কাশ্মীরের কুপওয়াড়া জেলা । জুলাই মাসের এক বর্ষা ভেজা সকাল । এক পশলা বৃষ্টির পর ঠান্ডা যেন গায়ে কাঁটার মতো বিঁধছে ! ছোট্ট পুলিশ স্টেশনে মাত্র দুজন অফিসার ও চারজন হাবিলদার । পুলিশ স্টেশনের পিছনেই পাইন বন আর পাহাড় । সেগুলি ধোঁয়াশায় ঢাকা ।
এই অঞ্চল ক্রমেই আতঙ্কবাদীদের আক্রমণের প্রধান ঘাঁটি হয়ে উঠছে । গত সপ্তাহে খবর এসেছে জঙ্গী গোষ্ঠির নেতা ফজল ইমাম লুকিয়ে গা ঢাকা দিয়ে আছে এই অঞ্চলে । তাই স্পেশাল এনফোর্সমেন্ট এসেছে দিল্লী থেকে । প্রায় পনেরো জন এনকাউন্টার স্পেশালিস্ট পুলিশের একটি দল ও সঙ্গে গোয়েন্দা অফিসার রুকমা দালভি।
ঢুকলেন এই স্টেশনের প্রধান পুলিশ অফিসার ফিরোজ বসির । রুকমা বললেন “আসুন অফিসার । আমি স্পেশালি ফজলের লুকিয়ে থাকার খবর পেয়ে এসেছি । আমরা এই অবস্থায় শান্ত হয়ে বসে থাকতে পারি না। সামনেই অমরনাথ যাত্রা শুরু । আপনি তো জানেন ওই সময় জঙ্গীরা কিরকম তৎপর হয়ে ওঠে ! বাই দ্য ওয়ে, আপনার কাছে ওর কোন ফোটো আছে ?”
“আছে ম্যাডাম । তবে ফজলকে চেহারা দেখে চেনা শক্ত ! ঘন ঘন চেহারা বদলায় ! কখনো মাথা ন্যাড়া তো কখনো বাবড়ি চুল । কখনো দাড়ি তো কখনো কামানো । খালি শুনেছি কোন এক এনকাউন্টারে মুখের ডান সাইডে একটা বড় ক্ষত হয়ে গেছে – সেটা আর কোনভাবেই ঢাকতে পারে না ।“ ছবিটা বাড়িয়ে দিল ফিরোজ ।
ছবিটার দিকে এক ঝলক তাকিয়েই চমকে উঠলেন ! এ কাকে দেখছেন ! মুহূর্তে যেন পাথর হয়ে গিয়ে বসে রইলেন রুকমা ! কেটে গেলো বেশ কয়েক মিনিট । ফজল ! একে তো তিনি চেনেন মহম্মদ ইমাম নামে ! মন ততক্ষণে চলে গেছে প্রায় দশ বছর আগে দিল্লী ইউনিভার্সিটির দিনগুলোয় । একসাথে হিস্ট্রি পড়তেন ইমাম আর রুকমা । হিস্ট্রিতে একটা ন্যাচারাল ফ্লেয়ার ছিল ইমামের । বিশেষ করে ইসলামিক হিস্ট্রি । কি যে সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে দিত – মনে হত চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠছে ঘটনাগুলো । কখন যেন কাছাকাছি এসে পড়েছিল দুটি মন । ইমামের সুন্দর চেহারাও রুকমার আকর্ষণের এক প্রধান কারণ ছিল । ইমাম ছিল দারুন সুপুরুষ ! গলার নীচে ঠিক বুকের ওপর একটা কালো তিল । শার্টের ওপরের বোতাম ক্যাসুয়ালি খুলে রাখতো ইমাম । কত মেয়ে যে মরতো ওর রূপ দেখে তার ঠিক নেই । ইউনিভার্সিটির ক্যান্টিনে বসে আড্ডা মারতে মারতে একদিন হঠাত বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে ফেলল ইমাম । দিয়েই তার তক্ষুণি হ্যাঁ চাই । ছেলেমানুষের মতো করতে লাগলো ইমাম । অবশেষে হ্যাঁ বলতে হল রুকমাকে – অথচ কলেজের বাইরে কতটুকু আর জানতো তাকে রুকমা ? বাড়িতেও কেউ জানতো না । সবে রুকমা ভাবছে বাড়িতে বলবে – এমন সময় একদিন ছুটির সময় দেখে একটা ফাঁকা ক্লাসরুমে ইমাম আর সহেলী খুব ঘনিষ্ট অবস্থায় বসে – ইমামের ঠোঁট সহেলীর বুকের ভাঁজে ! ওকে দেখতে পায় নি ইমাম । বিস্ময়ে রাগে দরদর করে চোখ থেকে জল পড়ে রুকমার । ধীরে সেখান থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয় সে । কিন্তু মন থেকে কি করে সরাবে ? সে যে সবটা মন ওকে দিয়ে ফেলেছিল ! নিজের চেয়েও বেশী ভালবেসে ফেলেছিল ইমামকে । অসহায় অবুঝ প্রেম !
ইমাম এরপর ওর কাছে অনেকবার এসেছে । অনেক মিষ্টি কথায় বোঝাতে চেয়েছে যে ওটা তার ক্ষনিকের দুর্বলতা ছিল। আসলে সে রুকমাকেই চায়। কিন্তু এরপর আর সম্পর্ক ধরে রাখতে পারে নি রুকমা। ইউনিভারসিটিতে থাকতে থাকতেই রাজনীতিতে যোগ দেয় ইমাম। ছাত্র নেতা হয়ে ওঠে । পরের বছর ওর থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য অন্য ইউনিভার্সিটিতে চলে যায় রুকমা । পাশ করে আই পি এস জয়েন করে সে । খুব তাড়াতাড়ি উন্নতি করে তার হার না মানা স্বভাবের জন্য । কিন্তু প্রথম প্রেম ইমামকে কোনদিন ভুলতে পারে নি ।
ফিরোজ বসিরের ডাকে হঠাত চটকা ভাঙ্গে রুকমার । “ম্যাডাম – আমরা আপনার আদেশের অপেক্ষায় ।“
বাস্তবে ফিরে আসেন জাঁদরেল অফিসার রুকমা । বলেন “ফজল এখানে কার কাছে লুকিয়ে আছে – কিছু খবর আছে?”
“শুনেছি ওর মা গ্রামেই কোথাও থাকে। বহুদিন যোগাযোগ নেই, কিন্তু এখন এসে সেখানেই উঠেছে । গ্রামের লোকজন ওকে খুব ভালবাসে । ওকে এমন ভাবে লুকিয়ে রেখেছে – কেঊ মরে গেলেও বলবে না ।“
“হুম, বুঝেছি ! ঠিক আছে – ধৈর্য ধরুন ।“
এর দুদিন পর খবর পাওয়া গেলো পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে জঙ্গীদের একটা বড় দল প্রচুর অস্ত্র নিয়ে রাতের অন্ধকারে পাহাড় ডিঙিয়ে প্রবেশ করবে । আর এলোপাথারি গুলি চালিয়ে তাদের কভার দেবে এখানকার জঙ্গীরা ।
রুকমা বললেন “এই সুযোগ ! ফজল নিশ্চই তার গোপন আস্তানা থেকে বেরোবে । ফজলকে জ্যান্ত ধরে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব । জঙ্গীরা ওকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবে । অতএব কোনঠাসা করে মেরে ফেলতে হবে এনকাঊন্টারে । তৈরী হোন । বি এসএফ কেও জয়েন করতে বলছি আমাদের সাথে । “
রাতের অন্ধকারে পুলিশবাহিনী ও বি এস এফের গুলিতে মারা গেলো বেশ কিছু জঙ্গী । উদ্ধার হল প্রচুর অ্যাসল্ট রাইফেল, বোমা, রকেট লঞ্চারের মতো অস্ত্র । পুলিশের মধ্যেও চারজন শহীদ হলেন ।
পরদিন ভোরে মৃতদেহগুলি এসে পৌঁছল পুলিশ স্টেশনে । একটি দেহ কেঊ সনাক্ত করতে পারল না । তার বাড়ি থেকে সম্ভবত কেঊ আসে নি । বাকী দেহগুলি আত্মীয়দের হাতে তুলে দেওয়া হল । প্রতিবেশী রাজ্যের মৃতদেহ গুলি কবর দেওয়া হল সরকারী অনুমতি নিয়ে । অবশেষে রুকমা এলেন অসনাক্ত দেহটি দেখতে । কোন সময় ফর্সা ছিল রঙ, এখন রোদে পুড়ে তামাটে । গাল ভেঙে গেছে । মাথার চুল পাতলা হয়ে টাক পড়ে এসেছে । মুখে একমুখ দাড়ি। ডান গাল দেখার কোন উপায় নেই এতো ঘন দাড়ি। নাঃ কোথায় সেই সুপুরুষ ইমাম ? এ তো মাঝ বয়েসি ঝড়ে ভাঙা এক পুরুষ । তাই নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয় এই ফজল কিনা ! অবশেষে লোকটির জামা একটানে খুলে ফেললেন রুকমা । এই তো ! এই তো সেই তিল ! তার আদরের ফজল ! ঘুমিয়ে পড়েছে চিরতরে ।
“এই ফজল ! আমি সনাক্ত করলাম !” বলে ঊঠলেন রুকমা । সবাইকে অবাক করে মাথার কাছে বসে পড়ে ফজলের মাথাটি কোলে তুলে নিলেন রুকমা। আস্তে আস্তে বিলি কেটে দিতে লাগলেন তার মৃত্যুক্লান্ত মুখে । দু চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো জাঁদরেল পুলিশ অফিসার রুকমা দালভির । কেউ যখন এসে ফজলের লাশ দাবী করল না, তখন নিজ দায়িত্ত্বে তাকে মাটি দিল রুকমা । বিস্মিত পুলিশ অফিসারদের চোখের সামনে, চুম্বন করে লাল গোলাপ রাখলো তার কবরে ।
anandapur.ccu@fr.dtdc.com
সুচিন্তিত মতামত দিন