কালিম্পং থেকে রিশপ
বাংলোর দরজায় লাগানো হলুদ আলোটা তীব্রতা বাড়িয়ে ঘরের কাচের দেওয়ালে ঠিকরে পড়তে লাগলো। না, অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকেও কোনো রহস্যজনক কিছু চোখে পড়লো না। তবে সত্যি বলতে কি এই নির্জনে একান্ত যাপনে এই ধরণের রহস্য খোঁজা খেলার মধ্যে যে আনন্দ পেলাম, তা ভ্রমণের গায়ে গন্ধরাজের সুগন্ধের মত জেগে রইলো। রাতের খাবার চলে এসেছে। সেই সকালে ল্যাপচাজগৎ থেকে ঠিক ঐ মুহূর্ত পর্যন্ত, মানে রাত সাড়ে ন’টা একটুও বিশ্রাম নেওয়ার কথা মনেও আসে নি। খাবার দেখে মনে হলো রাত হয়েছে, এবার শরীরকে বিশ্রাম দেওয়ার পালা। খাটের পাশে, রুমের পূর্ব দিকের দেওয়ালটাও কাচের। বড় বড় পর্দা ঝুলছে। পর্দা সরিয়ে কিছুটা অংশ ফাঁক করে দিলাম। ঘরের লাইট নেভাতেই ভেসে উঠলো দূর পাহাড়ের গায়ে টিম টিম জ্বলতে থাকা অজস্র আলোকমালা। সারারাত জ্বলবে এভাবেই! পাহাড়ে কখনও অন্ধকার নামে না, যদিও পাহাড়ের মানুষের জীবনে আছে প্রতিনিয়ত অন্ধকারের সাথে লড়াই। প্রকৃতির প্রতিকূলতাকে নিশ্বাসের সাথে বেঁধে নিয়েছে মানুষ। বেঁচে থাকা যতটা বাস্তব, প্রাকৃতিক প্রতিকূলতাও ঠিক ততটাই বাস্তব এদের কাছে। কখন যে এই নৈসর্গিক দৃশ্য দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে নেই। ঘুম ভাঙলো আলোকচ্ছ্বটায়। দূরে পাহাড়ের মাথার পিছন থেকে উঁকি মারছে সূর্যদেব। তাঁর রশ্মির একটি কণা কাচের দেওয়াল ভেদ করে স্পর্শ করছে আমার মুখ। সূর্য তো সব জায়গায় দেখা যায়, কিন্তু এমন স্পর্শ সত্যিই বিরল। পাশে শুয়ে থাকা আমার প্রিয় বন্ধুটি মানে পতিদেব আর আমার ছেলের ঘুমন্ত মুখের উপরও পড়েছে লালচে আভা। কি অপূর্ব! ঘুমোলে মানুষের নিষ্পাপ মনটাই শুধু জেগে ওঠে;তাই সরল দেখায়। এর উপর আলোর কোমল স্পর্শ আরও যেন মায়াবী করে তুলেছে ওদের মুখ!
সকাল সকাল বেরোতে হবে। পুরো কালিম্পং দেখে আমরা যাবো ‘রিশপ’। আগের দিন যে দাদা আমাদের এই হোটেলে নিয়ে এসেছিলেন, তিনিই আমাদের ঘুরিয়ে দেখাবেন গোটা কালিম্পং। ঠিক ন’টায় আমরা লাগেজ নিয়েই উঠে পড়লাম গাড়িতে। কাছেই আছে একটা মিউজিয়াম। সেখানে পৌঁছে দেখলাম গেট বন্ধ। দশাটার আগে খুলবে না। দাঁড়িয়ে থাকা মানেই সময় নষ্ট। এগিয়ে চললাম ‘পাইনভিউ’ নার্সারির দিকে। কালিম্পং এর এই নার্সারিটির নাম অনেকেই জানেন এর বিশালাকৃতির ও বিচিত্র দর্শন ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির ক্যাকটাস সম্ভারের জন্য। ঢুকেই সত্যিই অবাক হয়ে গেলাম। একেকটা ক্যাকটাসের আকৃতি মানুষের সমান। আর নামটা কেন গ্রিনভিউ সেটা ভিতরে ঢুকেই আন্দাজ করতে পেরেছিলাম। চারিদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। নয়নাভিরাম এমন সুন্দর প্রাকৃতিক বাগানে দু’দন্ড কাটাতে পারা সত্যিই সৌভাগ্য। এখান থেকে একটা কৃষ্ণমন্দির ঘুরে গেলাম এক মনেস্ট্রিতে। পাহাড়ের চূড়ায় স্নিগ্ধ, শান্ত পরিবেশে দাঁড়িয়ে আছে বৌদ্ধ স্থাপত্য। কি ভীষণ রকম নীরবতা! ওখানে দাঁড়িয়েই দূরে এক অন্য পাহাড় চূড়ার দিকে নির্দেশ করে ড্রাইভারদা বললেন, “ উধর দেখিয়ে,উস পাহাড়িকে উপর হ্যয় ‘ডেলো’, আভি হাম উধর যায়েঙ্গে”। এক পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে অন্য পাহাড়ের চূড়ায় যাওয়ার কথা ভাবলেই কেমন যেন এক রোমাঞ্চ জাগে মনে। দূর থেকে দেখতে পৃথক মনে হলেও আসলে পাহাড়ে একটার সাথে আরেকটার সম্পর্ক খুব সুদৃঢ়। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথে ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছে গেলাম ডেলো। ঢোকের মুখেই রয়েছে কাউন্টার প্রবেশ মূল্য দিয়ে ঢোকা যেবে ভিতরে। কেউ প্যারাগ্লাইডিং করতে চায়লে এখানেই আছে টিকিট কাউন্টার। সরু বাঁধানো রাস্তার দু’পাশে সাজানো ফুলগাছে। রাস্তাটা গিয়ে মিশেছে পাহাড়ি টিলায়। এদিক ওদিক ছড়ানো বেশ কিছু একইরকম রাস্তা গোটা ডেলো জুড়েই রয়েছে। মাঝে মাঝেই বিশ্রাম নেওয়ার জন্য চাতালের নিচে বসার জায়গা। প্রতিটি বসার জায়গা এমন এক অবস্থানে; যেখানে বসে দেখা যায় অনন্ত গভীর খাদের তলদেশ। ঠান্ডা হাওয়া হালকা হালকা বইছে। ছুঁয়ে যাচ্ছে মনের সাথে শরীরের অভ্যন্তর। ডেলোর আকাশ জুড়ে ভেসে বেড়াচ্ছে প্যারাগ্লাইডাররা। এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ! দেখেই এতো সুখ, না জানি প্রত্যক্ষ অনুভবে কত সুখ পাওয়া যাবে! কেটে গেল বেশ কয়েকঘন্টা সময়। এবার ছুটবো রিশপের পথে। ড্রাইভারদা কে বললাম তিনি পারবেন কি না আমাদের রিশপ পর্যন্ত নিয়ে যেতে। এমনিতে মারুতিভ্যানে এই রিশপের পথে যাওয়া বেশ রিস্ক, কিন্তু গাড়িটি একেবারেই নতুন। ড্রাইভারদা আরও কিছু অতিরিক্ত অর্থের বিনিময়ে আমাদের নিয়ে পাড়ি দিলেন সেই পথে। রাস্তা কোথাও ভালো আবার কোথাও খারাপ। পথে অনেক জায়গায় দেখলাম রাস্তা তৈরির কাজ চলছে। কিছুটা বিলম্ব হলো সেই অংশটুকু পেরিয়ে যেতে। আরও কিছুটা পথ পেরোতেই গাড়ি কিছুটা চড়াই উঠে বেঁকে গেল এক ছায়াঘেরা বনপথে। রাস্তা ভীষণ খারাপ! নুড়ি ভরা। গাড়ির চাকাতে নুড়ি পিছলে করকর আওয়াজ হচ্ছে।
রাস্তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেমন, ঠিক ততটাই ভয়ঙক যেন পথ। একটা সরু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নুড়ি ভরা পথে পৌঁছালাম আমরা। পাশে তাকালেই বুকটা কাঁপছে। গাড়ির পাশে একহাত মত জায়গা পড়ে আছে, তার ঠিক পর থেকেই শুরু হয়েছে অনন্ত বিস্তৃত খাদ। একবারের জন্য হলেও মনে হলো যদি বেঁচে ফিরি, তবে আর এই ভুল করবো না। এমন ভয়ানক পথে মারুতিভ্যানে আর নয়, আর ঠিক তখনই চড়াই উঠতে গিয়ে নুড়িপথে গাড়ির চাকা আটকে গঁ গঁ আওয়াজ করতে লাগলো। ড্রাইভার ব্যাকগিয়ারে কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে একটানে গাড়ি ঘুরিয়ে বাঁ-দিকে বাঁক নিল। যাক, এরপর আর অতটা খারাপ রাস্তা পেলাম না। ধীরে ধীরে গাড়ি প্রবেশ করতে লাগলো এক অচেনা পাহাড়ি গ্রামে। রাস্তা যেখানে এসে বাঁক নিয়ে খানিক নিচে নেমে গিয়েছে, ঠিক সেই সংযোগ স্থলেই বেশ বিস্তৃত এলাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ‘ নিউ সোনার বাংলা’ হোটেলটি। হোটেলের বাঁধানো লনের সামনেই সরু রাস্তা আর তারপরই শুরু হয়েছে গভীর খাদ। কালিম্পং এর হোটেল থেকেই এই হোটেলের সন্ধান পেয়েছিলাম। ছিমছাম সুন্দর হোটেল। রুমগুলো, সিঁড়ি সবই কাঠের। রুমের রাস্তার দিকের দেওয়ালটা কাচের। পর্দা সরালেই কাচের ওপারে অনন্ত বিস্তৃত আকাশ মিশে গিয়েছে গভীর অতলে। মাঝ বরাবর একা উন্নত শিরে দাঁড়িয়ে একটি লম্বা সরু গাছ। এ দৃশ্যপট বর্ণনার বাইরে; শুধু অনুভবের। হোটেলে গিজার নেই, তবে চাইলেই বালতিতে গরম জল দিয়ে যাচ্ছে। কনকনে ঠান্ডায় হাত-পা জমে যাওয়ার জোগাড়। আমরা যখন পৌঁছালাম রিশপে, তখন দুটো-আড়াইটে হবে! একটি অল্প বয়সের ছেলে এসে দু’বালতি গরমজল দিয়ে গেল। ছেলেটি বাঙালী, আমাদের নদীয়া জেলার ছেলে। আরও দুটি ছেলে আছে তারাও বাঙালী। সামান্য চায়নিজ দিয়ে পেট পুজো সেরে গিয়ে দাঁড়ালাম খোলা লনে। সামনে দিয়ে রাস্তাটা মিশে গিয়েছে দূর গ্রামের পথে।
উপর থেকে দেখা যাচ্ছে ঠিক আঁকা ছবির মত। হাঁটতে লাগলাম সেই দিকে ঢালু রাস্তা ধরে। রিশপে প্রকৃতিই একমাত্র দ্রষ্টব্য। এখানে প্রকৃতিকে আবিষ্কার করা যায়, শ্বাসবায়ুতে অনুভব করা যায়, ভরে নেওয়া যায় রোমকূপে রোমকূপে। প্রকৃতির চাদর গায়ে জড়িয়ে হাঁটতে থাকো শুধু, কোনো ক্লান্তি নেই!বেশ অনেকটা পথ এগিয়ে আবার পিছনের পথ ধরলাম। মোটা মোটা ফোঁটায় বৃষ্টির বিক্ষিপ্ত জলবিন্দু রাস্তার গায়ে ছবি আঁকছে। কিন্তু যখন হোটেলের কাছে ফিরে এলাম, বৃষ্টি বন্ধ। রাস্তার ধারে একটা বড় পাথরের উপর পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে এক দম্পতি, প্রকৃতির দিকে চেয়ে। মাঝে মাঝে মানুষকে যেন প্রকৃতির গায়ে অলঙ্কারের মত দেখায়। আমরা ওদের পাশ কাটিয়ে হোটেলের ডানদিকের মাটির রাস্তা ধরে এগোতে লাগলাম।
এভাবে পায়ে হেঁটে না ঘুরলে প্রকৃতির গন্ধ নেওয়া যায় না। জায়গাটা তো আমাদের কাছে সম্পূর্ণ অচেনা। পথ চিনে এভাবে এগিয়ে যেতে দারুণ রোমাঞ্চ জাগে মনে। সরু রাস্তা, তার উপর ভেজা, বেশ পিচ্ছিলও। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে হেঁটে চলেছি যেদিকে কিছুই চিনি না তার। মাঝে মাঝে পথের পাশে নজরে আসছে নাম না জানা রঙীন পাহাড়ি ফুল, পাথরের খাঁজে খাঁজে ফুটে আছে। বেশ কিছুটা হাঁটার পর দেখলাম পরপর কয়েকখানি ঘর। তিনটি মেয়ে ঘরের পাশদিয়ে নেমে যাওয়া পাহাড়ি ঢালের সরু পায়ে হাঁটা পথে নেমে যাচ্ছে নিচে। জানা হলো না কোথায় তাদের গন্তব্য। পৌনে চারটে বাজে। সন্ধ্যে প্রায় আগত। ফিরতে লাগলাম হোটেলের পথে। সন্ধ্যের আগের মুহূর্তটা হোটেলের খোলা লনে বসে চায়ের কাপ হাতে। তাকিয়ে থাকা দূর দিগন্ত পানে, যেখানে আকাশটা মিশে গিয়েছে সবুজ পাহাড়ি কোলা। বিচিত্র এক অনুভবে ভিজে আছে মন। সন্ধ্যে নামলো, ঠান্ডায় আর বাইরে বসা সম্ভব নয়। রুমে ফিরে এখন রাতটুকু নিজেদের মত কাটানো। এর মধ্যেই কিন্তু একফাঁকে ভাব করে নিয়েছি সেই নবদম্পতির সাথে। মাত্র সাতদিন আগেই ওদের বিয়ে হয়েছে। কর্পোরেট ব্যস্ত জীবনে বরাদ্দ দু’দিন ছুটি রিশপকে দিতে এসেছে। ইসস্! এই জন্যই বলে দেওয়ালেরও কান আছে। আর হোটেল গুলোই বা কেমন? আমাদের পাশের রুমেই আছে সেই দম্পতি.... আর খুব জোর ঝগড়া লেগেছে ওদের মধ্যে। সব কথা শোনা যাচ্ছে। কি করবো বলুন তো! বাড়িয়ে দিলাম টিভির আওয়াজটা।
ক্রমশ....
সুচিন্তিত মতামত দিন