⌘আপনারা সবই জানেন,তবুও :- জয়দেব
অজয় নদীর তীরে লাল মাটির দেশ বীরভূম। এখানকার মাটি তে তৃষ্ণা লেগে থাকে। তাই হয়তো এখানে মানুষ দার্শনিক হয় , উদাস কবি হয়, বিরল প্রেমিক হয়। এই খানে এক কবির নামে মেলা হয়।কেন্দুলি গ্রামে ,যার প্রাচীন নাম ‘কেন্দুবিল্ব’বা ‘কেন্দুরিল্য’।কবির নাম জয়দেব,কিছুতেই না হারিয়ে যাওয়া এক কবি।
গৌড়ে তখন সেন বংশের শাসন চলছে। লক্ষণ সেনের পঞ্চরত্নের প্রধানরত্ন জয়দেব। তখন ও বাংলাভাষা রাজসভার ভাষা হয়নি। উনি সংস্কৃত ভাষায় লেখেন। তবু তাঁর লেখা ‘দেবভাষা’ র মধ্যে কোথায় যেন একটা বাংলা মোহ লুকিয়ে আছে। তিনি লিখলেন “গীত গোবিন্দ”। পরম প্রেমিক গোবিন্দর প্রতি প্রেম নিবেদন করা এক গানের সংকলন। প্রাচীন কালজয়ী সাহিত্যের মধ্যে অন্যতম জায়গা নিয়ে রেখেছে এই গীত গোবিন্দ।“গীত গোবিন্দ” তখন বেশ জনপ্রিয় ছিল। দেবদাসীরা এই গান গাইত। রাজসভা, মন্দির , কিংবা গ্রামের মোড়ল মশাই এর উঠানে গান গুলি গীত হত।সেই ঢঙ্গে আরও অনেক কবি লিখলেন। কিছু খারাপ কিছু ভালো। সেই সুর ,শব্দ, ছন্দ ভানু সিংহের কিশোর বয়সের কলমেও ছাপ ফেলে গেল।যা আজো অন্তরে প্রশান্তি এনে দেয়।ঈশ্বরের প্রতি প্রেম আর ভক্তির অঞ্জলির দামী ভাষা বা ভাব কখন যেন মানবিক ,সাধারন, আর স্বাভাবিক যাপনের খুব কাছাকাছি এসে যায়। যেমন, জয়দেব লিখছেন,“ মম মরণেমেব বরমতি বিতথকেতনা।
কি মিতি বিষ হামি বিরহানলম চেতনা”।
রবিঠাকুর লিখলেন আমাদের মতো হেরে যাওয়া পাবলিক দের জন্যে,“মরন রে তুঁহুঁ মম ,শ্যাম সমান” আমি জানি আমার মতো বহু ‘সাধারন’মানুষ তীব্র শোকে , “মরন রে তুঁহুঁ মম ,শ্যাম সমান” গেয়ে থাকেন বা ভেবে থাকেন। অবশ্য জয়দেবের প্রবল ‘কেলি পরায়ণ’ কলমের পাশে ভানু সিংহ এর রাধা “ “শাওন গগনে”মেঘ দেখে চিন্তিত হন। (এই দোষ .........কথা হচ্ছিল জয়দেবের মধ্যে রবি বাবু চলে এলেন।)
তখন সদ্য কলম চালাচ্ছি ,ক্লাস টুয়েলভ এর এঁচোরে পাকা আমি। কেউ পাত্তা দেয় না। বন্ধুদের নাম দিয়ে একখান অতি খারাপ কবিতা লিখেছিলাম। তার শেষে ‘ভনিতা’ দিয়েছিলাম- “ শুক্লা বসনে রত্না ভরণে হে দেবী, আমি নিবেদিতা নই কবি।” শুক্লা আর রত্না আমার দুই সহপাঠিনী। খুব প্যাঁক খেয়েছিলাম। এই যে জয়দেব লিখতে গিয়ে আমার এই ফালতু ‘ভনিতা’ …মাপ করুন পিলিজ। জয়দেব এর ভনিতা দেখলে তাঁকে অনেক টা জানা যায়। অভিধানে তাঁর কথা পড়তে গিয়ে দেখি তাঁর পিতার নাম ভোজদেব আর মাতার নাম বামাদেবী । হেব্বি আনন্দ হল। আহা গো বীরভূমের গ্রামের কবি কে আধুনিক লোক জন কেমন মনে রেখেছে। কেমন খুঁজে তাঁর বুড়ো বাবা , মা এর নাম অভিধানে। তুলে রেখেছে। কত্ত পরিশ্রম। একটু উদ্বেল হল হিরিদয়। গীতগোবিন্দ একটু নজর দিতেই দেখি, সেখানেই জয়দেব জানিয়ে গেছেন তাঁর বাবা মার নাম। প্রত্যেক টি ‘ভনিতা’ভিন্ন। সেখানে যেমন বলছেন
“শ্রী জয়দেব ভনিতা মিতি গীতম।
সুখয়তু কেশব পদ মুপনীতম।”
অথবা
“স্মরি হরিপদ মনে কবি জয়দেব ভনে এই গাথা
সুরম্য কানন ভায় ব্যাথিতাঅবিকা তাই শ্রীরাধা”
আর রাজসভার কবির এক প্রিয়া ছিল। তাঁর কথা লিখছেন,
“বিহিত পদ্মাবতী সুখ সমাজে কুরু মুরারে মঙ্গল শতানি
ভনতি জয়দেব –কবি রাজ রাজে।”
পদ্মাবতী কবির সতীলক্ষ্মী বউ। বড্ড ভালো লেগে যায় এই কবি কে। বাড়ি র বউ কে নিয়ে এক অপূর্ব মর্যাদা ও ভালোবাসা দিয়ে নিজের সৃষ্টির সাথে জায়গা দেওয়া--- আনন্দের তো বটেই। আর গীত গোবিন্দের শেষ করছেন কবি –
“ শ্রীভোজদেবপ্রভবস্য বামাদেবীসুতশ্রীজয়দেবকস্য
পরাশরাদিপ্রিয়বন্ধুকণ্ঠে শ্রীগীতগোবিন্দকবিত্বমস্তু |”
পিতা আর মাতার নাম দিয়ে গীতগোবিন্দের শেষ ভনিতায় তাঁর প্রনাম রাখলেন।
প্রত্যেক বিরাট মানুষের সাথে একটা করে অলৌকিক ঘটনা ফ্রি পাওয়া যায়। জয়দেবের সাথেও আছে। কবি একটি পংতি লিখতে গিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। গোবিন্দ শ্রীরাধার পায়ে ধরে ক্ষমা চাইছেন। পদ মাধুর্যের জন্যে এটা রাখতে চাইছেন... । কিন্তু ভগবান তাঁর প্রেমিকার পায়ে পড়বেন। এটা হয়। লোকজন খারাপ বলবে। রাজামশাই না খেপে যান।লেখা ছেড়ে উঠে পড়লেন। স্নানের সময় হয়েছে। গামছা ঘাড়ে পুষ্করিণী গেলেন। পদ্মাবতী দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত হলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে জয়দেব ফিরে এলেন স্নান না করেই। বললেন, লেখা শেষ করে বাড়িতেই স্নান করে নেবেন। জয়দেব লেখা শেষ করে স্নান খাওয়া করে বিশ্রাম নিতে গেলেন।পদ্মাবতী খেতে বসতেই বিপত্তি। জয়দেব স্নান করে ফিরে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করছেন , “ তুমি আমার খাবার আগেই খেয়ে নিচ্ছ।”পদ্মাবতী অবাক হয়ে বলেন “ তুমি যে এই খেলে...তুমি যে লিখলে... তুমি তো ঘরে শুয়ে ছিলে।।”। শোবার ঘর ফাঁকা। কবি শশব্যস্ত হয়ে তাঁর আধখানা লেখাটি দেখে হতবাক হলেন।যে পংতি টি নিয়ে এত দুশ্চিন্তা করছিলেন। সে টি সম্পূর্ণ করা হয়েছে। তাতে লেখা আছে, “ দেহি পদ পল্লব মুদারম্”। কবি যেটি লিখতে দোলাচলে পড়েছেন তা গোবিন্দ স্বয়ং লিখে গেছেন। কবি আর কবি পত্নী অদ্ভুত ঘটনায় উদ্বেল হলেন।অমর চিত্র কথায় ছোট বেলায় এই গল্প টা পড়েছিলাম। আমার এক দাদা বলেছিল, “ধুর ভগবানের কাজ পড়েনি লিখতে আসবে।ও ব্যাটা জয়দেব নিজেই লিখেছিল... দুবার চান করেছিল।” তখন মজা লাগলেও। আজ ঐ ‘ভগবান’ কে খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে। গোবিন্দ বলে কোন এক ভগবান, কে পাপ করছে, কে লোক ঠকাচ্ছে, কে অন্যের ধনে লোভ দিছছে—এই সব না দেখে চুপ করে দেখছিল এক কবি একটা অপূর্ব পংতি রচনা করতে গিয়ে বার বার কাটাকুটি করছে।তাই কবি সেজে এসে লিখে যাচ্ছে। ভাবতে বেশ আনন্দ হয়।
আমি উত্তরা ধিকার সুত্রে একটা পোকায় কাটা গানের বইএ গীত গোবিন্দের কিছু ‘গীত’ পেলাম। প্রত্যেকটি গানের রাগ আর তাল উল্লেখ করা আছে। যেমন, “প্রলয়পয়োধিজলে ধৃতবানসি বেদম্ ।” রুপক তালে বাঁধা মালব রাগে এটি গাওয়ার নির্দেশ।
“রাধা বদন বিলোকন বিকশিত বিবিধ বিকার বিভঙ্গম” রাগ বরাড়ী।
“ কিশলয় শরনে তলে কুরু কামিনী চরণ নলিন বিনিবেশম্” রাগ বিভাস।
এখন এই গীত গুলির চর্চা হয় কিনা জানি না। হওয়া উচিৎ। কেমন শুনতে গান গুলি। ভাবতে তো আর পয়সা লাগে না তাই ভাবছি।কোন এক সদ্য সন্ধ্যে হওয়া রূপকথার গ্রামে , নদীর ধারে কেউ হয়ত এখনও গাইছে,
“ ধীরে সমীরে যমুনা তীরে বসতি বনে বনমালী” ।
সুচিন্তিত মতামত দিন