই অঞ্চলে সর্বত্র ঝুম চাষ প্রচলিত। গুহাটি লম্বায় ২৫ মিটার।
লুংলেই জেলার মামিতের কাছে আরো একটি গুহা আছে। মিলু পুক শহর থেকে এই গুহাটি ১৩০কিমি দূরে। এই গুহাটিতেও মানুষের মৃতদেহ ও কঙ্কাল পাওয়া গেছে। মিলু পুককে কঙ্কাল গুহা বলেও ডাকা হয়। এই গুহায় লাউ উপজাতিদের মাথার খুলি সংরক্ষিত আছে।
মিজোরামের পূর্বদিকে ভারত ও মায়ানমার সীমান্ত লাগোয়া ভাফাই ও ফারখওয়ান জনবসতির মাঝে রয়েছে কুংগারহি পুক। জনশ্রুতি অনুসারে অনেক অনেক দিন আগে মিজোরামের এই অঞ্চলে একটি সুন্দরী মেয়ে বাস করত। তার নাম ছিল কুংগারহি। একদিন অশুভ আত্মারা কুংগারহির রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে অপহরণ করে এই গুহাতে বন্দী বানিয়ে রাখে। কুংগারহি যখন তার স্বামীর সাথে পান্থিরা গ্রামে যাচ্ছিলো, তখনি ঘটে এই অপহরণ। স্বামী যত দিন না তাকে উদ্ধার করে, কুংগারহি বন্দী ছিল এই গুহায়। ভাফাইয়ের ৮কিমি পূর্বদিকে লামসিয়াল পুক। আইজল জেলার দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্ত লাগোয়া ফরখওয়ান গ্রামে লামসিয়াল পুকটি অবস্থিত। প্রাচীন কালে এই বসতিতে যে সব যোদ্ধারা বাস করত তাদের করোটি রাখা আছে এই গুহায়। এই অঞ্চলে গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে বিবাদ লেগেই থাকত প্রাচীন কালে। তখন যোদ্ধারা সংগ্রাম করে বাঁচাত নিজেদের অঞ্চল। ফার পুক বা পাইন গুহাও এই অঞ্চলের আরো একটি উল্লেখযোগ্য গুহা।
ঝটিকা সফর লেঙপুই
ছোট্ট এয়ারপোর্ট লেঙপুই। সারা দিনে দুটো বিমান নামা ওঠা করে। বিমান থেকে নামার পর বেশ গরম চারপাশ। সারদিনের রোদে তেতে আছে লেঙপুই উপত্যকা। লাউঞ্জ থেকে মালপত্র বুঝে নিয়ে, ILP করিয়ে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। চারপাশে অল্টো আর সুমোর ভীড়। হাঁকডাক আর তৎপরতায় ব্যস্ত ড্রাইভারেরা। আমাদের কিছুক্ষন অপেক্ষা করতে হবে এখানেই। কারণ গৌহাটি থেকে অন্য ফ্লাইটে আসছে আমার মামাতো ভাই সোনা। সবাই মিলে একসাথেই আইজল যাবো। কিছুক্ষন অপেক্ষা করতে হবে বলে, বাইরের ক্যাফেটেরিয়াতে ঢুকলাম। একটু চা, সিগারেট খাওয়া যাক! লেঙপুই এয়ারপোর্টের বাইরে এম সি রেস্টুরেন্ট কাম হোটেল। খিদের পেটে খেয়ে নিলাম এক প্লেট লাংফাং।
লেঙপুই থেকে আইজল পৌঁছাতে শেষ পর্যন্ত অনেক রাতই হয়ে গেলো। ভারতের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত বলে মিজোরামে সন্ধ্যে নামে তাড়াতাড়ি। আমাদের অল্টো গাড়ির ড্রাইভার রামা গালনামট্রুনা আমাদের নিয়ে চললো ট্যুরিস্ট লজের দিকে। ট্যুরিস্ট লজ পুরো প্যাকড। তাই জায়গা না পেয়ে আজ অগত্যা রাত কাটাতে হচ্ছে ঝার্কটের সিটি হোটেলে। একটা ফালতু হোটেল। তবুও ম্যানেজার সিলেটি বাঙালী এই যা রক্ষে। এয়ারপোর্টের স্থানীয় মিজো ডিশটার স্বাদ বেশ ভালই ছিল। এখন গাড়ির ঝাঁকিতে ঘুম ঘুম পাচ্ছে। সারাদিনে কম ধকল যায় নি।
আইজল
২৩শে মে ২০১৮। সক্কাল সক্কাল পাহাড়ি মুরগির ডাক ঘুম ভাঙিয়ে দিল। সকাল ৫টা ৩০মিঃ। টয়লেটে যাবার জন্য বাইরে বেরিয়েই দেখি দরজার সমনে লম্বা লাইন। আমাদের এই ফ্লোরে একটাই টয়লেট। দোতালার এই ফ্লোরে ৭/৮টা ঘর। ভাড়াও যথেষ্ট। আয়েস করে কম খরচে যারা প্রকৃতির আনন্দ নিতে চান তারা ভুলেও মিজোরামে আসবেন না। করণ জায়গাটা ভুলভাল...।
ঝার্কটের মুল রাস্তাতেই সুমকুমা পয়েন্ট। সুমকুমা পয়েন্ট থেকে ডানদিকে সিড়ির ধাপ। সোজা উঠে গেছে উপরের বাবুতালাঙ বস্তিতে। গতকাল রাতে এই গলিতেই ছিলাম। সিটি হোটেলে। সিটি হোটেল ছাড়াও হোটেল কসমো, হোটেল টি কে এই গলিতেই। হোটেলের ম্যানেজার শিলচরের বাঙালী। আইজলের অর্থনীতিতে সিলেটিরা একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায়। ঝার্কটের মূল রাস্তাতেই জসুয়া ট্যুর এন্ড ট্রাভেলস। সাত সকালে ওখানে গিয়েও ট্রান্সপোর্টের খোঁজ নিলাম। কিন্তু কোন লাভ হল না আখেরে। আসলে ট্যুরিজিম বিষয়টাই গড়ে ওঠে নি মিজোরামে। স্থানীয় এক মিজো ডাওয়ারে চাং আর থিম্পুই খেয়ে চললাম বড় বাজারের দিকে। ও হ্যাঁ বলে রাখা ভালো, থিম্পুই মানে চা আর চাং মানে পুরি। আর হোটেলকে স্থানীয় মিজো ভাষায় বলে ডাওয়ার।
বাজারে কত কিছু স্থানীয় শাকশব্জি......। ফলমূল, বাঁশের আগা, মাশরুম, আদা, গুগলি, শুটকি মাছ, কাঁকড়া, মশলাপাতি, জামাকাপড়, হরেকমাল। অলিগলি ঘুরতে ঘুরতে কিনেই ফেললাম থেইতে। লাল রঙয়ের এই ফল গুলি টক মিষ্টি স্বাদ। আর কিনলাম ২০টাকা দিয়ে জোংথ্রা মু। কালো রঙয়ের এই বীজগুলো শিম জাতীয় কোন ফলের। বড্ডো তেতো। খেতে পারলাম না। না জানলে যা হয়।
সক্কাল সক্কাল আমি আর প্রবীর বেড়িয়েছি গাড়ি ঠিক করার জন্য। গন্তব্য কার রেন্ট অফিস। সাথে ড্রাইভার মৈইয়া। ভুল করে নিউ সেক্রেটারিয়েটের দিকে অনেকটা গিয়ে গাড়ি আবার ঘোরায় মৈইয়া। আইজলের ড্রাইভার হয়ে না চেনে ট্যুরিজম অফিস না জানে কার রেন্ট অফিস। আমরা তো রীতিমত অবাক। কি করে সম্ভব? কেউ কি তবে এখানে বেড়াতে আসে না? যাচ্ছি খাদলাবুং এর দিকে। ওখানেই কার রেন্ট অফিস।
কার রেন্টাল থেকে এই কদিন ট্যুরের জন্য একটা বোলেরো গাড়ি ঠিক করলাম। প্রতি কি.মি.। ২৫টাকা করে। নাইট স্ট্যে ১০০০ টাকা প্রতিদিন। সেই সাথে ড্রাইভারের থাকা খাওয়াও আমাদের। আমরা তাতেই সই। কারণ কিচ্ছু করার নেই। তবু যে কার রেন্টাল থেকে ম্যাডাম সাংতাই আমাদের জন্য এতটা করেছেন আমরা তাতেই কৃতজ্ঞ। আজ সকালে কাজল লষ্কর বলে একজন এসেছিলেন আমাদের হোটেলের ঘরে। আমাদের হোটেল ম্যানেজারই ডেকে এনেছিলেন কাজল লষ্করকে। কাজলবাবুর নিজের জাইলো গাড়ি আছে। হোটেলের ঘরে অনেকক্ষন কথা হলো কাজল লষ্করের সাথে। কথাবার্তা ভালো। সবই ঠিক আছে। কিন্তু কিছুতেই প্রতিকিমি ৩০টাকার নিচে নামতে রাজি নন। উনি সিলেটি বাঙালী হলে আমরাও জাত-বাঙাল। দরদাম করতে আমরাও কিছু কম যাই না সিলেটিদের থেকে। লষ্করের সাথে আমাদের ডিল ক্যান্সেল হল।
সেলিং
আজ ২৪শে মে,২০১৮। একটু আগেই ফোন করেছিল আমাদের ড্রাইভার। বললেন রাস্তায় আছেন। ৫মিঃ এর মধ্যে ঝার্কট ঢুকছেন। আমাদের ড্রাইভারের ফোন নম্বর ৭০০৫৬৮২৯৪২। আজ যাচ্ছি মায়ানমারের সীমান্ত লাগোয়া আইজলের পূর্ব দিকে চাম্ফাই। চাম্ফাইকে কেন্দ্র করে ঘুরে নেওয়া যায় মুরলেন ন্যাশানাল পার্ক, জোখাথার (সীমান্ত শহর) , রি ডিল লেক(মায়ানমার) মুরাপুক আর লেংতেই ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি।
স্বাধীনতার আগে যদি রেলপথ আর ইংরেজী ভাষা ভারতরাষ্ট্র কে জুড়ে দেয়, তবে স্বাধীনতা পরবর্তী কালে চোখ বন্ধ করে হিন্দি সিনেমা ও হিন্দি গান। মিজোরামে আসার পর থেকে কোন কিছুতেই মিল পাচ্ছি না প্রতিদিনের জীবনে.... কিন্তু গাড়িতে উঠতেই “ দিল হ্যায় কে মান তা নেহি”। হালকা গান । Bolero-MZ01Q-1895...
আমাদের ড্রাইভার জোসা ব্রাদার। খুব ভালো ইংরেজী বলে। ফাঁকা রাস্তা। মাঝে মাঝে দু একটা আর্মি ট্রাক। হাত দেখিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। পার করলাম টুইরিট। লেঙপুই-এর আগে এটাই ছিল আইজলের এয়ারপোর্ট। সাজানো গোছানো বাড়িঘর আর ছায়াচ্ছন্ন রাস্তা। রোদ উঠলেও অতটা গরম নেই। রাস্তার পাশে সাদা শুয়োরের খোঁয়াড়। রাস্তা আলো করে বোগনভেলিয়ার ফুল। ছিমছাম বাড়ির সামনে ছোট্ট বাগান। সাজানো স্কুল... প্রেয়ার লাইন। ঝুম চাষের ছোটো ছোটো ক্ষেত। বাঁশের বাড়ি। নার্সারি। কলাবাগান আর বাঁশের জঙ্গল। পেড়িয়ে যাচ্ছি ধুলায় ভর্তি অজগরের মত রাস্তাটাকে। পথে আবার দেখা হলো টলং এর সাথে।
৪৫ কিমি পথ পেড়িয়ে এসেছি। এবারে একটু টি ব্রেক। এটা সেলিং। চাম্ফাই আর লুংলেই এর রাস্তা এখানেই ভাগ হয়েছে বাঁটুলের মত...
ট্যামডিল
কেইফাং থেকে ট্যামডিল দেখে ফিরে আসছি একই পথে। কেইফাং থেকে ট্যামডিল ১২কিমি। ফেরার পথে সারাটা রাস্তা কাদা পাথর আর ঝিরঝিরে বৃষ্টি সঙ্গী। সাথে ঈগলের রক ব্যান্ড। আমাদের ড্রাইভার জোসা স্বল্পভাষী সংগীতপ্রীয় মানুষ। পাহাড়ের গায়ে মিজো বাড়ি। ঝুম চাষ। চকচকে সবুজ পাতা। ঠান্ডা বাতাস আর জলকণায় ভিজে ওঠে শরীর। তখন জানালার কাঁচে নিঃশ্বাসের ছবি আঁকি। ত্রিভুজ পাহাড় আর আঁকাবাঁকা নীল দাগে মনে পড়ে নদী ...। ছেলেবেলার আঁকার খাতাটা খুঁজে পাই জানালার কাঁচে।
আইজল থেকে ৪৬কিমি দূরে সাইতুয়াল। এখানথেকে ১২ কিমি ভাঙাচোরা রাস্তা পেরিয়ে চলে যাওয়া যায় ট্যামডিলে। ট্যামডিল মিজোরামের একটা পিকনিক স্পট। চারিদিকে উঁচু উঁচু শৈলশিরা। মাঝখানে ট্যামডিল লেক। সবুজ শ্যওলা রঙের লেক। একপাশে কতগুলি প্যাডেল বোট। আর একদিকে কতগুলো থাকার জন্য ঘর ও লেকের পাশে ছোট্ট একটা বাগান। ট্যামডিলে পৌঁছাতে না পৌছাতেই নামলো বৃষ্টি। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে রেস্ট হাউসে মাথা গুঁজি। টপ টপ বৃষ্টি ফোঁটা শান্ত জলে আলপনা কাটে। বৃষ্টিকে মাথায় নিয়ে আবার রওনা দিলাম। অনেকটা পথ। আর দেরী করা ঠিক হবে না।
খজল
রাতেও বৃষ্টি হয়েছে। কালচে পাহাড়ের মাথায় এখনো থোকা থোকা সাদা মেঘ কুন্ডলী পাকিয়। নাম না জানা কয়েকটা পাখির ডাকে ঘুম ভাঙতেই বাইরে বেরিয়ে এলাম। স্বচ্ছ কাঁচের মত স্পষ্ট দূরের বাড়িঘর। চার্চের ঘন্টা জানান দিল সকাল ৭টা। গেস্টহাউসের বাইরে ফুলে ভর্তি কৃষ্ণচূড়া আর চার পাঁচটা ঝাঊ গাছ। এটা খজল। চাম্ফাই এখান থেকে আরো ৪১কিমি। গতকাল রাতে BDO কে ফোন করে এই গেস্টহাউসে থাকার অনুমতি পাই। খজলে কোন হোটেল নেই। থাকার জায়গা বলতে এই এক গেস্টহাউস আর একটা PWD ইন্সপেকশন বাংলো। গতকাল চাম্ফাই যাওয়ার পথে অনেক রাত হয়ে গেল। রাস্তাতে বৃষ্টিও ছিল। ওদিকে বাচ্চাগুলোর শরীর আর সাথ দিচ্ছিল না। অগত্যা এখানেই থাকার সিদ্ধান্তটা নিতে হয়েছিল।
সার্প টার্ণে কড়া ব্রেক। জাড্যের পরিবর্তনে পেছনে যাই ঝুঁকে। হাই স্পীডে নব্বই দশকের বলিউডি গান। কখন যে ফ্ল্যাশ ব্যকে হারিয়ে ঘুমিয়ে গেছিলাম কে জানে! গাড়ির ঝাঁকিতে ঘুম ভেঙে যায়। খজল আরো ২৩কিমি। ঘন সবুজ বন চাঁদোয়ার মত ঢেকে রেখেছে এই আদিম পাহাড়কে।
গত রাতের মেনুতে ছিল পার্ফেক্ট মিজো ডিশ। ভাত, ডাল , ডিমের ওমলেট আর বাই। বাই, স্থনীয় শাকশব্জী দিয়ে বানানো এক ধরণের সুপ। ড্রাইভার জোসাই শুধু খেলো ননভেজ। মিজোরামে গরু শুয়োর সব চলে। খ্রীষ্টান মিশনারীর প্রভাবে পালটে গেছে মিজোদের সংস্কার আচার ব্যবহার......। ভারতের মধ্যেই এ যেন এক টুকরো অন্য ভারত।
চাম্ফাই – জোখাথার- রি ডিল
রাস্তা যত সামনে এগোয় আকাশ ততই ঘন কালো। বৃষ্টি নামলো বলে। সাথে লিও রোজা। ভেনেজুয়েলার মিউজিক কম্পোজার। গল্পে গল্পে জানতে পারলাম ড্রাইভার জোসার একটা মিউজিক ব্যান্ড আছে আইজলে। বুমেরাং ব্যান্ড। মে মাসের শেষেই মৌসুমী আমন্ত্রন পেয়েছে মিজোরামে। ধ্বসা মাটি জল পেয়ে পেতেছে কাদার সংসার। কোথাও কোথাও গাড়ির চাকা ডুবে যাচ্ছে নরম মাটিতে।
অনেকটা উঁচুতে উঠে এসেছি। উপত্যকার নীচে নদী সমান্তরালে আবাদি জমি। ধান খেতের মধ্যে খাতকেটে বয়ে যাচ্ছে টুইপুই। ঘোলা জল। সবুজের মাঝে বাঁকানো গেরুয়া দাগ। নদী মানে শুধু নীল রং নয়।
tarai.tushar@gmail.com
সুচিন্তিত মতামত দিন