কলকাতার বইমেলার শেষ দিন । মানুষের ভিড় আর ধুলোর ঝড়ে দমবন্ধ অবস্থা সবার । বেরোবার পথে মানুষের ধাক্কাধাক্কি তার থেকে তুমুল বচসা আর তার থেকেই আলাপ বৈশাখী আর অনিন্দ্যর । রাগ থেকে অনুরাগ । বৈশাখী ভিক্টোরিয়া কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। বন্ধুদের সাথে এসেছে পড়ন্ত বিকেলে বইমেলা ঘুরতে । আর অনিন্দ্য ভট্টাচার্য আই টি তে চাকরি করে । বইয়ের পোকা । শেষ দিন ভিড় হবে জেনেও এসেছে বই কিনতে ।
কথা কাটাকাটি থেকে আলাপ তারপর প্রেম । দুবাড়িতেও জানাজানি হতে সবাই খুশি । নেই কোনো ওজর আপত্তি । দিব্বি চলতে থাকে ফোনাফুনি ঘোরাঘুরি । ইতিমধ্যে শেষ বৈশাখীর গ্রাজুয়েশন । হঠাৎ খবর অনিন্দ্য কে অফিসের প্রজেক্ট নিয়ে যেতে হবে অরল্যান্ডো । বৈশাখী এম এ পড়া শিকে তুলে অনিন্দ্যকে বিয়ে করে পাড়ি জমায় বিদেশে ।
আসার পর ধাতস্ত হতে সময় লাগে। সবই নতুন - জায়গা ,পরিবেশ ,সংসার ,আশপাশের পরিচিতরা। তবে সময়ের সাথে অভস্ত্য হয়ে যায় । বৈশাখী একটু বেশি মাত্রায় ইন্ট্রোভার্ট । নতুনদের সাথে মিশে যেতে পারেনা সহজে । এদিকে দেখতে দেখতে সাতটা বছর পার ।আলোচনার বিষয় এখন সংসারের ফাঁকটুকু ভরাট করতে চাই নতুন অতিথি । দুজনেই চাতক পাখির মতো বসে আছে একটা বাচ্চার আশায় । বৈশাখীর সারাদিন যেন কাটতেই চায় না ।
হঠাৎ যেন " প্রলয় শঙ্খ বাজিল বাতাসে " । জীবনটা তছনছ হয়ে গেলো। খবর আসে অনিন্দ্য অসুস্থ হয়ে পড়েছে কাজ করতে করতে । কলিগরা ওকে নিয়ে হাসপাতালের পথে । বিধাতা পুরুষ যখন স্বল্পায়ু লেখেন তখন দেশটা আমেরিকা হলেও কিছু করার থাকেনা । ম্যাসিভ হার্ট এটাক । চিকিৎসার কোনো সুযোগই পাওয়া যায়না । পথেই আসে মৃত্যু পরোয়ানা । বৈশাখী দেখার আগেই সব শেষ ।
কলকাতা থেকে দুবাড়ির লোকজন এলেও বৈশাখী অনড় । ও ফিরবে না । ততদিনে ও ছাড়পত্র পেয়ে গেছে ওদেশে থাকার । অনাড়ম্বর ভাবে শ্রাদ্ধ শান্তি মিটে গেলে সবাই যে যার জায়গায় কাজে ফিরে যায় ।
সবাইকে অবাক করে বৈশাখী খুব সহজেই ছন্দে ফিরে আসে । অনিন্দ্য শখ করে ওকে গাড়ি চালানো শিখিয়েছিলো । চেষ্টা চরিত্র করে ওয়ালগ্রিনসে একটা চাকরি জুটিয়ে নেয় । দ্রুত বদলাতে থাকে বৈশাখী । চেনা অচেনার বাছবিচার নাকরে সবার ডাকেই প্রতি উইকেন্ডে নানান পার্টি এটেন্ড , পার্টিতে আকণ্ঠ মদ্যপান , একা হোক বা সদলে লং ড্রাইভ যাওয়া , সময় পেলেই রৌদ্র স্নানের নাম করে নানান সী বীচে গিয়ে হোটেলে রাত কাটানো । আমূল পাল্টে ফেলে নিজেকে । যাদের সাথে নতুন আলাপ তারা ভাবতেই পারেনা বৈশাখী কোনোদিন মুখচোরা ছিল আর পুরোনোরা ওর পরিবর্তন দেখে নিজেরাই চুপ ।
অনিন্দ্যর মৃত্যুর বছর ঘোরার আগেই আমূল পাল্টে ফেলে নিজেকে । এ বৈশাখী সে বৈশাখী নয় । আগের বৈশাখী ছিল অনিন্দ্যর ছায়া । এই নিয়ে আড়ালে আবডালে চলতো হাঁসি ঠাট্টা ।বৈশাখী মুখচোরা বলে অনিন্দ্য খুব আগলে রাখতো ওকে ।
চেনারা আসতে আসতে ওকে এড়াতে শুরু করে । বৈশাখী এগিয়ে এলেও অন্যরা পাশ কাটাবার অছিলা খোঁজে । এক এক সময় বৈশাখীর জীবন উপভোগের উপায় বা উপকরণ গুলো লোকের চোখে এতো দৃষ্টিকটু লাগে যে কেউ কেউ প্রশ্ন সূচক ভাবে তাকালে ঝর ঝর করে হেঁসে উঠে জবাবে জানায় এগুলোই ওর এখন বেঁচে থাকার রসদ । ওর চোখের চাহনি আর শরীরী ভঙ্গি বুঝিয়ে দেয় যে যাই ভাবুক তাতে ওর কিছু এসে যায়না ।
অনিন্দ্যর মৃত্যুর প্রায় আটবছর পর মাত্র আটত্রিশ বছর বয়সে নিজের জন্মদিনের দিন বৈশাখী সুইসাইড করে । লিখে রেখে যায় - আর পারলাম না । তাই চলে যাচ্ছি । নিজেকে পাল্টেছি শুধু অনিন্দ্যকে ভুলতে । কিন্তু একদিনের জন্য ভুলতে পারলাম না । অনিন্দ্যকে ছাড়া বাঁচা অসম্ভব । অনিন্দ্য আমার জীবন ।
devjani.basu.kumar@gmail.com
Tags:
অণুগল্প