শুরুর কথা
আমাদের বাড়িতে কেউ গান গায় না। কষ্মিনকালেও কেউ কোনদিন গানের চর্চা করেনি। কিন্তু তবুও আমাদের বাড়ি গানময়। বাড়ি, ঘর-বাহির; আসবাব, মাটি-পাথর- ও দরজা-জানালার ফাঁকে ফাঁকে খেলা করে গান। নতুন কোন মানুষ গাঁয়ে এলে বা আমাদের কোন নিকটজন, হঠাৎ এসে পড়লে সে এই সংগীত মূর্চ্ছনা কানে নিতে পারবে না। সে বুঝতেই পারবে না এই যে জানালা দিয়ে মর্ম্মরধ্বনি ভেসে এল দিনের আলো ঠাসা এই ঘরের ভেতর, সেটি আসলে এক মাঝির গলার সুর। তাই জল-বাতাসা শেষ করে সে বলবে, ‘বা, তোমাদের এখানের বাতাস তো খুব মিস্টি!’
হ্যাঁ, এমনই আমাদের গ্রামের বাতাসের প্রবাহ। সে যে বায়ু, সে আমাদের একার নয়—কিন্তু তবু সে নিজের হয়ে ওঠে এই গানেরই কারণে। আমরা তখন টুকটুক ঘাড় নেড়ে বলি, ‘হ্যাঁ, মিস্টি বাতাস তো বটেই। তার সঙ্গে তুমি কি আর কিছু বুঝছ?’ তখন কুটুম ঘাড় কাত করে বলবে, ‘ঢের বুঝেছি। বাতাসে মিশে আছে পাখির ডাক, পাতার মর্ম্মর।’
আমরা বুঝে যাই, এভাবেই কুটুমের কানে গান প্রবেশ করছে। সেটা নিশ্চিত হবার জন্য বলি, ‘এই ধ্বনিকে কী গান বলে মনে হয়?’
‘উঁ—না হে, তেমন কিছু নয়; তবে কি জান—’ বলে সে কুটুম গুছিয়ে বসে। পাঞ্জাবীর একটা বোতাম খুলে দিয়ে বলে, ‘তবে বড় করে ধরলে—বাতাসের এই সুন্দর মর্মরধ্বনি—একটা মন খারাপের গান—যা অনুভবে ধরতে হয়।’
আর তখনই এসে পড়ে গানের প্রসঙ্গ। আমরা চাই কি না চাই—ছাই, গান এসে ঢুকে পড়ে আমাদের দৈনন্দিতার ভেতর। মাঝে মাঝে আমাদের তাই মনে হয়, এই যে ঘর-বাড়ি-উঠোন-টালিখোলা-তুলসীমচ্ছপ নিয়ে আমরা সকলে সংসার সাজিয়ে বসিয়েছি—তার সমস্ত কিছুই ওই গান থেকে তৈরি। কুটুম গাছের পেয়ারা নুন মাখিয়ে মৌজ করে খেতে খেতে বলে, ‘আর যাই হোক, তোমাদের বাড়িতে যখনই আসি, মনটা কেন জানি আপনা থেকেই গুনগুন করে ওঠে। একদিন রাতে দেখি, তোমাদের উঠোনের ওই ডালিমগাছটার নিচে আমি গলবস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়ে আছি আর গাছটা থেকে থেকে গান হয়ে উঠছে।’
‘এই হল সেই গান—যা তুমি অনুভবে ধরলে কুটুম। আর কি মনে হয় তোমার?’
‘তেমন কিছু নয়। ওই একবারই অমন অনুভব হয়েছিল। আমি গানের ধরতাই জানি না—গাছেরও নয়—ফলে এ সবই আমার বোধবুদ্ধির বাইরে চলে যায়। তবে আমি এটা বুঝি, এই বাড়িতে আলাদা কিছু ব্যাপার আছে। আমাদের বাড়ির পিছনেও বাগান আছে, বড় গাছ আছে—কিন্তু সে মর্ম্মরধ্বনি এই সংগীত বহুল—এমন শ্রুতিমধুর নয়।’ কুটুমকে চুপিচুপি বলি, ‘আমরা সেই সংগীত বাতাসের স্বর থেকে তুলে নিতে চাইছি। পাতার মর্ম্মরধ্বনি থেকে; আলোর স্তর থেকে, অন্ধকারের পরত থেকে।’
‘কিন্তু তা কিভাবে সম্ভব?’ কুটুম ভয়ানক উত্তেজিত।
‘আমাদের দরকার গানের কথা। আমি তা লিপিবদ্ধ করে নেব। বসিয়ে নেব এই সুর। গোটা পৃথিবীর বাকি মানুষ একই ছন্দে-সুরে গেয়ে উঠবে সেই গান।’
‘সেটা কার গান?’
‘এক মাঝির। যে নৌকা কাক ভোরে নৈঃশব্দতার ভেতর ডুবে গেছিল নদীতে। তার নাম কুপ্পুস।’
বরণমালিকা রূপ
শুনেছি তার বয়স ষোলো-সতের’র বেশি নয়। এই বয়সেই সে অপূর্ব সুন্দরী হয়ে উঠেছে। খবর পেয়েছি, সে সর্বক্ষণ গান নিয়ে মেতে থাকে। তার দুয়ারে বসে থাকে শালিক-টিয়া-চন্দনা। তারা সেই গান ঠোঁটে তুলে নেয়। ক্রমে ক্রমে এটা কথিত হচ্ছে যে, নৈঃশব্দও তার দুয়ারে দাঁড়িয়ে থেকে গান শিখবে।
তার কথা আমাকে প্রথম বলে, অচিত্যা কাঁড়ার। নামটা শুনে খুব অস্থির হয়ে উঠি। যে সুর দিয়ে আমাদের দেহ গড়ে ওঠে; গাছপালা-মাঠঘাট; সেই সুরের কথারা যদি মিলে যায়, এর চেয়ে ভালো কিছু আর হতে পারে না। সেই কথাদের সন্ধানে আমি কি না করেছি। গ্রামের যত পুরাতন মানুষজন তাদের সঙ্গে এই নিয়ে অজস্র কথা হয়েছে। কিন্তু গানের কথার কোন সন্ধান পাইনি।
অচিত্যা বলে, ‘বহুজনের কাছে আমি ওই নামটাই শুনেছি। ওই সে গানের ধারক বাহক।’
‘সে থাকে কোথায়?’
‘জানা নেই।’
‘অথচ বললে, সে খুব সুন্দরী।’
‘সে কথা মিথ্যে নয়।’
তুমি ৎ তাকে দেখনি।’
অচিত্যা খিরিশ গাছের নিচে গুছিয়ে বসে। মাথার উপর ছায়া। সে বলে, ‘তুমি বাতাসে রুণুরুণু আওয়াজ পাও?’ দমবন্ধ করে বলি, ‘পাই।’
‘তবে জানবে সে নূপূর পরে হেঁটে গেল।’ শুনে আমি স্তম্ভিত! অচিত্যা বলে চলে, ‘তুমি জানো কিভাবে ফুলের পাপড়ি খোলে? একটা পাপড়ি অপর থেকে কিরকম করে আলাদা হয়?’ ফিসফিস করে বলি, ‘জানি। খুব মৃদু ও গভীর একটা শব্দ। ওই সময় মূহুর্তরা থমকে দাঁড়ায়।’
‘সে শব্দ তখনি হয় যখন সে অধর থেকে ঠোঁট আলাদা করে।’ আমি অমনি কেঁপে উঠি। নিচু গলায় বলি, ‘তুমি সব বানাচ্ছ!’
‘না-হে। গান শোনার জন্য যেমন কান চাই, নারীকে দেখার জন্য তেমনি চোখ চাই।’
‘সে কিভাবে মিলবে?’
‘আগে তুমি ঠিক কর, তুমি কী চাও। তাকে না তার গানকে।’ কুটুম বলে।
‘আমার ভাবা হয়ে গেছে। তার কাছে যাব গান আনতে। কোন সেই গান যার জন্য এক মাঝির সলিল সমাধি হল। ফলত হল কি, ঈশ্বর উঠে এলেন আমাদের বাড়ি।’
‘এমনও হতে পারে, সে গান বটে—তবে সে গানকে কেউই আত্মস্থ করতে পারে না। আমি এই যে তোমাদের বাড়ি মাঝেমাঝে দৌড়ে আসি—এখন বুঝি আমি আসি না, ওই গানই টেনে আনে আমায়। আর তোমাকে টানে নারী।’
‘তুমি যে ওর ঠিকানা না জানার কথা বলছিলে তখন?’ আমার এই প্রশ্নে অচিত্যা একটা বিড়ি ধরিয়ে বলে, ‘আছে আছে। গানের ভেতর, মনের ভেতর, নদীর ভেতরই তার বসত—নদী বহতা সুরে বেজে ওঠে সেই নারী—যখন নদী বেয়ে সেখানের উজান নাম, তার গ্রাম মেলে তখন।’
‘আমি এখনই যাব।’
‘এত দৃঢ প্রতিঙ্গ তুমি, এখনই যাও—। কিন্তু ভাইপো, সে গান নিয়ে সত্যি তুমি করবে কী?’এই বলে সেই কুটুম নাচতে থাকে। আহা কী যে তার নাচের বাহার! পায়ের ছন্দে ধুলো ওড়ে, শুকনো পাতা মড়মড় করে ধুলি হয়। তুমি এমন নাচ কেন কুটুম?
অচিত্যা বলে, ‘উজান ভাটির মেয়ে সে। সারা বছর অপেক্ষা করে থাকে কখন বর্ষা আসবে—কখন বেড়াতে যাবে। কারণ হেমন্তকালে দিগন্তজোড়া পথ হেঁটে বেড়তে যাওয়া যে সম্ভব হবে না সেই গান মেয়ের। ওর দেখা পেলে তুমি ওকে হেমন্তের মাঠে বেড়াতে নিয়ে যেও। ওর খোঁপায় পরিয়ে দিও হৈমন্তী ফুল।’
মা বিশালাক্ষ্মীর মন্দির
নদীর ধারে আমাদের বাড়ি, বাড়ির ধারে উঠোন। আমাদের ঘরময়— নদী হে, বাতাস তোমার। আমরা সেই বাতাসে শ্বাস নিই। নদীর ছিটেতে আমাদের বাড়ির উঠোন ভিজে সপসপ। যেন গান এসে ভিজিয়ে দিল মাটি। সংগীত আবিল করল আমাদের। ভেজা মাটিতে গজিয়ে উঠল সবুজ ঘাস। প্রতিদিন সবুজ জলে সিক্ত হতে হতে তারা বেড়ে ওঠে। আমাদের গ্রাম দেবতার নাম আদিত্যবর্ণ।
এইভাবে গাছপালায় আবৃত হয় দেবী বিশালাক্ষ্মীর মন্দির। কোন এক নিশিভ্রমণের শেষে তাঁর নূপূর হারিয়ে যায়। সারারাত খুঁজে তিনি যখন ব্যর্থমনোরথ হন, ভোররাতে নদীর ধারে বসে থাকেন। তাঁর পরনে লাল পাড় সাদা শাড়ি। আলুথালু বেশবাস। কুপ্পুস মাঝি তখন বিকিকিনি করে নদী বেয়ে তার ঘরে ফিরছিল। মুখে এক ভাটিয়ালী সংগীত। গান শুনে মায়ের মন ভাল হয়ে গেল। মা বললে, ‘আর একবার গা!’ মাঝি বললে, ‘তুমি বললে আর আমাকে গাইতে হবে? এই কাকভোরে নদীর পারে তুমি কি করছ? ভাল ঘরের বউরা কী এইসময় বাইরে থাকে?’
‘গা না আর একবার। বড় মিঠে গাস তুই।’
মাঝি বলল, ‘কোন বাবুর নৌকায় সারারাত ছিলে, ভোর হতে সে তোমায় নামিয়ে দিয়ে গেছে এইখানে। কুলটা মেয়েমানুষের কথায় আমি গাই না।’
মা বিশালাক্ষ্মী এই অপমানে কুপিতা হলেন। উদ্যত তর্জনী সামনে বাড়িয়ে গর্জন করে উঠলেন, ‘এত সাহস তোর? আমাকে গালমন্দ করিস? যা, ওখানেই ডুবে যা তুই, সলিল সমাধি হোক তোর!’
এরপরই আমাদের গ্রামে, নদীর ধারে মায়ের মন্দির স্থাপন করা হয়। তিনি নিত্য পূজা পান।
সজনে ফুলের সারিগান
নদীর ধার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমরা যেখানে পৌঁছই, একদল মাঝিমাল্লা একত্র হয়ে এক সজনে বাগানের ধারে বসে সারিগান গায়। তারা আমাদের দেখে গান থামিয়ে দেয়।
এতটা পথের পুরোটাই যে আমরা হেঁটে এসেছি, তা নয়। ভ্যানে চাপিয়ে অনেকটা পথ পৌঁছে দিয়ে গেছে অচিত্যা কাঁড়ার। সে যতটুকু চেনে ততটুকু আমাদের পৌঁছে দিয়ে গেল। বাকিটা আমরা নিজেরাই। দিগন্ত বিস্তৃত সেই পথ আমরা হেঁটেছি। এখনও হেমন্ত আসেনি, বাতাসে তার লেশমাত্র নেই। ধূ ধূ মাঠ যেমন আছে, তেমনি পরপর সর্ষে ক্ষেতও আছে। সেই আলপথ দিয়ে, ধানের নাড়ার ফাঁক দিয়ে আমাদের পথ চলা। কুটুম টাল রাখতে না পেরে সে বার বার পিছিয়ে পড়ে, ধুতি জড়িয়ে আছাড় খায় আর চিৎকার করে, ‘দাঁড়াও ভাইপো, একটু আস্তে।’
মাল্লারা বলে, ‘ও কে?’
‘কুটুম।’
সকলে ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকে দেখে। কুটুম এক ঢোঁক জল খেয়ে বলে, ‘সেই মাঝির গান গো—।’ মাল্লারা সন্ধিগ্ধ হয়ে বলে, ‘কোন মাঝির কথা বলছ বলত?’
‘যে মাঝি মা বিশালাক্ষীকে গান শোনাতে রাজি না হওয়ায় নদীতে ডুবে যায়।’
‘ওঃ—’ বলে তারা ছিটকে উঠল। সকলে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে পড়ল। গাছের গায়ে ঠেস দিল। ফলত ঝরে পড়তে থাকল সজনে ফুল। কুটুম তড়িঘড়ি বলে উঠল, ‘আমরা যাব বরণমালিকার কাছে। তার কাছে গান আছে।’
অমনি তারা সকলে গাছকে ঘিরে ঘুরতে থাকল। নীরব, দু’হাতের অঞ্জলিতে জমা হতে থাকল সজনে ফুল। সে গাছ তখন আর গাছ নেই, হয়ে উঠেছে বিমূর্ত সংগীত। গানের কথারাই এবার ফুল হয়ে ঝরে পড়ে। কুটুম বলে, ‘তবে কী ধরে নেব, তোমরাই এক একটি গান? নাকি সবাই মিলে এক অখন্ড সংগীত?’
মাল্লারা বলে, ‘তার আগে বল দেখি এই গান নিয়ে তোমাদের এত উৎসাহ কেন?’
উত্তরে কুটুম কিছু বলার আগেই বলি, ‘আসলে আমাদের গ্রামখানা সেই গান দিয়েই গঠিত।’ শুনে তারা চক্রাকারে তাদের ঘোরা থামায়। বলে, ‘কেবলই গ্রাম?’
‘না। মাঠ-ঘাট-অরণ্যসকল।’
‘আর মানুষ?’
‘হ্যাঁ, এর মধ্যে মানুষকেও ফেলতে হয় বইকি। দেখ, আমরা তো খাল-বিল-নদী-নালার মানুষ—এককথায় জলের দেশের মানুষ। এর ভেতর কেউ হয় গানের, কেউ নৌকার। তেমনি এক নৌকার মানুষের খোঁজে আমাদের আসা।’
‘কিরকম?’
‘সে মানুষ জলের নিচে নৌকা বায়। তার গান জলের নিচেই। কিন্তু মাটির উপর তার গান আসে না। বাতাসে ভাসে সুর। সেই সুরেই আকাশ-বাতাস আবিল হয়ে যায়। আমরা সেই সুরে ভাসি, আমাদের গ্রাম ঠিকানা রহিত হয়ে যায়। আমরা ভাবি এই বুঝি সেই মাঝি উঠে এল জলতল থেকে। ওই বুঝি জলের আগায়, স্রোতের ফাঁকে ভেসে উঠল তার নৌকা।’
সজনে ফুলের মালা
‘তোমরা বরণমালিকার নাম করছিলে? সে ওই মাঝিরই কন্যা।’
‘সে থাকে কোথায়?’
‘বরণমালিকার বাস এই গ্রামের উত্তর –পূর্বে, হাওড়-বাঁওড় বেষ্টিত এক ভূমিখন্ডে। শুনেছি সে স্থানের নাম মায়াদ্বীপ। তুমি যে গানের কথা বললে, সে গান আমরাও বুঝি কিন্তু তার কিছুই আমাদের ধরা ছোঁয়ার মধ্যে আসে না। নদীজলে যখন প্রবল আলোড়ন ওঠে— নদী হয়ে ওঠে উদ্দাম ও চঞ্চল; ঢেউএর ভেতর থেকে গুবগুব শব্দ ওঠে, তখন আমরা বুঝি ওই শুরু হল মাঝির গান, নদীর গান—যা উঠে আসে শূন্যতা থেকে।’
তারা বলে চলে, ‘যে সময়ের কথা হচ্ছে, উত্তাল বাতাস তখন— নৌকা বাওয়া ছিল পাল তুলে স্রোতের টানে ভেসে যাওয়া। এমনই এক ফিরতি পথে ডুবে গেল সে। তারপর যে মাঝি ওই স্থান পার হয়, ওই জায়গা বাদ দিয়ে গান গায়। এই নাও আমাদের মুঠোভরা সজনে ফুল। এ ফুল তাকে দিও। ওদের ওদিকে সজনে ফুল ফোটে না। ববরণমালিকা সজনের ফুলে খুব ভালোবাসে। প্রতি হেমন্তে সজনেফুলের জন্য কত না পথ সে পাড়ি দেয়!’
‘তাকে কিভাবে চিনব?’
‘বুঝেছি তুমি তার রূপের খোঁজ করছ। তা, এ কথা বলতেই হয়, সে রূপবতী। নদীর ধারে বাস তার, নদীর ভেতরের নরম কাদামাটিতে সে নিজরূপ চর্চা করে। বন্য ফুলে সে নিজেকে সাজায়। তুমি ওর চুলের ভেতর পরিয়ে দিও সজনে ফুলের মালা। দেখবে, ও তখন গান হয়ে উঠছে।’
মাল্লাদের বর্ণিত পথে চলতে চলতে দেখি, পথ আর শেষ হয় না। কত পথ, কত পথ! তবু সেই বাঁওড়ভূমির দেখা মেলে না। কুটুম ভ্রান্ত হয়ে এক গাছের নিচে বসে পড়ল। বলল, ‘একটু সময় দাও ভাইপো, আর পারছি না! তোমার জন্যে কন্যে দেখতে যাচ্ছি, এত ছটফটালে হবে?’
‘কনে? মানে?’
‘বরণমালিকা হবে তোমার ঘরণী। আমার তেমনি ইচ্ছে। তুমি যে তাকে মনে মনে ভালবেসে ফেলেছ, সে কথা তুমিও হয়ত অনুভব কর না। গান যেমন অনুভব করে নিতে হয়, ভালবাসাও তেমনি।’
‘আমার ভালবাসা তুমি দেখলে কোথায়, হে কুটুম!’
‘এই যে তুমি কথায় কথায় ছবি এঁকে দিলে তার রূপের, সেটাই তো ভালবাসার প্রকাশ। যখনই তার ঠোঁট খোলার শব্দের কথায় তুমি শিহরিত হলে। তোমরা দু’টিতে মিলে নদীর ধারের এক ভিটেতে বাস করবে, গড়ে উঠবে জনপদ—গ্রাম। নাও হে, এবার ওঠো, চলা যাক।’
সজনে ফুলের বনে
আমরা এসে উপস্থিত হলাম এক নদীছাড়া এলাকায়, বুঝলাম এই হল বাঁওড়। সেখানে একটা ক্ষীণতনু লোক টুকটুক করে নৌকা বানিয়ে চলেছে একমনে। সে পদশব্দে আমাদের দেখল, কিন্তু আবার কাজে মন দিল। আমরা তাকে বিরক্ত না করে সামনে এগোলাম কারণ সেদিকে একটা গ্রাম দেখা যাচ্ছিল।
গ্রামে কোন মানুষ নেই! কুকুরও না। আমরা আবার সেই নৌকা-মানুষের কাছে ফিরে এলাম। সে আগেরবারের মতন মুখ তুলে আমাদের দেখল, কিন্তু কোন কথা বলল না। কুটুম এইবার তার পাশে গিয়ে এক টুকরো কাঠ টেনে নিয়ে জুত করে বসল। একটু দুলে নিয়ে বলল, ‘এখানেই সেই বরণমালিকা থাকে, না?’
লোকটা মুখ তুলে আমাদের দেখল। ঘাড় নাড়ল। হ্যাঁ। কুটুম এবার বলল, ‘কিন্তু সে কোথায়? গ্রামের লোক—তারা? গ্রাম ফাঁকা কেন?’
‘দিনের বেলা গ্রাম আর নিরাপদ নাই, তাই মানুষজনও নাই। তারা সব ফেরে আঁধার ঘনালে।’
‘তারা আছে কোথায়?’
‘সজনে বনে।’
‘তারা থাকে না কেন? ভয়টা কিসের?’
‘তুফানের। তখন সব ভেসে যায়। আবার সন্ধের সময় জল নেমে যায়।’
বললাম, ‘আসলে আমরা এসেছি বরণমালিকার খোঁজে। তার কাছে গান আছে। আমরা জানি সেই গান নদীতে ভেসে চলে। কিন্তু সেই গানকে কেউই কন্ঠে তুলে নিতে পারে না। একমাত্র বরনমালিকার সেই ক্ষমতা আছে।’
‘আপনারা যখন এতটা পথ বেয়ে একমাত্র একটা গানের খোঁজে এসেছেন তখন বলি, যে গ্রামখানা আপনারা দেখছেন, তা আসলে কোন গ্রাম নয়—এক শূন্যতামাত্র। আসলে এখানে কোন গ্রাম নেই। সেক্ষেত্রে আপনাকে এটাও মেনে নিতে হবে, আমিও এখানে নেই। কারণ সমগ্রের একাংশ মিথ্যা হলে সমগ্রকেও মিথ্যা হতে হয়।’
লোকটার নাম কুপ্পুস মাঝি।
সজনে ফুলের গ্রাম
আমরা ওর কাছ থেকে সরে আসি। মহা ক্ষিপ্ত হয়ে কুটুম বলে, ‘কি আজব লোক মাইরি! চোখের সামনে দিব্যি ফুসফুস করে বিড়ি টানছে—অথচ বলছে নেই—শূন্য?’
আমরা আবার গ্রামে ঢুকে পড়ি। ছায়াছন্ন, নিঃশব্দের পাহাড় হয়ে থাকা এক গ্রাম। সারিসারি ঘর, নিকোনো উঠোন, দেওয়াল আর অজস্র সজনে গাছে ঘেরা। প্রতিটি দেওয়ালে নৌকার ছবি আঁকা। এক মাঝি নৌকা বাইছে। নৌকার নিচে ঢেউ।
একমাত্র একটি বাড়ির দেওয়ালেই দেখলাম এক অসম্পূর্ণ নারীমূর্তি আঁকা। ক্ষীণ কটিদেশ। পুস্পসজ্জিত তার দেহের অলংকার। যৌবন সম্ভারে কোন ঘাটতি নেই। আমরা বুঝে গেলাম, এই হল বরণমালিকা। কিন্তু তার ঘরখানা সম্পূর্ণ নয়। অর্ধেক দৃশ্যমান।
রাত হয়ে এল। আমরা আর ফেরার চেষ্টা করলাম না। সেই সজনে গাছের নিচেই হাতে মাথা রেখে শুয়ে শুয়ে বাকি অর্ধেক ঘরের কল্পনা করতে থাকি। ঘুমের অতলে তলিয়ে যাবার আগে মনের ভেতর কিছু ছেঁড়া ছেঁড়া ছবি ভেসে উঠল।
মাঝরাতে হঠাৎ ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। উঠে বসে দেখি, কুটুম গভীর ঘুমে। মাথার উপর বৃহৎ শুক্লা দশমীর চাঁদ। জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে গোটা বাঁওড়। দিনের আলোর মতই চারিদিক পরিস্কার। সেই আলোয় আমাদের ঘিরে আছে একদল অশরীরী!
সজনে ফুলের আলো
তারা গ্রামবাসী। যখন তারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য পায়ে পায়ে এগুচ্ছে, আমি গুনগুন করে উঠলাম সেই সুর। মনোমুগ্ধকর সেই মিস্টি সুর ধীরে ধীরে ছেয়ে ফেলল বাঁওড়ের বাতাস। গোটা দলটা স্তব্ধ হয়ে গেল। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম, বরণমালিকার ঘরের যে অংশ শূন্য ছিল, ক্রমে ক্রমে তা গঠিত হতে থাকল। সমস্ত সজনে গাছে ফুল ধরে গেল। সুরের মূর্ছনায় তা বাতাসে ভেসে যেতে লাগল।
দলটার বৃদ্ধ নেতা আমাদের কাছে পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে বলল, ‘আপনারা কারা? এই সুর আপনারা কোথায় পেলেন? এতদিন শূন্য ছিল ঘরের যে অংশ, গানের সুরেই তা দৃশ্যমান হল; আমরা ভাবতে পারছি না!’
‘এমন অনেক সুর আছে, যা আমি জানি।’ একথা শুনে বৃদ্ধ চিৎকার করে বললে, ‘ভাইসব, সকলে নতজানু হও এই যুবকের কাছে। ‘আমি জানি’ –এই অনুভূতি সকলের হয় না। ওর হয়েছে। ওই আমাদের শূন্যতার স্বরূপ জানাবে।’
আমাদের বাঁধন খুলে দেওয়া হল। তখন আমরা বললাম, আমরা কে, কোথা থেকে এসেছি এবং কেন। শুনে বৃদ্ধ বলল, ‘আমাদের দেবতার নাম আদিত্যবর্ণ। তিনি বলে দিয়েছিলেন, যদি তুই তোর বাপের গান পুনরুদ্ধার করতে পারিস তবেই এই ঘর সম্পূর্ণ হবে।’
‘তারপর?’
‘গানের সেই সুরের খোঁজে সে কোথায় না কোথায় ঘুরেছে। এখন নদী বেয়ে তুমি সেই সুর হয়ে এলে। সমস্ত সজনে গাছ পুষ্পে-পত্রে সেজে উঠল।’
‘তাকে এখন কোথা পাওয়া যাবে?’
‘তুমি যেমন তার খোঁজে এসেছ, সেও তেমনি গেছে সেও গেছে সুরের খোঁজে। একদল মাঝি সারি গান গাইতে গাইতে নদী দিয়ে চলে যাচ্ছিল। তাদের গানের কথায় তোমার কথা উল্লেখ ছিল। কুপ্পুস মাঝি তা শুনে মেয়েকে বলে। এ বেশ হয়েছে ভাল। তোমার কাছে সুর আছে, তার কাছে কথা!’
মা বিশালাক্ষ্মীর অভিশাপ
বৃদ্ধ বলতে থাকল, ‘মা বিশালাক্ষীর ওই অভিশাপের পর থেকেই আমাদের কন্ঠ থেকে, গ্রাম থেকে গান হারিয়ে যেতে থাকে। অথচ মাঝিদের গলায় সুর না খেললেও সে যেন মাঝিই নয়, মাঝিদের গ্রামও কিছু নয়। বরণমালিকা ছিল আমাদের বাঁওড় এলাকার সেরা গাইয়ে। গান না গাইতে পারার জন্যে সে কেমন যেন শুকিয়ে যেতে লাগল। এইভাবে একসময় তার ঘরের একদিন শূন্য হয়ে ওঠে।
কুপ্পুস মাঝি সেই থেকে আর গ্রামের ভেতর ঢুকত না। প্রান্তসীমায় বসে সে একটা একটা করে নৌকা করে যেত আপনমনে আর গানের কথাদের একটু একটু করে নৌকার গায়ে খোদাই করে দিত আর ভাসিয়ে দিত জলে; যদি সেই গানের ভাষা পড়ে তাতে কেউ সুর যোজন করে আর আমাদের গ্রাম শূন্যতার গ্রাস থেকে মুক্ত হয়। নৌকা থেকে গানের কথাদের নিয়ে এসে দেওয়ালে আঁকত বরণমালিকা।
কিন্তু সুরহীন হওয়ায় সে দেওয়াল ক্রমে শূন্য হয়ে গেল। মাঝি বুঝতে পারেনি ভিতরে ভিতরে ক্ষয়ে যাচ্ছে আয়ু, তার গান, নৌকার তলদেশ ও নদীর গভীরতা। ও কেবল নদীকে জানত।’
সজনে ফুলের কন্যে
আমরা দ্রুত সেখানে ফিরে আসি যেখানে কুপ্পুস নৌকা বানায়। কিন্তু সে নেই। কেবল বালির উপর এক নতুন নৌকা কাত হয়ে আছে। তার গায়ে লেখা গানের কথাগুলো বাতাসে মিশে যাচ্ছে দ্রুত। পিছনে তাকিয়ে দেখি, করুণ বাতাসে কখন মিলিয়ে গেছে বরণমালিকার গ্রাম! অনন্ত বাঁওড়ের এইস্থানে আমরা দু’জন আর একখানি নৌকা।
ধূধূ প্রান্ত, নীল জলরাশির প্রবাহ ও মাথার উপর অজস্র নীল আকাশ ছাড়া —সকলই শূন্য! কুটুম মাথা নেড়ে বলে, ‘তাকে যে এইভাবে শূন্যতার মাঝে হারিয়ে যেতে দেওয়া যায় না; তার যে তোমার ঘরণী হবার কথা!’
দেখি, মাটিতে অভিশাপ লিখে দিয়ে, নূপূরের খোঁজে ওই দূর জল দিয়ে কুপ্পুসের বানানো নৌকায় ভেসে যাচ্ছেন মা বিশালাক্ষ্মী। কুটুম বলে, ‘এরকম অনেক জ্যোৎস্না আছে, যারা খুব নিঃসঙ্গ হয়। এরকম নিঃসঙ্গতার মাঝে ঈশ্বরের সঙ্গে মানুষের সাক্ষাৎ হয়।’
তখনই বাতাসে গান ভেসে ওঠে। আমরা কান পেতে শুনি সেই গান। থেমে থেমে কেটে কেটে আসছে গানের কথারা—মন রে, ও রে মন/শূন্যের ভারে উড়াল দিয়া যাও/ওরে মন, মন রে—/সে যেথা আছে তার কাছে যাও।
আমার হাত আঁকড়ে ধরে কুটুম। তার গা কাঁপছে। সে বলে, ‘কে গাইছে ভাইপো?’
বলি, ‘নদীর গান, নদীই গাইছে। কথা আর সুরকে মিলিয়েছে বাতাস।’ গান দিয়ে এখানে গ্রাম গড়ে উঠবে। বরণমালিকার মুছে যাওয়া গ্রাম। তখনই ফিরে আসবে সে।
আমরা বালিতে বসে পড়ি।
ani.chotogolpo@gmail.com
আমাদের বাড়িতে কেউ গান গায় না। কষ্মিনকালেও কেউ কোনদিন গানের চর্চা করেনি। কিন্তু তবুও আমাদের বাড়ি গানময়। বাড়ি, ঘর-বাহির; আসবাব, মাটি-পাথর- ও দরজা-জানালার ফাঁকে ফাঁকে খেলা করে গান। নতুন কোন মানুষ গাঁয়ে এলে বা আমাদের কোন নিকটজন, হঠাৎ এসে পড়লে সে এই সংগীত মূর্চ্ছনা কানে নিতে পারবে না। সে বুঝতেই পারবে না এই যে জানালা দিয়ে মর্ম্মরধ্বনি ভেসে এল দিনের আলো ঠাসা এই ঘরের ভেতর, সেটি আসলে এক মাঝির গলার সুর। তাই জল-বাতাসা শেষ করে সে বলবে, ‘বা, তোমাদের এখানের বাতাস তো খুব মিস্টি!’
হ্যাঁ, এমনই আমাদের গ্রামের বাতাসের প্রবাহ। সে যে বায়ু, সে আমাদের একার নয়—কিন্তু তবু সে নিজের হয়ে ওঠে এই গানেরই কারণে। আমরা তখন টুকটুক ঘাড় নেড়ে বলি, ‘হ্যাঁ, মিস্টি বাতাস তো বটেই। তার সঙ্গে তুমি কি আর কিছু বুঝছ?’ তখন কুটুম ঘাড় কাত করে বলবে, ‘ঢের বুঝেছি। বাতাসে মিশে আছে পাখির ডাক, পাতার মর্ম্মর।’
আমরা বুঝে যাই, এভাবেই কুটুমের কানে গান প্রবেশ করছে। সেটা নিশ্চিত হবার জন্য বলি, ‘এই ধ্বনিকে কী গান বলে মনে হয়?’
‘উঁ—না হে, তেমন কিছু নয়; তবে কি জান—’ বলে সে কুটুম গুছিয়ে বসে। পাঞ্জাবীর একটা বোতাম খুলে দিয়ে বলে, ‘তবে বড় করে ধরলে—বাতাসের এই সুন্দর মর্মরধ্বনি—একটা মন খারাপের গান—যা অনুভবে ধরতে হয়।’
আর তখনই এসে পড়ে গানের প্রসঙ্গ। আমরা চাই কি না চাই—ছাই, গান এসে ঢুকে পড়ে আমাদের দৈনন্দিতার ভেতর। মাঝে মাঝে আমাদের তাই মনে হয়, এই যে ঘর-বাড়ি-উঠোন-টালিখোলা-তুলসীমচ্ছপ নিয়ে আমরা সকলে সংসার সাজিয়ে বসিয়েছি—তার সমস্ত কিছুই ওই গান থেকে তৈরি। কুটুম গাছের পেয়ারা নুন মাখিয়ে মৌজ করে খেতে খেতে বলে, ‘আর যাই হোক, তোমাদের বাড়িতে যখনই আসি, মনটা কেন জানি আপনা থেকেই গুনগুন করে ওঠে। একদিন রাতে দেখি, তোমাদের উঠোনের ওই ডালিমগাছটার নিচে আমি গলবস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়ে আছি আর গাছটা থেকে থেকে গান হয়ে উঠছে।’
‘এই হল সেই গান—যা তুমি অনুভবে ধরলে কুটুম। আর কি মনে হয় তোমার?’
‘তেমন কিছু নয়। ওই একবারই অমন অনুভব হয়েছিল। আমি গানের ধরতাই জানি না—গাছেরও নয়—ফলে এ সবই আমার বোধবুদ্ধির বাইরে চলে যায়। তবে আমি এটা বুঝি, এই বাড়িতে আলাদা কিছু ব্যাপার আছে। আমাদের বাড়ির পিছনেও বাগান আছে, বড় গাছ আছে—কিন্তু সে মর্ম্মরধ্বনি এই সংগীত বহুল—এমন শ্রুতিমধুর নয়।’ কুটুমকে চুপিচুপি বলি, ‘আমরা সেই সংগীত বাতাসের স্বর থেকে তুলে নিতে চাইছি। পাতার মর্ম্মরধ্বনি থেকে; আলোর স্তর থেকে, অন্ধকারের পরত থেকে।’
‘কিন্তু তা কিভাবে সম্ভব?’ কুটুম ভয়ানক উত্তেজিত।
‘আমাদের দরকার গানের কথা। আমি তা লিপিবদ্ধ করে নেব। বসিয়ে নেব এই সুর। গোটা পৃথিবীর বাকি মানুষ একই ছন্দে-সুরে গেয়ে উঠবে সেই গান।’
‘সেটা কার গান?’
‘এক মাঝির। যে নৌকা কাক ভোরে নৈঃশব্দতার ভেতর ডুবে গেছিল নদীতে। তার নাম কুপ্পুস।’
বরণমালিকা রূপ
শুনেছি তার বয়স ষোলো-সতের’র বেশি নয়। এই বয়সেই সে অপূর্ব সুন্দরী হয়ে উঠেছে। খবর পেয়েছি, সে সর্বক্ষণ গান নিয়ে মেতে থাকে। তার দুয়ারে বসে থাকে শালিক-টিয়া-চন্দনা। তারা সেই গান ঠোঁটে তুলে নেয়। ক্রমে ক্রমে এটা কথিত হচ্ছে যে, নৈঃশব্দও তার দুয়ারে দাঁড়িয়ে থেকে গান শিখবে।
তার কথা আমাকে প্রথম বলে, অচিত্যা কাঁড়ার। নামটা শুনে খুব অস্থির হয়ে উঠি। যে সুর দিয়ে আমাদের দেহ গড়ে ওঠে; গাছপালা-মাঠঘাট; সেই সুরের কথারা যদি মিলে যায়, এর চেয়ে ভালো কিছু আর হতে পারে না। সেই কথাদের সন্ধানে আমি কি না করেছি। গ্রামের যত পুরাতন মানুষজন তাদের সঙ্গে এই নিয়ে অজস্র কথা হয়েছে। কিন্তু গানের কথার কোন সন্ধান পাইনি।
অচিত্যা বলে, ‘বহুজনের কাছে আমি ওই নামটাই শুনেছি। ওই সে গানের ধারক বাহক।’
‘সে থাকে কোথায়?’
‘জানা নেই।’
‘অথচ বললে, সে খুব সুন্দরী।’
‘সে কথা মিথ্যে নয়।’
তুমি ৎ তাকে দেখনি।’
অচিত্যা খিরিশ গাছের নিচে গুছিয়ে বসে। মাথার উপর ছায়া। সে বলে, ‘তুমি বাতাসে রুণুরুণু আওয়াজ পাও?’ দমবন্ধ করে বলি, ‘পাই।’
‘তবে জানবে সে নূপূর পরে হেঁটে গেল।’ শুনে আমি স্তম্ভিত! অচিত্যা বলে চলে, ‘তুমি জানো কিভাবে ফুলের পাপড়ি খোলে? একটা পাপড়ি অপর থেকে কিরকম করে আলাদা হয়?’ ফিসফিস করে বলি, ‘জানি। খুব মৃদু ও গভীর একটা শব্দ। ওই সময় মূহুর্তরা থমকে দাঁড়ায়।’
‘সে শব্দ তখনি হয় যখন সে অধর থেকে ঠোঁট আলাদা করে।’ আমি অমনি কেঁপে উঠি। নিচু গলায় বলি, ‘তুমি সব বানাচ্ছ!’
‘না-হে। গান শোনার জন্য যেমন কান চাই, নারীকে দেখার জন্য তেমনি চোখ চাই।’
‘সে কিভাবে মিলবে?’
‘আগে তুমি ঠিক কর, তুমি কী চাও। তাকে না তার গানকে।’ কুটুম বলে।
‘আমার ভাবা হয়ে গেছে। তার কাছে যাব গান আনতে। কোন সেই গান যার জন্য এক মাঝির সলিল সমাধি হল। ফলত হল কি, ঈশ্বর উঠে এলেন আমাদের বাড়ি।’
‘এমনও হতে পারে, সে গান বটে—তবে সে গানকে কেউই আত্মস্থ করতে পারে না। আমি এই যে তোমাদের বাড়ি মাঝেমাঝে দৌড়ে আসি—এখন বুঝি আমি আসি না, ওই গানই টেনে আনে আমায়। আর তোমাকে টানে নারী।’
‘তুমি যে ওর ঠিকানা না জানার কথা বলছিলে তখন?’ আমার এই প্রশ্নে অচিত্যা একটা বিড়ি ধরিয়ে বলে, ‘আছে আছে। গানের ভেতর, মনের ভেতর, নদীর ভেতরই তার বসত—নদী বহতা সুরে বেজে ওঠে সেই নারী—যখন নদী বেয়ে সেখানের উজান নাম, তার গ্রাম মেলে তখন।’
‘আমি এখনই যাব।’
‘এত দৃঢ প্রতিঙ্গ তুমি, এখনই যাও—। কিন্তু ভাইপো, সে গান নিয়ে সত্যি তুমি করবে কী?’এই বলে সেই কুটুম নাচতে থাকে। আহা কী যে তার নাচের বাহার! পায়ের ছন্দে ধুলো ওড়ে, শুকনো পাতা মড়মড় করে ধুলি হয়। তুমি এমন নাচ কেন কুটুম?
অচিত্যা বলে, ‘উজান ভাটির মেয়ে সে। সারা বছর অপেক্ষা করে থাকে কখন বর্ষা আসবে—কখন বেড়াতে যাবে। কারণ হেমন্তকালে দিগন্তজোড়া পথ হেঁটে বেড়তে যাওয়া যে সম্ভব হবে না সেই গান মেয়ের। ওর দেখা পেলে তুমি ওকে হেমন্তের মাঠে বেড়াতে নিয়ে যেও। ওর খোঁপায় পরিয়ে দিও হৈমন্তী ফুল।’
মা বিশালাক্ষ্মীর মন্দির
নদীর ধারে আমাদের বাড়ি, বাড়ির ধারে উঠোন। আমাদের ঘরময়— নদী হে, বাতাস তোমার। আমরা সেই বাতাসে শ্বাস নিই। নদীর ছিটেতে আমাদের বাড়ির উঠোন ভিজে সপসপ। যেন গান এসে ভিজিয়ে দিল মাটি। সংগীত আবিল করল আমাদের। ভেজা মাটিতে গজিয়ে উঠল সবুজ ঘাস। প্রতিদিন সবুজ জলে সিক্ত হতে হতে তারা বেড়ে ওঠে। আমাদের গ্রাম দেবতার নাম আদিত্যবর্ণ।
এইভাবে গাছপালায় আবৃত হয় দেবী বিশালাক্ষ্মীর মন্দির। কোন এক নিশিভ্রমণের শেষে তাঁর নূপূর হারিয়ে যায়। সারারাত খুঁজে তিনি যখন ব্যর্থমনোরথ হন, ভোররাতে নদীর ধারে বসে থাকেন। তাঁর পরনে লাল পাড় সাদা শাড়ি। আলুথালু বেশবাস। কুপ্পুস মাঝি তখন বিকিকিনি করে নদী বেয়ে তার ঘরে ফিরছিল। মুখে এক ভাটিয়ালী সংগীত। গান শুনে মায়ের মন ভাল হয়ে গেল। মা বললে, ‘আর একবার গা!’ মাঝি বললে, ‘তুমি বললে আর আমাকে গাইতে হবে? এই কাকভোরে নদীর পারে তুমি কি করছ? ভাল ঘরের বউরা কী এইসময় বাইরে থাকে?’
‘গা না আর একবার। বড় মিঠে গাস তুই।’
মাঝি বলল, ‘কোন বাবুর নৌকায় সারারাত ছিলে, ভোর হতে সে তোমায় নামিয়ে দিয়ে গেছে এইখানে। কুলটা মেয়েমানুষের কথায় আমি গাই না।’
মা বিশালাক্ষ্মী এই অপমানে কুপিতা হলেন। উদ্যত তর্জনী সামনে বাড়িয়ে গর্জন করে উঠলেন, ‘এত সাহস তোর? আমাকে গালমন্দ করিস? যা, ওখানেই ডুবে যা তুই, সলিল সমাধি হোক তোর!’
এরপরই আমাদের গ্রামে, নদীর ধারে মায়ের মন্দির স্থাপন করা হয়। তিনি নিত্য পূজা পান।
সজনে ফুলের সারিগান
নদীর ধার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমরা যেখানে পৌঁছই, একদল মাঝিমাল্লা একত্র হয়ে এক সজনে বাগানের ধারে বসে সারিগান গায়। তারা আমাদের দেখে গান থামিয়ে দেয়।
এতটা পথের পুরোটাই যে আমরা হেঁটে এসেছি, তা নয়। ভ্যানে চাপিয়ে অনেকটা পথ পৌঁছে দিয়ে গেছে অচিত্যা কাঁড়ার। সে যতটুকু চেনে ততটুকু আমাদের পৌঁছে দিয়ে গেল। বাকিটা আমরা নিজেরাই। দিগন্ত বিস্তৃত সেই পথ আমরা হেঁটেছি। এখনও হেমন্ত আসেনি, বাতাসে তার লেশমাত্র নেই। ধূ ধূ মাঠ যেমন আছে, তেমনি পরপর সর্ষে ক্ষেতও আছে। সেই আলপথ দিয়ে, ধানের নাড়ার ফাঁক দিয়ে আমাদের পথ চলা। কুটুম টাল রাখতে না পেরে সে বার বার পিছিয়ে পড়ে, ধুতি জড়িয়ে আছাড় খায় আর চিৎকার করে, ‘দাঁড়াও ভাইপো, একটু আস্তে।’
মাল্লারা বলে, ‘ও কে?’
‘কুটুম।’
সকলে ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকে দেখে। কুটুম এক ঢোঁক জল খেয়ে বলে, ‘সেই মাঝির গান গো—।’ মাল্লারা সন্ধিগ্ধ হয়ে বলে, ‘কোন মাঝির কথা বলছ বলত?’
‘যে মাঝি মা বিশালাক্ষীকে গান শোনাতে রাজি না হওয়ায় নদীতে ডুবে যায়।’
‘ওঃ—’ বলে তারা ছিটকে উঠল। সকলে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে পড়ল। গাছের গায়ে ঠেস দিল। ফলত ঝরে পড়তে থাকল সজনে ফুল। কুটুম তড়িঘড়ি বলে উঠল, ‘আমরা যাব বরণমালিকার কাছে। তার কাছে গান আছে।’
অমনি তারা সকলে গাছকে ঘিরে ঘুরতে থাকল। নীরব, দু’হাতের অঞ্জলিতে জমা হতে থাকল সজনে ফুল। সে গাছ তখন আর গাছ নেই, হয়ে উঠেছে বিমূর্ত সংগীত। গানের কথারাই এবার ফুল হয়ে ঝরে পড়ে। কুটুম বলে, ‘তবে কী ধরে নেব, তোমরাই এক একটি গান? নাকি সবাই মিলে এক অখন্ড সংগীত?’
মাল্লারা বলে, ‘তার আগে বল দেখি এই গান নিয়ে তোমাদের এত উৎসাহ কেন?’
উত্তরে কুটুম কিছু বলার আগেই বলি, ‘আসলে আমাদের গ্রামখানা সেই গান দিয়েই গঠিত।’ শুনে তারা চক্রাকারে তাদের ঘোরা থামায়। বলে, ‘কেবলই গ্রাম?’
‘না। মাঠ-ঘাট-অরণ্যসকল।’
‘আর মানুষ?’
‘হ্যাঁ, এর মধ্যে মানুষকেও ফেলতে হয় বইকি। দেখ, আমরা তো খাল-বিল-নদী-নালার মানুষ—এককথায় জলের দেশের মানুষ। এর ভেতর কেউ হয় গানের, কেউ নৌকার। তেমনি এক নৌকার মানুষের খোঁজে আমাদের আসা।’
‘কিরকম?’
‘সে মানুষ জলের নিচে নৌকা বায়। তার গান জলের নিচেই। কিন্তু মাটির উপর তার গান আসে না। বাতাসে ভাসে সুর। সেই সুরেই আকাশ-বাতাস আবিল হয়ে যায়। আমরা সেই সুরে ভাসি, আমাদের গ্রাম ঠিকানা রহিত হয়ে যায়। আমরা ভাবি এই বুঝি সেই মাঝি উঠে এল জলতল থেকে। ওই বুঝি জলের আগায়, স্রোতের ফাঁকে ভেসে উঠল তার নৌকা।’
সজনে ফুলের মালা
‘তোমরা বরণমালিকার নাম করছিলে? সে ওই মাঝিরই কন্যা।’
‘সে থাকে কোথায়?’
‘বরণমালিকার বাস এই গ্রামের উত্তর –পূর্বে, হাওড়-বাঁওড় বেষ্টিত এক ভূমিখন্ডে। শুনেছি সে স্থানের নাম মায়াদ্বীপ। তুমি যে গানের কথা বললে, সে গান আমরাও বুঝি কিন্তু তার কিছুই আমাদের ধরা ছোঁয়ার মধ্যে আসে না। নদীজলে যখন প্রবল আলোড়ন ওঠে— নদী হয়ে ওঠে উদ্দাম ও চঞ্চল; ঢেউএর ভেতর থেকে গুবগুব শব্দ ওঠে, তখন আমরা বুঝি ওই শুরু হল মাঝির গান, নদীর গান—যা উঠে আসে শূন্যতা থেকে।’
তারা বলে চলে, ‘যে সময়ের কথা হচ্ছে, উত্তাল বাতাস তখন— নৌকা বাওয়া ছিল পাল তুলে স্রোতের টানে ভেসে যাওয়া। এমনই এক ফিরতি পথে ডুবে গেল সে। তারপর যে মাঝি ওই স্থান পার হয়, ওই জায়গা বাদ দিয়ে গান গায়। এই নাও আমাদের মুঠোভরা সজনে ফুল। এ ফুল তাকে দিও। ওদের ওদিকে সজনে ফুল ফোটে না। ববরণমালিকা সজনের ফুলে খুব ভালোবাসে। প্রতি হেমন্তে সজনেফুলের জন্য কত না পথ সে পাড়ি দেয়!’
‘তাকে কিভাবে চিনব?’
‘বুঝেছি তুমি তার রূপের খোঁজ করছ। তা, এ কথা বলতেই হয়, সে রূপবতী। নদীর ধারে বাস তার, নদীর ভেতরের নরম কাদামাটিতে সে নিজরূপ চর্চা করে। বন্য ফুলে সে নিজেকে সাজায়। তুমি ওর চুলের ভেতর পরিয়ে দিও সজনে ফুলের মালা। দেখবে, ও তখন গান হয়ে উঠছে।’
মাল্লাদের বর্ণিত পথে চলতে চলতে দেখি, পথ আর শেষ হয় না। কত পথ, কত পথ! তবু সেই বাঁওড়ভূমির দেখা মেলে না। কুটুম ভ্রান্ত হয়ে এক গাছের নিচে বসে পড়ল। বলল, ‘একটু সময় দাও ভাইপো, আর পারছি না! তোমার জন্যে কন্যে দেখতে যাচ্ছি, এত ছটফটালে হবে?’
‘কনে? মানে?’
‘বরণমালিকা হবে তোমার ঘরণী। আমার তেমনি ইচ্ছে। তুমি যে তাকে মনে মনে ভালবেসে ফেলেছ, সে কথা তুমিও হয়ত অনুভব কর না। গান যেমন অনুভব করে নিতে হয়, ভালবাসাও তেমনি।’
‘আমার ভালবাসা তুমি দেখলে কোথায়, হে কুটুম!’
‘এই যে তুমি কথায় কথায় ছবি এঁকে দিলে তার রূপের, সেটাই তো ভালবাসার প্রকাশ। যখনই তার ঠোঁট খোলার শব্দের কথায় তুমি শিহরিত হলে। তোমরা দু’টিতে মিলে নদীর ধারের এক ভিটেতে বাস করবে, গড়ে উঠবে জনপদ—গ্রাম। নাও হে, এবার ওঠো, চলা যাক।’
সজনে ফুলের বনে
আমরা এসে উপস্থিত হলাম এক নদীছাড়া এলাকায়, বুঝলাম এই হল বাঁওড়। সেখানে একটা ক্ষীণতনু লোক টুকটুক করে নৌকা বানিয়ে চলেছে একমনে। সে পদশব্দে আমাদের দেখল, কিন্তু আবার কাজে মন দিল। আমরা তাকে বিরক্ত না করে সামনে এগোলাম কারণ সেদিকে একটা গ্রাম দেখা যাচ্ছিল।
গ্রামে কোন মানুষ নেই! কুকুরও না। আমরা আবার সেই নৌকা-মানুষের কাছে ফিরে এলাম। সে আগেরবারের মতন মুখ তুলে আমাদের দেখল, কিন্তু কোন কথা বলল না। কুটুম এইবার তার পাশে গিয়ে এক টুকরো কাঠ টেনে নিয়ে জুত করে বসল। একটু দুলে নিয়ে বলল, ‘এখানেই সেই বরণমালিকা থাকে, না?’
লোকটা মুখ তুলে আমাদের দেখল। ঘাড় নাড়ল। হ্যাঁ। কুটুম এবার বলল, ‘কিন্তু সে কোথায়? গ্রামের লোক—তারা? গ্রাম ফাঁকা কেন?’
‘দিনের বেলা গ্রাম আর নিরাপদ নাই, তাই মানুষজনও নাই। তারা সব ফেরে আঁধার ঘনালে।’
‘তারা আছে কোথায়?’
‘সজনে বনে।’
‘তারা থাকে না কেন? ভয়টা কিসের?’
‘তুফানের। তখন সব ভেসে যায়। আবার সন্ধের সময় জল নেমে যায়।’
বললাম, ‘আসলে আমরা এসেছি বরণমালিকার খোঁজে। তার কাছে গান আছে। আমরা জানি সেই গান নদীতে ভেসে চলে। কিন্তু সেই গানকে কেউই কন্ঠে তুলে নিতে পারে না। একমাত্র বরনমালিকার সেই ক্ষমতা আছে।’
‘আপনারা যখন এতটা পথ বেয়ে একমাত্র একটা গানের খোঁজে এসেছেন তখন বলি, যে গ্রামখানা আপনারা দেখছেন, তা আসলে কোন গ্রাম নয়—এক শূন্যতামাত্র। আসলে এখানে কোন গ্রাম নেই। সেক্ষেত্রে আপনাকে এটাও মেনে নিতে হবে, আমিও এখানে নেই। কারণ সমগ্রের একাংশ মিথ্যা হলে সমগ্রকেও মিথ্যা হতে হয়।’
লোকটার নাম কুপ্পুস মাঝি।
সজনে ফুলের গ্রাম
আমরা ওর কাছ থেকে সরে আসি। মহা ক্ষিপ্ত হয়ে কুটুম বলে, ‘কি আজব লোক মাইরি! চোখের সামনে দিব্যি ফুসফুস করে বিড়ি টানছে—অথচ বলছে নেই—শূন্য?’
আমরা আবার গ্রামে ঢুকে পড়ি। ছায়াছন্ন, নিঃশব্দের পাহাড় হয়ে থাকা এক গ্রাম। সারিসারি ঘর, নিকোনো উঠোন, দেওয়াল আর অজস্র সজনে গাছে ঘেরা। প্রতিটি দেওয়ালে নৌকার ছবি আঁকা। এক মাঝি নৌকা বাইছে। নৌকার নিচে ঢেউ।
একমাত্র একটি বাড়ির দেওয়ালেই দেখলাম এক অসম্পূর্ণ নারীমূর্তি আঁকা। ক্ষীণ কটিদেশ। পুস্পসজ্জিত তার দেহের অলংকার। যৌবন সম্ভারে কোন ঘাটতি নেই। আমরা বুঝে গেলাম, এই হল বরণমালিকা। কিন্তু তার ঘরখানা সম্পূর্ণ নয়। অর্ধেক দৃশ্যমান।
রাত হয়ে এল। আমরা আর ফেরার চেষ্টা করলাম না। সেই সজনে গাছের নিচেই হাতে মাথা রেখে শুয়ে শুয়ে বাকি অর্ধেক ঘরের কল্পনা করতে থাকি। ঘুমের অতলে তলিয়ে যাবার আগে মনের ভেতর কিছু ছেঁড়া ছেঁড়া ছবি ভেসে উঠল।
মাঝরাতে হঠাৎ ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। উঠে বসে দেখি, কুটুম গভীর ঘুমে। মাথার উপর বৃহৎ শুক্লা দশমীর চাঁদ। জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে গোটা বাঁওড়। দিনের আলোর মতই চারিদিক পরিস্কার। সেই আলোয় আমাদের ঘিরে আছে একদল অশরীরী!
সজনে ফুলের আলো
তারা গ্রামবাসী। যখন তারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য পায়ে পায়ে এগুচ্ছে, আমি গুনগুন করে উঠলাম সেই সুর। মনোমুগ্ধকর সেই মিস্টি সুর ধীরে ধীরে ছেয়ে ফেলল বাঁওড়ের বাতাস। গোটা দলটা স্তব্ধ হয়ে গেল। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম, বরণমালিকার ঘরের যে অংশ শূন্য ছিল, ক্রমে ক্রমে তা গঠিত হতে থাকল। সমস্ত সজনে গাছে ফুল ধরে গেল। সুরের মূর্ছনায় তা বাতাসে ভেসে যেতে লাগল।
দলটার বৃদ্ধ নেতা আমাদের কাছে পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে বলল, ‘আপনারা কারা? এই সুর আপনারা কোথায় পেলেন? এতদিন শূন্য ছিল ঘরের যে অংশ, গানের সুরেই তা দৃশ্যমান হল; আমরা ভাবতে পারছি না!’
‘এমন অনেক সুর আছে, যা আমি জানি।’ একথা শুনে বৃদ্ধ চিৎকার করে বললে, ‘ভাইসব, সকলে নতজানু হও এই যুবকের কাছে। ‘আমি জানি’ –এই অনুভূতি সকলের হয় না। ওর হয়েছে। ওই আমাদের শূন্যতার স্বরূপ জানাবে।’
আমাদের বাঁধন খুলে দেওয়া হল। তখন আমরা বললাম, আমরা কে, কোথা থেকে এসেছি এবং কেন। শুনে বৃদ্ধ বলল, ‘আমাদের দেবতার নাম আদিত্যবর্ণ। তিনি বলে দিয়েছিলেন, যদি তুই তোর বাপের গান পুনরুদ্ধার করতে পারিস তবেই এই ঘর সম্পূর্ণ হবে।’
‘তারপর?’
‘গানের সেই সুরের খোঁজে সে কোথায় না কোথায় ঘুরেছে। এখন নদী বেয়ে তুমি সেই সুর হয়ে এলে। সমস্ত সজনে গাছ পুষ্পে-পত্রে সেজে উঠল।’
‘তাকে এখন কোথা পাওয়া যাবে?’
‘তুমি যেমন তার খোঁজে এসেছ, সেও তেমনি গেছে সেও গেছে সুরের খোঁজে। একদল মাঝি সারি গান গাইতে গাইতে নদী দিয়ে চলে যাচ্ছিল। তাদের গানের কথায় তোমার কথা উল্লেখ ছিল। কুপ্পুস মাঝি তা শুনে মেয়েকে বলে। এ বেশ হয়েছে ভাল। তোমার কাছে সুর আছে, তার কাছে কথা!’
মা বিশালাক্ষ্মীর অভিশাপ
বৃদ্ধ বলতে থাকল, ‘মা বিশালাক্ষীর ওই অভিশাপের পর থেকেই আমাদের কন্ঠ থেকে, গ্রাম থেকে গান হারিয়ে যেতে থাকে। অথচ মাঝিদের গলায় সুর না খেললেও সে যেন মাঝিই নয়, মাঝিদের গ্রামও কিছু নয়। বরণমালিকা ছিল আমাদের বাঁওড় এলাকার সেরা গাইয়ে। গান না গাইতে পারার জন্যে সে কেমন যেন শুকিয়ে যেতে লাগল। এইভাবে একসময় তার ঘরের একদিন শূন্য হয়ে ওঠে।
কুপ্পুস মাঝি সেই থেকে আর গ্রামের ভেতর ঢুকত না। প্রান্তসীমায় বসে সে একটা একটা করে নৌকা করে যেত আপনমনে আর গানের কথাদের একটু একটু করে নৌকার গায়ে খোদাই করে দিত আর ভাসিয়ে দিত জলে; যদি সেই গানের ভাষা পড়ে তাতে কেউ সুর যোজন করে আর আমাদের গ্রাম শূন্যতার গ্রাস থেকে মুক্ত হয়। নৌকা থেকে গানের কথাদের নিয়ে এসে দেওয়ালে আঁকত বরণমালিকা।
কিন্তু সুরহীন হওয়ায় সে দেওয়াল ক্রমে শূন্য হয়ে গেল। মাঝি বুঝতে পারেনি ভিতরে ভিতরে ক্ষয়ে যাচ্ছে আয়ু, তার গান, নৌকার তলদেশ ও নদীর গভীরতা। ও কেবল নদীকে জানত।’
সজনে ফুলের কন্যে
আমরা দ্রুত সেখানে ফিরে আসি যেখানে কুপ্পুস নৌকা বানায়। কিন্তু সে নেই। কেবল বালির উপর এক নতুন নৌকা কাত হয়ে আছে। তার গায়ে লেখা গানের কথাগুলো বাতাসে মিশে যাচ্ছে দ্রুত। পিছনে তাকিয়ে দেখি, করুণ বাতাসে কখন মিলিয়ে গেছে বরণমালিকার গ্রাম! অনন্ত বাঁওড়ের এইস্থানে আমরা দু’জন আর একখানি নৌকা।
ধূধূ প্রান্ত, নীল জলরাশির প্রবাহ ও মাথার উপর অজস্র নীল আকাশ ছাড়া —সকলই শূন্য! কুটুম মাথা নেড়ে বলে, ‘তাকে যে এইভাবে শূন্যতার মাঝে হারিয়ে যেতে দেওয়া যায় না; তার যে তোমার ঘরণী হবার কথা!’
দেখি, মাটিতে অভিশাপ লিখে দিয়ে, নূপূরের খোঁজে ওই দূর জল দিয়ে কুপ্পুসের বানানো নৌকায় ভেসে যাচ্ছেন মা বিশালাক্ষ্মী। কুটুম বলে, ‘এরকম অনেক জ্যোৎস্না আছে, যারা খুব নিঃসঙ্গ হয়। এরকম নিঃসঙ্গতার মাঝে ঈশ্বরের সঙ্গে মানুষের সাক্ষাৎ হয়।’
তখনই বাতাসে গান ভেসে ওঠে। আমরা কান পেতে শুনি সেই গান। থেমে থেমে কেটে কেটে আসছে গানের কথারা—মন রে, ও রে মন/শূন্যের ভারে উড়াল দিয়া যাও/ওরে মন, মন রে—/সে যেথা আছে তার কাছে যাও।
আমার হাত আঁকড়ে ধরে কুটুম। তার গা কাঁপছে। সে বলে, ‘কে গাইছে ভাইপো?’
বলি, ‘নদীর গান, নদীই গাইছে। কথা আর সুরকে মিলিয়েছে বাতাস।’ গান দিয়ে এখানে গ্রাম গড়ে উঠবে। বরণমালিকার মুছে যাওয়া গ্রাম। তখনই ফিরে আসবে সে।
আমরা বালিতে বসে পড়ি।
ani.chotogolpo@gmail.com
সুচিন্তিত মতামত দিন