রাহুল ঘোষ

পরাজিতদের গল্প       ১.  প্রস্তাবনা
প্রথম পর্ব। ২০০৭ সালের শেষের দিক। ভারতের অন্যতম প্রধান ইংরেজি দৈনিক সংবাদপত্র 'হিন্দুস্তান টাইমস'-এ প্রকাশিত একটি ছোট্ট লেখায় চোখ আটকে গিয়েছিল। পি কে বালাচন্দ্রনের সেই লেখাটির শিরোনাম ছিল, 'Ravana is a hero for Sinhala nationalists'---শ্রীলঙ্কায় সিংহলী জাতীয়তাবাদের আধুনিক প্রবক্তারা কীভাবে প্রাচীন লঙ্কার রাজা রাবণের ভাবমূর্তিকে নিজেদের প্রচারে ব্যবহার করছেন, তার সংক্ষিপ্তঅথচ তথ্যসমৃদ্ধ বর্ণনা। পেশাগত দিক থেকে আমরা যে যা-ই করি না কেন; মহাকাব্যের কোনো পাঠ বা ঘটনা বা বর্ণনা তাকে কোনোদিন আলোড়িত করেনি, এরকম মানুষ খুঁজে পাওয়া বোধহয় প্রায় অসম্ভব! কারণ, যে-মানুষটি জীবনে সাহিত্যচর্চায় আগ্রহী হয়নি, সেও অন্তত শৈশবে বড়োদের মুখে শুনে বা ছবির বই থেকে মহাকাব্যের কাহিনির সঙ্গে পরিচিত হয়েছে। বস্তুত, ভারতীয় হিসেবে রামায়ণ ও মহাভারত সম্পর্কে অল্প-বিস্তর জ্ঞান আমাদের প্রায় জন্মগত অধিকার! সেই  অধিকার উপভোগ করতে-করতে আমরা যদি মহাকাব্যিক রসে নিমজ্জিত হতে থাকি, তাহলে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু সেই অধিকার যদি আমাদের প্রশ্ন করতে শেখায়, তাহলেই হয়ে যায় মুশকিল! কারণ, প্রশ্নগুলি তখন আমাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়; অথচ মহাকাব্যের মূলপাঠ হোক অথবা তার পাঠ্যবই-সুলভ ব্যাখ্যা, কোথাও সে-সব প্রশ্নের উত্তর মেলে না! ব্যক্তিগতভাবে আমার সঙ্গে দ্বিতীয়রকমের ঘটনা ঘটতে থাকায়, দিনের শেষে খবর-কাগজের মূল্য ফুরোলেও বালাচন্দ্রনের লেখাটি আমার মনে লেগে রইলো। প্রসঙ্গত, গত শতকের আশির দশকে আমাদের কিশোরবেলায় দূরদর্শনের পর্দায় রবিবারের সকালে রাস্তাঘাট ফাঁকা করে দেওয়ার মতো জনমোহিনী হিন্দি সিরিয়াল ছিল রামানন্দ সাগরের 'রামায়ণ'। তখন হোক বা তার পরবর্তী সময়ে, বিভিন্ন চ্যানেলে মহাকাব্যের বীর ও ভক্তিরসের অকুণ্ঠ প্রদর্শনকারীরা এত বছর ধরে প্রমাণ করে এসেছেন যে, মাস-মিডিয়া মূলত গতানুগতিক পথের বাইরে যাবে না। অতএব যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করতে হবে সম্ভাব্য সমস্ত দিক থেকে, 'যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখো তাই' প্রবাদটিকে শিরোধার্য করে। কারণ, কোথা থেকে কী 'অমূল্য রতন' উঠে আসবে, তা কেউ জানে না! প্রায় ১১ বছর আগে ছাপা-হওয়া বালাচন্দ্রনের ছোট্ট লেখাটি সেই ভাবনাই উসকে দিয়েছিল নির্ঘাত!

বালাচন্দ্রনের লেখাটির প্রসঙ্গে আবার পরে আসবো। আপাতত মূল অর্থাৎ রামায়ণ প্রসঙ্গে আসি। যতবারই এই মহাকাব্যের নাম উচ্চারিত হয়, ততবারই আমার মনে হয়, রামায়ণ আসলে কী? ধর্মগ্রন্থ না ইতিহাস না রূপকথা? নাকি, নেহাতই একটি মহাকাব্য? এক-এক করে উত্তর খোঁজা যাক। একথা অনস্বীকার্য যে, ভারতীয় সংস্কৃতিতে রামায়ণ যুগ-যুগ ধরে ধর্মগ্রন্থের মর্যাদাই পেয়ে আসছে। সম্ভবত নায়ক হিসেবে ভগবান বিষ্ণুর সপ্তম অবতার-রূপে পরিচিত রামের উপস্থিতি, 'দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন'-জাতীয় নীতিবাক্যের প্রতিষ্ঠা ও 'রামরাজ্য'-জাতীয় সুখকল্প জনপদের বর্ণনা রামায়ণের এমন মর্যাদালাভের কারণ। কিন্তু একটি ধর্মগ্রন্থের রূপ কি এতরকম হতে পারে? আমরা তো জানি, পৃথিবীর সমস্ত ধর্মই তাদের ধর্মীয় বইপত্রের মূলপাঠ ও পবিত্রতার বিষয়ে মোটামুটি একইরকম রক্ষণশীল। কেউ কি কখনও শুনেছেন যে, বেদ-উপনিষদ-গীতা-বাইবেল-কোরান-জিন্দাবেস্তা-ত্রিপিটক ইত্যাদির বিভিন্ন পাঠ আছে? হ্যাঁ, এইসব মূলপাঠের ব্যাখ্যা আছে বিভিন্ন রকমের; কিন্তু মূলপাঠটিই পাল্টে যাচ্ছে, এরকম দেখা যায় না। কিন্তু রামায়ণের মূলপাঠটিই তো বহুরকমের! রামায়ণ আদতে একটি সংস্কৃত মহাকাব্য, যার রচয়িতা ঋষি বাল্মীকি, একথা মনে রেখেও তার অজস্র পাঠের বৈধতা ও গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। কারণ, যত সংখ্যক মানুষ বাল্মীকি-রামায়ণে আস্থা রাখেন, তার থেকে অনেক-অনেক বেশি মানুষের জীবনযাত্রায় ও বিশ্বাসে তাদের শুনে আসা রামায়ণের বিভিন্ন  পাঠ জড়িয়ে আছে, যেগুলি অনেক ক্ষেত্রেই বাল্মীকির রচনার থেকে পৃথক, এবং ক্ষেত্রবিশেষে বিপরীতমুখীও বটে!  বাল্মীকি-রামায়ণের অন্যতম ইংরেজি অনুবাদক বিবেক দেবরায় উদ্ধৃত করেছেন যে, এ কে রামানুজনের একটি প্রবন্ধে অন্তত ৩০০ রকমের রামায়ণের উল্লেখ আছে, এবং সংখ্যাটি আরও বেশিও হতে পারে! ভারতের প্রায় সব ভাষায় রামায়ণ রচিত অথবা অনুদিত হয়েছে। যেমন, হিন্দিতে (আওধি উপভাষায়) তুলসীদাসের 'রামচরিতমানস', বাংলায় কৃত্তিবাস ওঝার 'শ্রীরামপাঁচালী', তামিলে কম্বনের (মতান্তরে, কম্বর) 'রামাবতারম' ইত্যাদি। শুধু ভারতেই নয়, পুরো ভারতীয় উপ-মহাদেশ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রায় সব দেশ, চিন, জাপান এবং ইরানেও রামায়ণের কাহিনি প্রচলিত আছে। রামায়ণ কিন্তু শুধু হিন্দু ধর্মেই সীমাবদ্ধ নয়। বৌদ্ধ ধর্মে 'দশরথ জাতক' নামে এবং জৈন ধর্মে 'পৌমাচারিয়ম' নামে তার উপস্থিতি আছে। শুধু কি তাই? সংস্কৃত ভাষাতেই বাল্মীকি-রামায়ণ ছাড়াও যোগবশিষ্ঠ, আনন্দ ও অদ্ভুত---এই তিনরকম রামায়ণ রয়েছে। মনে রাখার বিষয়, দেশ-বিদেশ-ভাষা-ধর্ম ভেদে যতরকম রামায়ণের কথা এখানে উল্লেখ করা হলো, তাদের প্রত্যেকটির পাঠই বাল্মীকির মহাকাব্যের থেকে কম-বেশি আলাদা। কোনো-কোনো ক্ষেত্রে পার্থক্য এতটাই বেশি যে, রচনাগুলি যে একই কাহিনি-আধারিত, তা মনে রাখাই মুশকিল হয়ে পড়ে! বাস্তবত, একটি ধর্মগ্রন্থের এমন বিচিত্র ও বিপরীতমুখী অস্তিত্ব থাকতে পারে না।

তাহলে কি রামায়ণকে আমরা ইতিহাস হিসেবে পড়বো? রামায়ণে উল্লিখিত বহু স্থান বা অঞ্চল আজকের আধুনিক ভারতের বুকেও দৃশ্যমান। রামের অযোধ্যা, সীতার মিথিলা, এবং আরও অনেক স্থাননাম আমাদের পরিচিত। অল্পসংখ্যক পণ্ডিতের মৃদু সন্দেহ থাকলেও রাবণের লঙ্কাই যে আজকের ভারতের দক্ষিণে প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কা, তাও প্রতিষ্ঠিত। তাছাড়া, ভারত হোক বা শ্রীলঙ্কা, বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে অজস্র ঐতিহাসিক নিদর্শন ও তাদের ঘিরে গড়ে ওঠা জনশ্রুতি রামায়ণকে ইতিহাস হিসেবে গ্রহণ করার পক্ষেই সওয়াল করে। কিন্তু ইতিহাসও কি এত পরস্পর-বিরোধী হয়? হ্যাঁ, ইতিহাসের কোনো একটি ঘটনার বিভিন্ন ব্যাখ্যা থাকতে পারে। যেমন, রামের লঙ্কা আক্রমণের মূল কারণ নিয়ে আমাদের দেশেই পাশাপাশি দু'টি ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। উত্তর ভারতে অধিক জনপ্রিয় মতটি হলো, রাবণই এর জন্য দায়ী। তিনি যদি সীতাহরণ না-করতেন, তাহলে রাম কখনোই লঙ্কা আক্রমণ করতেন না। কিন্তু দক্ষিণ ভারতে কিন্তু আরও একটি ধারণা প্রচলিত, এবং জনমনে সেটি বেশ প্রিয় । সেই ব্যাখ্যায় লঙ্কাকাণ্ডের জন্য রামকেই মূলত দায়ী করে বলা হয়, তিনি অনুজ লক্ষ্মণের সঙ্গে শূর্পনখাকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা তো করলেনই, এমনকি লক্ষ্মণ যখন শূর্পনখার নাক ও কান (কোনো-কোনো বর্ণনায় স্তনও) কেটে দিলেন, তখনও বাধা দিলেন না! ছোটো বোনের এমন অপমান-লাঞ্ছনা ও শারীরিক নিগ্রহের পরে কোনো প্রবল পরাক্রমী বড়ো ভাইয়ের প্রতিশোধস্পৃহা যেভাবে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে, রাবণের সীতাহরণ তারই ফল। শ্রীলঙ্কার মানুষও এই মতেই বিশ্বাসী। এই মতান্তরও কি আর্য ও দ্রাবিড় সংস্কৃতির সেই চিরাচরিত বিরোধাভাস? এতটা সরলীকরণ বোধহয় না-করলেও চলে! কেন, সে-কথায় পরে আসছি। কিন্তু এ তো গেল একটি ঘটনা নিয়ে বিপরীতমুখী ব্যাখ্যার কথা। কিন্তু রামায়ণে এক-একটি ঘটনা নিয়েই বহু অসামঞ্জস্য আছে, যা এই মহাকাব্যের প্রকৃত ইতিহাস বলে স্বীকৃতি পাওয়ার প্রধান অন্তরায়।

তাহলে রামায়ণকে কি শুধুই রূপকথা হিসেবেই পড়া উচিত? এই প্রশ্নের উত্তর সোজাসুজি 'হ্যাঁ' হলেই স্বস্তিদায়ক হতে পারতো। কারণ, এই মহাকাব্যের পাতায়-পাতায় অজস্র অলৌকিক ঘটনার সমাবেশ পাঠককে তেমন ইঙ্গিতই দেয়। রাবণের দশটি মাথার উল্লেখ, পুষ্পক নামক আকাশযানের বর্ণনা, মেঘের আড়ালে লুকিয়ে ইন্দ্রজিতের যুদ্ধ, সীতার অগ্নিপরীক্ষা ও পাতালপ্রবেশ, মানুষের মতো কথা-বলা এবং রাজনীতি ও রণকৌশলে পটু বানর (বালী, সুগ্রীব, হনুমান, অঙ্গদ প্রমুখ), ভালুক (জাম্বুবান) ইত্যাদির উপস্থিতি এবং আরও অনেক অলৌকিকের ঘনঘটা রামায়ণকে একটি রূপকথা হিসেবেই সীমাবদ্ধ করে রাখতে পারতো। কিন্তু ওই যে আগেই বলেছি, পরিচিত ও ইতিহাস-স্বীকৃত স্থাননাম, অজস্র নিদর্শনের উপস্থিতি এবং অঞ্চলভেদে যুগ-যুগ ধরে চলে আসা অসংখ্য লোকগাথা-উপকথাও তো রামায়ণকে নিয়ে আছে। নেহাত রূপকথা হলে তার এই ব্যাপ্তি কিন্তু অসম্ভব ছিল।

অতএব রামায়ণ নামক মহাকাব্যটি কখনোই শুধুমাত্র রূপকথা নয়। রামায়ণে ইতিহাসও জড়িয়ে আছে। তবে সেই ইতিহাসের প্রতি নিষ্ঠ থাকতে হলে আমাদের তার রূপকথা-সুলভ অলৌকিকতার চাদর সরিয়েই মহাকাব্যটি পড়তে হবে। কারণ, ইতিহাসের ব্যাখ্যা বিভিন্ন হতে পারে, কিন্তু ইতিহাস ও অলৌকিকতা একত্রে অবস্থান করতে পারে না! এতদিনে বহু ঐতিহাসিক, নৃতাত্ত্বিক, সমাজতাত্ত্বিক শাস্ত্রজ্ঞরা দেখিয়েছেন যে, রামায়ণের অলৌকিক ঘটনাবলি আসলে সাহিত্যের অ্যালেগোরি ও মেটাফর নামক অলঙ্কার হিসেবে ব্যবহৃত। জিজ্ঞাসু আধুনিক পাঠককে তাই সেইসব রূপক, উপমা ও বর্ণনার পাঠোদ্ধার করেই রামায়ণ পড়তে হবে। রামায়ণকে তাই কিছুটা ইতিহাস-আশ্রিত মহাকাব্য বলা যায়, যাতে স্থান ও কালভেদে বিভিন্ন কিংবদন্তি (ব্যক্তি ও প্রচলিত কাহিনি---উভয় অর্থেই) জড়িয়ে আছে। তবেই রামায়ণের নিরপেক্ষ পাঠ সম্ভব।

এই দীর্ঘ গৌরচন্দ্রিকার প্রয়োজন হলো, আধুনিক যুগের একজন মুক্তচিন্তক পাঠকের ঠিক কীভাবে রামায়ণকে দেখা উচিত, তার যথাযথ ভাবনার জায়গায় পৌঁছনোর জন্য। বিশেষ করে, আজকের অস্থির সময়ে যখন রামায়ণকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার ও পাল্টা-ব্যবহার করা হয়; যখন কোনো রাজনৈতিক শক্তি রামনবমীতে সশস্ত্র মিছিল নামায় রাস্তায়, আর তাদের বিরোধিতায় অন্য একটি রাজনৈতিক শক্তি পাল্টা-মিছিল করে ও ঘটা করে হনুমানজয়ন্তী পালন করে, তখন মহাকাব্যটির মুক্তপাঠের পক্ষে না-দাঁড়িয়ে উপায় থাকে না।

এবার দেখা যাক, রামায়ণ আসলে কী? রামায়ণ=রাম+অয়ণ। প্রসঙ্গত, 'অয়ন' শব্দটির অর্থ যাত্রা বা অগ্রগতি হলেও, 'অয়ণ' একটি অর্থহীন শব্দ। আসলে সংস্কৃত ব্যাকরণে সন্ধির নিয়ম অনুসারে 'রামায়ন' না-হয়ে 'রামায়ণ' হয়েছে। তাহলে 'রামায়ণ' শব্দটির অর্থ রামের যাত্রা বা জীবনপথের গতিমুখ। অর্থাৎ, রামের জীবন যেমন-যেমন এগোবে, রামায়ণের কাহিনিও তেমন এগোতে থাকবে। এখানে রামই মুখ্য, আর সবাই গৌণ; ক্ষেত্রবিশেষে অপ্রয়োজনীয়ও বটে! রামায়ণ নিয়ে এই অভিযোগ বহুদিনের যে, এই মহাকাব্যে রাম ছাড়া আর কোনো চরিত্রকেই যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। অথচ বিভিন্ন সময়ে কাহিনির গতিপথ নির্ধারণে লক্ষ্মণ, ভরত, ঊর্মিলা, শূর্পনখা, বিভীষণ, কুম্ভকর্ণ, মেঘনাদ, মন্দোদরী---কারও গুরুত্বই কম ছিল না। এঁদের কথা ছেড়ে দিন, কাহিনির নায়িকা সীতা এবং প্রধান বিপ্রতীপ চরিত্র রাবণও কি উপযুক্ত গুরুত্ব পেয়েছেন? নিরপেক্ষ বিচার বলবে, না। এ-নিয়ে আলোচনা-সমালোচনাও কিছু কম হয়নি। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ 'কাব্যে উপেক্ষিতা' নামক বিখ্যাত প্রবন্ধে রামায়ণে ঊর্মিলার যথোচিত মর্যাদা না-পাওয়া নিয়ে আক্ষেপ করেছিলেন। বিশেষত, সীতার দৃষ্টিকোণ থেকে রামায়ণকে দেখার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে অনেক আধুনিক বিশেষজ্ঞই কথা বলেছেন। এই প্রসঙ্গে আমাদের হয়তো মনে পড়বে, মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যেই সীতার দৃষ্টিকোণ থেকে রামায়ণ লিখেছিলেন আজকের বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জের কবি চন্দ্রাবতী, যিনি 'মনসামঙ্গল কাব্য'-এর রচয়িতা বংশীদাস ভট্টাচার্যের কন্যা। কিন্তু কালক্রমে আত্মবিস্মৃত বাঙালি চন্দ্রাবতীর রামায়ণকে সহজেই ভুলে যেতে পেরেছে! সাম্প্রতিক অতীতে 'সীতায়ন' লিখে মল্লিকা সেনগুপ্ত আবার সেই বিকল্প দৃষ্টিকোণের দিকে আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছিলেন, ঠিক যে-কাজ তেলুগু সাহিত্যে করেছেন পি ললিতাকুমারী। উগ্র পুরুষতান্ত্রিকতার যে-উপস্থিতি রামায়ণের পাতায়-পাতায়, তার বিপরীতে এইরকম বিকল্প ভাষ্যগুলির মাধ্যমেই একধরনের ভারসাম্য তৈরি হয় ও মুক্তপাঠের আবহ সৃষ্টি করে। পাশাপাশি একথাও বলার যে, রামায়ণ যেহেতু রামের 'অয়ন', তাই বাল্মীকির কাব্য বা তাঁকে অনুসরণ করে পরবর্তী সময়ে লেখা কাব্যগুলিতে রামেরই সর্বাধিক গুরুত্ব পাওয়া স্বাভাবিক। একই সঙ্গে একথাও মনে রাখার যে, রামায়ণের অন্য সব রচয়িতাই যে বাল্মীকিকে অন্ধ-অনুসরণ করেছেন, তাও নয়। বরং অনেকেই মহাকাব্যের পার্শ্বকাহিনি, স্থানীয় লোককথা, জনশ্রুতি ইত্যাদি উপাদানও গ্রহণ করেছেন।

তাহলে রামায়ণ আমরা কীভাবে পড়বো? বাল্মীকি-নির্দেশিত মেইনস্ট্রিম রামকাহিনিতে সীমাবদ্ধ থাকবো, নাকি স্বাধীন-পাঠের অভ্যাসে রামায়ণের অন্যান্য নির্ণায়ক চরিত্রগুলির আলো-আঁধারি বোঝার চেষ্টা করবো? যদি পরেরটিকে বেছে নেওয়া হয়, তবে আমাদের সামনে খুলে যাবে যুক্তি-তর্ক ও চিন্তার এক আশ্চর্য উজ্জ্বল জগৎ। বিশেষত, পরাজিত-পক্ষের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রগুলিকে প্রাপ্য গুরুত্ব দিয়ে দেখা এখানে জরুরি। প্রসঙ্গত, আমরা জানি, ইতিহাস চিরকাল বিজয়ীদের দ্বারা লেখা হয়। এমনকি, তারা যদি অন্যায়পথে সেই যুদ্ধ জেতে, তবুও তারাই শেষকথা বলার অধিকারী! পরাজিতদের কোনো বক্তব্য সেখানে ঠাঁই পায় না। ইতিহাসে পরাজিতদের আমরা সেভাবেই দেখি, যেভাবে বিজয়ীরা তাদের দেখাতে চায়। আপাদমস্তক সুদর্শন-সুপুরুষ রাবণকে যেভাবে  শিশুপাঠ্য কমিকস থেকে শুরু করে দশেরায় পোড়ানোর জন্য বিশালকায় দাহ্য প্রতিকৃতি পর্যন্ত ভয়ানক-বিকটদর্শন করে দেখানো হয়, অন্যান্য গুরুতর উদাহরণের কথা আপাতত ছেড়ে দিয়ে, সেটুকুই মনে রাখা যাক। রামায়ণকে ইতিহাস-আশ্রিত মানতে হলে তাই একথাও মেনে নিতে হবে যে, তা আসলে মুদ্রার একপিঠের গল্প। অপর পিঠের কাহিনি বলবে কে? এই প্রসঙ্গে একটি বিখ্যাত আফ্রিকান প্রবাদ মনে পড়ে গেল: 'Until the lion learns how to write, every story will glorify the hunter.' আমাদের স্কুল-বয়সে আমরা মাইকেল মধুসূদনের 'মেঘনাদবধ কাব্য'-এর অংশ পড়েছিলাম পাঠ্যবইয়ে। শুধু এই একটি রচনা দিয়েই মাইকেল বাংলা সাহিত্যকে মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে নিয়ে এসেছিলেন। মুদ্রার অন্যপিঠের গল্প সেই প্রথম আমাদের শোনা। কিন্তু কাব্যগুণে অনন্য-অসাধারণ এই মহাকবিতা যেন বিপরীতে দাঁড়িয়েও একদিক থেকে মূলধারার রামায়ণের মতোই। বাল্মীকি ও তাঁর অনুসারীরা যেমন রামবন্দনায় গদগদ, রাবণ-মেঘনাদের ঔজ্জ্বল্যে মাইকেল ততটাই আপ্লুত। অর্থাৎ, নিরপেক্ষ ভারসাম্যযুক্ত পাঠের সুযোগ সেখানেও নেই। সৌভাগ্যের কথা, প্রচলিত মহাকাব্যকে ভিন্ন আঙ্গিকে দেখার চেষ্টা সেখানেই থেমে যায়নি। সাম্প্রতিক সময়ে রাবণের দৃষ্টিকোণ থেকে কাহিনিটিকে ব্যাখ্যার চেষ্টাও হয়েছে বেশ কিছু। অবশ্য সেই ব্যাখ্যাগুলি যে সবক্ষেত্রেই 'রাবণায়ন' বলে চিহ্নিত হচ্ছে, তা নয়। শুধু রাবণ নয়, নির্ণায়ক পার্শ্বচরিত্রগুলিকেও বিশ্লেষণের প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছে বিকল্প পাঠের তাগিদে। তাই মুক্তচিন্তার কাছে সৎ থেকে মহাকাব্যকে পরাজিত-উপেক্ষিতদের দিক থেকে জেনে নেওয়ার জন্য এইসব প্রসঙ্গের অবতারণা।

 (ক্রমশ)

bhashaweb@gmail.com


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.