জানলার বাইরে কাঁচের ওপর ওরা কি করছে সেই তখন থেকে? বুঝিনা বাপু তোদের রকমসকম। গুণধরবাবু তাঁর স্ত্রী রূপশ্রী কে চুপিচুপি ডেকে দেখালেন। আজ সারাটা দুপুর ধরে এই পায়রা দুটো বকবকম্ বকবকম্ করে ঘুরে তো বেড়াচ্ছে সেই সঙ্গে ঠোঁটে ঠোঁট দিয়ে ঘষেই চলেছে। জ্বালিয়ে মারল ব্যাটারা!
রূপশ্রী এসে জানলার কাঁচ দিয়ে একবার কোনোরকমে দেখে আবারো চলে গেলেন। তাঁর টিভি সিরিয়াল মিস্ হয়ে যাবে। আবারো স্বামীর আবদারে উঠে আসতেই হল তাঁকে। তিনি এসে বললেন, কথাতেই তো বলে কপোত কপোতী যথা। জানোনা বুঝি? জানলা খুলে বলো দিকিনি, কবুতর, যাহ্! যাহ্! যাহ্! কবুতর যাঃ। আমাকে ডিসটারব করা কেন আবার? গুণধরবাবু বেশ হতাশ হলেন।
বেশ লাগছিল দেখতে। আবার রাগ যে ধরছিল না তা নায়। কোথায় ভর দুপুরে, মেঘলা আকাশে ঘরের মধ্যে থেকে এমন দৃশ্য দুজনে বসে দেখব তা না...দিন দিন শুষ্ক, কাষ্ঠ, নীরস তরুবর হয়ে যাচ্ছ তুমি। নামেই রূপশ্রী না রূপচ্ছিরি। সেই সেবার একজন কাজের লোক এসে বলেছিল না? এটা কি রূপচ্ছিরি বৌদির বাড়ি? সত্যি রূপের কি ছিরি হয়েছে দেখ! কি কুলুক্ষুণে তোমার অমন নাম রেখেছিলেন গো?
- হ্যাঁ, হ্যাঁ, যাও আমার সব বিচ্ছিরি। হয়েছে তো? যাহ! সেই সিন্ টা মাঝখান থেকে আবারো মিস্ হয়ে গেল। কাল রাতে কি একটা খবর দেখবেন বলে রিমোট টা হাতে নিয়ে ঠিক সময়ে চ্যানেলটা ঘুরিয়ে দিলেন বাবু। ভেবেছিলুম দুপুরে রিপিটটা দেখে মনের শান্তি করব । আজ আবার কবুতর কিস্সায় মেতে উঠেছেন। মিনসে এখন একলা একলা তারিয়ে তারিয়ে খাও তুমি । মনে মনে বললেন রূপশ্রী।
তবুও আজ গুণধরের খুব ইচ্ছে হচ্ছে একটা মাত্র বউকে পাশে নিয়ে সেই দৃশ্য উপভোগ করতে। আর কাকেই বা বলা যায় এসব কথা?
কার সঙ্গেই বা শেয়ার করা যায়? মোবাইলে একটা ছবি তুলে ফেসবুকে পোষ্ট করলে কেমন হয়? আজকের হইরও হয়ে যেতে পারেন তিনি। লাইক আর কমেন্টের বন্যায় বানভাসি হবে তার টাইমলাইন। ও বাবা! পুরুষ পায়রাটা কেমন আশ্লেষে জড়িয়ে ধরছিল মেয়ে পায়রাটিকে! স্বর্গীয় রমণীয় সে দৃশ্য! উইনডো সিলের ওপর যত্কিঞ্চিত জায়গা। তার মধ্যে অতি কষ্টে দুজনে মনের কথা কয়ে চলেছে। মেয়েটা মাথাটা কাত করে ছেলেটার ঘাড়ে রাখল। সব জানে এরা! ছেলেটা সস্নেহে নিজের মাথাটা কাত করে আলতো করে চেপে রাখল । মানে সম্মতি আছে তার পুরোপুরি। আবার মাঝেমাঝেই কেমন সুখের শব্দ বের করছে ঠোঁট নেড়ে। প্রেমের কথাই বলছে হয়ত । সাংসারিক কত কথা থাকে স্বামী স্ত্রী'মধ্যে। গুণধর আর রূপশ্রীর মধ্যে নাই থাকতে পারে। সব ফুরিয়েছে কেব্ল কেজো কথা ছাড়া। অবলা জীব দুটির কিন্তু প্রেম যেন ফুরোয় না । তারা বলেই চলেছে। আর মনের সুখে মাঝেমাঝে ডেকেই চলেছে। প্রেম করেই চলেছে! ঐ দেখ উত্তেজনার বশে মেয়ে পায়রা টি পিচিক করে এক ফোঁটা মল ত্যাগও করে ফেলেছে ।
আ মলো যা! সুখের ফোয়ারা যেন! হবেনা? চিন্তা নেই, ভাবনা নেই। জীবনের টেনশন নেই। সম্মুখে শান্তি পারাবার কেবল।
আর তাঁরা স্বামী স্ত্রী? নামেই শুধু বিবাহিত বর বৌ। কেমন পুরনো হয়ে গেল তাদের সম্পর্ক। সত্যি ওদের দেখেও শিখতে হয়। মনে মনে ভাবেন তিনি। দুটি পাখী। আজকে মানুষের প্রেম করার সময় নেই । ভাবতে ভাবতে দেখেন গুণধর। আবারো একজনের চারপাশে ঘুরপাক খায় একজনা। আরেকজনা মাথা নীচু করে উপভোগ করে সেই দৃশ্য। লজ্জা এদেরো নারীর ভূষণ তবে! মনে মনে ভাবেন গুণধর। এবার কুটুস করে মাটি থেকে কি একটা ঠোঁটে করে কুড়িয়ে নিয়ে আবারো ছেলেটি মেয়েটির মুখে পুরে দেয় পরম আদরে। তারপর মেয়েটিও কি যেন বলে ওঠে।
আমায় প্রোপোজ করার দিন একটা চকোলেটও খাওয়ায় নি তুমি। রূপশ্রী বেশ ঝেঁঝে ওঠে মাঝেমাঝেই। রোজ কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে শুকনো মুড়ি বাদাম, তাও বেশ বেজার মুখে কিনে বাসে তুলে দিতে। মনে নেই আমার?
গুণধর বউয়ের সামনে গিয়ে বললেন, সিনেমা যাবে? রূপশ্রী বললেন, সিরিয়ালটা শেষ করে বলব। কেন হঠাত পায়রার প্রেম দেখে প্রেম জেগে উঠেছে বুঝি?
গুণধর জানলার সামনে গিয়ে আবারো দাঁড়ান। সেই দৃশ্য আবারো। দুই পক্ষীর প্রেমালাপ তখনো অব্যাহত। তারা যেন আজ বড্ড বাড়িয়েছে, মনে হল হঠাত। নাকি গুণধরের জীবনে প্রেম নেই বলে ওরা দেখিয়ে দেখিয়ে বড্ড প্রেম করছে। একে অপরকে বড্ড ভালবাসছে যেন। কি হিংসুটে পাখীরে বাবা! একবার মনে হল জানলার সার্সি খুলে ওদের এই মিলন পর্বের সমাধা করে দিলেই শান্তি হবে যেন। আবারো পরক্ষণেই মনে হল ওরা যা খুশি করছে করুক, আমি না দেখলেই তো হল। জানলার সার্সিটা ধড়াম করে খুলেই দিতে গেলেন গুণধর। পাখীদুটি এক ঝটকায় উড়ে গেল। বাবা! শান্তি এতক্ষণে। নিকুচি করেছে তোদের দেখিয়ে দেখিয়ে প্রেম করা।ঠোঁটে ঠোঁট ঘষা। মনুষ্য জন্ম হলে বুঝতি সংসার জন্ম কত পাপের। বেরিয়ে যেত সব।
এবার নিজে গিয়ে আরাম করে বসলেন বারান্দার চেয়ারে। গিন্নীর সিরিয়াল শেষ হলে তবে এককাপ চা পাওয়া যাবে। চা তেষ্টায় ছাতি ততক্ষণ ফাটছে ফাটুক । অতঃপর ঘর ও বাহির। বারান্দার লাগোয়া শোবার ঘরে ঢুকলেন।
ওমা! এ কি দেখছেন গুণধর! সেই পাখী দুটো না? হ্যাঁ তারাই তো। সাদার ওপর কালো ছিট ছিট। ছেলেটা বেশ বড়সড়। মেয়েটা একটু ধুবলা পাতলা। আবারো বকবকম্, বকম্! ওরে পাপিষ্ঠ! এত বড় স্পর্ধা তোদের! যাহ্! ফুলশয্যা হচ্ছে বুঝি? দূর হ আমার বিছানার ওপর থেকে। চাদরে যদি পটি করে দিস তবে তোদের একদিন কি আমার একদিন । আজকেই তো চাদর বদলেছে রূপশ্রী। জানতে পারলে রক্ষে থাকবে না আর। বলতে বলতেই রূপশ্রী ধূমায়িত চায়ের কাপ নিয়ে ঘরে ঢুকলেন।
এই দ্যাখো। ওরা আবার এখানে। কি মুশকিলেই না পড়া গেল! রূপশ্রী নিজের চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললেন, ভালো কি করে বাসতে হয় শেখ ওদের দেখে। আজ ওরা তোমাকে শিক্ষা দিতে এসেছে। গুণধর বললেন, ঐ দ্যাখো আবারো আমায় দেখিয়ে দেখিয়ে ...দাঁড়া এবার তোদের খপ করে ধরে ঝপ করে শূন্যে উড়িয়ে দেব। নিকুচি করেছে ভালবাসাবাসির।
আদর করা আর শেষ হচ্ছেনা তবে রে। পাড়ার লোক ডাকব। লাঠি নিয়ে তাড়া করব। বলাই বাহুল্য, শূন্যেই আস্ফালন হল এসব কথার। আলিঙ্গন রত পায়রা দুটি মনের সুখে আদর কান্ডে তখনো । একে অন্যের শরীরে ভালবাসায় অবগাহন করতে ব্যাস্ত। ধবধবে সাদা বিছানার চাদরে ততক্ষণে গুণধরের বকুনি খেয়ে ভয়ে, তাদের দু এক ফোঁটা মলত্যাগ হয়ে গেছে। রূপশ্রী ভাবেন, বেচারা নিরীহ কেষ্টর জীব! বেশ করছিস। প্রেম কর তোরা আরো আরও । চাদর আমার অনেক আছে। গুণধর কে একটু শেখা তোরা। ভালোবাসতে টাকাপয়সা লাগেনা। মুড়ি বাদাম, চকোলেট কিছুই লাগেনা। শুধু চাই দুটো মনের আদানপ্রদান।
বকবকম্, বকম্। আবারো ডেকে ওঠে ওরা।
গুণধর আলনার পাশে টাঙানো একট ফোল্ডিং ছাতা নিয়ে উদ্যত এবার। পাখী দুটোর প্রেম পর্বের শেষ দেখেই ছাড়বেন তিনি। বন্দুক নেই তাঁর। ছাতি তো আছে।
রূপশ্রী বাধা দিয়ে ছাতাটা কেড়ে নিয়ে বললেন, কি হচ্ছে টা কি! তোমার না হয় মিডলাইফ ক্রাইসিস, ওরা সেসব বোঝে? কি নিষ্ঠুর গো তুমি! কবুতর প্রেম, নিকষিত হেম, কামগন্ধ নাহি তায়! বলি বুদ্ধিশুদ্ধি কি লোপ পেল তোমার? নাকি মিনসের ভীমরতি হল ? ভাগ্যি ওরা পাখী! মানুষ হলে দেখিয়ে দিত তোমায়। পাখী বলে পার পেয়ে গেলে।
indira.mukerjee@gmail.com
সুচিন্তিত মতামত দিন