আলোছায়ার বেদনাকীর্ণ
জোৎস্না রাতের
কবি তৈমুর খান ⟴
কবি অভাবী নৌকায় চড়ে কষ্টের জলে বিতৃষ্ণার পাল তুলে যখন মনোজগতের কল্পিত জোৎস্নার ভেতর দিয়ে দুঃখ সাগরে পাড়ি দিতে থাকেন, তখন তাঁর বোধের জগতে নাড়া দেয় বিশ্বাসের ভগ্নচূড়া চর। যে চরের উপর প্রপতিত সূর্যরশ্মি সদ্য ধুয়ে যাওয়া বালির চিকচিক সৌন্দর্যকে প্রস্ফুটিত করে মনের মধ্যে ফোঁটা ফুলের মতো, তখন চারিদিকের হতাশা আর বেদনাগুলো মিলেমিশে, জোটবেঁধে,অহংকারী স্রোতের দ্বারা ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে যায়।
কবি তৈমুর খান ⟴
কবি অভাবী নৌকায় চড়ে কষ্টের জলে বিতৃষ্ণার পাল তুলে যখন মনোজগতের কল্পিত জোৎস্নার ভেতর দিয়ে দুঃখ সাগরে পাড়ি দিতে থাকেন, তখন তাঁর বোধের জগতে নাড়া দেয় বিশ্বাসের ভগ্নচূড়া চর। যে চরের উপর প্রপতিত সূর্যরশ্মি সদ্য ধুয়ে যাওয়া বালির চিকচিক সৌন্দর্যকে প্রস্ফুটিত করে মনের মধ্যে ফোঁটা ফুলের মতো, তখন চারিদিকের হতাশা আর বেদনাগুলো মিলেমিশে, জোটবেঁধে,অহংকারী স্রোতের দ্বারা ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে যায়।
![]() |
পাঠ প্রতিক্রিয়ায় / নাসির ওয়াদেন |
আত্মমগ্নতা কবির হৃদয়ে --আবেগ, সংযোগ, ব্যথা, আনন্দ,হাসিকান্নাকে লিরিকের মূল সুর ধরলেও কবিসত্বায় তন্ময় ভাবও লক্ষ করা যায় -- বস্তুনিষ্ঠ কবিতা আমাদের বহির্জগতের কদর্য রূপ যেমন টেনে আনে, তেমনি মানবতার সুরও ঝংকৃত হতে থাকে । " আমার বাড়ি সেই তো বিনয়পুর / রোজ সন্ধ্যায় ছন্দ খুঁজে ফিরি /মন্দাক্রান্তা আর কি কেউ হবে? "--মন্দাক্রান্তা কবির চোখে পার্থিব চরিত্রকেও ছাড়িয়ে গেছে, বস্তুনিষ্ঠ ভাবনাকে আলোকিত করেছে এক উপমা যা সংস্কৃতের ছন্দের মতো ধীরগতি সম্পন্ন কিন্তু আবেগী,স্থিতধী এবং মননশীলতার চিত্রকল্প । "আমি শুধু নষ্ট হই " -- কবি মনে মনে ভিজতে থাকে আবেগ ভরা মেঘের জলধারায় --সেই আবেগ, আস্ফালন নিয়ে বেঁচে থাকতে চায় --" যতটুকু বেঁচে আছি, তার অধিক মৃত/ আস্ফালন যতটুকু তার অধিক সংযত।" কবির স্পর্শ লেগে আছে সংযমে। সংযম ছাড়া বেঁচে থাকা যায় না, জীবনের তীব্র কশাঘাতে মানুষ জর্জরিত হয়েও পালিয়ে যেতে চায়না --দাঁতে দাঁত চেপে প্রতিবাদ করতে, লড়াই করতে চায় -- লড়াকু মন নিয়ে ভেসে যাওয়া সংসারকে খড়কুটো দিয়ে নতুন বাসা বানাতে চায় । কবিদের কাজ ছন্নছাড়া মেঘের মতো উড়ে যাওয়া নয় -- সেই ছন্নছাড়া মেঘকুলকে সংবদ্ধ করে, জমাট করে বৃষ্টি ঝরানো -- সজীবতা ফিরিয়ে আনা, প্রকৃতির বুকে সবুজের উপহার বিছানো, সৃষ্টির মধ্যে মানবতার সুরকে উচ্চে তুলে ধরা, মৃতপ্রায় জীবকে সঞ্জীবনী সুধা, বিশল্যীকরণ ঔষধি পান করান। " আবার ফিরুক দিন অক্লান্ত শপথে / বিশ্বাসের স্বরলিপি বাজুক রক্তঝরা ঠোঁটে "। মানুষই আসল নির্মাতা, মানুষই গড়ে, আবার ভাঙে,ও মানুষই ইতিহাস রচনা করতে পারে । " মানুষের অশ্রুফুলে ঝিকিমিকি রাত / মানুষের রক্তে রাঙা পূজার গোলাপ ।"
অন্ধকার ভেদ করে আলো প্রজ্বলিত হয়, --" রক্তাক্ত চৈতন্য ঘিরে নামে অন্ধঘোর"--সেই অন্ধকার কাটিয়ে কবিদের নামতে হয়,-বাজীর মাঠে, সংগ্রামের ময়দানে, যুদ্ধের সাজে হাতে থাকে খোলা কবিতা তরবারি --উলঙ্গ তরবারি দিয়ে কুসংস্কার, আবর্জনা, নোংরা, গ্লানি দূর করার অভিলাষে যদি কবিতা প্রসবিত না হয়, তবে কবির জীবন বৃথা হয়ে যাবে । আবেগ নিয়ে, প্রত্যাশা নিয়ে, সংকল্প হয়ে কবি বলেন, --" যাব,যাব যেতেই হবে / মাথার উপর বিশল্যমেঘ/মনময়ূর জেগে উঠেছে /নূপুর পরে নিচ্ছে আবেগ ।" মুখোশ সমাজের পর্দা ছিঁড়ে দিতে প্রতিবাদে গর্জে ওঠে কবিতা -- সমাজসিন্ধু পার হয়ে যাবে পথের কবিতাগুলো। কবির সহজ কলম পাঠকের মনে বুনে চলেছে এক আত্মিক সম্পর্ক । কবির ব্যক্তিগত জীবনের জ্বালা যন্ত্রণাগুলো আজ তার প্রতিচ্ছবি হয়ে ফুটে উঠেছে কবিতার ক্যানভাসে ।কবির কবিতায় ঈশ্বরানুভূতির ব্যগ্রতা ও বিনম্রতা যতখানি দেখি তারচেয়ে বেশি দেখি আবেগবর্জিত বিশুষ্কতা, জনজীবনের, মানবজীবনের ছায়াবাজি, যে আলোছায়ার মধ্যদিয়ে কবির মনের ভেতরের দ্বিধা-দ্বন্দ্বগুলো ভেঙে চুরে মানবপ্রেম ঈশ্বরপ্রেমে রূপান্তরিত হয়ে ওঠে । ' জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর '-- প্রাত্যহিক জীবনের ঘটে যাওয়া ঘটনা, প্রকৃতির বুকে সেজে ওঠা চিত্রলিপি মানবিক ও নিঃশর্ত সমর্পণ-এর দর্শন ছাপিয়ে কবি হৃদয়ের আবেগের রসঘন প্রকাশ কালোত্তীর্ণ আকর্ষণে একালের পাঠকের মনে উৎসাহবোধ জাগিয়ে তুলবে এই প্রত্যাশা করতেই পারি ।
কবি তৈমুর খান এ সময়ের একজন প্রতিষ্ঠিত কবি নিঃসন্দেহে । নয়ের দশকের কবিদের মধ্যে এক অন্যতম বৃক্ষ সদৃশ -- যার সুশীতল ছায়াতলে পাঠক একটু জিরিয়ে নিতে চাইছে। সদ্য প্রকাশিত দুখানি কাব্যগ্রন্থ-- " জোৎস্নায় সারারাত খেলে হিরণ্য মাছেরা "-- প্রকাশক মধুসূদন রায়, বার্ণিক প্রকাশন-- পূর্ব বর্ধমান, প্রচ্ছদ - নচিকেতা মাহাতো, বিনিময়--১০০ টাকা, এবং " উন্মাদ বিকেলের জংশন " -- প্রকাশক-- প্রিয় শিল্প প্রকাশন-- মনোজ বন্দ্যোপাধ্যায়, যাদবপুর, কলকাতা -৩২ ,প্রচ্ছদ ও বিন্যাস - নন্দিতা বন্দ্যোপাধ্যায় ,বিনিময়-- ৮০ টাকা । বোর্ড বাঁধাই,সুন্দর মননশীল,প্রচ্ছদ ও মুদ্রণ নিখুঁত । আলোচনা এই দুখানি কাব্যগ্রন্থ ঘিরে, পাঠকের ভালো লাগলে, আমাদেরও ভালো লাগবে ।
mdnasiruddin1959@gmail.com