ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

স্বাধীনতার সত্তর বছর - বিনোদনের সাত দশক     দ্বিতীয় পর্ব – সাত দশকের বাংলা গান
আগের পর্বে সাত দশকের থিয়েটারের কথা বলেছি । এই পর্বে বলি গানের কথা – সাত দশকের বাংলা গান । বলে রাখি, গান বলতে আমি বুঝতে চেয়েছি গান যখন বিনোদন সামগ্রী । শাস্ত্রীয় গান বা গায়ন আমি এই আলোচনায় রাখিনি । আগের পর্বে বলেছি স্বাধীনতা-উত্তর পর্বে বাংলার থিয়েটারে নতুণ প্রাণসঞ্চার হয়েছিল, বাংলা থিয়েটারের অতুল ঐশ্বর্য ।

বাংলা গানের বিষয়টি কিন্তু তেমন নয় । স্বাধীনতার কাছে তার কিছু পাওয়ার ছিলনা, দেশের স্বাধীনতার আগেই সে স্বাধীন । কারণ বাংলা গানের ছিল রবীন্দ্রনাথ, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত, দ্বিজেন্দ্রলাল আর নজরুল ইসলাম । তাদের গান আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের চারণমন্ত্র হয়েছিল, আমরা গেয়েছি সে গান । বিপণণ সামগ্রী হয়ে ওঠার পর নিজের শক্তি অর্জনের জন্য বাংলা গানকে থিয়েটারের মত এতো দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হয়নি, বরং গানই থিয়েটার ও চলচ্চিত্রকে টেনে নিয়ে গেছে অনেকটা, তাদের বানিজ্যিক সাফল্যের কারণ হয়ে উঠেছে । সুতরাং স্বাধীনতার আগেই বাংলা গান স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠেছিল । স্বাধীনতা-উত্তর কালে যে সময়টাকে আমরা বাংলা গানের স্বর্ণযুগ বলি তারও শুরু স্বাধীনতার অন্তত এক দশক আগে । 

বাংলা গান বিপণন সামগ্রী হয়ে উঠলো বিশ শতকের একদম গোড়াতে । এডিশন আবিষ্কৃত ফোনোগ্রাফ যন্ত্র বা দম দেওয়া কলেরগান কলকাতায় এলো ফেব্রুয়ারি ১৯০১এ আর পরের বছরের গোড়াতেই বাংলা গানের ধ্বনীমুদ্রন বা রেকর্ডিংএর সূচনা হল । প্রসঙ্গত, আমরা জানি বিপণন যোগ্য গান শোনার মাধ্যম ও ধ্বনীমূদ্রন বা রেকর্ডিং ব্যবস্থায় ব্যাপক বদল এসেছে স্বাধীনতা উত্তর পর্বে । ১৯৬০ নাগাদ দম দেওয়া কলের গানের বদলে এলো ব্যাটারিচালিত রেকর্ড প্লেয়ার । ১৯৬২ থেকে দুটি মাত্র গানের ৭৮ আরপিএম রেকর্ডের উৎপাদন বন্ধ হয়ে এলো ৪টি গানের ৪৫ ঘুরণের এক্সটেন্ডেড প্লে ও ১৬টি গানের ৩৩ ঘুরণের লং প্লেয়িং রেকর্ড । ৮০র দশকের শুরুতে সমস্ত রকমের গ্রামফোন রেকর্ডের উৎপাদন বন্ধ হয়ে চলে আসে ক্যাসেট ও ক্যাসেট প্লেয়ার । দশ বছরের মধ্যে ক্যাসেট ও ক্যাসেট প্লেয়ার বিদায় নেয়, চলে আসে পাঁচশো গানের ধারণ খমতা বিশিষ্ট সিডি বা কমপ্যাক্ট ডিস্ক । ঙ্কয়েক বছরের মধ্যে সিডি ও সিডি প্লেয়ারের উৎপাদন বন্ধ হয়ে চলে চেসেছে মাইক্রো চিপস, যাতে অগুনতি গানের ধ্বনীমুদ্রন সম্ভব হয়েছে । অর্থাৎ স্বাধীনতা-উত্তরকালে গানের ধ্বনীমুদ্রন প্রযুক্তির ব্যাপক পরিবর্তন হয়ে গেছে । 

১৯০২এ বাংলা রেকর্ডের গানের প্রচলন হলেও পরিশীলিত গায়নশৈলী, গানের কথায় আধুনিক কাব্যের ছোঁয়া লাগতে এবং আমাদের গায়নরুচি তৈরি হতে অপেক্ষা করতে হয়েছে আরো ২৫/৩০ বছর । গত শতকের তিরিশের দশকে পৌঁছে বাংলা গানের আধুনিক হয়ে ওঠা বা বাংলা গানের স্বর্ণযুগের সূচনা হওয়ার অনুঘটক হিসাবে চারটি ঐতিহাসিক ঘটনা কাজ করেছিল, সেগুলি হল (১) ১৯২৭এ রেডিও বা বেতার ব্যবস্থার সূচনা (২) ১৯৩২এ বাংলা চলচ্চিত্রের সবাক হওয়া (৩) চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রগানের সফল প্রয়োগ শুরু হওয়া, আর (৪) বাংলা গানের জগতে নজরুল ইসলামের আবির্ভাব । ১৯২০র দশকেই উঠে এলেন অনেক শিল্পী – কৃষ্ণচন্দ্র দে, পঙ্কজ কুমার মল্লিক, শচিন দেববর্মন, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, রাইচাঁদ বড়াল, হিমাংশু দত্ত প্রমুখ । ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সন্তান শচিন দেববর্মন রেডিওতে প্রথম গান গাইলেন ১৯২৫এ, পঙ্কজ কুমার মল্লিক ১০২৭এ । আধুনিক বাংলা গানের গায়কীর অনেকটাই যেন ঠিক করে দিলেন শচিনদেব । বাংলা গানের জগতে শচিনদেবের গৌরবময় প্রতিষ্ঠা এবং আধুনিক বাংলা গানের মোড় ঘুরিয়ে দেবার ঘটনায় আরো দুজন মানুষের কথা একই সঙ্গে স্মরণীয় হয়ে আছে – তারা হলেন শচিনদেবের কুমিল্লার সাথী সুরসাগর হিমাংশু দত্ত ও গীতিকার অজয় ভট্টাচার্য । 

১৯৩০ থেকে ৪০এর মধ্যে বাংলা গানের জগতে উঠে এসেছিলেন অনেক কালজয়ী কন্ঠশিল্পী, সুরকার ও গীতিকার । কুন্দনলাল সায়গল, কানন দেবী, কাশেম মল্লিক, আব্বাসউদ্দীন আহমেদ, যুথিকা রায়, জগন্ময় মিত্র, গৌরিকেদার ভট্টাচার্য, সত্য চৌধুরী, সুধীরলাল চক্রবর্তী, বেচু দত্ত, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, জ্ঞাণেন্দ্র প্রসাদ গোস্বামী, মৃণালকান্তি ঘোষ, অপরেশ লাহিড়ী, সুপ্রীতি ঘোষ, সুপ্রভা সরকার, দিপালী নাগ, তারাপদ চক্রবর্তী,কমল দাশগুপ্ত, সলিল চৌধুরী প্রমুখ । বাংলা গানের জগৎ যেন চাঁদের হাট । তারপর চল্লিশ থেকে ষাট এই সময়কালে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, সতিনাথ মুখোপাধ্যায়, সুপ্রীতি ঘোষ, শ্যামল মিত্র, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, নির্মলেন্দু চৌধুরী, অখিলবন্ধু ঘোষ, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, উৎপলা সেন, প্রতীমা বন্দ্যোপাধ্যায়, মান্না দে, সুবীর সেন, আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়, শিপ্রা বসু, ইলা বসু, বাণী সরকার, তালাত মামুদ, জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, গায়ত্রী বসু, গীতা দত্ত, আরতী মুখোপাধ্যায়, সবিতা চৌধুরী, মৃণাল চক্রবর্তী, নির্মলা মিশ্র এবং আরো কত শিল্পী সুরকা্র আধুনিক বাংলাগানের ভুবনকে ঐশ্বর্যমন্ডিত করে গিয়েছেন । এদের গান আমাদের জানান দিল, শব্দের সঙ্গে সুরের সার্থক সংযোজন কি অবিস্মরণীয় মহিমার সৃষ্টি হয়, আমরা অনুভব করলাম সুর ছাড়া মানব হৃদয়ের অন্ধকার অভ্যন্তরে প্রবেশের আর কোন পথ খোলা থাকে না । বস্তুত, বাংলা সাহিত্য-শিল্প সৃজনের ক্ষেত্রে এতো বড় রোমান্টিক আন্দোলন আর হয়নি ! 

কাব্যের লাবণ্যই বাংলাগানের আশ্রয়, আমরা জানি । আমরা একথাও জানি, বাংলা গানের স্বর্ণ সময় কোন একক প্রয়াসে আসেনি, এসেছিল গায়ক, গীতিকার ও সুরকারের সম্মিলিত প্রয়াসে । গায়কের কন্ঠমাধুর্যে, সুরের স্নিগ্ধতায় আমরা অবগাহন করছি, কিন্তু নেপথ্যে থেকে যান গীতিকার । বাংলা গানের স্বর্ণসময়ে প্রথিতযশা কবি-সাহিত্যিকদের অনেক কবিতার সার্থক সঙ্গীতায়ন হয়েছে যেগুলি বাংলাগানের ভুবনে ‘লিজেন্ড’ হয়ে আছে । প্রেমেন্দ্র মিত্রর কবিতা ‘ছিপখান তিন দাঁড়, তিনজন মাল্লা দেয় দূর পাল্লা’ অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরে গেয়েছিলেন শ্যামল মিত্র । কে ভুলবে কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর লেখা ও সুধীন দাশগুপ্তর সঙ্গীতায়ন আর প্রতীমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্ঠে সেই গানটির কথা ‘বাঁশ বাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ঐ / মাগো আমার শোলক বলা কাজলা দিদি কই (১৯৫৫), কিংবা সন্ধ্যা মুখার্জীর কন্ঠে সলিল চৌধুরীর সুরে কবি বিমল ঘোষের ‘উজ্বল এক ঝাঁক পায়রা’ (১৯৫৩), বাণী ঘোষালের কন্ঠে সলিল চৌধুরির সুরে অন্নদাশংকর রায়ের ছড়া ‘তেলের শিশি ভাংলো বলে খুকুর পরে রাগ করো’ (১৯৫৫), ১৯৬০এ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে ও সুধীন দাশগুপ্তের সঙ্গীতায়নে, কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের আকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত কবিতা ‘সাগর থেকে ফেরা’ (‘সবুজের ছোঁয়া কি না তা বুঝি না’) । এবং সলিল চৌধুরী-হেমন্তর যুগলবন্দী সুকান্ত ভট্টাচার্যর রাণার, অবাক পৃথিবী, ঠিকানা আর কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তর ‘পালকি চলে’ – এই সব প্রবাদপ্রতীম গানগুলির কাছেই আমরা বারবার ফিরে আসি, এসব গানের বয়স বাড়ে না ।

কিন্তু তারপর ? মধ্য-আশিতে পৌছে আমাদের শিল্প-সাহিত্যে সৃষ্টির ভান্ডারের মত গানের ভূবনেও নেমে এলো চোখে পড়ার মত শূন্যতা । শচীন দেববর্মন ১৯৬৯এ তাঁর শেষ গানের রেকর্ড করে চলে গেলেন ১৯৭৫এ, সুধাকন্ঠ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তাঁর ৫৪ বছরের সঙ্গীত-সফর শেষ করে চলে গেলেন সেপ্টেম্বর ৮৯তে ৬৯ বছর বয়সে, আশির দশকেই চলে গেলেন, শ্যামল মিত্র (১৯৮৭),অখিলবন্ধু ঘোষ (১৯৮৮), গীতিকার গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার (১৯৮৬), নচিকেতা ঘোষ (১৯৭৬), রবীন চট্টোপাধ্যায়, নব্বইএর দশকে গানের ভূবন থেকে শেষ বিদায় নিলেন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, সতিনাথ মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরী (১৯৯৫) মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় প্রমুখ । একুশ শতকে পা দেবার আগেই বাংলাগানের ভূবনকে শূন্য করে চলে গেলেন সোনার দিনের প্রায় সব শিল্পীরা, শুধু থেকে গেলেন তখন প্রায় গানহীন মান্না দে, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, উৎপলা সেন, প্রতীমা বন্দ্যোপাধ্যায়, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, মৃণাল চক্রবর্তী, সবিতা চৌধুরী, আরতী মুখোপাধ্যায়, নির্মলা মিশ্ররা,গানের আকাল দেখার যন্ত্রণা নিয়ে । এই শূন্যতা এতো শীঘ্র পুরন হবার নয় । অতয়েব নব্বইএর দশকে শুরু হল বাংলাগানের ঝোঁক বদল । 

বদল এলো গানের কথায়, সুর রচনায় । এবং টেলিভিশনের কল্যাণে গান যেন হয়ে গেল শোনার নয় দেখার । ‘গানবাজনা’ শব্দটাকে পালটে দিয়ে কেউকেউ বললেন ‘বাজনাগান’ । ১৯৯২এ ঈর্ষনীয় কন্ঠসম্পদের অধিকারী সুমন চট্টোপাধ্যায় আধুনিক বাংলা গানের জগতে এলেন, প্রকাশিত হল তাঁর গানের ক্যাসেট ‘তোমাকে চাই’ । ক্যাসেট কোম্পানী ক্যাসেটের লেবেলে নাম দিলেন ‘জীবনমুখী’ গান । প্রায় একই সময়ে নচিকেতা চক্রবর্তী, অঞ্জন দত্ত, শিলাজিৎ প্রমুখ এক ঝাঁক নবীন শিল্পী তথাকথিত জীবনমুখী গানের জগতে হুড়মুড়িয়ে এসে গেলেন । তাঁরা আধুনিক বাংলা গানের একটা নতুন ছাঁচ তৈরি করতে চাইলেন । এদের কেউ কেউ বললেন তাদের শুনে আসা গানের ভাষা ছিল বোকা বোকা জীবনসম্পর্কহীন, তাঁদের এখনকার গানেই নাকি ধরা থাকছে সমকালীন জীবনের আবেগ ইত্যাদি । এতোদিন আধুনিক গান ছিল একটা সমবায়িক শিল্প - গীতিকার, সুরকার ও গায়কের সমবায়িক প্রয়াস আর তারা নিয়ে এলেন ‘ওয়ান পার্শন মিউজিক’ বা একক ব্যক্তির সঙ্গীত, গানের কথা সুর ও গায়ন একই ব্যক্তির এমনকি গলায় ঝোলানো তারযন্ত্রের বাদ্যসংগতও তাঁরই । এই ‘ওয়ান পার্শন মিউজিক’ কোন নতুন উদ্ভাবন নয়, আমাদের বাউল গানও একক ব্যক্তির সঙ্গীতই । তফাত এই যে সেই গানে মাটির স্পর্শ আর এদের গানে টুংটাং গীটারের শব্দ সহযোগে গলার শির ফুলিয়ে একটানা গেয়ে যাওয়া, গানের মুখড়া,অন্তরা, সঞ্চারীর কোন বালাই না রেখে । কাব্যের লাবণ্য সেইসব গানের আশ্রয় ছিল না । কলেজ কমনরুম ও রকের আড্ডার হালকা ভাষাতে মোড়া সেইসব গান । আমাদের আধুনিক বাংলা গানের যে ধারণা বা কনসেপ্টে এবং সোনার দিনের যে সব গান আমরা শুনেছি, তাতে গানের ভাষা নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু গানের সুরটিই কানে লেগে থাকতো বেশি । তাই রবীন্দ্রনাথের গান বা জনপ্রিয় আধুনিক গানের সুর যন্ত্রসঙ্গীতে বাজানো যায় কিন্তু জীবনমুখী গানের তকমা দিয়ে বিদেশ থেকে আমদানি করে যা চালানো হল তাতে এমন হবার নয় । সে গানে এলোমেলো কথা অনেক আছে কিন্তু সুর গুরুত্বপূর্ণ নয় । গানের কথা ও সুরের যে সমন্বয় একটা গানকে কালোত্তীর্ণ করে, তা তথাকথিত জীবনমুখী গানে ছিল না । ফল যা হওয়ার তাই হোল, অনেক সম্ভাব্য তরুণ, তাঁদের প্রতিভার অপচয় ঘটিয়ে হারিয়ে গেলেন, দশ বছরের মধ্যে ‘জীবনমুখী’ গান মুখ থুবড়ে পড়ল । এসে গেলো বাংলা ব্যান্ড । এও বিদেশ থেকে আমদানি করা ব্যাপার । হরেক কিসিমের যন্ত্রের জগঝম্প, কোমর দোলানো গান । গান যেন শোনার নয়, দেখার । গানের তো একটা সর্বজনীন দিক আছে গানের সুরে মানুষ ডুবতে চায়, স্নিগ্ধতায় অবগাহন করতে চায় । গানের ভেতর দিয়ে মানুষ তার স্নায়ুকে শান্ত করতে চায়, তার কর্মের ক্লান্তি অপনোদন করতে চায় । কিন্তু সে সব গানের কাব্যের লাবণ্যহীন বাণী আর গায়কের শিরা ফোলানো চিৎকার শ্রোতাদের ক্লান্তি নিয়ে এলো । ব্যান্ডের গানের জগতে কিছু পরে আসা সদ্যপ্রয়াত কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্যর ‘দোহার’ অবশ্য ভিন্নতার স্বাদ এনেছে চিরায়ত লোকজীবনের গানকে অবলম্বন করার কারণে এখনো লোকপ্রিয়তার সঙ্গে টিকে আছে সেই জন্যই । একসময় বাংলা গান লোকের মুখে মুখে ফিরতো চলচ্চিত্রে এর সার্থক প্রয়োগ ও সুর বৈচিত্রের জন্য, এখন চলচ্চিত্রের গানও আর মানুষকে টানতে পারছে না কথা ও সুরের দৈন্যতায় ।

সু্মন যে বছর ‘তোমাকে চাই’ ক্যাসেট নিয়ে সাময়িক হৈচৈ ফেললেন, তার পরের বছর ১৯৯৩তে রাজ্য সঙ্গীত আকাদেমির বার্ষিক কার্যবিবরণী তে বলা হয়েছিল “আধুনিক বাংলা গানের বাণীর দুর্বলতা বিষয়ে সভা উদ্বেগ প্রকাশ করে । সুর ও বাণীর মেলবন্ধনের অভাবে বাংলা আধুনিক গান তার আসন হারাচ্ছে । এদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন” । (তথ্যসূত্র : ‘অন্দরমহলের ছবি : বাংলা গান’/শোভন সোম - ‘দেশ’ পত্রিকা-এপ্রিল ২০০১) বাংলা গানের দুর্গতি মোচনের জন্য একটি উপ-সমতিও নাকি হয়েছিল । তারপরও প্রায় পঁচিশ বছর হতে চললো, প্রতি বছর মহা ধুমধাম করে সঙ্গীত মেলা হয়, কিন্তু বাংলা গানের দুর্গতি মোচনের কোন সংকেত পাওয়া যাচ্ছে না । 

গত পনেরো-কুড়ি বছরে শ্রীকান্ত আচার্য, ইন্দ্রনীল সেন, শ্রীরাধা বন্দ্যোপাধ্যায়, লোপামুদ্রা মিত্র, চন্দ্রাবলী দত্ত রুদ্র, স্বাগতালক্ষী দাশগুপ্ত, ইন্দ্রাণী সেন, মনোময় ভট্টাচার্য, রূপঙ্করের মত একঝাঁক সুকন্ঠ গায়ক উঠে এসেছেন সত্য, কিন্তু এদের একজনও নিজস্ব সৃষ্টির মধ্য দিয়ে আধুনিক বাংলা গানকে শাসন করতে পারেন এমন বলা যাচ্ছে না । তাদের কেউ কেউ ৫০/৬০ দশকের জনপ্রিয় আধুনিক গানগুলির রিমেইক বা পুনর্নির্মাণ করে শিল্পীর দায় মেটাতে চাইলেন, কেউবা আশ্রয় নিলেন রবীন্দ্র–দ্বিজেন্দ্রলাল-রজনীকান্তর গানে । ইন্দ্রনীল – শ্রীকান্ত - ইন্দ্রাণীরা কেন নিজস্ব সৃষ্টি করতে পারলেন না, এ বড় বিস্ময় । সৈকৎ মিত্র পিতা শ্যামল মিত্রের ছায়া থেকে বেরোতেই পারলেন না । পিতার জনপ্রিয় গানগুলিই হল তার আশ্রয় । রেকর্ড কোম্পানী (ক্যাসেট ও সিডি) এদের নিজস্ব সৃষ্টির ওপর ভরসা না রেখে ক্রমাগত অতীত দিনের গানের পুণর্নির্মাণ করালেন, তারা প্রভুত উপার্জন করলেন, কিন্তু আধুনিক বাংলা গানের সৃজনভূমিতে জোয়ার আনতে পারলেন না । কোথায় যেন পড়েছিলাম রবীন্দ্রনাথের কথা ‘প্রত্যেক যুগের মধ্যেই একটা কান্না আছে, সে কান্নাটা হল সৃষ্ট চাই’। আশির পর থেকে তো গানপ্রিয় বাঙালি এই কান্নাই তো কেঁদে চলেছে ! সৃষ্টি চাই, নবীন কালে নবীন শিল্পীর নবীন গান । অতয়েব গান শোনা বাঙালির হাতে রইল পেন্সিলই – মানে রবীন্দ্র-নজরুল- দ্বীজেন্দ্রলাল-রজনীকান্তর গান আর চিরন্তন লোক জীবনের গান । রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন বাঙালিকে চিরদিন সুখে দুঃখে তাঁর গান গাইতেই হবে । স্বাধীনতা-উত্তর সময়ের শেষ প্রান্তে পৌছে আমরা সেই বিশ্বাসের সত্যতা অনুভব করছি । গানহীনতার কান্না থেকে বাঙালি উদ্ধার পেয়েছে রবীন্দ্রগানের মধ্য দিয়ে ।

রবীন্দ্রনাথ নিজকন্ঠে তার গান রেকর্ডে গেয়েছিলেন ১৯০৮এ, শান্তিনেকেতনের আশ্রমকন্যারাও সেই আদিপর্বে রেকর্ডে গান গেয়েছিলেন, কিন্তু সেই ‘রবিবাবুর গান’ থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত হতে সময় লেগেছিল অনেক । ১৯৩৫এ পঙ্কজ কুমার মল্লিকের সঙ্গীত পরিচালনায় মুক্তি ছায়াছবিতে রবীন্দ্রনাথের গান ব্যবহৃত হ’ল । রবীন্দ্রকাহিনি নয় এমন চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রনাথের গানের প্রয়োগ সেই প্রথম । তারপর ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৪এর মধ্যে দশবারোটি রবীন্দ্র কাহিনি নয় এমন চলচ্চিত্রে রবীন্দ্র গানের সার্থক প্রয়োগ হয় । ছায়াছবিতে ববহৃত হবার ফলে তাঁর গান সমাদৃত হতে শুরু করল । ত্রিশের দশক থেকেই বাঙালি বিদ্যোৎসমাজে তাঁর গানের সার্বজনীনতা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে দীর্ঘ বিতর্ক শুরু হয় । তবুও সত্য এই যে, রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় তাঁর গানের সঙ্গে বাঙালির প্রবল আত্মীয়তা ঘটেনি । রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই একদল দক্ষ রবীন্দ্রগানের গায়ক গায়িকা ও প্রশিক্ষক তৈরি হলেন শান্তিনিকেতন সঙ্গীত ভবনের প্রয়াসে । তাঁদের আন্তরিক প্রয়াসে পতিষ্ঠিত সঙ্গীত শিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলি রবীন্দ্রগানের প্রসারে মুখ্য ভুমিকা নিয়েছিল তার প্রয়াণ-পরবর্তী কালে । রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের পরের বছর প্রতিষ্ঠিত হয় ‘গীতবিতান’ (১৯৪২) , তারপর ‘রবিতীর্থ’(১৯৪৬), ‘দক্ষিণী’ (১৯৪৮) ও ‘সুরঙ্গমা’ (১৮৫৭) । শৈলজা রঞ্জন মজুমদার, শুভ গুহঠাকুরতা, নীহারবিন্দু সেন, সুবিনয় রায় প্রমুখ এই প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে যুক্ত থেকে পরবর্তী প্রজন্মকে দীক্ষিত করেছেন রবীন্দ্র গানে । একদিকে বিশ্বভারতী সঙ্গীতভবন অন্যদিকে এইসব শিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলি থেকে উঠে এলেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, মায়া সেন, সুচিত্রা মিত্র, গীতা ঘটক, সাগর সেন, চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়, অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়, ঋতু গুহ প্রমুখ । ১৯৬১তে পৌছে তাঁর গানের যে সর্বগ্রাসী প্রভাব দেখা দিল তা সম্ভব হয়েছিল এঁদের কন্ঠ লাবণ্য ও গায়ন শৈলীর গুনে । কণক দাশ, পঙ্কজ মল্লিক, সায়গল, কানন দেবী, হেমন্ত, দেবব্রত পরবর্তী প্রজন্মের এঁরাই রবীন্দ্রগানের চাহিদা মিটিয়েছেন অসামান্য দক্ষতায় । সেই পথ বেয়ে উঠে এসেছেন রবীন্দ্রগানের দক্ষ শিল্পীরা । মানুষ শুনছেন তাঁদের গান । আমার কাছে স্বাধীনতা-উত্তর সত্তর বছরে বাংলা গানের ক্ষেত্রে সেরা প্রাপ্তি বাঙালির রবীন্দ্রগানের কাছে আসা,রবীন্দ্রনাথের গানে তার মজে যাওয়া ।


phalgunimu@gmail.com



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.