শব্দের মিছিলের "একমুঠো প্রলাপ" বিভাগটা আমাদের সুযোগ করে দেয়, ভালোলাগার আর ভালোবাসার মানুষগুলোর সামনে অম্লানবদনে উপস্হিত হয়ে তাঁদের ভাবনাচিন্তা কাজকর্মের ঝলক অনুরাগী এবং সমঝদারদের দরবারে এনে ফেলার । আমাদের অন্যতম উদ্দেশ্য বিপজ্জনকভাবে লো প্রোফাইল মেনটেইন করা এইসব ছুপারুস্তম হাই কোয়ালিটির লোকজনকে সরাসরি পাঠকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া, যারা দুর্দান্ত লিখছে পড়ছে ভাঙছে গড়ছে এবং চুপচাপ শিল্পকলার নানা শাখায় কাজ করে যাচ্ছে, নিরলস সমৃদ্ধ করে যাচ্ছে সাহিত্য সংস্কৃতির অঙ্গনে । আমাদের এবারের অতিথি কবি ঔপন্যাসিক প্রাবন্ধিক কলাম লেখিকা সুরসিকা তুষ্টি ভট্টাচার্য । 'শব্দের মিছিল' এর তরফ থেকে অফুরান ভালোবাসা শুভেচ্ছা রইল তুষ্টির জন্য ।
শর্মিষ্ঠা ঘোষ - তুষ্টি একটি জলজ্যাম্ত অলরাউন্ডার। উপন্যাস লিখছে , পাঁচফোড়নের পঞ্চ প্রকরণ লিখছে , অনুবাদ করছে , কলাম লিখছে , ফেসবুক স্ট্যাটাস লিখছে , সিরিয়াস কবিতা লিখছে । কোথায় পাও বস্ এত এনার্জি ?
তুষ্টি ভট্টাচার্য - হ্যাঁ, এনার্জির ব্যাপারটা নিয়ে এইমাত্র ভাবতে শুরু করলাম। সত্যি বলতে কী, লেখার তাড়না এলে, সেটা তক্ষুনি লিখে ফেলতেই হবে, এমন এক তীব্র অস্বস্তি আমার ভেতরে কামড়াকামড়ি করতে থাকে। আমাকে শান্তি দেয় না, না লেখা পর্যন্ত আমার নিস্তার নেই, এটুকু বুঝি। তাই যেভাবেই হোক, সেই লেখাটা লিখে ফেলি। এনার্জি নিশ্চই লাগে, কিন্তু সেভাবে তাকে নিয়ে ভাবিনি কখনও আলাদা করে। ওই তীব্রতাই আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নেয়। সারাদিনে এক থেকে দুঘন্টার বেশি লেখার সময় পাই না, তার মধ্যেই আমাকে এত কিছু লিখতে হয়। আপনাআপনি ওই তাড়না আমার লেখার স্পীড বাড়িয়ে দেয়, এটুকু বলতে পারি। একটা ভয়ঙ্কর লেখার খিদে টের পাই সবসময়ে। উপন্যাস লিখলাম এ বছরই প্রথম। গত দু/তিন বছর ধরে লিখব লিখব করেও কিছুটা লিখে আবার ছেড়ে দিয়েছি। কবিতা তো আছেই, কিছু গল্প, প্রবন্ধও লেখা হল। আর উপন্যাসের পর একটা নভেলেট।
শর্মিষ্ঠা ঘোষ - এই ফেসবুক পাড়ায় থেকে 'আমি তুমি প্রেম প্রেম মার্কা' লেখার রমরমা বাজারে সিরিয়াস লেখার জন্য নিজেকে মোটিভেট কর কি করে ?
তুষ্টি ভট্টাচার্য - আবারও বলি, আমার তাড়নার কথাই। যে আমাকে লেখায়। কোন অনুপ্রেরণা বা আধার আমার লাগে না। জীবনে ভীষণ রকম ভাবে একটাই অভাব থেকে যাবে আমার, তুমি যেমন বলেছ, তেমন ‘আমি তুমি প্রেম প্রেম মার্কা’ কবিতা লিখতে পারলাম না বলে। চেষ্টাও করেছি, বিশ্বাস কর, এত খারাপ হয়েছে, যে সে লেখা তখনই বাতিল করে দিয়েছি। আর ফেসবুক পাড়াই আমার লেখক সত্তার জন্মদাতা। লিখতাম হয়ত আগে থেকেই নিজের খাতায়, এখানে এসে একটা খোলা হাওয়ার মত পরিবেশ পেয়েছিলাম প্রাথমিক ভাবে। সেও আজ পাঁচ/ছয় বছর আগের কথা। এখান থেকেই যোগাযোগ হয়ে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হতে থাকল। ফলে এই ফেসবুক পাড়ার অবদান আমার জীবনে অনেকটাই। আর সিরিয়াসই বা শুধু কেন, অনেক হাল্কা লেখা, রম্য ধরনের লেখাও আমি লিখেছি। তবে সব কবিতাই সিরিয়াস আর সব কবিতাই প্রেমের বলে আমি মনে করি। তফাৎ হয় লেখার বিষয় বা স্টাইলে। আমি আমার মত লিখি, এইমাত্র। বাজার রমরম করবেই, আমাদের সেই বাজারেই সব্জী কিনতে, মাছ,মাংস বেচতে/কিনতে যেতে হবে, এটা ভুললে তো চলবে না! বাজারকে অস্বীকার করার চেষ্টা করি না যেমন, তেমন নিজের ক্ষেত্রে, তোমার কথিত মোটিভেশন বা আমার তাড়না এই রকম লেখা আমাকে দিয়ে লেখায় না।
শর্মিষ্ঠা ঘোষ - প্রথম পছন্দ কোনটা , পদ্য না গদ্য ? সাহিত্যে গুরুঠাকুর মান কাউকে ?
তুষ্টি ভট্টাচার্য - পদ্য না বলে কবিতাই বলি, কেমন? কবিতা যদি আত্মা হয় আমার, গদ্য হল শরীর। কোনটাকেই আমি সেকেন্ড পজিশনে রাখতে পারি না। তবে কবিতা লিখলে বা এলে, সেই সময়ে গদ্য লিখি না। আর গদ্য লেখার সময়ে সেদিকেই মন দিই। এই ভাবে নিজেকে দুভাগ করে রেখেছি ওদের জন্য। অবশ্যই সাহিত্যের গুরুঠাকুর আমার আছেন একজন। তিনি হলেন জীবন। প্রতি মুহূর্তে আমাকে হাতে ধরে শিখিয়ে চলেছে, আমার ভুল শুধরে দিয়ে চলেছে। তবু কখনও বিরূপ হয়নি বা ছেড়ে যায়নি। আর আগেই বলেছি, এই ফেসবুক থেকেই আমার কবি/লেখকদের সঙ্গে চেনাজান হয়েছে। ব্যক্তিগত ভাবে কাউকেই আমি আগে থেকে চিনতাম না, বা কারুর বাড়ি বসে থেকে আমাকে শেখার কোন উপায় ছিল না। এখানে আমাকে সিনিয়রদের অনেকে বিভিন্ন রকম উপদেশ দিয়েছেন। মন দিয়ে শুনেছি। কিছু মেনেছি, কিছু মানিনি। প্রথমেই বলি, নিয়ম করে রোজ লিখতে বসার পরামর্শ দিয়েছিলেন সমরজিৎ সিংহ। ওই কথা আজও মেনে চলি। নাওয়া, খাওয়া, রোজকার কাজের মত, পুজো করার মত লেখার সামনে বসি রোজ। সে লেখা হোক বা নাই হোক। এরপরে ছন্দ শিখেছি বাংলাদেশের জুয়েল মাজহারের কাছে, এখানে মৃণাল বসু চৌধুরীর কাছে। মৃণালদাকে এখনো মজা করে ‘গুরুদেব’ বলে ডাকি। প্রবন্ধ লেখা, বড় লেখা বা উপন্যাস লেখার জন্য প্রথম তাগাদা দিয়েছিলেন মলয় রায়চৌধুরী। এছাড়াও যশোধরা রায় চৌধুরী, নিরুপম চক্রবর্তী আর বারীন ঘোষালের নাম উল্লেখ না করলে নিজের সঙ্গে মিথ্যাচার করা হবে। আম প্রিয় বারীনদা ছিলেন আমার আম-সখা। এই উপন্যাসটা এ বছরও লেখা হত না, যদি না সৌমনা দাশগুপ্ত আমাকে রীতিমত জোর করে লিখতে বসাতেন। এই নামগুলো শুনে নিশ্চই বুঝতে পেরেছ, লেখার জগতে এঁরা প্রত্যেকেই বিভিন্ন ঘরানার। প্রভাব পড়লেও লিখেছি কিন্তু নিজের মত করেই। এঁদের পরামর্শ, স্নেহ ও মৃদু বকুনিতে অনেকখানি স্পর্ধা বেড়েছে, অনেকখানি শুধরে গেছি। আর বন্ধুদের(যাদের মধ্যে নিজের বয়সী ও বয়সে অনেক ছোটরাও আছে)নাম উল্লেখ না করেই বলছি, কত ভাবে যে তারা আমায় সাহায্য করেছে, সে বলে বোঝাবার নয়। ঋণ রয়ে গেল অনেকটাই। জানি না, কতটা পেরেছি তাঁদের প্রত্যাশা পূরণ করতে... তবু লেগে আছি, এটুকুই।
শর্মিষ্ঠা ঘোষ - কবিতা সংকলনের নাম রেখেছ "ব্ল্যাক ফরেস্ট" । এটা কি সিম্বলিক ?
তুষ্টি ভট্টাচার্য - প্রথমেই বলি যেকোন শিরোনাম দেওয়ার ক্ষেত্রে আমি ভীষণ রকম তালকানা। আমার প্রথম বইয়ের নাম ছিল, ‘ভিজে যাওয়া গাছ’। এই নাম দিয়েছিলেন শ্যামল কান্তি দাস নিজেই। কারণ নাম ঠিক করে উঠতে পারিনি। তবে ‘সৃষ্টিসুখ’ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ব্ল্যাকফরেস্ট বইটির নাম দেওয়ার জন্য আমাকে দুমিনিটও ভাবতে হয়নি। তার কারণ আর কিছু না, ওই নামের পেস্ট্রি/আইসক্রিম আমার খুব পছন্দের। এমনকি এখনো কোন ছেলেধরা একটা ব্ল্যাকফরেস্টের লোভ দেখিয়ে আমাকে বস্তায় পুরে নিয়ে চলে যেতে পারবে অনায়াসেই। এমনিতেই এই ব্ল্যাকফরেস্ট সিরিজের লেখাগুলো ছিল খুব ডার্ক। আর জঙ্গল ছিল পটভূমিকায়। ফলে এক চান্সে ব্ল্যাকফরেস্ট নামটাই স্থির হয়ে যায়। সিম্বলিক বলতে পার সেই অর্থে।
শর্মিষ্ঠা ঘোষ - সাহিত্য পড়াশুনোর , চর্চার নাকি জন্মগত প্রতিভার বিষয় বলে মনে কর ?
তুষ্টি ভট্টাচার্য - একটা মিনিমাম লেবেলের প্রতিভাকেও যদি চর্চা আর জ্ঞানের বিভা দেওয়া যায়, তা শতগুণে প্রস্ফুটিত হয় বলে আমি মনে করি। প্রতিভা বেশি থাকলে তো কথাই নেই! প্রতিভা থাকল আর চর্চা করলে না, পড়াশুনো করলে না, তখন ওই প্রতিভার জোরে কিছুদিন চলা যায় বটে, তবে ফুরিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে অচিরেই। চর্চায় ছুরির ধার বাড়ে। আর ওই ছুরিটা হল সেই প্রতিভা, যার ধার বাড়াবে নাকি মর্চে পড়তে দেবে সেটা তোমার ব্যাপার। আর পড়াশুনো হল সেই মানুষটি, যে ধার দেয়।
শর্মিষ্ঠা ঘোষ - বাংলা কাব্য সাহিত্যের কি নিজস্বতা বলে কিছু আছে নাকি সব ঐ ঔপনিবেশিক আর গ্লোবাল প্রভাব ট্রভাব ?
তুষ্টি ভট্টাচার্য - প্রভাব এড়ানো কী এত সহজ! সে তুমি ঔপনিবেশিক বা গ্লোবাল, যাই বল না কেন, প্রভাব এড়ানো যায় না, আর উচিতও নয়। যেভাবে একটি ভাষা অন্য এক ভাষা থেকে জন্ম নেয়, আরও কিছু ভাষার শব্দ সেই নতুন ভাষায় এসে মিশে যায়, তবুও সেই নতুন ভাষাটি কিন্তু তার নিজস্ব নামেই থেকে যায়। নিজস্বতা তো নিশ্চই আছে। ছন্দের চার বৃত্তের কথা ভাব। আবার সেই ছন্দে লেখা আগের কবিতার সঙ্গে এখনকার কবিতার ভাষা আর শব্দের ব্যবহার অনেক বদলেছে। আধুনিক বাংলা শব্দের সঙ্গে, ইংরেজি, হিন্দি শব্দও এসে যাচ্ছে লেখায় অনায়াসেই। নিজস্বতা মানে স্ট্যাটিক হয়ে থাকা নয়। ভাষাই বল বা সাহিত্য, একেবারেই যদি তার আদি বা নিজস্ব ফর্মে থেকে যায়, সেই ভাষা বা সাহিত্যের এগিয়ে চলা আর হয়ে ওঠে না। যেভাবে সংস্কৃত ভাষার কথাই ধরা যাক, সেই ভাষা থেকে কতগুলো ভাষার জন্ম নিল, কিন্তু সেই ভাষা তার নিজস্ব জায়গা ছেড়ে একটুও বদলালো না। আর তাই কথ্য ভাষা তো দূর, লিখিত ভাষার ক্ষেত্রেও এখন সংস্কৃত পিছিয়ে গেছে অনেকটা। প্রভাব আসুক, সেই ইংরেজ আমল থেকে যেই বিদেশী সাহিত্যের বিপুল ভাণ্ডার আমাদের হাতে এল, বাংলা সাহিত্য বদলাতে থাকল এবং সমৃদ্ধও হল। যেমন যেমন আমরা আমাদের জীবন ছন্দ বদলেছি, সাহিত্যও বদেলেছে তালে তালে। শুধু নকল না হলেই ভাল। এটুকু আমার চাওয়া।
শর্মিষ্ঠা ঘোষ - ফেসবুক কবিতা সাহিত্যের কোন উপকার করছে নাকি বইমুখিতা কমে গিয়ে মান পড়ে যাচ্ছে ?
তুষ্টি ভট্টাচার্য - ফেসবুক একটা প্ল্যাটফর্ম মাত্র। খোলা খাতার মত। যা খুশি লিখে ফেলাই যায়। তাতে অবশ্য সাহিত্যের উপকার কিছু হয়নি বলেই আমার ধারণা। বইমুখিতা কমেছে ঠিকই। তবে অনলাইন পত্রিকা বল বা ডাউনলোড করে ফেলা বইয়ের পাঠক বেড়েছে। আগেই বলেছি, ফেসবুকে না এলে বোধহয় আমার লেখার দিগন্তটা এতখানি প্রসারিত হত না, আর আমার মত আরো অনেকেই রয়েছে এমন। কিন্তু চর্চা বা পড়াশুনো কিন্তু ফেসবুকের বাইরে বেরিয়েই করতে হয়। ফেসবুককে শুধু যোগাযোগের মাধ্যম আর নিজের সাহিত্য কীর্তির প্রচারে কাজে লাগানো যেতে পারে। নতুন লিখতে এসে ফেসবুককে নিজের লেখার খাতা করে নিয়েছে যারা, তাদের উদ্দেশ্যে বলি, মকশো কিন্তু নিজের খাতাতেই করা ভাল। একটু হাত পাকিয়ে নিয়ে মাঠে নাম। এখন সত্যিই কিন্তু লেখক/কবি হওয়া খুব সহজ হয়ে গেছে ফেসবুকের প্রভাবে। আক্ষরিক অর্থেই এক মুক্তমঞ্চ, যেখানে উঠে ‘শো’ করাটা খুব সহজ। কিন্তু উইংসের আড়াল বা গ্রীনরুমের কথা ভুললে তো চলবে না!
শর্মিষ্ঠা ঘোষ - বর্তমানে নেটের দৌলতে পাঠক লেখকের সরাসরি মেলবন্ধন কি সাহিত্যিকদের রোমান্টিক ছবি টবি সব মুছে দিচ্ছে না ? তোমার কি মনে হয় ?
তুষ্টি ভট্টাচার্য - নেট জমানার আগেও লেখক/পাঠক জমায়েত হত বিভিন্ন মেলা বা অনুষ্ঠানে। লেখকদের বাড়ি গিয়ে কথা বলার চল তো এখনো আছে। তবে রাত দেড়টার সময়েও প্রাইভেসির পরোয়া না করে একজন লেখকের সঙ্গে একজন পাঠকের কথা বলা সম্ভব, শুধু এই ফেসবুকেরই দৌলতে। একজন রোমান্টিক কবিও কিন্তু বাজারে গিয়ে দরদাম করেন, মাছের কানকো উল্টে দেখে নেন, লাল আছে কিনা! এই চিত্র গুটিকয়েক পাঠক ছাড়া আর কেই বা দেখেছে! এফবিতেও কিন্তু এই চিত্রটি দেখা সম্ভব নয়। সেই কবির সাজানো গুছনো কিছু লিখিত শব্দ, নিদেন পক্ষে ‘লাইভ’ হলে তাঁর কন্ঠ, এটুকুই। এতে রোমান্টিকতার অভাব হয় না মোটেই। বরং লেখক/কবিদের একটু বেশি সুবিধেই হয়। প্রচারের বাইরেও তাঁরা এখানে তাঁদের লেখা সম্বন্ধে ইন্সট্যান্ট রিয়্যাকশন পেয়ে যান।
শর্মিষ্ঠা ঘোষ - দল বল যোগাযোগ পুরস্কার প্রতিষ্ঠান এসব পরিহার করা কি আদতে লিটিল ম্যাগাজিনের হিপোক্রিসি ? লিটলম্যাগও কি ঘুরিয়ে সেই গোষ্ঠীতন্ত্রেরই অনুসারী নয় ?
তুষ্টি ভট্টাচার্য - এই প্রশ্নটা এখন ভীষণ ট্রেন্ডি। প্রথম লিটল ম্যাগাজিন করতে আসা একদল তরুণের মনে অনেক স্বপ্ন থাকে। ধারদেনা করে, নিজেরা গায়েগতরে খেটে একটা পত্রিকা প্রকাশ নাহয় করা গেল। কিন্তু তারপর সেই পত্রিকা বিক্রি না হলে, ধারদেনা পিঠে বোঝার মত চেপে বসলে, তারা আর কতদিন সেই পত্রিকাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে? আশাহত, স্বপ্নহত একদল যুবা তখন বাধ্য হয়েই অনেকসময়ে গোষ্ঠির ছায়ায় আসে, নইলে বড় প্রতিষ্ঠানের কাছে বিকিয়ে যায়। তবে চিত্রটা এখন অনেক বদলেছে। বইমেলায় লিটল ম্যাগ প্যাভিলিয়নে কয়েক ঘন্টা খেয়াল করলেই বোঝা যায়, এখন লিটল ম্যাগের বিক্রি মোটামুটি ভালই। টুকটাক বিজ্ঞাপনও জুটে যাচ্ছে তাদের। লাভজনক কিছু না হলেও ধারের বোঝা আর মাথায় নিতে হচ্ছে না। তার কারণ আর কিছুই না, ভাল লেখকরা এখন এখানে লিখছেন। মান উন্নত হয়েছে, বিভিন্ন রকম এক্সপেরিমেন্টাল লেখা পাওয়া যাচ্ছে, যা কিনা বাজার চলতি পত্রিকাগুলোয় পাওয়া যায় না। এভাবেই একেকটি লিটল ম্যাগ এখন ধীরে ধীরে ‘দাঁড়িয়ে’ যাচ্ছে। অর্থাৎ কিনা নিজের পায়ে ভর দিয়ে সেও বড় হয়ে যাচ্ছে। এমনকি একেকজন তো সামান্য হলেও লেখকদের সাম্মানিক দিচ্ছে। ছোট পত্রিকার পরিসর বাড়লেই যদি মনে করা হয় যে, সে একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে, এ বড় ভুল ধারণা। আর প্রতিষ্ঠান হতে অসুবিধেই কীসের? হ্যাঁ, পরিসর বাড়লে যোগাযোগ বাড়ছে, পুরস্কারও হয়ত পেয়ে যাচ্ছে কেউ কেউ। এতে তো হিপোক্রিসির কিছু আমি দেখি না। একজন না-খেতে পাওয়া মানুষ যদি নিজের ইচ্ছেশক্তি আর কর্মদক্ষতার জোরে অর্থবান হয়ে, রোজ দুবেলা ভাল মন্দ খায়, সেটা কি খুব দোষের? ছোট তো একদিন না একদিন পায়ে পায়ে বড় হয়ে ওঠেই, তাই না? আর দেখ, গোষ্ঠীতন্ত্র নতুন কিছু না, আগেও ছিল, এখনো আছে। আবার গোষ্ঠীর বাইরেও থেকে যাওয়া কেউ কেউ আগেও ছিল, এখনো আছে। সমস্ত সিস্টেমেই এটা হয়ে আসছে, পরেও হবে। ছোট, মেজ, সেজ, বড় সব রকম প্রতিষ্ঠানেই গোষ্ঠী রয়ে গেছে। গোষ্ঠীর বাইরে একা একা কিছু মানুষই বল বা পত্রিকা, তাদের নিজের মত করে ছিল, আছেও।
শর্মিষ্ঠা ঘোষ - সার্থক লেখক হতে গেলে কি সমাজ বিচ্ছিন্ন জীবন কাটাতে হয় ?
তুষ্টি ভট্টাচার্য - এরকম ভাবনা আমি একেবারেই মানি না। এরকম কোন ধারণা নিয়ে কেউ যদি লিখতে আসে, তার লেখার সার্থকতা কতদূর, সে সময়ই বলবে। যে কোন সৃষ্টি যদি, সমাজ বিচ্ছিন্ন হয়, সময়ের পরিসরকে ধরতে পারবে না কোনমতেই। সমাজ অর্থাৎ সম্পর্ক, তাদের টানাপোড়েন আমাদের হয়ত অনেকটা সময় নিয়ে চলে যায়, আপাতভাবে মনে হতে পারে, এই সমস্ত সাংসারিক কাজে কত সময় নষ্ট হল, ভাবনা মাঠে মারা গেল, লেখার সময় পাওয়া গেল না, ইত্যাদি। কিন্তু একবার চোখ বুজে ভাবা যাক, একটি মানুষ একেবারে একা, তার চারপাশে আর কেউ নেই, সে লিখবে কী নিয়ে? প্রকৃতি নাহয় রয়েছে মানলাম, কিন্তু মানুষ অর্থাৎ চরিত্র কই? প্রকৃতির সৌন্দর্য, তার ভয়াল রূপ, মানুষ আর তার বিভিন্ন আঙ্গিক, এইসমস্ত কিছুই তো আমাদের সাহিত্যের উপাদান। সংঘর্ষের মধ্যে, বিবাদের মধ্যে, প্রেমের ভেতরে, মায়ার ভেতরে জড়িয়েই একটা লেখা স্বয়ং সম্পূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। আর লেখকের অভিজ্ঞতাই তাকে দিয়ে লেখায়। ফলে সমাজ বিচ্ছিন্ন থাকা মোটেই যুক্তিগ্রাহ্য নয়।
সুচিন্তিত মতামত দিন