রোববার ছুটির দিন পাড়ার চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে সুনীল হরি শিবু আর দীপ্তেনের সাথে চা খেতে খেতে আমাদের জমিয়ে আড্ডা চলছিল। হরি বলছিল, “দেশটা রসাতলে গেল, শেষকালে শেয়াল কুকুর শকুনের মত মানুষকেও ভাগাড়ের মাংস খেতে হল। দুদিন আগেই আমি কোলকাতা গিয়েছিলাম, দুপুরে ফুটপাতের দোকানে পঞ্চান্ন টাকা প্লেট বিরিয়ানি খেলাম। ভালই লেগেছিল, এখন টিভির খবর শুনে তো আমার বমি আসছে।“ শিবু বলে উঠল, “বিরিয়ানিতে মরা গরুর মাংস খেলি না শুয়োর কুকুর বিড়ালের মাংস খেলি দেখ।“
- ভাগাড়ের মাংস, সে আবার গরু না শুয়োর বিড়াল।
দীপ্তেন বলে উঠল,“ভাগ্যিস ভাগাড়ের খবরটা উঠল তাই মিডিয়ার শিশু ধর্ষণ, ভোটের খুনোখুনির খবরগুলো কিছুটা ব্যাকফুটে চলে গেল।“ এবার সুনীল বিড়িতে একটা টান দিয়ে বলল, “একটা ভাল জিনিস দেখেছিস মাইরি, ধর্ষণ আর ভোটের খুনোখুনি নিয়ে নেতারা শালা উল্টোপাল্টা বললেও ভাগাড় নিয়ে কিন্তু এখনও রাজনীতি আরম্ভ হয়নি। আজকের খবরটা দেখেছিস? মেট্রোতে একজোড়া ছেলে মেয়ে জড়াজড়ি করেছে না চুমু খেয়েছে অমনি কয়েকজন লোক দমদম স্টেশনে ওদের ট্রেন থেকে জোড় করে নামিয়ে গণধোলাই দিয়েছে। শালারা তোরা যখন ট্রেনে খিস্তি মারিস, রাস্তার ধারে প্যান্ট থেকে ওটা বার করে সব্বার সামনে দোয়ালে হিসি করিস তখন তোদের এই ন্যাকামির ভদ্দর লোকগিরিটা কোথায় যায়? ওরা দুজন দুজনকে ভালোবাসত, জড়াজোড়ি করেছে চুমু খেয়েছে বেশ করেছে। আমিও আমার মেয়েবন্ধুকে জড়িয়ে ধরে সব্বার সামনে চুমু খাব, দেখি কোন শালা আমার গায়ে হাত দেয়। আসলে কি জানিস, বুড়ো দামড়াগুলোর মনে প্রেম ফুরিয়ে গেছে বাড়িতে বউ ঝাঝানি মারে, বাইরে কাউকে প্রেম করতে দেখলে ওনাদের আর সহ্য হয় না, গা জ্বালা করে।“
- না রে দীপু, ট্রেনে সবার সামনে যেমন জড়াজড়ি করে চুমু খাওটা অশোভন, তেমনি ওদের মারধর করাটাও অন্যায়।
আমাদের কাছেই চায়ের দোকানের ধারে একটা লোক দাঁড়িয়েছিল, সে এবার আস্তে আস্তে আমাদের কাছে এসে বলল, “চলুন আপনাদের ডাক এসেছে।“
- চলুন মানে? আপনি কে মশাই যে আপনি ডাকলেই যেতে হবে।
- আমি ডাকিনি, আমাদের সাহেব ডেকেছেন। আপনাদের সব কথাবার্তা আমার ভিডিও রেকর্ড করা হয়ে গেছে।
- কোথায় নিয়ে যাবেন, থানায় ? থানার বড়বাবু আমাদের কিচ্ছু করবে না।
আমরা আর কিছু বলার আগেই লোকটা আমাদের পাঁচ জনকেই তুলে মেঘের মধ্য দিয়ে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে একটা সুন্দর পার্কে বসিয়ে দিল। দেখলাম আমরা সবাই সাদা ধপধপে পায়জামা পাঞ্জাবী পরে আছি, ওখান্কার সবাইকেও সাদা জামাকাপড় পরা দেখলাম। জায়গাটা বেশ সুন্দর, সামনে নদী বহে যাচ্ছে, একটু দূরে গাছপালায় ভরা পাহাড়, চারিদিক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। লোকটা এবার আমাদের বলল, - সাহেবের জরুরী মিটিং চলছে, মিটিং শেষ হলে ডাক পড়বে । এটা পরলোকের পার্ক, এখানে তোমরা বসো, তোমাদের কেউ দেখতে পাবে না, আর তোমাদের কথাও কেউ শুনতে পাবে না। কিন্তু তোমরা সবাইকে দেখতে পাবে , সবার কথা শুনতে পাবে।
- স্যার, পরলোকে, মানে আমরা এখন স্বর্গে আছি?
- স্বর্গ না নরক একটু পরেই বুঝবে।
আমরা চুপচাপ বসে আমাদের পাশের লোকগুলোর কথা শুনছিলাম। কাছেই এক জন বৃদ্ধ, একজন যুবক, আর একটা বাচ্চা মেয়ে বসেছিল। ওদের কথাবার্তায় বুঝলাম ওরা কয়েকদিন আগেই এখানে এসেছে। বৃদ্ধটা বাচ্চা মেয়েটাকে জিজ্ঞাসা করল, - তোমার কি হয়েছিল মা, এই বয়সে তুমি এখানে?
- আমি ভেড়া চড়াচ্ছিলাম, কয়েকটা লোক এসে আমার ওপর অত্যাচার করে আমাকে মেরে ফেলল। কাশ্মীরের এই ঘটনাটা নিয়ে কাগজে টিভিতে খুব হৈচৈ হল, তোমরা শুনে থাকবে নিশ্চয়ই।
বৃদ্ধ এবার যুবককে জিজ্ঞাসা করলেন, - তোমার কি হয়েছিল বাবা?
- ভোট দিতে যাচ্ছিলাম, ওরা বলল ‘দাদা এই রোদে আপনাকে ভোট দিতে যেতে হবে না, আমরা দিয়ে দেবো’, তবু আমার গণতান্ত্রিক অধিকার নিজে প্রয়োগ করতে এগোতে গেলাম, একটা বোম এসে পড়ল আমার গায়ে। তারপরেই দেখলাম আমি এখানে, আর আপনি?
- সান্ধ্যভ্রমণে বেরিয়েছিলাম, গঙ্গার ধারে হাঁটছিলাম হঠাত শরীরটা কিরকম করে উঠল, ঘাম হতে থাকল, তারপর আর জানি না, দেখছি আমি এখানে।
ওদের কথা শেষ হতে না হতে একটা বউ এসে ওদের পাশে বসল। বৃদ্ধ বলল - তুমি কি আজই এখানে এলে মা?
- হ্যাঁ মেসোমশাই, তিন মাস হল আমাদের বিয়ে হয়েছিল, শ্বশুরবাড়ি থেকে একটা গাড়ি চেয়েছিল, বাবা গাড়ি দিতে পারেনি, একটা বাইক দিয়েছিল। তাই শাশুড়ি আর স্বামী মিলে আমার গায়ে আগুন ধরিয়ে দিল। তারপরই আমি এখানে।
আমাদের যে লোকটা এখানে এনেছিল এবার সে এসে বলল, “চলুন এবার সাহেবের কাছে।“
আমি ‘’আমি কিছুতেই যাব না” বলে চিৎকার করে উঠতেই মায়ের ডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেল। মা আমাকে বলছে, -সমু, কি গোঁ গোঁ করছিলি, সেই নটার সময় বিছানায় শুয়ে টিভির খবর শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছিস, টিভিটা বন্ধও করিসনি। রাত হয়ে গেছে, এগারোটা বাজে খাবি চল।
ssanjibkumar@gmail.com
সুচিন্তিত মতামত দিন