ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

খাতির
বাঁ হাতের তাসগুলো একবার দেখে নিয়ে সুধীর রমলাকে চায়ের কথা বলল। রমলার খুব একটা ইচ্ছে ছিল না। আগে সবাই আসুক, নইলে যতবার যে আসবে আবার চায়ের কথা উঠবে সে জানে। একটু গড়িমসি করছিল, সুধীর আবার বললে—কই, যাও রমলা!’

অগত্যা উঠতেই হয়। একবার দীপেন আর একবার মিনতির দিকে চোরা চোখে চেয়ে রান্না ঘরে গেল। রান্নাঘরে এদিক-ওদিক তাকিয়ে, কাপ-ডিস, চায়ের কৌটো, চিনির কৌটো, এটা-সেটা নাড়াচাড়া করতেই করতেই কথাটা মনে এলো তার। সুধীর এতো খাতির করে কেন সবাইকে? কই, ওরা যখন কারো বাড়ি যায়, এত তো কেউ করে না! তাহলে তারই বা অত ইয়ে করার দরকার কিসের! মিনতি এলে যেন বেশী খাতিরের বহর। অথচ, মিনতির বাড়ি সেদিন গিয়ে তো দেখল, যাওয়ার কত পরে এককাপ চা, দুটো বিস্কুট দিল। আজ সেও শুধু চা আর বিস্কুটই দেবে। দেখি, সুধীর কি বলে! সেদিন মিনতির বাড়ি থেকে চলে আসবার সময় মিনতি মুখ ফুটে শুধু একবার বলেছিল—চলে যাচ্ছেন, এত তাড়াতাড়ি! কিছু খেলেন না তো!!’ 

সুধীর মুখচোরার মত হেসে বলেছিল—আরে, ঠিক আছে। রোজ রোজ আসা-যাওয়া, অত খাওয়া কিসের?’

তাহলে ওদের জন্য তোমারই বা অত খাওয়ানোর তাড়া কেন, বুঝি না বাপু’ রাগত মুখে কথাটা ভাবল রমলা। চায়ের কাপগুলো একটা স্টিলের থালার উপর বসিয়ে, একটা ছোট্ট ডিসে খানকয়েক বিস্কুট নিয়ে ঘরে এলো রমলা। এসে দেখল দীপেন নেই, শুধু সুধীর আর মিনতি বসে আছে। মিনতি রমলাকে দেখেই কেমন আড়ষ্ট হয়ে গেল। সুধীরের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই, একনাগাড়ে চোখ বন্ধ করে কথা বলেই চলেছে। রমলা চায়ের থালাটা সুধীরের পাশেই খাটের উপরে রাখল। মিনতির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল—দীপেন দা কই, চা খাবেন না?” মিনতি ঠিক কি বলবে বুঝতে পারছিল না। দীপেন ঘরের ভিতরে এসে যেন মিনতিকে বাঁচাল। চায়ের কাপগুলো হাতে হাতে ধরিয়ে দিয়ে নিজের কাপে মুখ দিতে যাবে, প্রণব এসে হাজির। 

--কই,আমার চা কই?’

দ্যাখো কান্ড, কে কখন আসবে, হাত গোনা আছে নাকি! প্রণব একেবারে ঘুর্ণি ঝড়, এলে থামানো মুশকিল। রমলার চা খাওয়া হয়নি, নিজের কাপটা তাড়াতাড়ি বাড়িয়ে দিল প্রণবের দিকে। প্রণব হাসিমুখে বলে উঠল---রাগ করলেও আমার কিছু করার নেই, খুব চা খিদে পেয়েছিল, আমি কিন্তু নিলাম। মনে মনে গাল দিচ্ছ তো! তা দাও...একটু/আধটু গালাগাল খাওয়া ভাল, হজম হয়।‘ প্রণব যেন কি, এমন করে বলে! ---আহা...আবার কত কথা!’ বলে ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের জন্য চা করতে গেল রমলা। একটু বেশী করেই করে রেখে আসবে, আবার কে কখন এসে পড়বে। এখনও দু/চার জনের আসার বাকি আছে। যাবার আগে প্রণবের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তিনি কই?’

-তাঁর সময় কই? পথ-শিশুদের খাওয়া-দাওয়া আছে না? আগে তারা, তারপর তোমরা, আমরা’ বলে নিজের বুকে একটা হাত ঠেকিয়ে দেখাল। কণা নানারকম সামাজিক ক্রিয়াকান্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকে, সময় কাটে, ভালও লাগে। ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে মিনতির দিকে তাকিয়ে বাইরে পা দিল রমলা।


(২)

রাত এখন অনেক। সবাই কখন চলে গেছে। যদিও অন্যদিনের চেয়ে আজ একটু দেরিতে আসর ভেঙ্গেছে, দু একবার জোর গলায় কথাও শোনা গেছে। মরমে মরে আছে রমলা। তার বাড়িতেই এমন ঘটনা ঘটবে, সে ভাবেনি। সুধীর দার্শনিকের মত চোখ বন্ধ করে যতই জ্ঞান দিক, তার যে এই ব্যাপারে কিছু করার ছিল, এটা রমলা জানে। সুধীর কিছু বলল না কেন? তারই তো আগে বলা উচিৎ ছিল। এটা তোমার বাড়ি, তোমার বাড়িতে বসে এই ধরণের আকচা-আকচি, কথা কাটাকাটি......আর তুমি কিছু বলবে না? অন্ততঃ যাতে গোলমাল, অকথা-কুকথা কেউ না বলে, সে কথাটাও তো বলতে পারত সুধীর! কিন্তু, ঐ যে, সকলের কাছে ভদ্র মানুষ সেজে থাকা, সেটা তাহলে চলবে না যে! তাই চুপ করে রইল। বেশ, তুমি নাহয় চুপ করে রইলে, কিন্তু তোমার যে মিনতির উপর একটা মায়া, টান আছে, সেকথা কি সুধীর অস্বীকার করতে পারবে? এই নিয়ে কিছু বলতে যাও, অমনি বলবে—কেন, আমার কাউকে ভাল লাগলে, সেকথা গোপন করব কেন? ভাললাগা কি অন্যায় নাকি, কি মুশকিল! আমার তো সামনের গলিতে থাকে রবীনের মেয়েটাকেও খুব ভাল লাগে, সেটা কি অন্যায় নাকি!’ কে বোঝাবে, রবীনের দশ বছরের মেয়ে আর মিনতি এক নয়! একটা বাচ্চা মেয়েকে ভাললাগা আর একজন পরস্ত্রীকে ভাললাগা, দুটো কি এক? সুধীরকে বোঝাতে যাও, চোখ বন্ধ করে তত্ত্ব আউড়াবে। 

আসল ঘটনা টা ঘটেছিল আড্ডা-গল্পের শেষ প্রহরে। আর এক প্রস্থ চা করতে গিয়েছিল রমলা। এও সুধীরের ফরমায়েশ। রমলা চা নিয়ে ঘরে ঢুকে দেখে অন্যেরা চায়ের অপেক্ষা না করে চলে গেছেন। অন্যেরা মানে দীপ্তি আর রণেনদা। ওদের ছেলের কাল কি একটা পরীক্ষা আছে, তাই বাড়ি যাবার তাড়া। স্বপন মুখ দেখিয়েই চলে গেছে, ওর আজ নাইট শিফটের ডিউটি। বাকিদের মধ্যে আছে শুধু মিনতি-দীপেন আর প্রণব। প্রণব আর দীপেন কিছু একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে ঠিকই, কিন্তু দীপেন বেশ উত্তপ্ত। চড়া গলায় কিছু বলল প্রণবকে। সুধীর রমলাকে দেখে অপ্রস্তুতে পড়লেও কিছু বলেনি, বলা উচিৎ মনে করেনি। ওদের ব্যাপার,ওরাই মিটিয়ে নিক। মিনতির কথা বলার কোন দরকার ছিল না, আগ বাড়িয়ে প্রণবকে বলল---প্রণবদা, এ কিন্তু অন্যায়! ও তো ঠিক কথাই বলেছে, তাই না সুধীরদা?’ দীপেনকে ইঙ্গিত করে কথাটা বলে সুধীরকে সাক্ষী মানল। রমলা বিরক্ত হল। তার বাড়িতে বসে নিজেদের ব্যক্তিগত সমস্যার সুরাহা এখানে কেন? বিশেষ করে যেখানে কণাও অনুপস্থিত। সুধীরকে ইশারা করল চুপ করার, সুধীর অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে সিগারেট টানতে লাগল। দীপেনের রাগ তখনও কমেনি,কড়া গলায় আবার কি একটা বলে উঠল প্রণবকে। এবার চটে উঠল প্রণব। শুরু হল বাক-বিতন্ডা, কথা কাটাকাটি, শেষে ঝগড়া থেকে সুধীরের সঙ্গে মিনতিকে নিয়ে ইঙ্গিত, বাদ রইল না কিছুই। দীপেন যে এই নিয়ে বেশ চাপে থাকে বোঝা গেল তার কথায়। সুধীরকে নিয়ে বলতেই থমকে গেল প্রণব। এ কি কান্ড! যার বাড়িতে বসে আথিতেয়তা নিচ্ছে তাকে নিয়েই কথা! রেগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল প্রণব। রমলার খারাপ লাগলেও কিছু বলল না। পরে ফোন করে বুঝিয়ে বলবে। এখন কিছু বললে আরো কি কথা দীপেন বলত, তার ঠিক নেই। প্রণব চলে গেলে চায়ের কাপ গুলো জড়ো করে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো রমলা। ফিরে দেখল মিনতি, দীপেনরা চলে গেছে। সুধীর মাথা নিচু করে বসে আছে। দীপেনের কথা নিয়ে বলতে গেল, সুধীর অল্পক্ষণ রমলার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল---আমাকে নিয়ে না বলে তোমায় প্রণবকে নিয়ে বললে ভাল হত বলছ?’

ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে উত্তর দিল রমলা—না, মিনতিকে নিয়ে তোমায় বললে আমার মুখখানা কেমন হয়, তুমি সেটা দেখতে পাও না। কিন্তু প্রণবদাকে নিয়ে আমায় বললে তোমার মুখখানা যেমন হবে, সেটা আমি দেখতে চাই না বলেই, তোমার মত কাউকে অত খাতির করি না।‘ 

সুধীর মুখ নিচু করল। রমলার চোখের দিকে তাকাতে পারছিল না। 

chatterjee.jharna@gmail.com



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.