মাঝরাতের নিস্তব্ধতা খান খান করে গুলির শব্দ। ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম আমি আর পিকু। হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছি। এটা গুলিরই আওয়াজ। আবার আরেকটা, একটু দূর থেকে। তাড়াতাড়ি করে মশাড়ি থেকে বেরিয়ে এক ছুটে নীচে। মশাড়িতে শোয়ার অভ্যেস নেই, তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে জড়িয়ে মড়িয়ে যাচ্ছেতাই অবস্থা। দোতলা থেকে নেমে দেখি নীচের সমস্ত আলো জ্বালানো, দাদু নেই ঘরে, দাদুর স্কুটার ও নেই। এলসা বাঘের মত গর্জন করে বাড়ির চারিপাশে চক্কর দিচ্ছে। আমরা বর বউ দুজনেই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এত রাত্তিরে রাইফেল নিয়ে কাদের ধাওয়া করল দাদু? আমি এরই ফাঁকে দেখে নিয়েছি দাদুর ঘরে রাইফেলটাও নেই। কি করব? এত রাতে মামাকে ফোন করে ঘুম ভাঙাবো? নাহ, আরেকটু অপেক্ষা করে দেখি, তারপর ফোনটা করব।
দেশের জমিজমা বিক্রি হওয়ায় একসময় হাতে প্রচুর টাকা পেয়েছিল দাদু। সেই টাকায় উত্তরবঙ্গের নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনের পিছন দিকে প্রায় জলের দরে প্রচুর জমি কিনে রেখেছিল। প্রচুর মানে প্রচুর। তখন এ জায়গা পাণ্ডববর্জিত। রিটায়ারমেন্টের পরে শহরের কোলাহল ছেড়ে এই নিরিবিলিতে এসে বাস করবে বুড়ো বুড়িতে, এই ছিল প্ল্যান। ছেলে মেয়েদেরও ছুটিতে বেড়াতে আসার একটা জায়গা হবে। কলকাতা পুলিশের উচ্চতম পদ থেকে অবসরের পর সত্যি সত্যিই দিদুকে নিয়ে দাদু এখানে চলে আসে। আমরা তখন অনেক ছোট। খুব সাধারণ, ছোট্ট দোতলা একটা বাড়ি। দাদুর মায়ের নামে নাম রাখে 'চারু ভিলা। এই চারু ভিলাকে বাড়ি কম, ফার্মহাউসই বেশি বলা চলে। বাড়ির বাউন্ডারির মধ্যে তিনটে পুকুর, তাতে সবসময় মাছ কিলবিল করছে। আমরা এলে এই পুকুরেরই মাছ ধরে খাওয়া হয়। আর হেন ফুল বা ফলের গাছ নেই, যে দাদুর বাড়িতে নেই। এক নয়, একাধিক করে। এছাড়াও আছে এক ঝাঁক সাদা পায়রা, তাদের জন্য আবার দাদু গাছে গাছে ঘর করে দিয়েছে। আর আছে এলসা। একেবারে পুলিশি কুকুর, দাদু নিজের হাতে ট্রেন করেছে। বাড়ির চারপাশ ধু ধু। দাদুর গাদা গাদা ধানজমি আর বাঁশ বাগান পেরিয়ে সেই দূরে চক্রবর্তী দাদুর মাছের ভেরি। ইনিও দাদুর মত আরেক পাগল। এছাড়া আর এই চৌহদ্দিতে সভ্য ভদ্র শহুরে মানুষ বিশেষ আর কেউ নেই।
দূরে দূরে কিছু আদিবাসী বস্তি আছে। ওই বস্তি থেকেই দীর্ঘ এতবছর ধরে এবাড়িতে কাজ করে আসছে প্রমিলা দি। আর দিদু চলে যাওয়ার পর থেকে তো এখন প্রমিলাদির হাতেই পুরো সংসারের ভার। তবু কিছুতেই মামার কাছে গিয়ে শিলিগুড়ি শহরের বাড়িতে থাকবে না দাদু। এই খোলা জায়গা ছেড়ে দাদুর প্রাণ হাঁপিয়ে ওঠে। এই ৭৫ বছর বয়সেও বুড়োর সাহসের কমতি নেই। নেহাত শরীর খারাপ হলে কটা দিন বাধ্য ছেলের মত মামার কাছে থাকে, একটু চাঙ্গা হলেই ফুরুত। কারুর তোয়াক্কা করার দরকার নেই। অটোয়ালা ঠিক করা আছে, ফোনে ডেকে নিলেই হল। প্রমিলাদিকেও ফোনে আগাম জানিয়ে দেয়। ব্যাস, আর কি।
পিকু অনেকক্ষণ ধরে উসখুস করছিল "তুমি এত নিশ্চিন্তে কি করে বসে আছো? একজন বয়স্ক মানুষ...." আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে বললাম " আমি আমার দাদুকে চিনি। তুমি নিশ্চিন্তে থাকো, দাদুর কিচ্ছু হবে না। দিব্যি অক্ষত দেহে, পারলে দু চারটেকে কেলিয়ে ফিরবে। তোমায় আজ সন্ধ্যেবেলা ক্যারামে কিরকম বলে বলে হারাচ্ছিল বলো? হুইস্কির পেগটা বোর্ডের এক কোনায় রেখে, চোখ কুঁচকে একের পর এক পারফেক্ট শটগুলো মারছিল। দাদুর এই স্পিরিটই আমাদের ভরসা"। "তবু একবার ফোন করো না?"
ফোন করে কোনো লাভ হল না। ফোন বাড়িতেই বাজছে। পিকু তো আর দাদুর সব ইতিহাস জানে না। রাত্তির বেলা ডিউটি করে ফিরছে। চোখের সামনে ছিনতাইবাজ দেখে তাড়া করেছে। ওদের ছোঁড়া গুলিতে ড্রাইভার আহত। একহাতে স্টিয়ারিং আরেক হাতে সার্ভিস রিভলভার নিয়ে তাদের তাড়া করে ধরেছে। সঠিক সময় অবশ্য ফোর্স এসে পৌঁছে গেছিল। একবার তো রাজনৈতিক দুষ্কৃতীদের ছোঁড়া বোমায় পা গ্যাংগ্রিন হয়ে প্রায় বাদ দেওয়ার অবস্থা হয়েছিল। ডাক্তারদের চিকিৎসা, দিদুর অক্লান্ত সেবা তো বটেই, দাদুর নিজের কলজের জোর কি কম ছিল?
দাদুর সততা আর নির্ভীকতার জন্য পুলিশমহল, মন্ত্রিমহল, আমলামহল সর্বত্র দেবেন্দ্রনাথ সেন আজও পরম শ্রদ্ধেয়। চাকরি করা কালীন 'হট হেডেড' বলে কিঞ্চিৎ বদনাম থাকলেও সবকিছু ছাপিয়ে গেছে দাদুর সততা আর সাহস। এই 'হট হেডডের' প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল দাদুরই মুখে শোনা এক গল্প। দাদু তখন নতুন নতুন জয়েন করেছে। ফোর্সে তখন অ্যাঙলো ইন্ডিয়ানদের সংখ্যাই বেশি। তারা কথায় কথায় ক্যাসুওয়ালি 'সন অফ আ বিচ' বলেই থাকে। কেউ গায়ে মাখে না, এটাই ওদের কালচার। দাদু কয়েকবার ওদের বারণ করেছিল। তা সত্বেও একদিন দাদুকে একদিন কেউ ওই সম্ভাষণ করায় দাদু ঘুসি মেরে তার নাক ফাটিয়ে দিয়েছিল। এই বুড়ো বয়সেও দাদুর রগচটামি একফোঁটাও কমেনি।
আরো কত গল্প বলতে লাগলাম পিকুকে। একবার রাতে সার্জেন্ট ক্লাবে ভরপুর হুইস্কি খেয়ে ফিরেছে। দাদু তখন ট্রাফিকে। পরদিন সকালে প্রধানমন্ত্রীর পাইলট। ডিউটিতে তো রিপোর্ট করেছে কিন্তু এদিকে হ্যাঙওভার তো কাটছে না। তারপর এক সিনিয়রের পরামর্শে আগেরদিন যা খেয়েছিল, সেই একই জিনিষের এক পেগ নিট মেরে দিয়ে শান্তি। এত ভালো পাইলটিং করেছিল দাদু সেদিন, যে প্রধানমন্ত্রী নিজে যেচে দাদুর তারিফ করেছিলেন। তারপর থেকে প্রধানমন্ত্রী কলকাতায় এলেই পাইলটিঙের দায়িত্ব পড়ত দাদুর। রিটায়ারমেন্টের পরেও একবার পুরী গিয়ে মেয়েদের সঙ্গে অভব্য আচরণ করার জন্য দুই উড়েকে বেধড়ক পিটিয়েছিল।
পিকুকে দাদুর এইসব গল্প শোনানোর মাঝে আমার মোবাইলটা বাজল। ছুটে গিয়ে ধরলাম। দেখলাম মামা । চিরাচরিত ঠান্ডা, বিন্দাস গলায় বলল "চাপ নিস না, বাবা ঠিক আছে। চক্রবর্তী কাকুর বাড়িতে ডাকাত পড়েছিল। উনি বাবাকে ফোন করেন আর বাবা তাই ডাকাত ধরতে বেরিয়ে পড়ে। দুটোকে থানায় পুড়েছে, বাকিগুলো পালিয়েছে। উনি এখন থানায় বসে পরমানন্দে ইনভেস্টিগেশনের তদারকি করছেন। আর সেন বাবুকে পেয়ে তো থানার বড় বাবুও আহ্লাদে আটখানা। তুমুল খাতিরদারি চলছে। যা তোরা এবার ঘুমোতে যা।"
দোতলায় আর উঠলাম না। আলোগুলো নিভিয়ে একতলাতেই শুয়ে পড়লাম। দাদুর "বেটি ওঠ, বেটি ওঠ' ডাকে ঘুম ভাঙল। চেয়ে দেখি অনেকক্ষণ সকাল হয়ে গেছে। দাদু শহর থেকে একগাদা সিঙ্গারা, কচুড়ি, জিলিপি এনে হাজির করে বলছে "নে নে, তাড়াতাড়ি ব্রাশ কর"। হাসি হাসি মুখে ঘুম থেকে উঠে , দাদুকে জড়িয়ে ওই বাসি মুখেই দাদুর গালে চক্কাস করে একটা চুমু খেয়ে বললাম "প্রাউড অফ ইউ দাদু"।
piyaliganguli.phoenix@gmail.com
সুচিন্তিত মতামত দিন